রফিকুলের হাতে ধরেই বদলে গেল কৃষ্ণপুর
Published: 4th, May 2025 GMT
রফিকুল ইসলামের (৫৫) সেই ১০ বছর আগের জীবনের সঙ্গে এখন আর কোনো মিলই নেই। ওই সময় তাঁর বসতভিটা ছাড়া কোনো জমি ছিল না। অন্যের জমিতে দিনমজুরি খেটে কোনো রকমে চলত তাঁর সংসার। এক বেলা খাবার জুটল তো, অন্য বেলায় জুটত না। স্ত্রী–সন্তান নিয়ে প্রায়ই তাঁকে উপোস থাকতে হতো। সব প্রতিকূলতা ছাপিয়ে আজ তিনি সফল চাষি। আজ তাঁর জমি, বাড়ি সবই আছে।
রফিকুল ইসলামের ভাগ্যের চাকা মূলত বদলে গেছে সবজি চাষে। তাঁর বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার কাবিলপুর ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে। তিনি এখন এলাকার অনেক সবজিচাষির পথপ্রদর্শক।
পীরগঞ্জ উপজেলা থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে কৃষ্ণপুর গ্রাম। ওই গ্রামে রফিকুল ইসলামের বাড়ি। ফসল ভালো হতো না বলে একসময় অভাব লেগেই থাকত গ্রামটিতে। এক ফসলি উঁচু জমি ছিল গ্রামবাসীর একমাত্র ভরসা। এখন গ্রামটির ৯৫ ভাগ মানুষই সারা বছর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নানা রকম সবজির চাষ করেন। খেতগুলো সব সময় শসা, করলা, পটোলসহ নানা রকম শাকসবজিতে ভরে থাকে। ফলনও ভালো। এখানকার সবজি ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে।
গত শুক্রবার গ্রামটিতে ঢুকেই চোখে পড়ে মাঠের পর মাঠ সবজিখেত। কেউ খেত থেকে শসা, পটোল, করলা তুলছেন, কেউ করছেন পরিচর্যা। বেশির ভাগ বাড়িতে চকচক করছে টিনের চালা। আধা পাকা বাড়িও আছে কয়েকটি।
রফিকুল ইসলামের বাড়িতে পৌঁছে দেখি সুনসান অবস্থা। কেউ নেই। খটকা লাগে। কিছুটা হতাশও হই। তাঁকে খোঁজ করতে থাকলে একজন দেখিয়ে দেন, ওই যে রফিকুল সবজিখেতে কাজ করছেন। কিছু দূর এগোতেই দেখা যায়, নিজের করলাখেত পরিচর্যা করছেন তিনি। পরিচয় জেনে জমি থেকে আলে উঠে আসেন। শোনান নিজের ভাগ্য ও গ্রাম বদলে দেওয়ার গল্প। ১৯৭০ সালে তাঁর জন্ম। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। বাবা আমির উদ্দিনের অভাবের সংসার, তাই লেখাপড়া করা হয়নি। কাজ পেলে খাবার জুটত, না পেলে অনাহারে থাকতে হতো। তাঁর কষ্টের কথা শুনে মিঠাপুকুর উপজেলার রানীপুকুর ইউনিয়নের কৃষক সাইফুল ইসলাম ২০১৪ সালে কিছু করলার বীজ তাঁর হাতে দিয়ে জমিতে লাগানোর পরামর্শ দেন। এ বীজ রফিকুল ৭ শতক বসতভিটার চারদিকে লাগান। ৬০ দিনের মাথায় করলা ধরে। বিক্রি করে আয়ও হয় ৫ হাজার ৮০০ টাকা। এরপর পুরোপুরি করলা চাষে লেগে পড়েন তিনি। প্রথম বছরের লাভের টাকা দিয়ে পরের বছরে অন্যের ২০ শতক জমি বর্গা নেন। এবারও তাঁর করলার ফলন ভালো হয়। বসতভিটাসহ ২৭ শতক জমির করলা বিক্রি করে আয় করেন ১৮ হাজার টাকা। করলার পাশাপাশি পটোল, শসা ও লাউয়ের চাষ শুরু করেন।
এভাবে একপর্যায়ে চাষের জমি বাড়ে, আয় বাড়ে। দিনমজুর থেকে রফিকুল ইসলাম হয়ে ওঠেন সফল সবজিচাষি। কেনেন ১৮ শতক জমি, বানান টিনের বাড়ি। তাঁর দুই সন্তান রশিদুল ইসলাম ও রাশিদুল ইসলামও সবজির চাষ করছেন। স্ত্রী রশিদা বেগম রফিকুল ইসলামের সবজি চাষে সহায়তা করছেন। এবার ৫০ শতকে করলা, ২০ শতকে শসা, ১০ শতকে পটোল চাষ করেছেন। ইতিমধ্যে ৭০ হাজার টাকার সবজি বিক্রিও করেছেন। এখনো খেতে যে পরিমাণ সবজি আছে, তা বিক্রি করলে আয় হবে আরও দেড় লাখ টাকার বেশি।
সবজি চাষে রফিকুলের সাফল্য গ্রামের আরও কিছু দরিদ্র মানুষের ভাগ্যবদলে সহায়ক হয়েছে। এ রকম আরেকজন কৃষক জহুরুল হক। গ্রামটির প্রবেশমুখেই তাঁর বাড়ি। এক সময় তিনি দিনমজুরি করতেন। এখন সবজি বিক্রির টাকায় ১৫ শতক জমি কিনেছেন। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পড়াচ্ছেন। তিনি জানান, ৭ বছর ধরে ৫০ শতক জমিতে সারা বছরে সবজি চাষ করছেন তিনি।
স্বামী মারা যাওয়ার পর গ্রামের জহরা বেগমকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হতো। এতে এক বেলা খাবার জুটলেও আরেক বেলা জুটত না। দুই সন্তান নিয়ে প্রায় না খেয়ে থাকতে হতো। ছয় বছর আগে বসতভিটার ১০ শতক জমিতে শসা, লাউ ও পেপের চাষ শুরু করেন। এ সবজি বিক্রি করে আয় হয় ১০ হাজার টাকা। পরের বছর অন্যের ১৫ শতক জমি বর্গা নিয়ে সবজি চাষ করেন। এবার ৪০ শতকে করলা ও শসার চাষ করেছেন। বন্ধক নিয়েছেন ১৮ শতক জমি। আছে ৬টি ছাগল, হাঁস-মুরগি। দুই সন্তানকে নিয়ে সুখে আছেন—জানালেন তিনি।
ওই গ্রামের শিক্ষিত যুবক জেনারুল ইসলামও চাকরির পেছনে না ঘুরে ৭ বছর ধরে সবজির চাষ করছেন। তিনি বলেন, ধানের চেয়ে সবজি চাষে বেশি লাভ। এক একর জমিতে ধান চাষ করে বছরে আয় হবে ৪০-৪৫ হাজার টাকা। কিন্তু এক একরে সারা বছর সবজির চাষ করলে খরচ বাদ দিয়ে লাভ হবে প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। তাই গ্রামের ৯৫ ভাগ মানুষ সবজি চাষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাদেকুজ্জামান সরকার বলেন, অন্য ফসলের তুলনায় সবজি চাষে লাভ বেশি। বিষয়টি বুঝতে পেরে কৃষ্ণপুর গ্রামের ধনী–গরিব সবাই সবজির চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। এখানকার সবজি স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও রোগবালাই দূর করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বসতভ ট অন য র র সবজ করছ ন উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
রফিকুলের হাতে ধরেই বদলে গেল কৃষ্ণপুর
রফিকুল ইসলামের (৫৫) সেই ১০ বছর আগের জীবনের সঙ্গে এখন আর কোনো মিলই নেই। ওই সময় তাঁর বসতভিটা ছাড়া কোনো জমি ছিল না। অন্যের জমিতে দিনমজুরি খেটে কোনো রকমে চলত তাঁর সংসার। এক বেলা খাবার জুটল তো, অন্য বেলায় জুটত না। স্ত্রী–সন্তান নিয়ে প্রায়ই তাঁকে উপোস থাকতে হতো। সব প্রতিকূলতা ছাপিয়ে আজ তিনি সফল চাষি। আজ তাঁর জমি, বাড়ি সবই আছে।
রফিকুল ইসলামের ভাগ্যের চাকা মূলত বদলে গেছে সবজি চাষে। তাঁর বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার কাবিলপুর ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে। তিনি এখন এলাকার অনেক সবজিচাষির পথপ্রদর্শক।
পীরগঞ্জ উপজেলা থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে কৃষ্ণপুর গ্রাম। ওই গ্রামে রফিকুল ইসলামের বাড়ি। ফসল ভালো হতো না বলে একসময় অভাব লেগেই থাকত গ্রামটিতে। এক ফসলি উঁচু জমি ছিল গ্রামবাসীর একমাত্র ভরসা। এখন গ্রামটির ৯৫ ভাগ মানুষই সারা বছর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নানা রকম সবজির চাষ করেন। খেতগুলো সব সময় শসা, করলা, পটোলসহ নানা রকম শাকসবজিতে ভরে থাকে। ফলনও ভালো। এখানকার সবজি ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে।
গত শুক্রবার গ্রামটিতে ঢুকেই চোখে পড়ে মাঠের পর মাঠ সবজিখেত। কেউ খেত থেকে শসা, পটোল, করলা তুলছেন, কেউ করছেন পরিচর্যা। বেশির ভাগ বাড়িতে চকচক করছে টিনের চালা। আধা পাকা বাড়িও আছে কয়েকটি।
রফিকুল ইসলামের বাড়িতে পৌঁছে দেখি সুনসান অবস্থা। কেউ নেই। খটকা লাগে। কিছুটা হতাশও হই। তাঁকে খোঁজ করতে থাকলে একজন দেখিয়ে দেন, ওই যে রফিকুল সবজিখেতে কাজ করছেন। কিছু দূর এগোতেই দেখা যায়, নিজের করলাখেত পরিচর্যা করছেন তিনি। পরিচয় জেনে জমি থেকে আলে উঠে আসেন। শোনান নিজের ভাগ্য ও গ্রাম বদলে দেওয়ার গল্প। ১৯৭০ সালে তাঁর জন্ম। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। বাবা আমির উদ্দিনের অভাবের সংসার, তাই লেখাপড়া করা হয়নি। কাজ পেলে খাবার জুটত, না পেলে অনাহারে থাকতে হতো। তাঁর কষ্টের কথা শুনে মিঠাপুকুর উপজেলার রানীপুকুর ইউনিয়নের কৃষক সাইফুল ইসলাম ২০১৪ সালে কিছু করলার বীজ তাঁর হাতে দিয়ে জমিতে লাগানোর পরামর্শ দেন। এ বীজ রফিকুল ৭ শতক বসতভিটার চারদিকে লাগান। ৬০ দিনের মাথায় করলা ধরে। বিক্রি করে আয়ও হয় ৫ হাজার ৮০০ টাকা। এরপর পুরোপুরি করলা চাষে লেগে পড়েন তিনি। প্রথম বছরের লাভের টাকা দিয়ে পরের বছরে অন্যের ২০ শতক জমি বর্গা নেন। এবারও তাঁর করলার ফলন ভালো হয়। বসতভিটাসহ ২৭ শতক জমির করলা বিক্রি করে আয় করেন ১৮ হাজার টাকা। করলার পাশাপাশি পটোল, শসা ও লাউয়ের চাষ শুরু করেন।
এভাবে একপর্যায়ে চাষের জমি বাড়ে, আয় বাড়ে। দিনমজুর থেকে রফিকুল ইসলাম হয়ে ওঠেন সফল সবজিচাষি। কেনেন ১৮ শতক জমি, বানান টিনের বাড়ি। তাঁর দুই সন্তান রশিদুল ইসলাম ও রাশিদুল ইসলামও সবজির চাষ করছেন। স্ত্রী রশিদা বেগম রফিকুল ইসলামের সবজি চাষে সহায়তা করছেন। এবার ৫০ শতকে করলা, ২০ শতকে শসা, ১০ শতকে পটোল চাষ করেছেন। ইতিমধ্যে ৭০ হাজার টাকার সবজি বিক্রিও করেছেন। এখনো খেতে যে পরিমাণ সবজি আছে, তা বিক্রি করলে আয় হবে আরও দেড় লাখ টাকার বেশি।
সবজি চাষে রফিকুলের সাফল্য গ্রামের আরও কিছু দরিদ্র মানুষের ভাগ্যবদলে সহায়ক হয়েছে। এ রকম আরেকজন কৃষক জহুরুল হক। গ্রামটির প্রবেশমুখেই তাঁর বাড়ি। এক সময় তিনি দিনমজুরি করতেন। এখন সবজি বিক্রির টাকায় ১৫ শতক জমি কিনেছেন। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পড়াচ্ছেন। তিনি জানান, ৭ বছর ধরে ৫০ শতক জমিতে সারা বছরে সবজি চাষ করছেন তিনি।
স্বামী মারা যাওয়ার পর গ্রামের জহরা বেগমকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হতো। এতে এক বেলা খাবার জুটলেও আরেক বেলা জুটত না। দুই সন্তান নিয়ে প্রায় না খেয়ে থাকতে হতো। ছয় বছর আগে বসতভিটার ১০ শতক জমিতে শসা, লাউ ও পেপের চাষ শুরু করেন। এ সবজি বিক্রি করে আয় হয় ১০ হাজার টাকা। পরের বছর অন্যের ১৫ শতক জমি বর্গা নিয়ে সবজি চাষ করেন। এবার ৪০ শতকে করলা ও শসার চাষ করেছেন। বন্ধক নিয়েছেন ১৮ শতক জমি। আছে ৬টি ছাগল, হাঁস-মুরগি। দুই সন্তানকে নিয়ে সুখে আছেন—জানালেন তিনি।
ওই গ্রামের শিক্ষিত যুবক জেনারুল ইসলামও চাকরির পেছনে না ঘুরে ৭ বছর ধরে সবজির চাষ করছেন। তিনি বলেন, ধানের চেয়ে সবজি চাষে বেশি লাভ। এক একর জমিতে ধান চাষ করে বছরে আয় হবে ৪০-৪৫ হাজার টাকা। কিন্তু এক একরে সারা বছর সবজির চাষ করলে খরচ বাদ দিয়ে লাভ হবে প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। তাই গ্রামের ৯৫ ভাগ মানুষ সবজি চাষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাদেকুজ্জামান সরকার বলেন, অন্য ফসলের তুলনায় সবজি চাষে লাভ বেশি। বিষয়টি বুঝতে পেরে কৃষ্ণপুর গ্রামের ধনী–গরিব সবাই সবজির চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। এখানকার সবজি স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও রোগবালাই দূর করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।