মোগল রাজকন্যা গুলবদনের হজের অভিজ্ঞতা
Published: 18th, May 2025 GMT
১৫৭৬ সালের শরতের একদিনে, মোগল সাম্রাজ্যের সাহসী রাজকন্যা গুলবদন বেগম রাজপরিবারের একদল নারীকে নিয়ে মক্কা ও মদিনার উদ্দেশে এক নজিরবিহীন যাত্রা শুরু করেন। এটি ছিল মোগল সাম্রাজ্যের কোনো নারীর প্রথম হজযাত্রা। গুলবদন, সম্রাট বাবরের কন্যা এবং মোগল সাম্রাজ্যের প্রথম নারী ইতিহাসবিদ, এই যাত্রার মাধ্যমে সাহসিকতা, উদারতা এবং বিদ্রোহের এক অসাধারণ নজির স্থাপন করেন।
১৫২৩ সালে কাবুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন গুলবদন বেগম। ছিলেন সম্রাট বাবর ও তাঁর স্ত্রী দিলদার বেগমের কন্যা। তাঁর জন্মের সময় বাবর হিন্দুস্তান জয়ের পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিলেন, তাই গুলবদনের শৈশব কেটেছে বাবার সঙ্গে সীমিত সাক্ষাতের মধ্যে। ছয় বছর বয়সে, বাবরের আগ্রা জয়ের পর, গুলবদন কাবুল থেকে আগ্রায় যান, যা তাঁকে মোগল মেয়েশিশুদের মধ্যে প্রথম করে তোলে। পরবর্তী সময়ে আফগান রাজা শের শাহ সুরির হাতে মোগল পরিবার বিতাড়িত হলে, গুলবদনসহ রাজপরিবারের নারীরা কয়েক মাসের কঠিন যাত্রার মাধ্যমে কাবুলে ফিরে যান। এই যাত্রায় তাঁবুতে থাকা, পালকি ও ঘোড়ার পিঠে পাহাড়ি পথ পাড়ি দেওয়া এবং শত্রু ও চোরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে গুলবদন তাঁর সাহসিকতার পরিচয় দেন।
বাঁধাধরা জীবনযাপন গুলবদনের মনকে অস্থির করে তুলেছিল। এই অস্থিরতাই তাঁকে ৫৩ বছর বয়সে ১৫৭৬ সালের অক্টোবরে, ফতেহপুর সিক্রি থেকে ১১ জন নারীসহ হজযাত্রার জন্য প্রস্তুত করে। তিনি সম্রাট আকবরকে বলেছিলেন, এটি ছিল সৃষ্টিকর্তার প্রতি তাঁর অঙ্গীকার।
আরও পড়ুনবিরে শিফা: একটি অলৌকিক কুয়ার গল্প০৫ মে ২০২৫গুলবদনের হজযাত্রা
গুলবদন ও তাঁর সঙ্গীরা আকবরের প্রদত্ত ‘সালিমি’ ও ‘ইলাহি’ নামের দুটি জাহাজে যাত্রা শুরু করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল সোনা, রুপা, হাজার হাজার নগদ অর্থ এবং ১২ হাজার পোশাক দানখয়রাতের জন্য। তবে মক্কার নৌপথ তখন পর্তুগিজদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, যারা মুসলিম জাহাজ লুট করত বা পুড়িয়ে দিত। ফলে গুলবদন ও তাঁর দল প্রায় এক বছর সুরাট বন্দরে আটকা পড়েন। নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁরা আরব সাগর পাড়ি দিয়ে চার সপ্তাহ পর জেদ্দায় পৌঁছান। এরপর উটের পিঠে তপ্ত মরুপথ অতিক্রম করে তাঁরা মক্কায় প্রবেশ করেন।
ইতিহাসবিদদের মতে, গুলবদনের এই যাত্রার বিস্তারিত বিবরণ ঐতিহাসিক নথিতে কম পাওয়া যায়। অনেকে মনে করেন, রাজপরিবারের পুরুষ ইতিহাসবিদেরা ‘শালীনতা ও পবিত্রতা’ রক্ষার নামে নারীদের এই অসাধারণ অভিযানের তথ্য বাদ দিয়েছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ রুবি লাল তাঁর বই ভ্যাগাবন্ড প্রিন্সেস: দ্য গ্রেট অ্যাডভেঞ্চারস অব গুলবদন-এ এই যাত্রাকে সাহসিকতা, উদারতা এবং বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
মক্কায় বিদ্রোহী গুলবদন
মক্কায় পৌঁছে গুলবদন ও তাঁর সঙ্গীরা পরবর্তী চার বছর আরবে থেকে যান। তাঁরা হারেমের সীমাবদ্ধতা ছেড়ে মরুভূমিতে যাযাবরের জীবন বেছে নেন। মুদ্রা ও পোশাক বিতরণের মতো গুলবদনের দানশীলতা মক্কায় রটে যায়। এই উদারতা অটোমান সুলতান মুরাদের ক্ষোভের কারণ হয়, যিনি এটিকে সম্রাট আকবরের রাজনৈতিক প্রভাব প্রদর্শনের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেন।
সুলতান মুরাদ তিন দফায় গুলবদন ও তাঁর সঙ্গীদের আরব ত্যাগের নির্দেশ দেন, কিন্তু গুলবদন প্রতিবারই তা প্রত্যাখ্যান করেন। রুবি লালের মতে, এটি ছিল একজন মোগল নারীর নজিরবিহীন বিদ্রোহ, যা তাঁর স্বাধীনতার প্রতি গভীর আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করে। অবশেষে, সুলতান মুরাদ গুলবদনের একগুঁয়েমিতে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে অটোমান তুর্কি ভাষায় নিন্দাসূচক শব্দ ব্যবহার করেন, যা সম্রাট আকবরের অসন্তোষের কারণ হয়।
আরও পড়ুনবিরে গারস: যে কুয়ায় নবীজি (সা.) গোসল করতেন০৪ মে ২০২৫
গুলবদনের ফেরা
১৫৮০ সালে সুলতান মুরাদের আদেশের পর গুলবদন ও তাঁর সঙ্গীরা আরব ত্যাগ করেন এবং ১৫৮২ সালে ফতেহপুর সিক্রি থেকে ৬০ কিলোমিটার পশ্চিমে খানওয়াতে পৌঁছান। ফিরে এসে গুলবদনকে ‘নবাব’ হিসেবে সম্মানিত করা হয়। সম্রাট আকবর তাঁকে ‘আকবরনামা’ গ্রন্থের লেখকদের মধ্যে একমাত্র নারী হিসেবে যুক্ত করেন। তবে আকবরনামার একটি অধ্যায়ে তাঁর মক্কা ভ্রমণের কথা থাকলেও, আরবে কাটানো সময় এবং সুলতান মুরাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি।
গুলবদন শুধু একজন সাহসী রাজকন্যাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন মোগল সাম্রাজ্যের প্রথম নারী ইতিহাসবিদ। তাঁর লেখা ‘হুমায়ূননামা’ সম্রাট হুমায়ূনের জীবনীভিত্তিক গ্রন্থ, যাতে তিনি নিজের জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করলেও হজযাত্রার বিষয়টি বাদ দিয়েছেন। এই গ্রন্থ অসম্পূর্ণ এবং এর কয়েকটি পৃষ্ঠা হারিয়ে গেছে। তাঁর এই যাত্রা মোগল সাম্রাজ্যের নারীদের সীমাবদ্ধতা ভেঙে বেরিয়ে আসার এক অসাধারণ উদাহরণ। ইতিহাসের পাতায় তাঁর অবদান এবং সাহসের গল্প আজও অনুপ্রেরণা জোগায়।
আরও পড়ুনবিরে রুমা: মদিনার পানির সংকট দূর করেছে যে কুয়া০৩ মে ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এই য ত র হজয ত র পর ব র প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
পদ স্থগিত নেতার পক্ষে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির বিবৃতি, দ্রুত মুক্তি দাবি
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে সাদাপাথর লুটের মামলায় গ্রেপ্তার বিএনপি নেতা সাহাব উদ্দিনের মুক্তি দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে উপজেলা বিএনপি। গতকাল সোমবার উপজেলা বিএনপির পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানানো হয়। কেন্দ্র থেকে পদ স্থগিত হওয়া একজন নেতার পক্ষে এমন বিবৃতি দেওয়ায় দলের ভেতরে ও বাইরে সমালোচনা শুরু হয়েছে।
গত শনিবার রাতে সিলেট নগরের আম্বরখানা এলাকা থেকে সাহাব উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-৯)। তিনি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি ছিলেন। গত ১১ আগস্ট কেন্দ্রীয় বিএনপি চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ দলীয় নীতি ও আদর্শবিরোধী কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে সাহাব উদ্দিনের পদ স্থগিত করে।
গতকাল উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবদুল মন্নান ও সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, সাহাব উদ্দিন বিগত স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের অগ্রসৈনিক ও মিথ্যা মামলায় নির্যাতিত নেতা। তাঁকে সাদাপাথর লুটের মামলায় মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠানোয় উপজেলা বিএনপির পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয় এবং অবিলম্বে তাঁর মুক্তি দাবি করা হয়।
এ বিষয়ে কথা বলতে উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবদুল মন্নানের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আকবরের সঙ্গে কথা হয়। তিনি সাহাব উদ্দিনের চাচাতো ভাই। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা মাঠে আছি। আমরা তাঁকে ভালোভাবে চিনি। তিনি কোনো লুটপাটে ছিলেন না। বরং লুটপাটের বিরুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বে আমরা মিছিল, মানববন্ধন করেছি। এ তথ্য আমরা মৌখিকভাবে জেলা বিএনপিকেও জানিয়েছি।’
উপজেলা বিএনপির বিবৃতিতে সাহাব উদ্দিনের বিষয়ে ‘মিথ্যা অভিযোগে সদ্য পদ স্থগিত হয়েছে’ বলে দাবি করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক এমরান আহমদ চৌধুরীর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তাঁরা রিসিভ করেননি। তাই এ বিষয়ে জেলা বিএনপির অবস্থান ও কোনো বক্তব্য জানা যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা বিএনপির এক নেতা বলেন, বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে সাহাব উদ্দিনের পদ স্থগিত করা হয়েছে। এমন অবস্থায় উপজেলা বিএনপি কীভাবে ওই নেতার পক্ষে বিবৃতি দেয়, সেটা অবশ্যই সাংগঠনিকভাবে বিবেচনায় নেওয়া উচিত। ব্যক্তির অপকর্মের দায় কেন সংগঠন নেবে? বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত।
সাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে সরকারি প্রায় ১৫০ একর জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। গত ১৭ মার্চ প্রথম আলোয় এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে ১৮ মার্চ সরকারি জমি উদ্ধারে অভিযানে নামে স্থানীয় প্রশাসন। প্রশাসন অভিযান চালিয়ে প্রায় ৭০ একর জমি উদ্ধার করে এবং ১০০টি পাথর ভাঙার যন্ত্র উচ্ছেদের পাশাপাশি প্রায় ৫০টি টিনশেড ঘর উচ্ছেদ করা হয়।
এ ছাড়া কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জে সরকারি জমি দখলের ঘটনায় ১৯ মার্চ সাহাব উদ্দিনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় জেলা বিএনপি। পাশাপাশি অভিযোগ তদন্তে জেলা বিএনপির সহসভাপতি আশিক উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
গত ১০ এপ্রিল ভোলাগঞ্জে পাথর কোয়ারি পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদনে সাহাব উদ্দিন ও তাঁর স্বজনেরা জমি দখল ও লুটপাটে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, উপজেলা সভাপতির নেতৃত্বে এমন অপরাধ দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে।
সাহাব উদ্দিনকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তাঁকে ‘সাদাপাথর লুটপাটে অভিযুক্ত অন্যতম মূলহোতা’ হিসেবে উল্লেখ করে। সাদাপাথর লুটের ঘটনায় কোম্পানীগঞ্জ থানায় গত ১৫ আগস্ট খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর করা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই মামলায় অজ্ঞাতনামা এক হাজার থেকে দেড় হাজার জনকে আসামি করা হয়।