এপ্রিলে রেমিট্যান্স এসেছে ২৭৫ কোটি ডলার
Published: 4th, May 2025 GMT
দেশে চলতি এপ্রিল মাসে বৈধ পথে ব্যাংকিং চ্যানেলে ২৭৫ কোটি ২০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৩৩ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসাবে)। সেই হিসাবে দৈনিক গড়ে রেমিট্যান্স এসেছে ৯ কোটি ১৭ লাখ ডলার বা ১ হাজার ১১৯ কোটি টাকা।
রবিবার (৪ মে) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
রেমিট্যান্সের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত এপ্রিল মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ২৭৫ কোটি ২০ হাজার মার্কিন ডলার। আগের বছর একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ২০৪ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ের ব্যবধানে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ৪৫৩ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরেরর একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ১ হাজার ৯১১ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি।
আরো পড়ুন:
লেনদেন সীমা বাড়ল
বিকাশ-নগদ-রকেটে দিনে ৫০ হাজার টাকা পাঠানো যাবে
রূপালী ব্যাংক: এই সেই তিন ডাকাত
দেশে চলতি বছরের মার্চ মাসে বৈধ পথে ব্যাংকিং চ্যানেলে ৩২৯ কোটি ৫৬ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমান ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি। একক মাসে এত বেশি পরিমাণ রেমিট্যান্স আগে কখনো দেশে আসেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা জানান, অর্থপাচারে বর্তমান সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ফলে হুন্ডিসহ বিভিন্ন অবৈধ চ্যালেনে টাকা পাঠানো কমে গেছে। ফলে বৈধপথে রেমিট্যান্স আহরণ বেড়েছে। এছাড়া গত রমজান মাস কেন্দ্র করে পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি বেশি অর্থ পাঠিয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশিরা। আগামী ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করেও রেমিট্যান্স পাঠানোর ধারা অব্যাহত রয়েছে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাইয়ে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। আগস্টে এসেছে ২২২ কোটি ৪১ লাখ মার্কিন ডলার, সেপ্টেম্বরে ২৪০ কোটি ৪৭ লাখ মার্কিন ডলার, অক্টোবরে ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, নভেম্বর মাসে ২১৯ কোটি ৯৯ লাখ মার্কিন ডলার, ডিসেম্বর মাসে ২৬৩ কোটি ৮৭ লাখ মার্কিন ডলার, জানুয়ারি মাসে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ মার্কিন ডলার এবং ফেব্রুয়ারিতে এসেছে ২৫২ কোটি ৭৬ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স।
ঢাকা/এনএফ/বকুল
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র ম ট য ন স এস ছ
এছাড়াও পড়ুন:
শ্রমিক অসন্তোষ বনাম টেকসই বৈদেশিক বিনিয়োগ পরিবেশ
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বৈদেশিক বিনিয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি। বর্তমানে দেশে প্রায় ৬৩৪ টির বেশি বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হলেও, শ্রমিক অসন্তোষ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইন-শৃঙ্খলার অবনতির কারণে এই বিনিয়োগ প্রবাহ বারবার হুমকির মুখে পড়ছে, যা একটি বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ তৈরিতে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এই সংকটগুলো বৈদেশিক বিনিয়োগে দৃশ্যমান প্রভাব ফেলেছে। নিরাপদ ও স্থিতিশীল পরিবেশের অভাবে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী নতুন বিনিয়োগ থেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন, যা দেশের শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতিকে শ্লথ করে দিচ্ছে।
শ্রমিক অসন্তোষের প্রধান কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সময়মতো বেতন ও বোনাস না পাওয়া, ন্যায্য মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নের অভাব, বৈষম্যমূলক আচরণ, অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং অভিযোগ নিষ্পত্তিতে গাফিলতি। এছাড়াও নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাব, অগ্নি নিরাপত্তা ও সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের ঘাটতিও শ্রমিকদের উদ্বেগ বাড়ায়। ট্রেড ইউনিয়নে অংশগ্রহণে সীমাবদ্ধতা, জীবনমানের দুরবস্থা, প্রশিক্ষণের অভাব, অর্থনৈতিক চাপ, স্থানীয় প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাও অসন্তোষকে ত্বরান্বিত করে। এসব উপাদান শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করে, যা শেষ পর্যন্ত আন্দোলনে রূপ নেয়।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শ্রমিকদের মধ্যে নতুন প্রত্যাশা ও চাপ তৈরি হয়। একই সঙ্গে ভারত-চীন-মালয়েশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের শিল্প স্থিতিশীলতাকে জটিল করে তোলে। অনেক সময় পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা তৈরি করে গার্মেন্টস সেক্টরের অর্ডার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের দিকে সরিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়, যা শিল্পখাতকে দুর্বল করে, বিনিয়োগকারীদের আস্থায় আঘাত হানে এবং শ্রমিক অসন্তোষকে ত্বরান্বিত করে তোলে।
শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমছে। অনেকেই নিরাপত্তাহীনতার কারণে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার চিন্তা করছেন বা নতুন বিনিয়োগে পিছিয়ে যাচ্ছেন। ২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বরে কিছু জাপানি কোম্পানি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। ২০১৩ সালের রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বিদেশি ব্র্যান্ড অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদন ভিয়েতনাম, ইথিওপিয়া ও মিয়ানমারে স্থানান্তরিত করেছে।
বর্তমান শিল্প পরিবেশে একটি নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষণীয়—আমরা প্রতিক্রিয়া নির্ভর পদক্ষেপ নিচ্ছি, প্রতিরোধমূলক নয়। কোনো অসন্তোষ শুরু হলে তখন আলোচনা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ, ও কখনো কখনো শিল্প পুলিশ, র্যাব বা সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। কিন্তু এসব হচ্ছে তাৎক্ষণিক সমাধান; দীর্ঘমেয়াদী ও কাঠামোগত পরিবর্তন হচ্ছে না।
এই প্রেক্ষাপটে, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি তুলনামূলকভাবে একটি কার্যকর সমাধান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যদি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করা হয়, তবে অনেক শ্রমিক অসন্তোষ উৎপত্তির আগেই তার মীমাংসা সম্ভব হবে। শ্রীলঙ্কা, ভারত, ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়া সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ব্যবস্থার মাধ্যমে শিল্প পরিবেশ অনেক বেশি স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে ইপিজেড অঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি সম্পূর্ণভাবে প্রয়োগের ফলে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে তুলনামূলকভাবে সফল ফলাফল পাওয়া গেছে।
শুধু আইন প্রণয়ন নয়, তার যথাযথ বাস্তবায়ন ও তদারকি জরুরি। শ্রম আইন ২০০৬ , সংশোধনী ২০১৩, ২০১৮, বাংলাদেশ ইপিজেড শ্রম আইন, ২০১৯ , ইপিজেড শ্রমবিধিমালা ২০২২ -এর নানা ধারা বাস্তবিক পরিপ্রেক্ষিতে উপযোগী করে তোলা এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। শ্রম আদালতের কার্যকারিতা বাড়াতে হলে দক্ষ বিচারক, শ্রম আইনে পারদর্শী আইনজীবী এবং দ্রুত রায় কার্যকর করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর শ্রম পরিদর্শকদের পরিদর্শন কার্যক্রম আরও দক্ষ ও কার্যকর করতে হবে। পরিদর্শনকালীন সময়ে অভিযোগ নিষ্পত্তিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করলে বড় ধরনের শ্রমিক অসন্তোষ সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যখন একটি দেশে পুঁজি বিনিয়োগ করেন, তখন তারা শুধু উৎপাদন খরচ, কর অব্যাহতি বা বাজার বিবেচনাই করেন না বরং, শ্রম পরিস্থিতি ও শ্রম অসন্তোষ একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিবেচ্য বিষয়। বিশ্বব্যাংক ও আঙ্কটাডের রিপোর্টে দেখা গেছে, শ্রম অস্থিরতা বিনিয়োগ সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন ২০২৩ সালের একটি জরিপে জানায়, শ্রম অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাংলাদেশে বিনিয়োগে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে মালিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা জরুরি। অনেক মালিক অভিযোগ ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব না দিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়মিত সভা করেন না এবং কল্যাণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। এতে শ্রমিকদের মধ্যে অবিশ্বাস ও অসন্তোষ তৈরি হয়, যা দ্রুত বিক্ষোভে রূপ নিতে পারে। লাইন লিডার ও সুপারভাইজাররা অভিযোগের তাৎক্ষণিক সমাধান না করে বরং বকাঝকা করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। তাই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে গ্রিভেন্স রিড্রেস সিস্টেম (জিআরএস) চালু ও নিয়মিত পর্যালোচনা অত্যাবশ্যক, যাতে শান্তিপূর্ণ কর্মপরিবেশ বজায় থাকে যেকোনো শ্রমিক অসন্তোষের সূচনালগ্নে শিল্প পুলিশ উপস্থিত হয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করে। তবে এ ক্ষেত্রেও শ্রম আইন, শ্রমিকদের মনস্তত্ত্ব এবং অসন্তোষ নিরসনের কৌশল নিয়ে শিল্প পুলিশের আরও গভীর জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের প্রয়োজন রয়েছে। যদি তাদের এ বিষয়ে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় এবং তারা কৌশলীভাবে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়, তাহলে শ্রমিক অসন্তোষ দ্রুত, শান্তিপূর্ণ ও কার্যকরভাবে নিরসন করা সম্ভব হবে।
শ্রমিকদের মধ্যে শিল্পবান্ধব মনোভাব গড়ে তুলতে প্রেষণা, সচেতনতা এবং মোটিভেশনাল প্রচার কার্যক্রম গ্রহণ জরুরি। এর মাধ্যমে তাদের দায়িত্ববোধ ও কাজে আগ্রহ বাড়ানো সম্ভব, যা শিল্পের স্থিতিশীলতা এবং কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি, বন্ধ বা অচল কারখানার বিক্রয় ও পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়া সহজ ও কার্যকর করতে বিদ্যমান আইনগত জটিলতা দূর করে একটি স্বচ্ছ, দ্রুত ও বাস্তবমুখী ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন, যাতে মালিক, বিনিয়োগকারী ও শ্রমিক—সবারই স্বার্থ রক্ষা হয়। সেইসাথে, যারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গুজব রটিয়ে বা নাশকতার মাধ্যমে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি করে, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এই সব পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই শিল্পখাতে টেকসই শান্তি ও স্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব।
শ্রমিক অসন্তোষ বাংলাদেশের শিল্প ও বৈদেশিক বিনিয়োগের অগ্রগতিতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাধা মোকাবেলায় কেবল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি, কাঠামোগত ও অংশীদারিত্বমূলক সমাধান। শ্রমিক, মালিক, সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে শ্রমিকদের প্রেষণা, নিরাপত্তা ও ন্যায্যতার নিশ্চয়তা দেওয়া গেলে বিনিয়োগবান্ধব, স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ শিল্প পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব। এই পথেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক বিনিয়োগ নিশ্চিত হবে।
ড. সোহেল মিয়া: শ্রম সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ