জনস্বার্থ মামলা বিচারিক সক্রিয়তার এক অস্ত্র
Published: 14th, May 2025 GMT
কলোনিয়াল হ্যাংওভার শব্দটির দারুণ ট্রান্সলেশন (অনুবাদ) করেছিলেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। ট্রান্সলেশন না বলে বরং বলা যায় ‘ট্রান্সক্রিয়েশন’; অনুবাদের চমৎকারিত্ব আর অভিনবত্বের কারণে এমনটা বলা। তিনি শব্দটির অনুবাদ করেছিলেন ‘ঔপনিবেশিক ঝুলনমায়া’।
ঔপনিবেশিক শাসকেরা চলে গেছে বহু বছর আগে, কিন্তু রয়ে গেছে ‘মায়া’; রয়ে গেছে প্রশাসনিক, বিচারিক ও আইনি নানা ধরনের উপাচার। এগুলো আমাদের মায়ায় আচ্ছন্ন রেখেছে। এখনো এমন একটা ধারণা বিরাজ করে, ‘উপনিবেশ উপাসনা’ যেন মুক্তির পথ। অথচ যাদের কারণে উপনিবেশ, তাদের সব কি মানা হয়? উত্তর নিশ্চিতভাবেই নেতিবাচক।
ব্রিটিশদের সেই অর্থে মলাটবদ্ধ কোনো সুনির্দিষ্ট সংবিধান নেই, কিছু সাংবিধানিক নীতি ও কনভেনশন রয়েছে। তাদের লিখিত সংবিধান না থাকলেও কোনো ব্যত্যয় নেই, সাংবিধানিকতাই সেখানে চূড়ান্ত। আমরা অনেক দেশের অনুপ্রেরণায় অল্প সময়ে ভালো একটা সংবিধান করলেও তার মান্যতা নিশ্চিত করতে পারিনি।
পাবলিক ইন্টারেস্ট বা জনস্বার্থ (মামলা) বিষয়টির মাহাত্ম্য বা মর্মার্থ আমরা সাধারণত যে স্বাভাবিকতায় বিবেচনা করি, ব্যাপারটা তা নয় হয়তো সব সময়। এই বাক্য অস্বস্তি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে না; বরং জনস্বার্থ মামলা নিয়ে ধারণাগত স্বচ্ছতা যেন পাওয়া যায়, সেটাই উদ্দেশ্য।
ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস আসলে ভাষাভুক্ত প্রত্যয়ের ক্রমানুক্রমিক বিশ্লেষণের ইতিহাস। আর এখানে আইনের বিবর্তনের সঙ্গে ভাষার বিবর্তনের ইতিহাসের দারুণ এক সাযুজ্য দেখা যায়। কারণ, আইনের ব্যাখ্যা আসলে এর টেক্সটের ব্যাখ্যা, যার আইনি পরিভাষা ‘ইন্টারপ্রিটেশন অব স্ট্যাটিউট’।
সমকাল তার পূর্বোক্ত সময়ে রচিত অথবা সংযোজিত নতুন অভিজ্ঞতা বা প্রত্যয়গুলো আত্মবিবর্তনের প্রয়োজনে বিশ্লেষণ করে নেয়। এ বিশ্লেষণের ধারাবাহিকতায় সেই সমকাল সচেতনভাবে কিংবা অবচেতনের কবলে পড়ে আরও নতুন কিছু প্রত্যয় ও অভিজ্ঞতা সংযোজিত করে। আর এভাবেই সমৃদ্ধ হয় ভাষা ও আইন।
অনাচারক্লিষ্ট ও বৈষম্যপূর্ণ আর্থসামাজিক ব্যবস্থা জনস্বার্থ লঙ্ঘনের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মনে রাখতে হবে, নীতিহীনতার বিরুদ্ধে পরিশোধন এবং ন্যায়সাধন কেবল আইনি পথে মোকাবিলা করে অর্জন করা সম্ভব নয়, এর জন্য চাই মানুষের আন্তরিক সচেতনতা, রাজনীতিকদের রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা ও আইনজীবীদের সাংবিধানিক প্রজ্ঞা।‘অর্থ বিবেচনায় জনস্বার্থের ধারণাটি অস্পষ্ট ও অপ্রকট, তবে এটা সার্বিক বিবেচনার বিষয়। সাধারণত জনস্বার্থ বলিতে জনসাধারণের জন্য কল্যাণকর কিছু বুঝায়। জনস্বার্থে কোন কিছু করা অর্থ জনসাধারণের জন্য তাহাদের স্বার্থের অনুকূল কিছু করা। জনস্বার্থ সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তনশীল। আজ যাহা জনস্বার্থের বিষয় বলিয়া গণ্য হইতেছে, দশ বৎসর পর তাহা অনুরূপ বলিয়া বিবেচিত নাও হইতে পারে। তবে জনস্বার্থ কথাটি শূন্যে বিবেচনা করা যায় না, ইহা প্রকৃত তথ্য ও পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিচার্য। জনসাধারণের, সাধারণ কল্যাণ, রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও রক্ষণ দাবি করে। যে বিষয়ে সাধারণ মানুষের স্বার্থ নিহিত আছে, তাহার জন্য সরকারি আইন প্রণয়ন যুক্তিযুক্ত।’ জনস্বার্থবিষয়ক এ ব্যাখ্যা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও আনিসুজ্জামান সম্পাদিত ‘আইন–শব্দকোষ’ থেকে নেওয়া।
শব্দের অর্থ আমাদের এ ধারণা দেয় যে জনস্বার্থ ধারণাটিও পরিবর্তনশীল, তাই আমাদের জানাবোঝাও এই পরিবর্তনের সঙ্গে নবায়ন করে নিতে হবে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে ‘সোশিওলজিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স’ আমাদের আইনসংক্রান্ত জ্ঞানকাণ্ডে হাজির করে ডকট্রিনাল রিসার্চের পরিবর্তে এমপিরিরিক্যাল রিসার্চ। আর এই গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনকে আইনের শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল ফারুকের ভাষায় ‘ল ইন অ্যাকশন অ্যাজ অপোজ টু ল ইন বুক’।
এই সময়ের পরার্থপরতা বোধসম্পন্ন আইনজীবীরা আইনকে বইয়ের সাদা জমিনের পাতা থেকে বাস্তবের পৃথিবীতে আনতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। বিরল বোধসম্পন্ন কিছু আইনজীবী, যাঁদের ক্যারিয়ারের বড় অংশ জনস্বার্থ মামলার ইতিহাসে পরিপূর্ণ আর নবীন আইনজীবীদের অনেকে আগামী দিনে পূর্বসূরিদের অনুসরণ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
বাংলাদেশের জন্মপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সাংবিধানিক কাঠামোর আন্তসম্পর্ক দারুণভাবে জড়িয়ে আছে। অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের উদ্দেশ্য ছিল সংবিধান প্রণয়ন। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সাংবিধানিক পথচলা শুরু। প্রণীত সংবিধানে মানুষের সাংবিধানিক অধিকার, তথা সব মৌলিক অধিকারের সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। কার্যত নিশ্চয়তাই প্রদান করা হয়নি; বরং তা নিশ্চিতকরণের জন্য যথাযথ আইনগত প্রক্রিয়ার বিধানও নিশ্চিত করা হয়, যা নিশ্চিত করা যায় সর্বোচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্টের কাছে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করার মাধ্যমে। এই অধিকারও সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। আর এই অধিকার প্রয়োগপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাস নানাভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে।
সাংবিধানিক এই অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে কিছু প্রায়োগিক জটিলতা দেখা দেয় শুরুতে, বিশেষ করে বিশেষ জনগোষ্ঠীর জনস্বার্থ–সংক্রান্ত বিষয়ে। তবে এটি স্বীকার্য যে এই প্রায়োগিক জটিলতা উন্নত সাংবিধানিক সংস্কৃতির দেশগুলোতেও প্রাথমিকভাবে ছিল। বাংলাদেশের জনস্বার্থ মামলার শুরুর ইতিহাসে ১৯৭৪ সালের বেরুবাড়ী মামলা থেকে। যদিও এ ধরনের মামলার প্রথম প্রচলন ঘটে যুক্তরাষ্ট্রে ১৮৭৬ সালে জার্মান ইমিগ্র্যান্টদের আইনি সাহায্য প্রদানের মাধ্যমে।
পরবর্তী সময়ে নানা দেশে এই পদ্ধতিতে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে সুবিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়। একই ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতা নিয়ে চলা ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও জনস্বার্থ মামলা সাংবিধানিক ইতিহাসের বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তবে উন্নত আইনি সংস্কৃতির দেশ হিসেবে ভারত এ ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রসর অবস্থানে আছে।
প্রথানুগ ও সাবেকি ভাবধারা—এমন সব বিশেষণ যুক্ত থাকে আমাদের বিচার বিভাগের বৈশিষ্ট্য চিত্রিত করতে, সেই বিবেচনায় জনস্বার্থ মামলার মতো পশ্চিমা আইনি প্রতিকারপদ্ধতির অনুসরণ করে আমাদের বিচার বিভাগ আধুনিক মনস্কতার পরিচয় দিয়েছে। আর গত তিন দশকে বিচারিক সক্রিয়তা বা জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজমের অন্যতম অনুশীলন মাধ্যম হয়ে উঠেছে জনস্বার্থ মামলা।
ইতিবাচক, না নেতিবাচক—এমন কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়েও বলা যায়, আমাদের দেশে জনস্বার্থ মামলা মানে পরিবেশসংক্রান্ত মামলা—এমন একটা সাধারণ ধারণা প্রতিষ্ঠা না পেলেও বলা চলে, প্রচার পেয়েছে। অথচ জনস্বার্থ মামলার পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। ব্যক্তিস্বাধীনতার যে অধিকার, সেটি কোনো আইনের অসাংবিধানিক প্রয়োগে যদি ব্যাহত হয়, কোনো নাগরিকের স্বাধীনতা লুট হয়, সেটি জনস্বার্থ বিঘ্নকারী বেআইনি পদক্ষেপ। আইনের অপপ্রয়োগ বা অসাংবিধানিক প্রয়োগ রোধে পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন নিয়ে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। সাম্প্রতিক মেঘনা আলমের ঘটনা এর উদাহরণ। মেঘনা আলমের ঘটনায় যদিও কোনো জনস্বার্থ মামলা হয়নি।
ব্যক্তি অধিকার আদতে মানবাধিকার। মানবাধিকার আইন প্রত্যেককে সমান হিসেবে বিবেচনা করে না; বরং তাদের এতটাই স্বতন্ত্র মনে করে যে তারা যেন প্রত্যেকে অনন্য হয়ে ওঠে এবং সে কারণে প্রত্যেকে এমন সম-আচরণ পাওয়ার অধিকারী হয়, যা প্রত্যেক অদ্বিতীয় মানুষের প্রাপ্য।
নতুন সময়ে পরিবর্তনশীল বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বৈষম্যহীনতা নীতি বা ‘প্রিন্সিপাল অব নন–ডিসক্রিমিনেশন’ মানবাধিকারের পরিপূর্ণ সারাংশকে ধারণ করতে পারছে না। এটা বলা যেতে পারে, বর্তমানে একমাত্র নীতি যা মানবাধিকারের দর্শন ও বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম, তা হলো ‘মানবিক মর্যাদা’ সংরক্ষণের ধারণা। মানবাধিকারকে বর্তমানে যথার্থই মানবিক মর্যাদায় সংরক্ষণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
ব্রিটিশ আমল পাকিস্তান আমল ও স্বাধীনতা–পরবর্তী বাংলাদেশ আমল। এই তিন আমলের আইন নিয়ে আমাদের আইন ও বিচারব্যবস্থা। সব আইনকে মোটাদাগে ‘প্রি–কনস্টিটিউশনাল ল’ বা সংবিধান–পূর্ব আইন ও ‘পোস্ট–কনস্টিটিউশনাল ল’ বা সংবিধানোত্তর আইন—এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
আইন তা সংবিধান প্রণয়নের আগে (পেনাল কোড, ফৌজদারি কার্যবিধি—এমন সাবস্ট্যানশিয়াল এবং প্রসিডিওরাল আইন ১৯৭২–এর সংবিধান প্রণয়ন–পূর্ব আইন) হোক বা পরে হোক, তা সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে তা অসাংবিধানিক বলে গণ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই আইন ব্যাখ্যায় সাংবিধানিকতার পরীক্ষা নিতে ‘ডকট্রিন অব এক্লিপস’–এর প্রয়োগ করতে হবে। এটি সাংবিধানিকতার ‘লিটমাস টেস্ট’।
আইনের অমোঘ ঐতিহাসিকতা এই যে অনুশীলনের মাধ্যমেই এর ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়। জনস্বার্থ মামলার ক্ষেত্রেও তা–ই। জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজমকে পরবর্তী পর্যায়ে নিতে জনস্বার্থ মামলা কার্যকর অবদান রেখে চলেছে।
চব্বিশের অভ্যুত্থান, পরবর্তী আইনি সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সক্রিয়তার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে বিচার বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার দ্বারপ্রান্তে। এটি স্বীকার্য যে কেবল জনস্বার্থ মামলার সাহায্য নিয়ে বিচার বিভাগীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করা সম্ভব নয়। অনাচারক্লিষ্ট ও বৈষম্যপূর্ণ আর্থসামাজিক ব্যবস্থা জনস্বার্থ লঙ্ঘনের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মনে রাখতে হবে, নীতিহীনতার বিরুদ্ধে পরিশোধন এবং ন্যায়সাধন কেবল আইনি পথে মোকাবিলা করে অর্জন করা সম্ভব নয়, এর জন্য চাই মানুষের আন্তরিক সচেতনতা, রাজনীতিকদের রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা ও আইনজীবীদের সাংবিধানিক প্রজ্ঞা।
এম এম খালেকুজ্জামান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ব ধ ন প রণয়ন ন শ চ ত কর র জন ত ক স ব ধ নত পরবর ত আইনজ ব আম দ র র জন য র আইন আইন র ও আইন ব আইন
এছাড়াও পড়ুন:
কর্মকর্তাদের দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করবে এনবিআর
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৫৫০ কোটি ডলার ঋণের পরবর্তী কিস্তি পেতে সরকার একগুচ্ছ সংস্কার বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কর প্রশাসনে দুর্নীতি নিয়ে একটি জনমত জরিপ চালানো। পাশাপাশি বিদ্যুৎ, সারে ভর্তুকি এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রণোদনা ধাপে ধাপে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা জানানো হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরিকল্পনা রয়েছে, প্রতি অর্থবছর শেষে ছয় মাসের মধ্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতিসহ অসদাচরণ ও শৃঙ্খলাভঙ্গের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থার পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হবে।
গত সোমবার দুই কিস্তির অর্থ ছাড়ের পর সংস্থাটি ‘বাংলাদেশ কান্ট্রি রিপোর্ট’ প্রকাশ করেছে। এ প্রতিবেদনে পরবর্তী কিস্তি পেতে শর্ত ও বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতির উল্লেখ রয়েছে। পরবর্তী কিস্তির জন্য আইএমএফ মোট ৩৩টি শর্ত দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো– আগামী অর্থবছরে সরকারকে অতিরিক্ত ৩০ হাজার কোটি টাকা কর রাজস্ব আহরণ করতে হবে।
এদিকে চলতি মাসের শুরুতে দুই কিস্তির অর্থ ছাড়ের অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশ আইএমএফ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার কাছে একটি চিঠি দেয়। এখানে বিনিময় হার নীতি, ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কার, রাজস্ব আহরণ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে; যা আইএমএফের প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, বৈদেশিক অর্থের ঘাটতি এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় স্বল্পমেয়াদে সংকোচনমূলক নীতি থাকবে। কাঠামোগত সংস্কার প্রচেষ্টা জোরদার করা হবে। বিশেষ করে নতুন বিনিময় হার ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ ঘাটতি দূর করার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
চিঠির সঙ্গে সংযুক্ত অর্থনৈতিক ও আর্থিক নীতির স্মারকে (এমইএফপি) সরকারের বিভিন্ন অঙ্গীকার রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কর প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও সুশাসনের জন্য কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হবে। এর মধ্যে কর প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়াতে প্রতি দুই থেকে তিন বছরে একবার জরিপ চালানো হবে। কর্মকর্তাদের নৈতিকতা প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হবে এবং তারা প্রতিবছর আনুগত্যের ঘোষণা দেবেন।
এনবিআরের পরিকল্পনা রয়েছে, প্রতি অর্থবছরের শেষে ছয় মাসের মধ্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতিসহ অসদাচরণ, শৃঙ্খলাভঙ্গের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থার পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হবে। এনবিআর আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে কর্মকর্তাদের জন্য একটি আচরণবিধি ও নৈতিকতা সনদ প্রকাশ করবে। এনবিআরকে দুই ভাগ করে রাজস্ব আহরণ ও নীতি গ্রহণে আলাদা বিভাগ করার বিষয়টি উপদেষ্টা পরিষদ অনুমোদন করেছে। শিগগির এ-সংক্রান্ত অধ্যাদেশ কার্যকর এবং একটি বিস্তারিত কর্মকৌশল প্রকাশ করা হবে।
এতে আরও বলা হয়, ইতোমধ্যে ভ্যাট ও আমদানি শুল্কে করছাড় কমিয়ে আনা শুরু হয়েছে। তাছাড়া আদর্শ ভ্যাটহার ১৫ শতাংশ বাস্তবায়নের আওতা বাড়িয়েছে। বেশ কিছু পণ্যে শুল্কায়নের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন মূল্য বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে কর আহরণ অটোমেশন এবং প্রশাসনের উন্নয়নসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে করে বাড়তি ১০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আসবে বলে সরকার মনে করছে।
ভর্তুকি কমানোর পরিকল্পনা
সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ভর্তুকি কমিয়ে অগ্রাধিকার ব্যয়ে সুরক্ষা দেবে এবং আগামী দুই বছরের মধ্যে তা টেকসই পর্যায়ে আনার জন্য একটি বহুমুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে। একটি কাঠামোগত বেঞ্চমার্ক অনুযায়ী আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে একটি তিন বছরের রোডম্যাপ গৃহীত হবে, যার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রয় মূল্যের ব্যবধান ধাপে ধাপে কমানো হবে।
রপ্তানি ভর্তুকির ক্ষেত্রে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে তৈরি পোশাক, চামড়া ও পাট খাতে প্রণোদনা কমানো হয়েছে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের মধ্যে তা পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হবে। একই সঙ্গে ২০২৭ সালের জানুয়ারির মধ্যে রেমিট্যান্স প্রণোদনা প্রত্যাহার করা হবে।