১৫৭৬ সালের শরতের একদিনে, মোগল সাম্রাজ্যের সাহসী রাজকন্যা গুলবদন বেগম রাজপরিবারের একদল নারীকে নিয়ে মক্কা ও মদিনার উদ্দেশে এক নজিরবিহীন যাত্রা শুরু করেন। এটি ছিল মোগল সাম্রাজ্যের কোনো নারীর প্রথম হজযাত্রা। গুলবদন, সম্রাট বাবরের কন্যা এবং মোগল সাম্রাজ্যের প্রথম নারী ইতিহাসবিদ, এই যাত্রার মাধ্যমে সাহসিকতা, উদারতা এবং বিদ্রোহের এক অসাধারণ নজির স্থাপন করেন।

১৫২৩ সালে কাবুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন গুলবদন বেগম। ছিলেন সম্রাট বাবর ও তাঁর স্ত্রী দিলদার বেগমের কন্যা। তাঁর জন্মের সময় বাবর হিন্দুস্তান জয়ের পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিলেন, তাই গুলবদনের শৈশব কেটেছে বাবার সঙ্গে সীমিত সাক্ষাতের মধ্যে। ছয় বছর বয়সে, বাবরের আগ্রা জয়ের পর, গুলবদন কাবুল থেকে আগ্রায় যান, যা তাঁকে মোগল মেয়েশিশুদের মধ্যে প্রথম করে তোলে। পরবর্তী সময়ে আফগান রাজা শের শাহ সুরির হাতে মোগল পরিবার বিতাড়িত হলে, গুলবদনসহ রাজপরিবারের নারীরা কয়েক মাসের কঠিন যাত্রার মাধ্যমে কাবুলে ফিরে যান। এই যাত্রায় তাঁবুতে থাকা, পালকি ও ঘোড়ার পিঠে পাহাড়ি পথ পাড়ি দেওয়া এবং শত্রু ও চোরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে গুলবদন তাঁর সাহসিকতার পরিচয় দেন।

বাঁধাধরা জীবনযাপন গুলবদনের মনকে অস্থির করে তুলেছিল। এই অস্থিরতাই তাঁকে ৫৩ বছর বয়সে ১৫৭৬ সালের অক্টোবরে, ফতেহপুর সিক্রি থেকে ১১ জন নারীসহ হজযাত্রার জন্য প্রস্তুত করে। তিনি সম্রাট আকবরকে বলেছিলেন, এটি ছিল সৃষ্টিকর্তার প্রতি তাঁর অঙ্গীকার।

আরও পড়ুনবিরে শিফা: একটি অলৌকিক কুয়ার গল্প০৫ মে ২০২৫

গুলবদনের হজযাত্রা

গুলবদন ও তাঁর সঙ্গীরা আকবরের প্রদত্ত ‘সালিমি’ ও ‘ইলাহি’ নামের দুটি জাহাজে যাত্রা শুরু করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল সোনা, রুপা, হাজার হাজার নগদ অর্থ এবং ১২ হাজার পোশাক দানখয়রাতের জন্য। তবে মক্কার নৌপথ তখন পর্তুগিজদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, যারা মুসলিম জাহাজ লুট করত বা পুড়িয়ে দিত। ফলে গুলবদন ও তাঁর দল প্রায় এক বছর সুরাট বন্দরে আটকা পড়েন। নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁরা আরব সাগর পাড়ি দিয়ে চার সপ্তাহ পর জেদ্দায় পৌঁছান। এরপর উটের পিঠে তপ্ত মরুপথ অতিক্রম করে তাঁরা মক্কায় প্রবেশ করেন।

ইতিহাসবিদদের মতে, গুলবদনের এই যাত্রার বিস্তারিত বিবরণ ঐতিহাসিক নথিতে কম পাওয়া যায়। অনেকে মনে করেন, রাজপরিবারের পুরুষ ইতিহাসবিদেরা ‘শালীনতা ও পবিত্রতা’ রক্ষার নামে নারীদের এই অসাধারণ অভিযানের তথ্য বাদ দিয়েছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ রুবি লাল তাঁর বই ভ্যাগাবন্ড প্রিন্সেস: দ্য গ্রেট অ্যাডভেঞ্চারস অব গুলবদন-এ এই যাত্রাকে সাহসিকতা, উদারতা এবং বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

মক্কায় বিদ্রোহী গুলবদন

মক্কায় পৌঁছে গুলবদন ও তাঁর সঙ্গীরা পরবর্তী চার বছর আরবে থেকে যান। তাঁরা হারেমের সীমাবদ্ধতা ছেড়ে মরুভূমিতে যাযাবরের জীবন বেছে নেন। মুদ্রা ও পোশাক বিতরণের মতো গুলবদনের দানশীলতা মক্কায় রটে যায়। এই উদারতা অটোমান সুলতান মুরাদের ক্ষোভের কারণ হয়, যিনি এটিকে সম্রাট আকবরের রাজনৈতিক প্রভাব প্রদর্শনের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেন।

সুলতান মুরাদ তিন দফায় গুলবদন ও তাঁর সঙ্গীদের আরব ত্যাগের নির্দেশ দেন, কিন্তু গুলবদন প্রতিবারই তা প্রত্যাখ্যান করেন। রুবি লালের মতে, এটি ছিল একজন মোগল নারীর নজিরবিহীন বিদ্রোহ, যা তাঁর স্বাধীনতার প্রতি গভীর আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করে। অবশেষে, সুলতান মুরাদ গুলবদনের একগুঁয়েমিতে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে অটোমান তুর্কি ভাষায় নিন্দাসূচক শব্দ ব্যবহার করেন, যা সম্রাট আকবরের অসন্তোষের কারণ হয়।

আরও পড়ুনবিরে গারস: যে কুয়ায় নবীজি (সা.

) গোসল করতেন০৪ মে ২০২৫

গুলবদনের ফেরা

১৫৮০ সালে সুলতান মুরাদের আদেশের পর গুলবদন ও তাঁর সঙ্গীরা আরব ত্যাগ করেন এবং ১৫৮২ সালে ফতেহপুর সিক্রি থেকে ৬০ কিলোমিটার পশ্চিমে খানওয়াতে পৌঁছান। ফিরে এসে গুলবদনকে ‘নবাব’ হিসেবে সম্মানিত করা হয়। সম্রাট আকবর তাঁকে ‘আকবরনামা’ গ্রন্থের লেখকদের মধ্যে একমাত্র নারী হিসেবে যুক্ত করেন। তবে আকবরনামার একটি অধ্যায়ে তাঁর মক্কা ভ্রমণের কথা থাকলেও, আরবে কাটানো সময় এবং সুলতান মুরাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি।

গুলবদন শুধু একজন সাহসী রাজকন্যাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন মোগল সাম্রাজ্যের প্রথম নারী ইতিহাসবিদ। তাঁর লেখা ‘হুমায়ূননামা’ সম্রাট হুমায়ূনের জীবনীভিত্তিক গ্রন্থ, যাতে তিনি নিজের জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করলেও হজযাত্রার বিষয়টি বাদ দিয়েছেন। এই গ্রন্থ অসম্পূর্ণ এবং এর কয়েকটি পৃষ্ঠা হারিয়ে গেছে। তাঁর এই যাত্রা মোগল সাম্রাজ্যের নারীদের সীমাবদ্ধতা ভেঙে বেরিয়ে আসার এক অসাধারণ উদাহরণ। ইতিহাসের পাতায় তাঁর অবদান এবং সাহসের গল্প আজও অনুপ্রেরণা জোগায়।

আরও পড়ুনবিরে রুমা: মদিনার পানির সংকট দূর করেছে যে কুয়া০৩ মে ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এই য ত র হজয ত র পর ব র প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

দ্রুত নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করুন: আকবর খান

ঢাকা-৮ আসনে দ্রুত নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য আকবর খান। তিনি বলেন, “ভোটের অধিকার জনগণের পবিত্র আমানত, এটি সচেতনভাবে প্রয়োগ করতে হবে।”

বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) রাজধানীর মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা জননেতা সাইফুল হক-এর ঢাকা-৮ আসনে নির্বাচনী গণসংযোগ ও প্রচারপত্র বিতরণ কর্মসূচিতে তিনি একথা বলেন।

গণসংযোগের শুরুতে ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি মীর মোফাজ্জল হোসেন মোশতাকের সভাপতিত্বে এক সংক্ষিপ্ত পথসভা হয়। 

সেখানে আকবর খান বলেন, “নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে অবিলম্বে ভোটের গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরিতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে—২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে—ঢাকা-৮ আসনের বহু নাগরিক ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যে তরুণের এখন বয়স ২৫ বা ২৬, তারা কখনো ভোট দিতে পারেনি, ভোট কী তা জানে না- এটি গণতন্ত্রের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়।”

তিনি আরো বলেন, “গত ১৬-১৭ বছর ধরে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এবং আমাদের নেতা সাইফুল হক জনগণের ভোটাধিকারের আন্দোলনে রাজপথে সংগ্রাম করে আসছেন। এর জন্য জেল-জুলুম, নির্যাতন সহ্য করেও তিনি থেমে থাকেননি। ভোটাধিকার গণমানুষের দীর্ঘ লড়াই ও ত্যাগের ফসল। এই অধিকার ভুল ব্যক্তিকে নির্বাচিত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।”

আকবর খান বলেন, “জননেতা সাইফুল হক গণমানুষের পরীক্ষিত নেতা। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের জনগণ যেন তাকে ভোট দিয়ে নিজেদের সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার কথা ও দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস সংসদে তুলে ধরার সুযোগ করে দেন- এটাই আমাদের আহ্বান।”

গণসংযোগ ও প্রচারপত্র বিতরণ কর্মসূচি বাংলাদেশ ব্যাংক এলাকা থেকে শুরু হয়ে মতিঝিল, কমলাপুর, ফকিরাপুল, কালভার্ট রোড হয়ে বিজয়নগরে এসে শেষ হয়। এতে শতাধিক নেতাকর্মী অংশ নেন।

কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা সিকদার হারুন মাহমুদ, মীর রেজাউল আলম, কবি জামাল সিকদার, ফাইজুর রহমান মুনির, বাবর চৌধুরী, মহানগর নেতা যুবরান আলী জুয়েল, সালাউদ্দিন, রিয়েল মাতবর, আরিফুল ইসলাম, মুজিবুল হক চুন্নু, গোলাম রাজিব, মাহমুদুল হাসান খান, ফয়েজ ইবনে জাফর, নান্টু দাস, শিবু মহন্ত ও হুমায়ুন কবির প্রমুখ।

ঢাকা/এএএম/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • খুলনায় ২২ বোতল মাদকসহ যুবক আটক
  • সিদ্ধিরগঞ্জে বিজয় দিবস-৩৬ নাইট ক্রিকেট টূর্নামেন্টের উদ্বোধন
  • দ্রুত নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করুন: আকবর খান