কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার ক্রয়ের দরপত্রে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সর্বনিম্ন মূল্যের দরপত্র দাখিলকারীকে বাদ দিয়ে তিন নম্বরে থাকা কোম্পানিকে টেন্ডার দেওয়া হয়েছে। এতে সরকারের প্রায় ১০ লাখ টাকা গচ্চা গেছে। আবার দরপত্রে অংশ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দাবি করে আদালতে মামলা করেছে ওয়ালটন।
শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন বিভাগের জন্য গত বছরের ২২ ডিসেম্বর ৪৫টি কম্পিউটারের দরপত্র আহ্বান করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি)। দরপত্রে অংশ নেয় ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, সফট-টেক, স্মার্ট টেকনোলজি (বিডি) লিমিটেড, ক্রিয়েচার কম্পিউটারস, গ্লোবাল ব্র্যান্ড লিমিটেডসহ সাতটি প্রতিষ্ঠান। কম্পিউটার সরবরাহের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন সরকারকে প্রধান করে সাত সদস্যের স্পেসিফিকেশন কমিটি গঠন করে গত বছরের ১৭ অক্টোবর। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে ব্র্যান্ড, মডেল, প্রসেসর, মেমরি, স্টোরেজ, গ্রাফিক্সসহ ১৭টি বিষয় উল্লেখ করে একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করে দেয় ওই কমিটি।
অথচ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮ এর ২৯(৩) ধারায় আছে– কারিগরি টেন্ডার আহ্বানে স্পেসিফিকেশনে ট্রেডমার্ক, পেটেন্ট, নকশা, উৎপাদনকারী বা সরবরাহকারীর নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা যাবে না। কিন্তু এসব বিধানের তোয়াক্কা না করে মডেল, স্পেসিফিকেশন ও কোম্পানির নাম উল্লেখ করে দরপত্র আহ্বানের সুপারিশ করেন স্পেসিফিকেশন কমিটি ও সিনিয়র প্রোগ্রামার নাসির উদ্দিন।
এ বিষয়ে কমিটির আহ্বায়ক মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন সরকার বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে ভালো জিনিস কিনতে গ্লোবাল কোম্পানির নাম উল্লেখ করেছি।’
এদিকে কম্পিউটার ক্রয়ের কারিগরি স্পেসিফিকেশন মূল্যায়নের জন্য ২ সদস্যের মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়। তারা সাত কোম্পানির জিনিসপত্র মূল্যায়ন করে মতামত দেন। বলা হয়, ওয়ালটন ডিজি-টেক বাংলাদেশি ব্র্যান্ড। ওয়ালটন কর্তৃপক্ষ বলেছেন ডেল বা এইচপির সমমানের তারা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া শর্ত পূরণ করতে পারেনি ওয়ালটন। শর্ত অনুযায়ী ওয়ালটনকে বাদ দিতে পারেন।
কারিগরি স্পেসিফিকেশন মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক সাইফুর রহমান বলেন, ‘কে শর্ত পূরণ করেছে সেটা আমাদের বিষয় না। আমরা শুধু যেসব মানদণ্ড নির্ধারণ করা আছে, সে অনুযায়ী টেকনিক্যাল দিকগুলো যাচাই করেছি।’
পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন-২০০৬ এর ৪৮(২) ধারা অনুযায়ী টেন্ডার পেয়ে থাকে সবচেয়ে কম মূল্যের দরপত্র দাখিলকারী প্রতিষ্ঠান। কুবির কম্পিউটার ক্রয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম দরপত্র ছিল ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রির, যা ৪৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু এ কোম্পানিকে টেন্ডার না দিয়ে তিন নম্বরে থাকা স্মার্ট টেকনোলজিকে দেওয়া হয়। যাদের দরপত্র ছিল ৫৬ লাখ ৩৪ হাজার টাকার।
সর্বনিম্ন দরপত্র হওয়ার পরও ওয়ালটন কোম্পানিকে টেন্ডার না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানির চিফ বিজনেস অফিসার তৌহিদুর রহমান রাদ বলেন, ‘আমরা সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের টেন্ডার দেয়নি। এ বিষয়ে সিনিয়র প্রোগ্রামারের (নাসির) কাছে কয়েকবার চিঠি ও ই-মেইল করে জানতে চাইলেও কোনো রেসপন্স করেননি। এতে আমাদের কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ফলে আমরা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি।’
ওয়ালটনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির আপিল বিভাগের রিভিউ প্যানেল জানান, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কম্পিউটার ক্রয়ের বিনির্দেশে কয়েকটি ব্র্যান্ড উল্লেখ করলেও সমতুল্য শব্দটি যোগ করায় প্রসেসর ও গ্রাফিক্স ব্যতীত অন্যত্র বড় ধরনের ব্যত্যয় হয়েছে বলে মনে হয়নি। তবে প্রশাসনের কাছে ওয়ালটন কারণ জানতে চাইলে তাদের ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এ ধরনের মাইনর ডেভিয়েশনকে উল্লেখ করে সর্বনিম্ন দরপত্র উপেক্ষা করে নন-রেসপনসিভ হিসেবে মূল্যায়িত করে সরকারের ৯ লাখ ৯৪ হাজার টাকার ক্ষতি করা হয়েছে। এ ক্ষতির দায় টেকনিক্যাল কমিটির তিন সদস্যের ওপর বর্তায়। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮ এর ৬০(৩)ঙ বিধি মোতাবেক দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে ওয়াল্টন। এ ছাড়া আপিলকারীর নিরাপত্তা জামানত ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তারা।
ওয়ালটনের ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে তৌহিদুর রহমান রাদ বলেন, কোম্পানি একটি দরপত্রকে কেন্দ্র করে অনেক টাকা বিনিয়োগ করে। এই টাকার সুদ আসে। তবে টাকার পরিমাণ জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
দরপত্র কম হওয়ার পরও কাজ না পাওয়ার বিষয়ে টেন্ডারের প্রকিউরমেন্ট কমিটির এনটিটি ও সিনিয়র প্রোগ্রামার মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের ভাষ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন যে শর্ত উল্লেখ করেছিল তা ওয়ালটন ডিজি-টেক পূরণ করতে পারেনি। এ ছাড়া ২ নম্বরে থাকা সফট টিচের ব্যবসায়িক ছাড়পত্র না থাকায় তাদের দেওয়া হয়নি। স্মার্ট টেকনোলজি শর্ত পূরণ করায় তাদের টেন্ডার দেওয়া হয়।
ওয়ালটন ডিজি-টেক কোম্পানিকে কেন নন-রেসপন্স করা হয়েছে, জানতে চাইলে মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, দরপত্র চলাকালীন তারা (ওয়ালটন) বারবার বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তাদের জিনিসগুলো ক্রয় করার জন্য বলেছেন, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ।
তিন নম্বরে থাকা কোম্পানিকে কেন টেন্ডার দেওয়া হয়েছে? এ প্রশ্নের জবাবে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মোহাম্মদ সোলায়মান জানান, টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন কমিটির মানদণ্ডের আলোকে কম্পিউটার ক্রয়ের কারিগরি স্পেসিফিকেশন মূল্যায়ন কমিটি যেভাবে মতামত দিয়েছে সেভাবে নির্ধারণ করেছেন তারা।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র দরপত র ম হ ম মদ র জন য অন য য় কম ট র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

নিউমুরিং টার্মিনাল পরিচালনায় প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রপ্রক্রিয়া চেয়ে রিটের শুনানি ২৯ জুন

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার ক্ষেত্রে ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রপ্রক্রিয়া আহ্বান করার নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের ওপর শুনানির জন্য ২৯ জুন দিন ধার্য করেছেন হাইকোর্ট। শুনানির জন্য ওই দিন বেলা দুইটায় সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। বিচারপতি হাবিবুল গনি ও বিচারপতি শেখ তাহসিন আলীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ দিন নির্ধারণ করেন।

এর আগে রিটটি শুনানির জন্য গত ২৫ মে আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে। সেদিন রাষ্ট্রপক্ষের সময়ের আরজির পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ‘অবকাশের পর’ শুনানির জন্য রাখেন। ৩ জুন থেকে ২১ জুন পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটি চলে।

সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, বেঞ্চটির আজকের কার্যতালিকায় রিটটি ৬২৬ নম্বর ক্রমিকে ওঠে, যার নিচে ২৯ জুন বেলা দুইটায় সময় লেখা রয়েছে।  

রিট আবেদনকারীর অন্যতম আইনজীবী আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অবকাশকালীন ছুটির পর গতকাল সোমবার রিটটি আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে। বিষয়টি উপস্থাপন করা হলে আদালত শুনানির জন্য ২৯ জুন বেলা দুইটায় সময় নির্ধারণ করেন।

নিউমুরিং টার্মিনাল বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে বাংলাদেশ যুব অর্থনীতিবিদ ফোরামের পক্ষে সংগঠনের সভাপতি মির্জা ওয়ালিদ হোসাইন ওই রিটটি করেন। ‘নিউমুরিং টার্মিনালে সবই আছে, তবু কেন বিদেশির হাতে যাচ্ছে’ শিরোনামে গত ২৬ এপ্রিল প্রথম আলোতে প্রতিবেদন ছাপা হয়। এটিসহ এ বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন রিটে যুক্ত করা হয়েছে।

রিট আবেদনকারীপক্ষের আইনজীবীর ভাষ্য, ২০১৯ সালে সমঝোতা স্মারকের মধ্য দিয়ে প্রক্রিয়া শুরু হয়। টার্মিনাল অপারেটর সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। জিটুজির ভিত্তিতে প্রকল্প কাজ পেতে হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে দুই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করতে হয়। অথচ পিপিপি কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে দেওয়া প্রজেক্ট প্রোফাইলে অনুমিত বিনিয়োগ হিসেবে ২০০ কোটি টাকা দেখা যায়, যা জিটুজি গাইডলাইন–২০১৭ সংশ্লিষ্ট বিধির পরিপন্থী।

রিটের প্রার্থনায় দেখা যায়, দেশীয় অপারেটরদের অনুমতি না দিয়ে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) আইন ও নীতি লঙ্ঘন করে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির চলমান প্রক্রিয়া কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না—এ বিষয়ে রুল চাওয়া হয়েছে। যেকোনো অপারেটরকে এনসিটি পরিচালনার জন্য দায়িত্ব (নিযুক্ত) দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতি অনুসারে ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক পাবলিক বিডিং (দরপত্র আহ্বান) নিশ্চিত করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না—সে বিষয়েও রুল চাওয়া হয়েছে। রিটে নৌ পরিবহন সচিব, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিবাদী করা হয়েছে।

প্রথম আলোতে গত ২৬ এপ্রিল প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রয়োজনীয় সবকিছু আছে এবং ভালোভাবে চলতে থাকা এই টার্মিনাল আওয়ামী লীগ আমলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগ আমলের সেই ধারাবাহিকতা এগিয়ে নিচ্ছে। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম টার্মিনাল অপারেটর সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডকে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে জিটুজি ভিত্তিতে টার্মিনালটি পরিচালনার ভার দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এর বিরুদ্ধে অনেক দিন ধরে সরব বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীরা। আন্দোলন-বিক্ষোভও করেন তাঁরা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নিউমুরিং টার্মিনাল পরিচালনায় প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রপ্রক্রিয়া চেয়ে রিটের শুনানি ২৯ জুন