কলোনিয়াল হ্যাংওভার শব্দটির দারুণ ট্রান্সলেশন (অনুবাদ) করেছিলেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। ট্রান্সলেশন না বলে বরং বলা যায় ‘ট্রান্সক্রিয়েশন’; অনুবাদের চমৎকারিত্ব আর অভিনবত্বের কারণে এমনটা বলা। তিনি শব্দটির অনুবাদ করেছিলেন ‘ঔপনিবেশিক ঝুলনমায়া’।

ঔপনিবেশিক শাসকেরা চলে গেছে বহু বছর আগে, কিন্তু রয়ে গেছে ‘মায়া’; রয়ে গেছে প্রশাসনিক, বিচারিক ও আইনি নানা ধরনের উপাচার। এগুলো আমাদের মায়ায় আচ্ছন্ন রেখেছে। এখনো এমন একটা ধারণা বিরাজ করে, ‘উপনিবেশ উপাসনা’ যেন মুক্তির পথ। অথচ যাদের কারণে উপনিবেশ, তাদের সব কি মানা হয়? উত্তর নিশ্চিতভাবেই নেতিবাচক।

ব্রিটিশদের সেই অর্থে মলাটবদ্ধ কোনো সুনির্দিষ্ট সংবিধান নেই, কিছু সাংবিধানিক নীতি ও কনভেনশন রয়েছে। তাদের লিখিত সংবিধান না থাকলেও কোনো ব্যত্যয় নেই, সাংবিধানিকতাই সেখানে চূড়ান্ত। আমরা অনেক দেশের অনুপ্রেরণায় অল্প সময়ে ভালো একটা সংবিধান করলেও তার মান্যতা নিশ্চিত করতে পারিনি।

পাবলিক ইন্টারেস্ট বা জনস্বার্থ (মামলা) বিষয়টির মাহাত্ম্য বা মর্মার্থ আমরা সাধারণত যে স্বাভাবিকতায় বিবেচনা করি, ব্যাপারটা তা নয় হয়তো সব সময়। এই বাক্য অস্বস্তি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে না; বরং জনস্বার্থ মামলা নিয়ে ধারণাগত স্বচ্ছতা যেন পাওয়া যায়, সেটাই উদ্দেশ্য।

ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস আসলে ভাষাভুক্ত প্রত্যয়ের ক্রমানুক্রমিক বিশ্লেষণের ইতিহাস। আর এখানে আইনের বিবর্তনের সঙ্গে ভাষার বিবর্তনের ইতিহাসের দারুণ এক সাযুজ্য দেখা যায়। কারণ, আইনের ব্যাখ্যা আসলে এর টেক্সটের ব্যাখ্যা, যার আইনি পরিভাষা ‘ইন্টারপ্রিটেশন অব স্ট্যাটিউট’।

সমকাল তার পূর্বোক্ত সময়ে রচিত অথবা সংযোজিত নতুন অভিজ্ঞতা বা প্রত্যয়গুলো আত্মবিবর্তনের প্রয়োজনে বিশ্লেষণ করে নেয়। এ বিশ্লেষণের ধারাবাহিকতায় সেই সমকাল সচেতনভাবে কিংবা অবচেতনের কবলে পড়ে আরও নতুন কিছু প্রত্যয় ও অভিজ্ঞতা সংযোজিত করে। আর এভাবেই সমৃদ্ধ হয় ভাষা ও আইন।

অনাচারক্লিষ্ট ও বৈষম্যপূর্ণ আর্থসামাজিক ব্যবস্থা জনস্বার্থ লঙ্ঘনের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মনে রাখতে হবে, নীতিহীনতার বিরুদ্ধে পরিশোধন এবং ন্যায়সাধন কেবল আইনি পথে মোকাবিলা করে অর্জন করা সম্ভব নয়, এর জন্য চাই মানুষের আন্তরিক সচেতনতা, রাজনীতিকদের রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা ও আইনজীবীদের সাংবিধানিক প্রজ্ঞা।

‘অর্থ বিবেচনায় জনস্বার্থের ধারণাটি অস্পষ্ট ও অপ্রকট, তবে এটা সার্বিক বিবেচনার বিষয়। সাধারণত জনস্বার্থ বলিতে জনসাধারণের জন্য কল্যাণকর কিছু বুঝায়। জনস্বার্থে কোন কিছু করা অর্থ জনসাধারণের জন্য তাহাদের স্বার্থের অনুকূল কিছু করা। জনস্বার্থ সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তনশীল। আজ যাহা জনস্বার্থের বিষয় বলিয়া গণ্য হইতেছে, দশ বৎসর পর তাহা অনুরূপ বলিয়া বিবেচিত নাও হইতে পারে। তবে জনস্বার্থ কথাটি শূন্যে বিবেচনা করা যায় না, ইহা প্রকৃত তথ্য ও পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিচার্য। জনসাধারণের, সাধারণ কল্যাণ, রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও রক্ষণ দাবি করে। যে বিষয়ে সাধারণ মানুষের স্বার্থ নিহিত আছে, তাহার জন্য সরকারি আইন প্রণয়ন যুক্তিযুক্ত।’ জনস্বার্থবিষয়ক এ ব্যাখ্যা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও আনিসুজ্জামান সম্পাদিত ‘আইন–শব্দকোষ’ থেকে নেওয়া।

শব্দের অর্থ আমাদের এ ধারণা দেয় যে জনস্বার্থ ধারণাটিও পরিবর্তনশীল, তাই আমাদের জানাবোঝাও এই পরিবর্তনের সঙ্গে নবায়ন করে নিতে হবে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে ‘সোশিওলজিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স’ আমাদের আইনসংক্রান্ত জ্ঞানকাণ্ডে হাজির করে ডকট্রিনাল রিসার্চের পরিবর্তে এমপিরিরিক্যাল রিসার্চ। আর এই গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনকে আইনের শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল ফারুকের ভাষায় ‘ল ইন অ্যাকশন অ্যাজ অপোজ টু ল ইন বুক’।

এই সময়ের পরার্থপরতা বোধসম্পন্ন আইনজীবীরা আইনকে বইয়ের সাদা জমিনের পাতা থেকে বাস্তবের পৃথিবীতে আনতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। বিরল বোধসম্পন্ন কিছু আইনজীবী, যাঁদের ক্যারিয়ারের বড় অংশ জনস্বার্থ মামলার ইতিহাসে পরিপূর্ণ আর নবীন আইনজীবীদের অনেকে আগামী দিনে পূর্বসূরিদের অনুসরণ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

বাংলাদেশের জন্মপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সাংবিধানিক কাঠামোর আন্তসম্পর্ক দারুণভাবে জড়িয়ে আছে। অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের উদ্দেশ্য ছিল সংবিধান প্রণয়ন। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সাংবিধানিক পথচলা শুরু। প্রণীত সংবিধানে মানুষের সাংবিধানিক অধিকার, তথা সব মৌলিক অধিকারের সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। কার্যত নিশ্চয়তাই প্রদান করা হয়নি; বরং তা নিশ্চিতকরণের জন্য যথাযথ আইনগত প্রক্রিয়ার বিধানও নিশ্চিত করা হয়, যা নিশ্চিত করা যায় সর্বোচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্টের কাছে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করার মাধ্যমে। এই অধিকারও সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। আর এই অধিকার প্রয়োগপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাস নানাভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে।

সাংবিধানিক এই অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে কিছু প্রায়োগিক জটিলতা দেখা দেয় শুরুতে, বিশেষ করে বিশেষ জনগোষ্ঠীর জনস্বার্থ–সংক্রান্ত বিষয়ে। তবে এটি স্বীকার্য যে এই প্রায়োগিক জটিলতা উন্নত সাংবিধানিক সংস্কৃতির দেশগুলোতেও প্রাথমিকভাবে ছিল। বাংলাদেশের জনস্বার্থ মামলার শুরুর ইতিহাসে ১৯৭৪ সালের বেরুবাড়ী মামলা থেকে। যদিও এ ধরনের মামলার প্রথম প্রচলন ঘটে যুক্তরাষ্ট্রে ১৮৭৬ সালে জার্মান ইমিগ্র্যান্টদের আইনি সাহায্য প্রদানের মাধ্যমে।

পরবর্তী সময়ে নানা দেশে এই পদ্ধতিতে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে সুবিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়। একই ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতা নিয়ে চলা ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও জনস্বার্থ মামলা সাংবিধানিক ইতিহাসের বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তবে উন্নত আইনি সংস্কৃতির দেশ হিসেবে ভারত এ ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রসর অবস্থানে আছে।

প্রথানুগ ও সাবেকি ভাবধারা—এমন সব বিশেষণ যুক্ত থাকে আমাদের বিচার বিভাগের বৈশিষ্ট্য চিত্রিত করতে, সেই বিবেচনায় জনস্বার্থ মামলার মতো পশ্চিমা আইনি প্রতিকারপদ্ধতির অনুসরণ করে আমাদের বিচার বিভাগ আধুনিক মনস্কতার পরিচয় দিয়েছে। আর গত তিন দশকে বিচারিক সক্রিয়তা বা জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজমের অন্যতম অনুশীলন মাধ্যম হয়ে উঠেছে জনস্বার্থ মামলা।

ইতিবাচক, না নেতিবাচক—এমন কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়েও বলা যায়, আমাদের দেশে জনস্বার্থ মামলা মানে পরিবেশসংক্রান্ত মামলা—এমন একটা সাধারণ ধারণা প্রতিষ্ঠা না পেলেও বলা চলে, প্রচার পেয়েছে। অথচ জনস্বার্থ মামলার পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। ব্যক্তিস্বাধীনতার যে অধিকার, সেটি কোনো আইনের অসাংবিধানিক প্রয়োগে যদি ব্যাহত হয়, কোনো নাগরিকের স্বাধীনতা লুট হয়, সেটি জনস্বার্থ বিঘ্নকারী বেআইনি পদক্ষেপ। আইনের অপপ্রয়োগ বা অসাংবিধানিক প্রয়োগ রোধে পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন নিয়ে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। সাম্প্রতিক মেঘনা আলমের ঘটনা এর উদাহরণ। মেঘনা আলমের ঘটনায় যদিও কোনো জনস্বার্থ মামলা হয়নি।

ব্যক্তি অধিকার আদতে মানবাধিকার। মানবাধিকার আইন প্রত্যেককে সমান হিসেবে বিবেচনা করে না; বরং তাদের এতটাই স্বতন্ত্র মনে করে যে তারা যেন প্রত্যেকে অনন্য হয়ে ওঠে এবং সে কারণে প্রত্যেকে এমন সম-আচরণ পাওয়ার অধিকারী হয়, যা প্রত্যেক অদ্বিতীয় মানুষের প্রাপ্য।

নতুন সময়ে পরিবর্তনশীল বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বৈষম্যহীনতা নীতি বা ‘প্রিন্সিপাল অব নন–ডিসক্রিমিনেশন’ মানবাধিকারের পরিপূর্ণ সারাংশকে ধারণ করতে পারছে না। এটা বলা যেতে পারে, বর্তমানে একমাত্র নীতি যা মানবাধিকারের দর্শন ও বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম, তা হলো ‘মানবিক মর্যাদা’ সংরক্ষণের ধারণা। মানবাধিকারকে বর্তমানে যথার্থই মানবিক মর্যাদায় সংরক্ষণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

ব্রিটিশ আমল পাকিস্তান আমল ও স্বাধীনতা–পরবর্তী বাংলাদেশ আমল। এই তিন আমলের আইন নিয়ে আমাদের আইন ও বিচারব্যবস্থা। সব আইনকে মোটাদাগে ‘প্রি–কনস্টিটিউশনাল ল’ বা সংবিধান–পূর্ব আইন ও ‘পোস্ট–কনস্টিটিউশনাল ল’ বা সংবিধানোত্তর আইন—এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়।

আইন তা সংবিধান প্রণয়নের আগে (পেনাল কোড, ফৌজদারি কার্যবিধি—এমন সাবস্ট্যানশিয়াল এবং প্রসিডিওরাল আইন ১৯৭২–এর সংবিধান প্রণয়ন–পূর্ব আইন) হোক বা পরে হোক, তা সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে তা অসাংবিধানিক বলে গণ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই আইন ব্যাখ্যায় সাংবিধানিকতার পরীক্ষা নিতে ‘ডকট্রিন অব এক্লিপস’–এর প্রয়োগ করতে হবে। এটি সাংবিধানিকতার ‘লিটমাস টেস্ট’।
আইনের অমোঘ ঐতিহাসিকতা এই যে অনুশীলনের মাধ্যমেই এর ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়। জনস্বার্থ মামলার ক্ষেত্রেও তা–ই। জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজমকে পরবর্তী পর্যায়ে নিতে জনস্বার্থ মামলা কার্যকর অবদান রেখে চলেছে।

চব্বিশের অভ্যুত্থান, পরবর্তী আইনি সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সক্রিয়তার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে বিচার বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার দ্বারপ্রান্তে। এটি স্বীকার্য যে কেবল জনস্বার্থ মামলার সাহায্য নিয়ে বিচার বিভাগীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করা সম্ভব নয়। অনাচারক্লিষ্ট ও বৈষম্যপূর্ণ আর্থসামাজিক ব্যবস্থা জনস্বার্থ লঙ্ঘনের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মনে রাখতে হবে, নীতিহীনতার বিরুদ্ধে পরিশোধন এবং ন্যায়সাধন কেবল আইনি পথে মোকাবিলা করে অর্জন করা সম্ভব নয়, এর জন্য চাই মানুষের আন্তরিক সচেতনতা, রাজনীতিকদের রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা ও আইনজীবীদের সাংবিধানিক প্রজ্ঞা।

এম এম খালেকুজ্জামান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ব ধ ন প রণয়ন ন শ চ ত কর র জন ত ক স ব ধ নত পরবর ত আইনজ ব আম দ র র জন য র আইন আইন র ও আইন ব আইন

এছাড়াও পড়ুন:

রোডক্র্যাশে বেশি মারা যাচ্ছে তরুণরা

১২ আগস্ট জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যুব দিবস পালিত হলো। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল “প্রযুক্তি নির্ভর যুবশক্তি বহুপাক্ষিক অংশীদারিত্বে অগ্রগতি”। এই দিবস উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে প্রতি বছর পালন করা হয় বিভিন্ন কর্মসূচি। কিন্তু রোডক্র্যাশে বেশি মারা যাচ্ছে তরুণরা, সেদিকে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। ৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ রোডক্র্যাশ। তাই দিবসটিতে রোডক্র্যাশ প্রতিরোধে তরুণদের ভূমিকা সম্পর্কে কর্মসূচি রাখা প্রয়োজন।

রোডক্র্যাশে প্রতি বছর বিশ্বে মৃত্যুর সংখ্যা ১২ লাখ ছুঁইছুঁই। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী রোডক্র্যাশে বছরে ১১ লাখ ৯০ হাজার মানুষ নিহত হয়। রোডক্র্যাশে প্রতি মিনিটে বিশ্বে ২ জন ব্যক্তি এবং দিনে মৃত্যু হয় ৩ হাজার ২০০ জনের। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী ৫ থেকে ২৯ বছর বয়সের মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণ রোডক্র্যাশ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত ‘গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি ২০২৩’ তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। 

রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী সকল বয়সের মানুষের মৃত্যুর ১২তম প্রধান কারণ রোডক্র্যাশ। একই সঙ্গে কর্মক্ষম ১৮ থেকে ৫৯ বছর বয়সের দুই তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যুর কারণও রোডক্র্যাশে। প্রতি লাখে এই মৃত্যুর হার ১৫ শতাংশ। মৃত্যুর পাশাপাশি হতাহতের সংখ্যাও অনেক। রোডক্র্যাশে দুই থেকে পাঁচ কোটি মানুষ বিভিন্ন মাত্রায় আহত হন।

আরো পড়ুন:

ঝিনাইদহের সড়কে ঝরল ২ শিক্ষার্থীর প্রাণ

অ্যাম্বুলেন্স নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ডোবায়, নারীর মৃত্যু

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাংলাদেশে রোডক্র্যাশে মৃত্যু হয়েছে, ২১ হাজার ৩১৬ জনের। একইভাবে ২০১৮ সালে ২৪ হাজার ৯৪৪ জনের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। ২০২১ সালের রিপোর্টে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে মৃত্যু হয়েছে ৩১ হাজার ৫৭৮ জনের। ২০১৬ সালে প্রতি লাখে মৃত্যুহার ছিল ১৫.৩ শতাংশ এবং ২০২১ সালে এই মৃত্যুহার ছিল প্রতি লাখে ১৯ জনের মতো।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত দুর্ঘটনা প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় ২০২৪ সালে দেশে প্রাণহানি হয়েছে ৫ হাজার ৩৮০ জনের। এর আগে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছিল ২০২১ সালে। সেবার সড়কে মৃত্যু হয়েছিল ৫ হাজার ৮৪ জনের।

বিশ্বব্যাপী প্রত্যেকদিন এক হাজারের বেশি শিশু এবং ৩০ বছরের কম বয়সী যুবক রোডক্র্যাশে মারা যায়। বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ১৪ জন রোডক্র্যাশে প্রাণ হারান। অথচ এই মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য। জাতিসংঘ নির্ধারিত নিরাপত্তা কৌশল অনুসরণ করে এই প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু কমানো সম্ভব।

ওয়ার্ল্ড হেলথ র‌্যাঙ্কিং অনুসারে, সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম। সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ও তার সঠিক প্রয়োগ ব্যতীত দেশে রোডক্র্যাশ কমানো বা রোধ করা সম্ভব নয়। সঠিক আইন ও তার প্রয়োগের ফলে সড়ক দুর্ঘটনা, যা বর্তমানে একটি বড় সমস্যা, তা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা যেতে পারে। তাই সবার জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’।

বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকার বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কার আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। আমাদের দাবি, সড়ক নিরাপত্তার সংস্কার ভাবনায় সমন্বিত সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোডক্র্যাশকে প্রতিরোধযোগ্য একটি অসংক্রামক রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সংবিধানের ১৮ (১) অনুচ্ছেদ অনুসারে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এ ছাড়াও অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৩.৬ অর্জনে ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে রোডক্র্যাশে প্রাণহানির সংখ্যা ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনার তাগিদ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বৈশ্বিক পর্যায়েও ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘভুক্ত সদস্য দেশগুলো বিশ্বব্যাপী রোডক্র্যাশে নিহত ও আহতের সংখ্যা শতকরা ৫০ ভাগ কমিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য গ্লোবাল প্ল্যান ফর সেকেন্ড ডিকেড অব অ্যাকশন ফর রোড সেফটি ২০২১-২০৩০ এর আওতায় ৫টি স্তম্ভের কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হলো- বহুমুখী যানবাহন ও ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, নিরাপদ যানবাহন, নিরাপদ সড়ক অবকাঠামো, নিরাপদ সড়ক ব্যবহার, রোডক্র্যাশ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্বারোপ। এ ছাড়াও সড়ক ব্যবহারকারীদের জন্য ৫টি আচরণগত ঝুঁকি যেমন, গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ না করা, সিট বেল্ট ব্যবহার না করা, মানসম্মত হেলমেট পরিধান না করা, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো এবং শিশুবান্ধব বিশেষায়িত আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। 

এসব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ২০১০ থেকে ২০২১ সালে বেলারুশ, ব্রুনাই দারুসসালাম, ডেনমার্ক, জাপান, লিথুয়ানিয়া, নরওয়ে, রাশিয়ান ফেডারেশন, ত্রিনিদাদ, টোবাগো, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ভেনিজুয়েলা রোডক্র্যাশে মৃত্যু হার ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।

বাংলাদেশে বিদ্যমান সড়ক পরিবহন আইন- ২০১৮ ও সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২ মূলত পরিবহন সংক্রান্ত আইন। তাই উল্লিখিত বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ে উদ্যোগসমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়নে এই আইন ও বিধিমালা যথেষ্ট নয়। এ জন্যই প্রয়োজন জাতিসংঘ প্রস্তাবিত বর্ণিত ৫টি স্তম্ভ এবং আচরণগত ঝুঁকির কারণসমূহ বিবেচনায় নিয়ে একটি নতুন সমন্বিত সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন এবং এর বাস্তবায়ন।

রোডক্র্যাশ প্রতিরোধে আমাদের আরও সোচ্চার হতে হবে। সড়কে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করতে হলে প্রথমেই সড়কে প্রাণহানির প্রকৃত সংখ্যা উদঘাটন করে এর সমাধান করা প্রয়োজন। তাই সড়ককে নিরাপদ করতে আলাদা করে সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা জরুরি। সড়ককে নিরাপদ করতে সবার একযোগে কাজ করতে হবে। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতন হতে হবে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ সংশোধন হতে পারে এক সপ্তাহের মধ্যে
  • ঢাবিতে ছাত্র রাজনীতির রূপরেখা প্রণয়নে কমিটি গঠন
  • সোনারগাঁয়ের আলোচিত চেয়ারম্যান লায়ন বাবুল গ্রেপ্তার
  • দুদক সংস্কার আইন এক-দুই মাসের মধ্যে প্রণয়ন: আসিফ নজরুল
  • রোডক্র্যাশে বেশি মারা যাচ্ছে তরুণরা
  • ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা চ্যালেঞ্জের
  • বাহাত্তরের ‘সরব কণ্ঠ’ বীর উত্তম জিয়াউদ্দিন, নীরবেই চলে গেলেন
  • দেশের ওষুধশিল্পে সংকট ও ঝুঁকি তৈরি হওয়ায় বিএনপি মহাসচিবের উদ্বেগ
  • চবিতে শিবিরকে নিয়ে ছাত্রদলের মিথ্যাচারের অভিযোগ
  • গণতন্ত্রে উত্তরণে আমরা কেন বারবার হোঁচট খাচ্ছি