আমার এক মার্কিন বন্ধু আছে, নাম উইলি। রাজনীতি নিয়ে উইলির আগ্রহে বেশ ঘাটতি আছে। তবু হঠাৎ সে বলল, তোমাদের হাসিনা আর কত বছর থাকবেন? আমি বললাম, তাঁকে তো আমরা আট মাস আগেই বিদায় করে দিয়েছি। তুমি হয়তো জানো না।
উইলি বলল, কেন? ইলেকশনে ডিফিটেড হয়েছে নাকি? আমি বললাম, ‘না, আমাদের দেশে ইলেকশনে কেউ বিদায় হয় না। একবার গদিতে বসলে আর ছেড়ে যেতে চায় না। ভাগাতে হয়েছে ম্যাস এজিটেশন, মানে গণ-আন্দোলন করে। তুমি তো বাংলা কাগজ পড়ো না, তুমি এসব বুঝবে না।’ উইলি বলল, ‘উইয়ার্ড! আজগুবি তো!’
আজগুবি তো বটেই! এত বছর আমাদের দেশে কত কত নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু কোনো সিস্টেম তৈরি হয়নি যে একটা নিয়মমাফিক সরকার গঠিত হবে। যার যেমন দরকার, সেভাবে নির্বাচন দিয়েছে। আমাদের দেশের নির্বাচনগুলো নিয়ে ভাবলে সত্যি দুঃখ লাগে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে অনেক নির্বাচন হয়েছে, কিংবা নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। এগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়—বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অন্তর্বর্তী সরকার-পূর্ববর্তী (১৯৭১-১৯৯০) এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অন্তর্বর্তী সরকার-পরবর্তী (১৯৯১-২০২৪)।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন-পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোতে কোনো প্রকার প্রকৃত বিরোধী দলের অস্তিত্ব ছিল না। শাসকেরা যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবে নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারিত হয়েছে। প্রথম নির্বাচনটা ছিল শেখ মুজিবের সময়। জাসদকে দুটি আসন দিয়ে তিনি নির্বাচনের দায়ভার সম্পন্ন করেন। এরপরের নির্বাচনগুলোর ভাগ্য নির্ধারণ করেছিলেন মূলত ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসা জেনারেল ও তাঁদের অনুসারী রাজনীতিকেরাই। এগুলো কোনোটি ছিল শুধু ‘হ্যাঁ’ ধরনের ভোট, আবার কোনোটি ছিল ‘হ্যাঁ-না’ নির্বাচনের প্রহসন, জনগণের তেমন কোনো অংশগ্রহণ ছিল না।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন একটি নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখা তৈরি করে নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়েছিলেন। এর পরবর্তী নির্বাচন বা নির্বাচনের প্রচেষ্টাগুলো রাজনীতিবিদদের নানাবিধ অপরিপক্ব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দূষিত হয়েছে। কখনো চেষ্টা হয়েছে নির্বাচনী নিরপেক্ষ সরকারকে নিজেদের ইচ্ছামতো বানাতে, কখনো বা নির্বাচন হয়েছে নিরপেক্ষ সরকারব্যবস্থা একদম উঠিয়ে দিয়ে। মধ্যে আরেকটা নির্বাচন ছিল জেনারেল মইনের দেওয়া। এসব নির্বাচনের কয়েকটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল—১.
এই নির্বাচনগুলো নিয়ে অনেক বড় বড় রাজনৈতিক প্রবন্ধ লেখা যায়। আমি সে চেষ্টা করব না। আমি এই নির্বাচনগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ে সংক্ষেপে চারটি মডেল দাঁড় করিয়েছি, যাতে পাঠকেরা খুব সহজেই এই নির্বাচনী প্রচেষ্টাগুলো বুঝতে পারেন। এই মডেলগুলোর শিরোনাম, ‘নির্বাচনের চার মডেল’—
১. নিজেদের মতো ‘নিরপেক্ষ’ নির্বাচন করা। বিচারপতি ও সরকারপ্রধান কে হবেন, তা সরকার নির্ধারণ করবে। নিজেদের মতো করে নিয়ম বানিয়ে নাও। যার সঙ্গে মতে মিলবে না, তাঁকে বাদ দিয়ে দাও। মোদ্দাকথা, নিজেদের মতো করে নিরপেক্ষ সরকারে নির্বাচন!
২. প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নতুন নিয়মে নির্বাচন। জবরদস্তি করে নিজের প্রার্থী ছাড়া সবাইকে বসিয়ে দেওয়া। সরতে না চাইলে তাঁকে ডিবিতে নাও। যেহেতু একজন মাত্র থাকবে, তাই আসলে ভোটের প্রয়োজন নেই। কিন্তু বিরোধী দলও তো দরকার। এ জন্য কিছু আসন ছেড়ে দিলেই হলো।
৩. পূর্বনির্ধারিত নির্বাচন হয়ে যাবে নির্বাচন। লিস্টে কে জিতবেন, কে হারবেন, তা থাকবে। কমিশন তা ঘোষণা দিয়ে দেবে।
৪. ডামি-আমি নির্বাচন। মাঠে কোনো অপজিশন নেই। যে জিতবে, সে-ই আপন। ঘোষণা দেবে কমিশন। এখানে কোনো কারচুপির প্রয়োজন নেই।
সীমিত সম্পদের দেশে সব সময় জনগণের পছন্দসই নীতিনির্ধারণ বা প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না। তার ওপর আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এসব খবরদারি প্রতিষ্ঠান তো রয়েছেই। নিজেদের নীতি চর্চা করে নির্বাচনে হারাটাও গৌরবের। আমাদের রাজনীতিবিদদের এই হারটা মেনে নেওয়ার অভ্যাস করতে হবে। নাহিদ ইসলাম ঠিকই বলেছেন, একটা নির্বাচনই শেষ নির্বাচন নয়। সামনে জেতার অনেক সুযোগ হবে।মডেলগুলো অনেক পাঠকের বেশ পরিচিত। তবে পাঠকদের জন্য একটা কুইজ আছে, এই মডেলগুলোর কোনটি কোন সময়ের এবং তখন কে ছিলেন ক্ষমতায়? পাঠকেরা মন্তব্য সেকশনে লিখতে পারেন।
সামনেই নির্বাচন। সরকার সংস্কার নিয়ে কাজ করছে যেন সামনের নির্বাচনগুলো নিরপেক্ষ ও অবাধ হয়। দেশের জনগণও তাই চান। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে-ই ক্ষমতায় যাক না কেন, তাদের ইচ্ছা থাকবে ভবিষ্যতে এই চারটা মডেলের একটাতে ফেরত যেতে। এই দুই ইচ্ছার দ্বন্দ্ব মিটিয়ে সামনে এগিয়ে চলা আমাদের দেশের জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ।
গণতান্ত্রিক দেশে সরকার পরিচালনায় দুটি স্তর থাকে। নিচের স্তরটা হলো, শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি। তার ওপরে পলিসি বা নীতিনির্ধারণ। ভিত্তি রাষ্ট্রের আর পলিসি হলো যারা সরকার গঠন করেছে তাদের। এই দুইয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ রাখা চলবে না। শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি একটা সরকারের পলিসি প্রয়োগে বাধা হতে পারবে না। যদি বাধা হয়, তাহলে বুঝতে হবে পলিসিতে গড়বড় আছে। আবার পলিসি প্রয়োগ করার জন্য ভিত্তিকে নাড়ানো যাবে না। গণতান্ত্রিক সরকারে, যেকোনো রাজনৈতিক দলকে তাদের পলিসি জনগণকে বুঝিয়ে, তাদের কাছে গ্রহণীয় করে পুনর্নির্বাচিত হতে হবে।
আরও পড়ুনউদ্বেগটা নিজেদের মধ্যকার বিভাজন নিয়ে২ ঘণ্টা আগেএতে কিছুটা ঝুঁকি থাকবেই। সীমিত সম্পদের দেশে সব সময় জনগণের পছন্দসই নীতিনির্ধারণ বা প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না। তার ওপর আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এসব খবরদারি প্রতিষ্ঠান তো রয়েছেই। নিজেদের নীতি চর্চা করে নির্বাচনে হারাটাও গৌরবের। আমাদের রাজনীতিবিদদের এই হারটা মেনে নেওয়ার অভ্যাস করতে হবে। নাহিদ ইসলাম ঠিকই বলেছেন, একটা নির্বাচনই শেষ নির্বাচন নয়। সামনে জেতার অনেক সুযোগ হবে।
কিন্তু আমাদের দেশে সমস্যা দেখা দেয়, যখন রাজনীতিবিদেরা নির্বাচিত হওয়ার জন্য শাসনতান্ত্রিক ভিত্তিকে টেম্পারিং বা নড়বড় করেন। এই ক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে বড় সহায়ক থাকে পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং সংবিধান সংশোধনীর ১৪৮(৩) ধারা। এই দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দাপটে কোনোভাবেই নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের আইন সংবিধানে রাখা যাচ্ছিল না। শাসকেরা বেছে নেন ওপরে বর্ণিত চার মডেলের একটি। আমাদের রাজনীতিবিদেরা যত দিন ভিত্তি ও পলিসির পৃথকীকরণ না বুঝবেন বা চর্চা না করবেন, তত দিন আমাদের ভুগতে হবে।
ট্রাম্প আসার পর পুরো দুনিয়ায় দারুণ হইচই শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু ভালো করে দেখলে দেখা যাবে, সবই ট্রাম্পের পলিসি বা নীতিসংক্রান্ত পরিবর্তন। ট্যারিফ, ইমিগ্রেশন, ব্যয়সংকোচন, ইউক্রেনে সবই ওপরের স্তরের পরিবর্তন, ভিত্তি একই রয়ে গেছে। বাইরের থেকে মনে হচ্ছে, পুরো আমেরিকা ওলটপালট। আবার চার বছর পর নতুন নির্বাচন হবে, নতুন কেউ আসবেন-আশা করা যায় ট্রাম্পের চেয়েও ঠান্ডা মাথার কেউ এবং পলিসিও কিছুটা ধীরস্থির হবে।
ভারতের নরেন্দ্র মোদির প্রতি আস্থা বাংলাদেশে অনেকটা শূন্যের পর্যায়ে। তাঁর যত মুসলমানবিরোধী পলিসিতে সেখানকার লোকেরাও বিরক্ত হয়ে পড়েছেন। তার ওপর যোগ হয়েছে মোদির নতুন বাংলাদেশ বৈরিতা। কিন্তু আমাদের দেশে অনেকেই জানেন না, ২০২৪ সালের নির্বাচনে তিনি কোনো রকমে সরকার টিকিয়ে রেখেছেন বিহারের নীতীশ কুমারের জনতা দলের সমর্থনে। আবার যখন নির্বাচন হবে, হয়তো নতুন কেউ আসবেন এবং মোদির এই সাম্প্রদায়িক নীতির পরিবর্তন হবে।
এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে সামনে আমাদের দেশে রাজনীতিবিদেরা পলিসি ভালো বা খারাপ, যা ইচ্ছা পরিবর্তন করুন না কেন, শাসনতান্ত্রিক ভিত্তিটাকে যেন তারা নড়বড়ে না করেন এবং প্রতি চার-পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচন দেবেন। রাজনীতিবিদেরা আর যেন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার যথেচ্ছ ব্যবহার না করতে পারেন। দেশের জনগণ আবার নির্বাচনে ওই চার মডেলের একটাতে ফিরে যেতে চায় না।
এই নিয়ে একটা পরামর্শ সংস্কার কমিশন বিবেচনা করে দেখতে পারেন। যেসব সংস্কার দরকার সব শেষ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যদি সংবিধানের কিছু পরিবর্তন করতে চান, আগে সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চের সম্মতি লাগবে। তাঁরা আলোচনা করে সম্মতি দিলে, তারপর সংসদে আলোচনা হবে। সরকারি দলের দুই-তৃতীয়াংশ এবং বিরোধী দলের দুই-তৃতীয়াংশ সম্মতি দিলে তারপর সংশোধনী পাস হবে। অবশ্য এর একটা পূর্বশর্ত আছে—দেশে একটি প্রকৃত বিরোধী দল থাকবে।
প্রশ্ন আসবে, যদি আবার মিলিটারি ক্যু হয়, তখন কী হবে? তাহলে আবার হয়তো আমাদের ‘হ্যাঁ–না’ ভোট দিয়ে শুরু করে এই চার মডেলের একটা দিয়ে শেষ করতে হবে।
তবে মন বলছে, সামনে এসব হবে না। আমাদের সেনাবাহিনীর জন্য ২০২৪ সালের আগস্টে কত বড় সুযোগ ছিল! তারা কোনো সুযোগ না নিয়ে সিভিল সরকার গঠনে সহায়তা করেছে এবং দেশের জনগণের আস্থা ও শ্রদ্ধা কুড়িয়েছে। ভবিষ্যতেও অবশ্যই তারা এই উদাহরণ মেনে চলবে।
সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ব দ র আম দ র দ শ দ শ র জন র জন ত ক ত র ওপর ক ষমত য় সরক র র ব চ রপত জনগণ র র জন য র র জন র পল স
এছাড়াও পড়ুন:
সমাবেশে লোক ভাড়া করে বেশি মাথা দেখানো কী ফল দেয়
গত কয়েক সপ্তাহে রাজধানীতে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সভা হয়ে গেল। এখনো হচ্ছে। বড় বড় রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে জুলাই আন্দোলনের ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন ‘সদ্যোজাত’ দল—সবাই, এই আন্দোলন মাসে সভা করেছে।
সরকারও পিছিয়ে নেই, তারাও জুলাই সনদ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সভা করেছে সংসদ ভবনের সামনে। এই মাসটাতে প্রতিটি সভাই জাতির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ—বিভিন্ন অঙ্গীকার ও তথ্যে ভরপুর।
যাঁরা সভাগুলোয় যোগ দিয়েছেন বা যাঁরা অন্যভাবে সভাগুলোর প্রতি নজর রেখেছেন, তাঁদের জন্য এতসব গুরুগম্ভীর তথ্য সম্ভবত মনে রাখা খুব সহজ নয়। তবে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা, সবার জন্য সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জুলাই সনদ নিয়ে নেতারা যা যা বলেছেন, সেগুলো মোটাদাগে সবাই স্মরণ করবেন।
তবে একটা জিনিস সবাই মনে রাখবেন। সেটা হলো ‘হেড কাউন্ট’। কোন দলের সভায় কত লোক হলো, কাদের সভায় রাস্তা কতটুকু উপচে উঠেছিল এবং যানবাহন কতক্ষণ বন্ধ ছিল—এই জিনিসগুলো আলোচনায় এসেছে।
আমাদের রাজনীতিবিদদের দরকার হেড কাউন্ট বা মাথার হিসাব। কারা সভায় কত মাথা আনতে পারলেন, তা দিয়ে জনপ্রিয়তা মাপা হয়ে থাকে। সমাবেশে যত বেশি হেড কাউন্ট, টিভি সংবাদ ও পত্রিকায় জনসভার ছবিও তত ভালো দেখাবে।
তবে জনসভার হেড কাউন্ট দল বিচারে বা জনপ্রিয়তার দৌড়ে যে খুব প্রভাব ফেলে, তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। বিগত সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের প্রতিটি জনসভায় উপচে পড়া ‘মাথা’ থাকত। কিন্তু জনতার স্বতঃস্ফূর্ত হেড কাউন্টের কাছে তারা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেনি।
জনসভায় হেড কাউন্ট জিনিসটা আমাদের রাজনীতিতে অনেক দিন ধরে চলে আসছে। একাত্তরের আগে দেখেছি, রাজনৈতিক দলগুলো বাস পাঠিয়ে ডেমরা, তেজগাঁও থেকে শ্রমিকদের নিয়ে আসত। প্রয়োজন হলে কাঁটাবন বস্তি থেকেও লোক আসত। তাতেই ভরে যেত পল্টন ময়দান। ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শেখ মুজিবের সভা ভরাতে বাস-ট্রেনের প্রয়োজন হয়নি, মানুষ নিজেদের উদ্যোগে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসেছিল।
এখন সময় পাল্টে গেছে। সবকিছু এখন ফাইভ স্টারভিত্তিক। দলের কাজকর্ম সব এখন ফাইভ স্টার ভবনে। রাজনৈতিক দলের ইফতার হবে ফাইভ স্টার হোটেলে। নেতাদের গাড়িবহর হবে ১০০টি গাড়িতে। দলের জনসভায় লোক আনানো হবে রেলগাড়িতে।মাওলানা ভাসানী যখন পল্টনে সভা করতেন, তখন অন্য দলের লোকজনও ওখানে যেত। কারণ, তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা সব সময়ে তুঙ্গে ছিল। তাঁর সভায় ডান দিকে টুপি মাথায় তাঁর ভক্ত ও মুরিদেরা থাকতেন, বাম দিকে লাল ঝান্ডা হাতে বা লাল পট্টি কপালে বেঁধে তাঁর রাজনৈতিক অনুসারীরা বসতেন। দক্ষিণপন্থী-বামপন্থী কোনো হাঙ্গামা হতো না। সবাই মন দিয়ে তাঁর সাম্যের বাণী শুনতেন। মাওলানা ভাসানী হেড কাউন্ট নিয়ে কখনো খুব মাথা ঘামাতেন না, যা ভাবতেন তাই বলতেন, আর যা বলতেন তা-ই করতেন।
এখন সময় পাল্টে গেছে। সবকিছু এখন ফাইভ স্টারভিত্তিক। দলের কাজকর্ম সব এখন ফাইভ স্টার ভবনে। রাজনৈতিক দলের ইফতার হবে ফাইভ স্টার হোটেলে। নেতাদের গাড়িবহর হবে ১০০টি গাড়িতে। দলের জনসভায় লোক আনানো হবে রেলগাড়িতে।
জনসভার জন্যও কোনো সীমারেখা নেই। মাঠ-ময়দান, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল চত্বর সবই বৈধ। রাজনৈতিক দলগুলোর অঢেল টাকা। তার কিছুটা সভা-সমিতিতে হেড কাউন্ট বাড়াতে খরচ হবে, সেটাই স্বাভাবিক।
১৯ জুলাই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মহাসমাবেশ উপলক্ষে বাইরে থেকে সমর্থকদের ঢাকায় আনার জন্য চার জোড়া বিশেষ ট্রেন ভাড়া করা হয়েছিল। ইসলামী আন্দোলনও গাড়ি ও লঞ্চ ভাড়া করে বাইরে থেকে লোক এনে ইদানীং ঢাকায় সভা করেছে। আমির আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘সারা দেশ থেকে কয়েক হাজার গাড়ি রিজার্ভ করা হয়েছে।’
আগে ছাত্ররা সভা করত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায়। বটতলায় সমাবেশ করাটাই ছিল তাদের গর্ব। একুশে যেত শহীদ মিনারে। এখন ছাত্রদের দলগুলো রাজনৈতিক দলগুলোকে পাল্লা দিচ্ছে। বাস-ট্রেন ভাড়া করে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ‘ছাত্র’ আনছে তাদের ‘ছাত্রসভায়’ যোগ দিতে।
জনসমর্থন দেখাতে রাজধানীতে ৩ জুলাই ছাত্রদল ও এনসিপির পৃথক সমাবেশ হয়েছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে, জনসভায় হেড কাউন্ট বাড়াতে ছাত্রদল চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত ২০ বগির বিশেষ ট্রেন ভাড়া করেছে।
আরও পড়ুনসমাবেশটি আগের মতো ছুটির দিনেও হতে পারতো২৮ মে ২০২৫প্রথম আলোর খবরে প্রকাশ, ঐতিহাসিক জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ অনুষ্ঠানে সারা দেশ থেকে ছাত্র-জনতা আনতে আট জোড়া ট্রেন ভাড়া করেছে সরকার। এসব ট্রেনে করে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ছাত্র-জনতাকে ৫ আগস্ট ঢাকায় নিয়ে আসার কর্মসূচি নেওয়া হয়। আট জোড়া ট্রেনের জন্য প্রায় ৩০ লাখ ৪৬ হাজার টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও দেশের সব টিভি চ্যানেলে এই অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে, তবু বাইরের থেকে লোক আনতে হয়েছে। কারণ, সরকারের প্রয়োজন হেড কাউন্ট।
রাজনীতির আরেকটা হেড কাউন্টের বর্ণনা আশা করি এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কিছু রাজনৈতিক দলের সভায় এই হেড কাউন্ট সবার চোখে পড়বে—স্টেজের ব্যানারে একটা ফ্যামিলি ট্রি-এর ছবি। বিএনপির ব্যানারে হেড কাউন্ট থাকে তিন—জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। আওয়ামী লীগের ব্যানারে হেড কাউন্ট দুই—শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনা; তৃতীয়জন তারা এখনো ঠিক করে উঠতে পারেনি।
এক শ বছর পরে, এই দল দুটির ব্যানারে ফ্যামিলি ট্রি আরও বড় হবে, হেড কাউন্টও স্বভাবত আরও অনেক বাড়বে!
আজকাল আমাদের রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতারা প্রায় সবাই পুরোমাত্রায় ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে গেছেন। নেতাদের আগের দিনের মতো ঢাকার বাইরে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে সভা-সমিতি করতে দেখা যায় না। সেটাও একটা কারণ হতে পারে ঢাকার সভার হেড কাউন্ট বাড়ানোর। নেতারা যাবেন কেন জনগণের কাছে, জনগণকেই আসতে হবে তাঁদের কাছে! জনগণ হলো রাজনৈতিক দলের হেড কাউন্ট।যুক্তরাষ্ট্রে খোদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও তাঁর রিপাবলিকান পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কে, তা বলতে পারবেন কি না, সন্দেহ আছে। কারণ, ওদের ব্যানারে কোনো ফ্যামিলি ট্রি নেই।
একক হেড কাউন্টের বিষয়টাও এখন বলা যেতে পারে। শেখ হাসিনার সময় টিভি স্ক্রিনের ওপরের বাঁ দিকের কোনায় শেখ মুজিবের একটা মাথার ছবি প্রায়ই দেখা যেত বছরের প্রায় দশটা মাস। স্বাধীনতা দিবস, ৭ মার্চ, মৃত্যুদিবস, জন্মদিবস, বিজয় দিবস, পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগমন দিবস ইত্যাদি সব দিবসে মাসব্যাপী অনুষ্ঠান থাকত। এই একক হেড কাউন্টটা শেখ মুজিবের মর্যাদা বাড়াতে কোনো সাহায্য করেনি।
এখন ইন্টারনেট-যুগে আমাদের শহরে গ্রামে প্রায় প্রতিটি জায়গায় ইন্টারনেট সংযোগ আছে। আমাদের জাতীয় দলের একজন বড় নেতা লন্ডনে বসে প্রায় প্রতিদিন বাংলাদেশে তাঁর সমর্থক ও দলীয় নেতাদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়ালি কথা বলছেন। ঢাকার জনসভায়ও তিনি ভার্চ্যুয়ালি যোগ দিয়েছেন।
আরও পড়ুনছাত্রদের নতুন দল কি নতুন রাজনীতি হাজির করতে পারবে২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫সুতরাং সশরীর হাজির হয়ে দলের হেড কাউন্ট বাড়াতে হবে, এই যুগে এ ধারণাটা অচল। হেড কাউন্ট বাড়াতে সভাস্থল থেকে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ভার্চ্যুয়াল যোগাযোগ স্থাপন করা যেতে পারে। যার যত সংযোগ এবং প্রতি সংযোগের স্ক্রিনে যত লোক দেখছেন, তার তত হেড কাউন্ট।
রাজনৈতিক দলগুলো ভাড়া করা গাড়িতে বাইরের থেকে লোকজন নিয়ে এসে আরও বড় প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারেন। যদি কোনো অর্বাচীন প্রশ্ন করে বসেন—বাইরের থাকে আনা লোকগুলোও কি ভাড়াটে? আড়াই কোটি লোকের শহরে হেড কাউন্ট দেখাতে, তাদের শহরের বাইরের থেকে লোক আনতে হবে কেন?
আজকাল আমাদের রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতারা প্রায় সবাই পুরোমাত্রায় ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে গেছেন। নেতাদের আগের দিনের মতো ঢাকার বাইরে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে সভা-সমিতি করতে দেখা যায় না। সেটাও একটা কারণ হতে পারে ঢাকার সভার হেড কাউন্ট বাড়ানোর। নেতারা যাবেন কেন জনগণের কাছে, জনগণকেই আসতে হবে তাঁদের কাছে! জনগণ হলো রাজনৈতিক দলের হেড কাউন্ট।
সালেহ উদ্দিন আহমদ লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ই-মেইল: [email protected]
*মতামত লেখকের নিজস্ব