টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলা সদরে লৌহজং নদের কুমুদিনী হাসপাতাল ঘাটে সেতু না থাকায় সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন অন্তত ৩৫টি গ্রামের বাসিন্দারা। তাঁরা এই ঘাটে একটি পদচারী–সেতু নির্মাণের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে সভা-সমাবেশ করছেন, তবে কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ না নেওয়ায় তাঁরা হতাশ।

সর্বশেষ গত শুক্রবার বিকেলে সদরের সাহাপাড়া বাজারে সমাবেশ করেন সাহাপাড়া, আন্ধরা, মুন্দিরাপাড়া, সরিষাদাইড়, পাহাড়পুর, ভাওড়া, কুতুববাজারসহ আশপাশের গ্রামের লোকজন। সমাবেশ স্থানীয় বাসিন্দা শহীদ ভবানী প্রসাদ সাহা সরকারি কলেজের প্রদর্শক (ডেমোনেস্টেটর) প্রাণ গোপাল সাহা, সরিষাদাইড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মুক্তি সাহা, মির্জাপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি নিরঞ্জন পাল, ব্যবসায়ী খন্দকার সালাউদ্দিন, তারপদ সাহা, শ্রীদীপ সাহা, বিপ্লব কুমার সাহা, সাবেক ইউপি সদস্য ময়নাল হক, খন্দকার আবদুল সাত্তারসহ কয়েক শ মানুষ অংশ নেন।

এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই ঘাটে সেতু না থাকায় মির্জাপুরের দক্ষিণাঞ্চলসহ আশপাশের অন্তত ৩৫ গ্রামের মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ভরা বর্ষায় ঘাটে খেয়ানৌকায় পারাপার চলে। এ ছাড়া শুষ্ক মৌসুমে চলাচলের জন্য স্থাপন করা হয় বাঁশের সাঁকো। কয়েক মাস আগেও প্রায় এক লাখ টাকা ব্যয়ে বাঁশের সাঁকো স্থাপন করা হয়। এরই মধ্যে ৩ মে সন্ধ্যার পর উজানের পানির স্রোত আর কচুরিপানার চাপে সাঁকোটি ভেসে যায়। নদ পারাপারের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় লোকজন প্রায় তিন কিলোমিটার ঘুরে পোষ্টকামুরী ও পাহাড়পুর এলাকার দুই সেতু দিয়ে গন্তব্যে যান। এ কারণে অতিরিক্ত অর্থ ও সময় নষ্ট হচ্ছে বলে দাবি এলাকাবাসী।

আজ বুধবার সকালে দেখা যায়, ভেঙে যাওয়া বাঁশের সাঁকো চার দিন আগে মেরামত করা হয়েছে। নদে পানি আগের চেয়ে কম। স্রোতও কমে গেছে। সাঁকো দিয়ে লোকজন কোনো রকম পার হচ্ছেন। লোকজন সাঁকো দিয়ে হেঁটে নদ পার হয়ে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের তৈরি করা রাস্তা দিয়ে রিকশা, অটোরিকশা, ব্যক্তিগত গাড়িসহ নানা ধরনের যানবাহনে গন্তব্যে যান। কুমুদিনী হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, নার্সিং স্কুল ও কলেজ, ভারতেশ্বরী হোমসের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই নদের দক্ষিণ পাড়ে থাকেন। তাঁরাও গ্রীষ্মে বাঁশের সাঁকো আর বর্ষায় নৌকা ব্যবহার করে নদের উত্তর পাড়ে অবস্থিত ওই সব প্রতিষ্ঠানে কর্মস্থলে যান।

কুমুদিনী হাসপাতালের কর্মচারী বুড়িহাটী গ্রামের সিদ্দিক মিয়া জানান, ‘সাঁকো যখন ভেঙেছিল, তখন দুই কিলোমিটারেরও বেশি জায়গা ঘুরে কর্মস্থলে আসতে হয়েছে। এতে বাড়তি টাকা ও সময় ব্যয় করতে হয়।’

নিজের অপারগতার কথা জানিয়ে গৃহিণী নাজমা বেগম বলেন, ‘বয়স হইছে। অহন আর এই বাঁশের বিরিজ দিয়া হাঁটা পারি না। একটা পাকা বিরিজ অইলে কতে যে ভালো অইতো।’

মির্জাপুর উপজেলা প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘লৌহজং নদের ওই ঘাটটি কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের নিজস্ব রাস্তার সঙ্গে যুক্ত। এলজিইডি থেকে ঘাটে সেতু নির্মাণ করা যাবে, তবে কুমুদিনী কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে।’

কুমুদিনী হাসপাতালের পরিচালক প্রদীপ কুমার রায় জানান, ‘ওই স্থানে সেতু নির্মাণের অনুমতির বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের। প্রায় ২০ বছর আগে হাসপাতালের রাস্তা দিয়ে একটি ট্রাক চলাচলের সময় কুমুদিনীর এক নারী কর্মীর পায়ের ওপর দিয়ে চালক চাকা উঠিয়ে দেন। পরে ওই নারী মারা যান। রাস্তাটিতে প্রচুর রোগীসহ হাসপাতালের কর্মী ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা চলাচল করেন। সেতু নির্মাণ করা হলে যান চলাচল করলে দুর্ঘটনার শঙ্কা থাকে। এ জন্য সেতু স্থাপনে কর্তৃপক্ষ অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে এলাকাবাসীর দাবি অনুযায়ী ওই স্থানে পদচারী–সেতু হলে ভালো হবে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ল কজন

এছাড়াও পড়ুন:

পশতু কাফেলায় বাংলাদেশি: টিটিপি কি নতুন আঞ্চলিক টানাপোড়েন তৈরি করছে

তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানকে বলা হয় টিটিপি। ‘তেহরিক’ মানে সক্রিয়তা বা আন্দোলন। তালেবান অর্থ শিক্ষার্থীরা। বাংলায় টিটিপির অর্থ দাঁড়ায় পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন।

আফগানিস্তানে বহু সংগ্রাম শেষে পশতু তালেবান এখন ক্ষমতায়। পাকিস্তানের পশতু এলাকার টিটিপি তাদেরই উপশাখা। তবে আফগান বা পাকিস্তান কোনো দেশের তেহরিক-ই-তালেবান আগের মতো ‘ছাত্রদের আন্দোলনে’ নেই; একটা বিশেষ আদর্শের সব বয়সীর উদ্যোগে পরিণত হয়েছে এবং এটা কেবল পশতু এলাকাতেও সীমিত নেই।

পাকিস্তানে টিটিপির হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে একাধিক বাংলাদেশির নিহত হওয়ার খবর বের হওয়ার পর এত দিনকার অনিচ্ছুক অনেকে মানছেন, তালেবদের এ আন্দোলন ইতিমধ্যে আঞ্চলিক চেহারা নিচ্ছে। শত্রু-মিত্রের ধরনও পাল্টাচ্ছে তাদের।

টিটিপি ‘পশতুনিস্তান’কে নতুন অবয়ব দিয়েছে

পশতুভাষীরা আফগানিস্তানের প্রধান জাতি। প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ সেখানে তারা। পাকিস্তানে পশতুনরা সংখ্যায় দ্বিতীয় প্রধান জাতি। খাইবার পাখতুনখাওয়া (সাবেক উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ) এবং বেলুচিস্তানে তাদের বড় বসতি হলেও করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ শহরেও সংখ্যায় অনেক আছে। সব মিলে সংখ্যায় প্রায় সাত কোটির মতো হবে পশতুভাষীরা। এ জাতির পুরোনো সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ইরান ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে। ওই সব অঞ্চলেও অল্পবিস্তর আছে তারা।

বিভিন্ন রাষ্ট্রের সীমান্তে বিভক্ত হয়ে পড়লেও পশতুনদের মধ্যে পশতুনিস্তান বলে এক হারিয়ে ফেলা জনপদের কল্পনা আছে। যে জনপদ ভাগ করে গেছেন স্যার মার্টিমার ডুরান্ট ১৮৯৩ সালে। তাঁর কলমের দাগই আজকের ‘ডুরান্ট লাইন’।

পশতুনরা মনে করে, কৃত্রিম ওই রেখা তাদের জাতিসত্তাকে বিভক্ত করেছে। সেই ক্ষোভের দানা বাঁধা ঠেকাতে আড়াই হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এ সীমান্তে পাকিস্তান এখন কাঁটাতার বসাচ্ছে। কিন্তু কৃত্রিম সীমান্তের মতোই কাঁটাতার পশতুনদের যে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত রাখতে পারছে না, তার এখনকার প্রমাণ কল্পনার পশতুনিস্তানজুড়ে তালেবান আদর্শবাদের উত্থান।

‘সীমান্ত গান্ধী’ নামে পরিচিত গাফফার খানের (১৮৯০-১৯৮৮) নেতৃত্বের আমলে এবং তার পরে বহুকাল পশতুনদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ধারাই ছিল প্রবল। এখন ডুরান্ট লাইনের দুই দিকে প্রাধান্য চলছে ইসলামপন্থী দাবিদার ‘তালেব’দের। আফগানিস্তানে তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। পাকিস্তান সরকার ও সশস্ত্র বাহিনী সেই রাজনৈতিক সুনামি থেকে পাঞ্জাব ও সিন্ধুকে বাঁচাতে চাইছে। এর মধ্যে কল্পনার পুরোনো পশতুনিস্তান অনেকটাই ধর্মতান্ত্রিক সামাজিক চেহারা নিয়ে ফেলেছে।

যেভাবে তালেবান আন্দোলনের বিস্তার

তালেবান আন্দোলনের জন্ম প্রায় ৩০ বছর আগে ডুরান্ট লাইনের উভয় দিক মিলে। সীমান্তের দুই দিকের মাদ্রাসগুলোয় পশতুভাষী শিক্ষার্থীদের যোদ্ধা-জনবল বানাতে পাকিস্তানের বিভিন্ন সংস্থা অনেক পরিশ্রম করেছে। ১৯৯৬ সালে এসে তারা প্রথম কাবুলে ক্ষমতা দখলে সক্ষম হয়। চার-পাঁচ বছর পর ক্ষমতা থেকে তারা উৎখাত হয় এবং পাকিস্তানের পশতু এলাকায় আশ্রয় নেয়।

নতুন করে সংগঠিত হয়ে প্রায় দুই দশক পর ন্যাটো বাহিনীকে তাড়িয়ে আবার কাবুলে ক্ষমতায় আসে ২০২১ সালের আগস্টে। এরপর ডুরান্ট লাইনের পাকিস্তান অংশে শুরু তালেবান সশস্ত্রতার তৃতীয় তরঙ্গ। তেহরিক–ই–তালেবান এখানে ২০০৭ থেকেই ছিল। কাবুল জয় শেষে তারা ‘পাকিস্তান জয়’ করতে নেমেছে কেবল।

আফগান টিটিএর মতো পাকিস্তানের টিটিপিও দেশটির অনেকগুলো সশস্ত্র সংগঠনের একটি জোট বা নেটওয়ার্ক। অন্তত ১৫টি গ্রুপ আছে এই নেটওয়ার্কে। দুটি গ্রুপ চীনের উইঘুর এলাকা ও উজবেকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করছে। সর্বশেষ বাংলাদেশিদের যুক্ত থাকারও খবর এল। সমগ্র জোটের সমন্বয় কীভাবে হচ্ছে, সেটা বলা মুশকিল। তবে আফগান পাখতিয়ারে আত্মগোপনে থাকা নুর ওয়ালি মেহসুদকে টিটিপির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা মনে করে খুঁজছে পাকিস্তান।

আরও পড়ুনভারত কি পাকিস্তান–তালেবান দ্বন্দ্বের সুযোগ নিচ্ছে১৫ জানুয়ারি ২০২৫পাকিস্তানে টিটিপির পরিসর

পাকিস্তানের টিটিপিবিরোধী যুদ্ধের ভরকেন্দ্র খাইবার পাখতুনখাওয়া (কেপি)। বলা বাহুল্য, এখানকার সবাই টিটিপির সমর্থক বা সদস্য নয়। তবে সংখ্যায় তারা অনেক, সর্বত্র আছে অল্পবিস্তর এবং বাড়ছেও।

পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য এখানকার যুদ্ধক্ষেত্রটা বিশাল ও জটিল। তাদের এখানে লড়তে হচ্ছে নিজ জনগণের বিরুদ্ধে। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর অন্তত ১৫ শতাংশ সদস্য পশতুভাষী। ফলে পশতুভাষী সেনা ও গেরিলারা পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে পড়ছেন।

টিটিপি দমন করতে যখনই হঠাৎ কোনো অভিযান চালানো হয়, তখন বেসামরিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তারা সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে খেপে ওঠে। আবার সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পূর্বে অবহিত করে অভিযান চালালে সেটা সফল হয় না। এ মুহূর্তে কেপিতে চলছে ‘অপারেশন সর্বাকফ’। সর্বাকফ ফারসি শব্দ। যার অর্থ, জান দিতে প্রস্তুত যারা।

নাম থেকেই স্পষ্ট রাষ্ট্রীয় সৈনিকেরা মৃত্যুপণ করে টিটিপি দমনে নেমেছেন। গত বছর জুনে ‘আজম-ই-ইসতেখাম’ (স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে সমাধান) নামে আরেকটা অভিযান চালিয়েছিলেন তাঁরা। তবে এসব অভিযানে টিটিপি দুর্বল হয়েছে বলে সাক্ষ্য মেলে না।

পাকিস্তানের তালেবান কেবল নিজেদের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে না, পশতু এলাকার পুরোনো রাজনেতিক দল আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির কর্মীদেরও আক্রমণ করছে। ইসলামাবাদের নির্বাহী শক্তির বিপরীতে এ এলাকায় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তারা কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রাখতে চায় না। এএনপি পশতু এলাকায় বামপন্থী আদর্শের পরম্পরা লালন করছে, যা তালেবান দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত।

টিটিপির সব উপদল একই আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে লড়ছে এমন নয়। কেউ কেউ কেপি এলাকায় শরিয়াহ আইন বাস্তবায়ন করতে পারলেই খুশি। অনেকে পাকিস্তান সরকারকে ‘তাগুদ’ হিসেবে অভিহিত করে উৎখাত করতে চায়। কেউ কেউ চায় পশতুনিস্তানকে এক করতে। আবার বিদেশি যোদ্ধারা ‘হিজরত’ করছে সুন্নি হানাফি মাজহাবের ধর্মীয় একটা মুক্তাঞ্চলের স্বপ্ন নিয়ে।

খাইবার পাখতুনখাওয়ার মামুজাই এলাকায় তেহরিক–ই–তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) সাবেক প্রধান হাকিমুল্লাহ মেহসুদের ঘনিষ্ঠজন টিটিপির সাবেক কমান্ডার লতিফ মেহসুদকে (মাঝে) একটি সাজোয়া যানের ওপর দেখা যাচ্ছে। ফাইল ছবি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ