জনসংযোগ পেশা ছেড়ে গড়ে তুলেছেন ‘সুখের খামার’
Published: 9th, May 2025 GMT
জোবায়ের ইসলাম একজন পূর্ণকালীন কৃষক। জন্ম সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার পূর্ব লক্ষ্মীকোলা গ্রামে। পেছনে তাকালে দেখা যায়, ২০ বছরের ঢাকার জীবন এবং এর মধ্যে ১৪ বছরের পেশাজীবন ছেড়ে নিজের শিকড়ে ফেরার সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জোবায়ের। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে গ্রামে ফিরে এসে শুরু করেন এক নতুন জীবন। তাঁর লক্ষ্য ছিল দেশের কৃষিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া, পরিবারের জন্য নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করা এবং এক টেকসই কৃষিব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা। তাঁর এই যাত্রার ফলাফলই হলো একটি উদ্ভাবনী কৃষি উদ্যোগ ‘সুখের খামার’।
ঢাকার জীবন থেকে ফিরে এসে জোবায়েরের যাত্রা সহজ ছিল না। শুরুতে ক্ষতির সম্মুখীন হলেও ধীরে ধীরে তাঁর সংগ্রাম সফলতায় রূপ নেয়। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নতুন খামারিদের জন্য দিকনির্দেশনা দেন তিনি। আমরা যখন তাঁর গ্রামে ঢুকি, সুখের খামারের ঠিকানা জিজ্ঞেস করার সঙ্গে সঙ্গে মানুষেরা পথ দেখিয়ে দেয়। পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে এই খামারের প্রভাব। সারা দেশ থেকে লোক আসছে। গ্রাম পাল্টে যাচ্ছে, গ্রামবাসীও লাভবান ও খুশি।
শুরুর গল্প
সিরাজগঞ্জ থেকে এসএসসি ও এইচএইচসি পাস করার পর ২০০৪ সালে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন জোবায়ের ইসলাম। মার্কেটিংয়ে বিবিএ–এমবিএ করেন সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে। পড়ালেখা শেষ করে যোগ দেন জনসংযোগ পেশায়। পাশাপাশি লেখালেখি করেছেন।
চাকরিজীবনের ১৪ বছরের মাথায় এসে একসময় জোবায়ের চিন্তা করেন, গ্রামে ফিরে গিয়ে খামারি হবেন। কিন্তু পরিবার কি তা মানবে? তা ছাড়া ১৯ বছর ঢাকার জীবন ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার বিষয়টা এত সহজও নয়। তিনি ঠিক করলেন সবার আগে স্ত্রীকে মানাবেন, পরে পরিবারের অন্যদের।
স্ত্রী আফসানা মিনাকে বুঝিয়ে বলতেই তিনি রাজি হয়ে গেলেন। তখন ২০২০ সাল, করোনা মহামারি চলছে। ‘হ্যাপি ফার্মিং’ স্লোগান নিয়ে শ্বশুরবাড়ি বগুড়ার কাহালুর বাগইল গ্রামে খামার শুরু করলেন জোবায়ের। খামারের জন্য এই অঞ্চল বেছে নেওয়ার বেশ কিছু কারণ আছে। সবচেয়ে বড় কারণ, এই অঞ্চলকে তিনি চাষাবাদের রাজধানী মনে করেন। এখানে বছরে তিনবার চাষ করা যায়—দুবার ধান, একবার আলু। এ ছাড়াও লাউ, করলা, শিম, মরিচ, ক্যাপসিক্যামসহ যেকোনো সবজির ফলনও খুব ভালো হয়। গরুর খামারের জন্যও এই অঞ্চল খুব উপযোগী।
জোবায়ের তিনটা গরু কিনেছিলেন ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে। এর মাধ্যমে শুরু হলো তাঁর বাণিজ্যিক খামারের যাত্রা। মোট পুঁজি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার টাকা। তবে তখনো পুরোপুরি ঢাকা ছাড়েননি তিনি। আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলেন। ২০২৩ সালে পরিবার নিয়ে ঢাকা ছাড়লেন। গ্রামে ফিরে নিজেই হাল ধরলেন সবকিছুর।
কর্মী নিয়োগ
খামারের বিক্রি বাড়ানোর জন্য জোবায়ের ঢাকার কিছু শিক্ষিত যুবককে লক্ষ্য বানিয়েছিলেন। কারণ, কিছু দক্ষ লোক প্রয়োজন, যাঁরা গ্রামে থাকবেন, গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিশে যাবেন। তাই তিনি ঢাকার পরিচিত কিছু মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তাঁদের বোঝালেন যে গ্রামেই সব সুযোগ-সুবিধা থাকবে। জোবায়েরের কথায় রাজি হয়ে তাঁরা চলে এলেন সুখের খামারের হাল ধরতে। দল বড় হতে লাগল।
জোবায়ের বলেন, ‘১৯ বছরে আমার একটা নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে, সেটাই কাজে লাগাচ্ছি। বর্তমানে সুখের খামার অংশে ৫ জন এবং সুখের খামার ফার্ম হাউস প্রজেক্টে ৪ জন পূর্ণকালীন কর্মী রয়েছে। সুখের খামার গেস্টহাউসে আছে ২ জন। মোট ১১ জন কাজ করছে আমার সঙ্গে।’
হেড অব ডিজিটাল হিসেবে সুখের খামারে কাজ করছেন শাহিন মুরতাজা, যিনি ছিলেন একজন ওয়েব ডেভেলপার। ঢাকার চাকরি ছেড়ে তিনিও বাগইল গ্রামে ফিরে গেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একদিন হঠাৎ জোবায়ের ভাইয়ের ফোন। বললেন, “যদি বেতন পাও, আর থাকা-খাওয়ার কোনো টেনশন না থাকে, তাহলে চলে এসো আমার সুখের খামারে। একসঙ্গে বড় হই।” বিষয়টি আমার ভালো লাগল। একমুহূর্ত সময় নিলাম না। সোজা চলে গেলাম গ্রামে। সবাই গ্রাম ছেড়ে ঢাকা যায়। আর আমি ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছি গ্রামে, তা-ও আবার খামারে চাকরি করতে। অনেকে অবাক হয়েছে, হাসাহাসিও করেছে এ নিয়ে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, আমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
বাঙলা কলেজ থেকে পাস করেই নির্বাহী হিসেবে সুখের খামারে চাকরি নিয়েছেন ইয়াকুব আলী। তিনি বলেন, ‘আমি এককথায় চলে এসেছি। চাকরি যেহেতু করতেই হবে, নাহয় গ্রামেই করলাম। ভালোই লাগছে।’
সুখের খামারের কার্যক্রম ও পরিকল্পনা
বিশ্বব্যাপী কৃষি–পর্যটনশিল্প (অ্যাগ্রো-ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি) বর্তমানে ৫৬ বিলিয়ন ডলারের। শহরের মানুষকে গ্রামীণ জীবনের সৌন্দর্য এবং কৃষকের পরিশ্রম চেনানোর জন্য অ্যাগ্রো-ট্যুরিজম প্রচার করছেন জোবায়েররা। সব মিলিয়ে সুখের খামার কেবল গরু মোটাতাজাকরণের প্রকল্প নয়, বরং এটি একটি শিক্ষাকেন্দ্রও। এখানে নতুন খামারিদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শহরের ব্যস্ত মানুষ, প্রবাসী এবং তরুণ উদ্যোক্তারা একটি টেকসই খামার পরিচালনার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন সুখের খামারে এসে।
জোবায়ের ইসলাম এখন মাসে গড়ে চার লাখ টাকা আয় করেন। গরু, ছাগল, ভেড়া ও মুরগি পালনের পাশাপাশি আধুনিক পদ্ধতিতে বিষমুক্ত সবজি, ধান ও কলা চাষ করছেন তাঁরা। কৃষি পর্যটনের জন্য আছে মাটি দিয়ে তৈরি পরিবেশবান্ধব একটি কটেজ। বহু মানুষ এখানে নিয়মিত এসে কৃষিকাজ দেখেন। গত দেড় বছরে শহর থেকে ১৪৪ জন ভ্রমণকারী সুখের খামারে এসেছেন। গ্রামের প্রকৃতি উপভোগের পাশাপাশি ন্যায্য দামে হাঁস, মুরগি, ডিম, দুধ, সবজি ও চাল কিনেছেন তাঁরা।
জোবায়ের ইসলামের সঙ্গে সুখের খামারের সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আছেন তাসদীখ হাবীব। জোবায়েরের দায়িত্ব প্রতিদিনকার পরিচালন। হাবীবের দায়িত্ব কৌশল, পরিকল্পনা ও বিপণন। সুখের খামারের দুটি প্রধান প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেছেন তাঁরা। একটি হলো গরু বর্গা প্রকল্প। এটি ছয় মাসের বিনিয়োগ প্রকল্প। ছয় মাস পর গরু বিক্রির লাভের ৫০ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগকারীর সঙ্গে ভাগ করা হয়।
আরেকটি হলো সুখের খামার ফার্ম হাউস। ৩০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত সমন্বিত কৃষি প্রকল্প। এখানে কৃষিপ্রেমী মানুষদের অংশীদার করে টেকসই কৃষি ও অ্যাগ্রো ট্যুরিজমের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
জোবায়ের ইসলাম জানান, তাঁদের লক্ষ্য শুধু সুখের খামারেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ভবিষ্যতে একটি টেকসই কৃষি ইকোসিস্টেম তৈরি করতে চান, যেখানে গ্রামীণ জীবন ও আধুনিক প্রযুক্তির সংমিশ্রণ ঘটবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ ব য় র ইসল ম প রকল প র জন য পর ব র র জ বন ট কসই
এছাড়াও পড়ুন:
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে কি না, তা বিএনপির বক্তব্যের বিষয় নয়: মঈন খান
ছবি: বিএনপির মিডিয়া সেলের ভিডিও থেকে নেওয়া