আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দেখেছি অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে কীভাবে প্রকল্প, মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। নতুন নতুন প্রকল্পের উদ্ভাবন করা হয়েছে। এসব প্রকল্পের অধিকাংশের যথাযথ সমীক্ষা ছিল না; ছিল টাকার শ্রাদ্ধ। বিভিন্ন বাহানায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো মানে বাজেট বৃদ্ধি। সব কিছুকে ‘উন্নয়ন’ বলে চালানো হয়েছে, যার অধিকাংশই জনগণের কাজে আসেনি। 
বর্তমানে নারায়ণগঞ্জে যেসব প্রকল্প চলমান, সেগুলোর ভবিষ্যৎ ও পরবর্তী বাস্তবতা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এর একটি হচ্ছে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নির্মিতব্য কদম রসুল সেতু। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব ও পশ্চিম পারকে যুক্ত করার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু। সেতুটিকে নারায়ণগঞ্জবাসীর দীর্ঘ দিনের স্বপ্নও বলা চলে। এর নকশায় বড় ধরনের ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ ত্রুটি এখনই যে তৈরি হয়েছে, তা নয়। জনসমক্ষে প্রকল্পটি উন্মুক্ত হওয়ায় ত্রুটি নজরে এসেছে। জনগণ যেহেতু এসব প্রকল্পের অংশীজন; প্রকল্পের শুরুতে তাদের মতামত নিলে সে ত্রুটি আগেই চিহ্নিত হতো।

সেতুটি নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে যৌথভাবে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। ৭৩৫ কোটি টাকার প্রকল্প ২০১৭ সালে একনেকে অনুমোদিত হয়েছে। কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৮ সালে; মেয়াদ ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন।

সেতুটির পূর্ব পারের র‍্যাম্প-স্পট (নামার মুখ) বন্দর উপজেলার সিএসডি অঞ্চল এবং পশ্চিমাংশের র‍্যাম্প শহরের নারায়ণগঞ্জ কলেজের সামনে। কলেজটি শহরের ব্যস্ততম নবাব সিরাজউদ্দৌলা সড়কে অবস্থিত। এর উত্তর পাশে নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুল এবং কলেজ ঘেঁষে শহরের সবচেয়ে বড় পণ্যস্থল দিগুবাবুর বাজারের প্রবেশমুখ। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে নারায়ণগঞ্জ শহরে রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, বাস টার্মিনাল একই জায়গায় অবস্থিত। সেখানে যাওয়ায় যেমন, তেমনই দেশের বৃহত্তর রং ও সুতার বাজার টানবাজারে যাওয়ার জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। এখানে রয়েছে রেলক্রসিং; যেখানে বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে। সব মিলিয়ে, সিরাজউদ্দৌলা সড়কটিতে সব সময় যানজট থাকে। 

নারায়ণগঞ্জে অপরিকল্পিত নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে এখানে গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত পরিবহন ব্যবস্থা। ১৮৮৫ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ রেল ব্যবস্থা চালু হলে শহরটি পূর্ববঙ্গের সিংহদ্বারে পরিণত হয়েছিল। গোয়ালন্দ থেকে স্টিমারে নারায়ণগঞ্জ; তারপর রেল বা সড়কপথে ঢাকাসহ অন্যান্য জায়গায় যাওয়া যেত। প্রায় দেড়শ বছর পরে এ যোগাযোগ ব্যবস্থা জনদুর্ভোগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
এ পরিস্থিতিতে কদম রসুল সেতুর নকশা প্রণয়নে এলাকার বাস্তবতা, ট্রাফিক প্রভাব নিরূপণে সমীক্ষার ক্ষেত্রে ত্রুটি রয়েছে। এই সেতু দিয়ে ঘণ্টায় কত যান চলাচল করবে এবং তার ধারণ সক্ষমতা এ সড়কের কতটুকু রয়েছে, তা প্রকল্পের নকশায় গুরুত্ব পায়নি। বিদ্যমান ব্যবস্থায় সেতু থেকে সড়কে গাড়ি নামার বাস্তবতা নেই। ১ নম্বর রেলগেটের কাছে বন্দর খেয়াঘাট। প্রতিদিন সেখানে এক লাখ ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ লোক যাতায়াত করে। এর ৬০ শতাংশ যদি সেতু ব্যবহার করে, তাহলে কী দাঁড়াবে? 

নারায়ণগঞ্জ শহরে বর্তমানে সাড়ে ৯ লাখ মানুষের বসতি। যদি বর্তমান হারে জনসংখ্যা বাড়ে তাহলে আগামী একশ বছরে এ সংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটিরও বেশি। কদম রসুল সেতুর মতো প্রকল্প অন্তত একশ বছর সামনে রেখে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। রাজনীতি ও আত্মস্বার্থ যখন গুরুত্বপূর্ণ হয়, তখন কোনো কিছু বিবেচনায় থাকে না। 
ত্রুটিপূর্ণ নকশা নিয়ে কদম রসুল সেতু প্রকল্পের টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। মনে হচ্ছে, যেনতেনভাবে সেতু বানিয়ে দিলেই কাজ সারা হয়ে গেল। জনগণের কাজে লাগুক বা না লাগুক। বর্তমান নকশায় এ সেতুর মুখ যেভাবে আছে, সেভাবে বাস্তবায়িত হলে উপকার তো নয়ই, স্থায়ীভাবে নারায়ণগঞ্জবাসীর জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে উঠবে। নারায়ণগঞ্জের জন্য আশীর্বাদ না হয়ে তা অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। 
এ পরিস্থিতিতে কদম রসুল সেতুর পশ্চিম পারের মুখটি পরিবর্তন করে দ্রুত সেতুর কাজ শুরু করা জরুরি। নকশা পরিবর্তন করতে গিয়ে প্রকল্প যাতে বিঘ্নিত বা বিলম্বিত না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

রফিউর রাব্বি: লেখক; আহ্বায়ক, নারায়ণগঞ্জ নাগরিক আন্দোলন

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ন র য়ণগঞ জ ন র য়ণগঞ জ প রকল প র ব যবস থ র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

ইরান কিছুই ভুলবে না, সব মনে রাখবে

বিশ্বভণ্ডদের সরদার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভয়ংকর প্রতারণার সর্বশেষ পরিণতি হিসেবে আমরা গত সপ্তাহান্তে ইরানে সরাসরি বড় ধরনের মার্কিন হামলা দেখলাম। ইরানে ইসরায়েলের উসকানিমূলক আগ্রাসনের পর ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রও সরাসরি এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল।

ইসরায়েল যেভাবে ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া ও ইয়েমেনে সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে, ঠিক সেই কায়দায় এবার তারা ইরানের শিল্প স্থাপনা, সামরিক ও বিজ্ঞান নেতৃত্বের ওপর হামলা চালিয়েছে; শত শত সাধারণ মানুষকেও হত্যা করেছে। এটি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর চিরাচরিত ধরন।

গেল শনিবার ইরানের ফর্দো, নাতানজ ও ইস্পাহান শহরের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র বোমা হামলা চালায়। এরপর এই যুদ্ধপিপাসা যেন আরও ভয়ংকর রূপ নিয়েছে।

তবে এটি স্পষ্ট, ইরানিরা তাঁদের মাতৃভূমি রক্ষায় শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবে। তাঁরা কোনো কিছুকে সমঝে চলবে না। এ অঞ্চলের যেসব আরব দেশে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি আছে এবং যারা এ আক্রমণে কোনো না কোনোভাবে সহযোগী, তাদের জন্যও কঠিন পরিণতি হতে পারে। কারণ, এটি আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ওপর সরাসরি হামলা।

আরও পড়ুন২৫০০ বছরের পুরোনো দুশমনি: ইসরায়েল কি ‘মরদখাই’? ইরান কি ‘হামান’?১৭ জুন ২০২৫

ট্রাম্প হামলার ঠিক আগমুহূর্তে যে ‘আলোচনার নাটক’ করছিলেন, সেটি নিছক হাস্যকর রাজনৈতিক ছলনা ছিল না। আর ইসরায়েলও কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র নয়। এটি কার্যত একটি সামরিক গুদামঘর, যা তার মদদদাতা ও মালিকদের স্বার্থে কাজ করে।

ইসরায়েল ও তাদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, ইরানই হলো সবচেয়ে বড় শত্রু। তারা এমনভাবে কথা বলে এসেছে, যেন ইরান এখনই একটা পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ইসরায়েলের ওপর ফেলতে যাচ্ছে।

কিন্তু এ কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আদতে ইসরায়েল নিজেই একটা দখলদার উপনিবেশ, যাদের কাছে অনেক পারমাণবিক অস্ত্র মজুত আছে এবং প্রচুর ভয়ংকর সাধারণ অস্ত্রও রয়েছে। এসব সাধারণ অস্ত্র তারা গাজা ধ্বংস করতে ও ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা চালাতে ব্যবহার করেছে।

যেকোনো সুস্থ মানুষ একমত হবেন—না ইরান, না ইসরায়েল, না অন্য কোনো দেশের পারমাণবিক অস্ত্র থাকা উচিত। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, যারা নিজেরাই ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে, তারা কি সত্যিই ইরানের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলতে পারে? কিংবা যে যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একমাত্র দেশ হিসেবে জাপানে পারমাণবিক বোমা ফেলেছিল, তারা কি এই অভিযোগ করার নৈতিক অবস্থানে আছে?

আরও পড়ুনইরানে হামলা ইসরায়েলের জন্য কৌশলগত বিপর্যয় ডেকে আনবে ১৭ জুন ২০২৫

এমনকি ইউরোপীয় দেশগুলোও, যাদের নিজস্ব অতীতে ঔপনিবেশিক শোষণ আর ফ্যাসিবাদ ছিল, তারাও কি এ বিষয়ে নীতিকথা বলার মতো জায়গায় আছে? নিশ্চয়ই না।

ইরান পারমাণবিক বোমা বানাতে পারে—এই জুজুর ভয় আসলে একটা অজুহাত, একটা ধোঁকা। ইসরায়েল আর তাদের সমর্থক জায়নবাদীরা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ইরানকে অনেক দিন আগেই শত্রু বানিয়ে তুলেছে। এখন তারা ইরানে হামলা চালিয়েছে মূলত ফিলিস্তিন নিয়ে মানুষ যেন কথা না বলে, সেই জন্য।

এখন যখন সারা বিশ্বের দৃষ্টি ইরানের দিকে, তখন ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের আরও বেশি হত্যা করছে, আরও বেশি জমি দখল করছে। ইরান হলো এই হত্যাযজ্ঞ থেকে নজর সরানোর একটা হাতিয়ার, একধরনের চালাকি।

এমনটা ভাবাও অস্বাভাবিক নয় যে ভবিষ্যতে ফিলিস্তিন ইস্যু থেকে মনোযোগ সরাতে ইসরায়েল পাকিস্তান, তুরস্ক, ইয়েমেন, এমনকি টিমবাকটু (টিমবাকটু পশ্চিম আফ্রিকার একটি ঐতিহাসিক শহর) পর্যন্ত আক্রমণ করতে পারে।

এই ফাঁকা অজুহাত মোকাবিলার সবচেয়ে উপযুক্ত উপায় হলো মনোযোগ ঠিক রাখা এবং ফিলিস্তিনের ওপরই দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করে রাখা। কারণ, সেখানে এখনো হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করছে ইসরায়েলি জায়নবাদীরা।

ইরানিরা নানা রাজনৈতিক মতের মানুষ, কিন্তু একটা ব্যাপারে তারা প্রায় সবাই একমত। সেটি হলো, নিজেদের দেশকে রক্ষা করতে হবে। কারণ, ইরান হলো এক প্রাচীন ও গভীর শিকড়ের সভ্যতা। এর উত্তরাধিকার প্রত্যেক ইরানির মধ্যেই আছে। তারা নিজেরাই সেই ইতিহাস ও স্মৃতির ধারক।

ইরানে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান নিয়ে সবচেয়ে হাস্যকর প্রচারণাগুলোর একটি হলো প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর পক্ষ থেকে ‘ইরানের মহান জনগণের’ উদ্দেশে নানা চটকদার বার্তা পাঠানো। এটি ছিল ইসরায়েলি প্রোপাগান্ডাযন্ত্র ‘হাসবারা’র (ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় বা আধা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পরিচালিত আন্তর্জাতিক প্রোপাগান্ডা বা জনমত প্রভাবিত করার প্রচার অভিযান) বানানো এক ফালতু কৌশল। এর উদ্দেশ্য ছিল ইরানের ভেতরে বিদ্রোহ বা অস্থিরতা উসকে দেওয়া, যাতে নেতানিয়াহু নিজের স্বার্থ উদ্ধার করতে পারেন।

কিন্তু ইরানে যদি কোনো প্রকৃত রাজনৈতিক বিরোধিতা থাকে, তা আসে জনগণের ভেতর থেকেই। এমন চটকদার প্রচারণা দিয়ে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তেমনি যারা ইসরায়েলি মিডিয়ায় ‘ইরানে বোমা ফেললে গণতন্ত্র আসবে’ বলে যে ভাষ্য দাঁড় করাতে চায়, তা–ও ধোপে টেকে না।

আরও পড়ুনইরান, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র—কে জিতল এই যুদ্ধে৮ ঘণ্টা আগে

ইরানিরা নানা রাজনৈতিক মতের মানুষ, কিন্তু একটা ব্যাপারে তারা প্রায় সবাই একমত। সেটি হলো, নিজেদের দেশকে রক্ষা করতে হবে। কারণ, ইরান হলো এক প্রাচীন ও গভীর শিকড়ের সভ্যতা। এর উত্তরাধিকার প্রত্যেক ইরানির মধ্যেই আছে। তারা নিজেরাই সেই ইতিহাস ও স্মৃতির ধারক।

হ্যাঁ, ইরানিরা তাদের শাসকদের অপছন্দ করে এবং সেটা যথেষ্ট যুক্তিসংগতও। কিন্তু যখন তারা দেখেছে, ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করতে চাওয়া একদল লুটেরা এবার তাদের দেশেও বোমা ফেলছে, তখন তাদের সেই অনুভূতি বদলে যেতে শুরু করেছে।

ইরানিরা এখন তাদের সরকারের পক্ষ নিচ্ছে না, বরং তারা নিজের দেশের মালিকানা বুঝে নিচ্ছে। একটি দেশের সার্বভৌমত্ব তার জনগণের, সরকারের নয়। কারণ আজ যারা শাসক, কাল তারা থাকবেই—এমন কোনো গ্যারান্টি নেই।

কিন্তু ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো বসতি-উপনিবেশভিত্তিক রাষ্ট্রগুলো এই সত্য এখনো বুঝতে পারেনি।

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র যেসব পারমাণবিক কেন্দ্রে বোমা ফেলেছে, সেগুলো কোনো সরকারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়; সেগুলো সব ইরানি জনগণের সম্পদ। ইরানিরাই তাদের দেশ ও ভূখণ্ডের মালিক। এই সহজ সত্য অন্যের জমিতে এসে নিজেদের স্বপ্ন গড়ে তুলতে চাওয়া ইসরায়েলি জায়নবাদীরা কখনোই বুঝবে না।

আরও পড়ুনকোনো ইহুদিরাষ্ট্র ৮০ বছর টেকে না—যে ভয়ে ভীত ইসরায়েল০৬ নভেম্বর ২০২৩

ইরানের সঙ্গে এ লড়াইয়ে ইসরায়েল হারবেই এবং এই পরাজয়ের প্রভাব শুধু ইরানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; এটি গোটা অঞ্চলের জনগণের ওপর প্রভাব ফেলবে। ফলে নিজেদের ভূমি রক্ষায় লড়াই চালিয়ে যাওয়া ফিলিস্তিনি, লেবানিজ, সিরীয় ও ইয়েমেনিদের মনোবল বাড়বে।

একই সঙ্গে এই হার কাঁপিয়ে দেবে সেই আরব শাসকদের, যারা দাসানুদাসের মতো ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে, ফিলিস্তিনিদের হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতা করেছে এবং ‘আব্রাহাম চুক্তি’র মতো এক ভ্রান্ত স্বপ্নে সই করে নিজেদের মর্যাদা বিসর্জন দিয়েছে। এই শাসকদের অবস্থান এখন আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।

তেল আবিবের যে বর্বর ও গণহত্যাকারী ইসরায়েলি জায়নবাদী সরকার আছে, তারা সব সময় অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দেখায়। তারা সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ভাবতে চায়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে যাচ্ছে।

ইসরায়েলি নেতারা যদি সত্যিই ভেবে থাকে, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন, তাঁরা শুধু কিছু আবেগী ছাত্র এবং তাঁরা তাদের জন্য হুমকি নয়, তাহলে সামনে যা আসছে তা দেখে তারা হতবাক হবে।

আরও পড়ুনইসরায়েল ইরানকে ভাঙতে চেয়েছিল, উল্টো জুড়ে যাচ্ছে২১ জুন ২০২৫

ইসরায়েলিরা এত দিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা শক্তি বলে ভেবে এসেছে। কিন্তু এখন সেই যুক্তরাষ্ট্রের একদম কেন্দ্রে এক জায়নবাদবিরোধী জোয়ার উঠছে।

এই পরিবর্তন বোঝার জন্য শুধু টুকার কার্লসন, স্টিভ ব্যানন, কংগ্রেস সদস্য মার্জরি টেইলর গ্রিনের মতো কয়েকজন প্রভাবশালী আমেরিকানের কথা শুনলেই হয়। তাঁরা ও তাঁদের মতো লাখো–কোটি আমেরিকান এখন এই হত্যাযজ্ঞ চালানো জায়নবাদীদের কারণে একটার পর একটা যুদ্ধের ভার বইতে বইতে ক্লান্ত। এবার তাঁরা আর তা সহ্য করবেন না।

এই সামরিক হামলা ইরানি জনগণের মধ্যে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি যে চিরন্তন শত্রুতা সৃষ্টি করেছে, তা আর সহজে মুছবে না।

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে আজ যে দেশকে আক্রমণ করেছে, সেটি হলো ফেরদৌসি, হাফিজ, রুমি, নিমা ইউশিজ ও ফরুঘ ফার্রোখজাদের মতো কবির জন্মভূমি ও সংস্কৃতির বিশাল ঐতিহ্যের অধিকারী ইরান। এই মহান ব্যক্তিত্বরা ইরানিদের মধ্যে এমন এক ঐক্য গড়ে তুলবে, যা ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে জাতিকে এক করে রাখবে।

আরও পড়ুনইরান যখন পরিবর্তনের পথে, তখনই কেন এই হামলা১৯ জুন ২০২৫

অপর দিকে এই জাতির বিরুদ্ধে যারা হামলা চালিয়েছে, তাদের ‘নেতা’ কারা? তাদের নেতারা হলেন থিওডর হার্‌ৎজেল, ডেভিড বেন-গুরিয়ন, বারুক গোল্ডস্টেইনের মতো লোকেরা, যাঁদের অনেকেই ইতিহাসে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত।

ইসরায়েল এ হামলা চালিয়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করতে পারেনি। বরং এ হামলা ইরানকে আরও দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথে ঠেলে দিয়েছে।

এখন যদি ইরান নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তাদের দোষ দেওয়া কঠিন। কারণ, ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র মিলিতভাবে শুধু ইরান নয়, গোটা অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকাকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

ওয়াশিংটনে একটি কথা অনেক দিন থেকে চালু আছে। সেটি হলো ইরানে হামলা হলে তাতে সে দেশটির শাসকদের শক্তি বেড়ে যায়। কিন্তু এবার সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এ হামলা ইরানের সরকারকে বরং আরও অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। এখন ইরানি জনগণ নিজের দেশকে নিজেরা রক্ষা করছে এবং এই প্রতিরোধ কত দূর গড়াবে, ইসরায়েল তার শেষ দেখতে পাবে না।

আজ ইরানের সরকার যদি আত্মরক্ষার জন্য কিছু করে, সেটাকে একমাত্র সরকারের কাজ বলা যাবে না। কারণ, এটি ইরানি জনগণের শক্তি, মনোবল ও ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ।

ইরানিরা কখনো সেই সব বিদেশি শক্তিকে কখনো ভুলবে না, কখনো ক্ষমা করবে না, যারা তাদের দেশের মাটি আক্রমণ করেছে, অবকাঠামো ধ্বংস করেছে, আর নিরীহ মানুষদের হত্যা করেছে।

ইরানিরা ইসরায়েলের ওপর পাল্টা প্রতিশোধ নেবে। তবে তারা তা নেবে না বোমা দিয়ে, না ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে। বরং নিজেদের দীর্ঘকাল ধরে জমে থাকা ক্ষোভ, স্মৃতি আর শক্ত মানসিকতা দিয়ে সেই প্রতিশোধ তারা নেবে।

তারা তাকিয়ে থাকবে সেই বিশ্বাসঘাতক পাহলভি রাজবংশের দিকেও, যারা একসময় ইরানে শাসন করেছে এবং এখন যুক্তরাষ্ট্রে বসে নিজের দেশের বদনাম করছে আর ইসরায়েলের প্রশংসা করছে।

ইতিহাসে একটি কাহিনি আছে। আড়াই হাজার বছর আগে যখন আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট ইরানে হামলা চালান, তখন পারস্যের বীর এরিওবারজানেস মাতৃভূমি রক্ষার জন্য লড়েছিলেন। কিন্তু এক বিশ্বাসঘাতক রাখাল তাঁকে ধোঁকা দিয়ে শত্রুকে পাশ কাটিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।

এ গল্প অনেকটা সেই গ্রিক যোদ্ধা এফিয়ালতেসের মতো, যিনি নিজের জাতিকে ঠকিয়ে শত্রুপক্ষের কাছে গোপন রাস্তা ফাঁস করে দিয়েছিলেন।

আজ আমরা হয়তো সেই প্রাচীন রাখালের নাম জানি না, কিন্তু আজকের যাঁরা নিজের দেশকে অপমান করে ইসরায়েলের পক্ষে কথা বলছেন, তাঁদের নাম আমরা জানি। সময় এলে তাঁদের জবাবদিহির মুখে পড়তেই হবে।

হামিদ দাবাশি নিউইয়র্ক শহরের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইরানি স্টাডিজ ও তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক। তিনি সেখানে তুলনামূলক সাহিত্য, বিশ্ব সিনেমা ও উপনিবেশ-উত্তর তত্ত্ব পড়ান।

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আগামীর বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত নতুন বাংলাদেশ : মাও. আবদুল হালিম
  • ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থানে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে ইরান
  • সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘এক্সকিউজ’ দেওয়ায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত : হাসনাত আবদুল্লাহ
  • ‘মব’–সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের দাবি বাম জোটের
  • সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অজুহাত দেওয়ার ট্রেনিংপ্রাপ্ত: হাসনাত আবদুল্লাহ
  • ‘মতপার্থক্য দূর করে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া খুব কঠিন বিষয় না’
  • সরকারের উচিত ছিল খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করা: এ্যানি
  • জনগণ সরকারের কাছে আইনের শাসন প্রত্যাশা করে: রিজভী
  • প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কসোভোর রাষ্ট্রদূতের সৌজন্য সাক্ষাৎ
  • ইরান কিছুই ভুলবে না, সব মনে রাখবে