ভারত যুদ্ধ লাগিয়ে যেভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি বাড়িয়ে দিল
Published: 20th, May 2025 GMT
২০২৩ সালের ৯ মে পাকিস্তানের বড় বড় শহরে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। তাঁরা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা পর্যন্ত করেছিলেন।
লক্ষ্যগুলোর মধ্যে ছিল রাওয়ালপিন্ডিতে সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর, লাহোরে একজন শীর্ষ সামরিক কমান্ডারের বাসভবন (যেটি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়) এবং আরও কিছু স্থাপনা ও স্মৃতিস্তম্ভ।
ওই বিক্ষোভকারীরা মূলত পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) সমর্থক ছিলেন। তাঁরা তাঁদের নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিলেন। ইমরান খানকে ইসলামাবাদ হাইকোর্টে দুর্নীতির অভিযোগে আটক করা হয়েছিল।
ইমরান খানকে ৪৮ ঘণ্টারও কম সময়ে মুক্তি দেওয়া হলেও ওই বিক্ষোভগুলোকে সেনাবাহিনীর আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হয়। পাকিস্তানে সেনাবাহিনীকে দীর্ঘদিন ধরে সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যারা প্রায় সব ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব বজায় রেখে আসছে।
এর ঠিক দুই বছর পর, ২০২৫ সালের ১১ মে, হাজার হাজার মানুষ আবার রাস্তায় নামেন। কিন্তু এবার তাঁরা মাঠে নামেন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নয়, বরং তাদের প্রশংসা করতে ও তাদের সমর্থন জানাতে।
গত সপ্তাহে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র সামরিক সংঘর্ষ হয়। উভয় পক্ষই একে অপরের স্থাপনাগুলোয় আক্রমণ চালায়। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর দুই দেশের মধ্যে এত বড় সংঘাত আর দেখা যায়নি।
প্রায় যুদ্ধের পর্যায়ে পড়া এই সংঘাতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ প্রভাব স্পষ্ট। সেটি হলো সেনাবাহিনীর প্রতি জনসমর্থন তীব্রভাবে বেড়েছে। সেনাবাহিনীকে ভারতীয় আগ্রাসন থেকে দেশকে রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
গ্যালাপ পাকিস্তানের একটি জরিপে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের ১১ থেকে ১৫ মে পর্যন্ত ৫০০ জনের বেশি উত্তরদাতার মধ্যে ৯৬ শতাংশ মনে করেন, পাকিস্তান এই সংঘর্ষে জয়ী হয়েছে।
আল–জাজিরাকে দেওয়া প্রাথমিক তথ্য ও জরিপের প্রবণতা অনুযায়ী, ৮২ শতাংশ মানুষ সেনাবাহিনীর কার্যক্রমকে ‘অত্যন্ত ভালো’ বলে মূল্যায়ন করেছেন। আর মাত্র ১ শতাংশের কম মানুষ অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ৯২ শতাংশ মানুষ বলেছেন, এই সংঘর্ষের কারণে তাঁদের সেনাবাহিনীর প্রতি ধারণা আরও ইতিবাচক হয়েছে।
‘কালো দিবস’ থেকে ‘ন্যায্য যুদ্ধের দিন’-এ রূপান্তরমার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরের দিন, ১১ মে পাকিস্তানের শহরগুলোয় মানুষ গাড়ি ও মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। তাঁরা জাতীয় পতাকা ওড়ান এবং সেনাবাহিনী, বিশেষ করে সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনিরের প্রশংসা করে পোস্টার বহন করেন। বাতাসে ছিল উল্লাস আর স্বস্তির আবেশ।
এর আগের চার দিন ধরে পাকিস্তান তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সঙ্গে এক উত্তেজনাপূর্ণ সামরিক সংঘর্ষে জড়িয়ে ছিল।
৭ মে ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সশস্ত্র হামলাকারীদের হাতে ২৬ বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার দুই সপ্তাহ পর ভারত এই হামলার জন্য ইসলামাবাদকে দায়ী করে পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এতে কমপক্ষে ৫১ জন নিহত হন, যাঁদের মধ্যে ১১ জন সেনাসদস্য ও বেশ কয়েকটি শিশু ছিল।
পরের তিন দিন ধরে এই দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ একে অপরের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও আর্টিলারি নিক্ষেপ করে। এটি উপমহাদেশের ১৬০ কোটি মানুষকে সর্বাত্মক যুদ্ধের কিনারায় নিয়ে যায়।
যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর পাকিস্তান সরকার ১০ মে তারিখটিকে ‘ন্যায্য যুদ্ধের দিন’ হিসেবে ঘোষণা করে। এটি ২০২৩ সালের ৯ মের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। ওই দিনকে সরকার ‘কালো দিবস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। কারণ, সেদিন ইমরান খানের সমর্থকেরা সরকারি ও বেসরকারি অবকাঠামোর বিরুদ্ধে সহিংসতা চালিয়েছিল।
যুদ্ধবিরতির ছয় দিন পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে ‘সামরিক ইতিহাসের স্বর্ণালি অধ্যায়’ বলে অভিহিত করেন।
প্রধানমন্ত্রী শরিফ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এটি পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর বিজয়, সেই সঙ্গে স্বনির্ভর, গর্বিত ও মর্যাদাশীল পাকিস্তানি জাতির বিজয়। সমগ্র জাতি সিসার প্রাচীরের মতো সশস্ত্র বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়েছে।’
তিনি এখানে ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের নাম ‘বুনইয়ান মারসুস’-এর উল্লেখ করেন, যা একটি আরবি বাক্যাংশ [‘বুনইয়ান মারসুস’ নামটি মূলত পবিত্র কোরআনের সূরা আস্-সাফ (৬১: ৪)-এর একটি আয়াত থেকে নেওয়া হয়েছে], যার অর্থ ‘সুদৃঢ়ভাবে গাঁথা সিসার প্রাচীর’ বা ‘অটলভাবে দাঁড়ানো সিসার প্রাচীর’।
২০২৩ সালের আগস্ট থেকে কারাগারে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তাঁর আইনজীবীদের মাধ্যমে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলে, সেনাবাহিনীর এখন আগের চেয়ে বেশি জনসমর্থন প্রয়োজন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তাঁর অ্যাকাউন্টে প্রকাশ করা এক বার্তায় ইমরান খান বলেন, ‘জাতির মনোবলই সশস্ত্র বাহিনীর শক্তি। এ জন্যই আমি সব সময় জোর দিয়ে বলেছি, আমাদের জনগণকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না এবং আমাদের বিচারব্যবস্থায় নতুন প্রাণ ফিরিয়ে আনতে হবে।’
২০২৩ সালের মে মাসে গ্রেপ্তারের পর দ্রুত মুক্তি পেলেও একই বছরের আগস্ট মাসে ইমরানকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি এখনো তাঁর স্ত্রী বুশরাসহ কারাগারে।
শ্রদ্ধা থেকে ভয়১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই দেশটির সেনাবাহিনী সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে রয়ে গেছে।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের (এসওএএস) রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক মারিয়া রশিদ বলেন, সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে ‘পাকিস্তানের ভৌগোলিক সীমানা এবং আদর্শিক সীমানার রক্ষক’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
এই আধিপত্য চারটি সামরিক অভ্যুত্থান এবং দশকজুড়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শাসনের মাধ্যমে সুদৃঢ় হয়েছে। ২০২২ সালে ছয় বছরের দায়িত্ব শেষে অবসর নেওয়ার আগে পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া তাঁর বিদায়ী ভাষণে স্বীকার করেছিলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী কয়েক দশক ধরে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে। তিনি ভবিষ্যতে সেনাবাহিনী পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করবে না বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
গত কয়েক বছরে জনসাধারণের সমর্থনে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব পরীক্ষার মুখে পড়েছে। ২০১৮ সালে ইমরান খান প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় বলেছিলেন, তাঁর সরকার এবং সেনাবাহিনী ‘একই লাইনে’ আছে। কিন্তু ইমরানের পূর্বসূরিদের মতোই সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে।
২০২২ সালের এপ্রিলে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে খানকে পদচ্যুত করা হয়। তবে আগের নেতাদের থেকে ভিন্নভাবে ইমরান খান প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেন এবং তাঁর অপসারণে সরাসরি সেনাবাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার অভিযোগ তোলেন। সেনাবাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্র বারবার জোরালোভাবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে।
২০২২ সালের নভেম্বরে জেনারেল আসিম মুনির সেনাপ্রধান হওয়ার পর এই দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়। খান ও তাঁর দল পিটিআই প্রতিবাদ শুরু করে। এর ফলে তাঁর ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহসহ কয়েক ডজন ফৌজদারি মামলা করা হয়।
২০২৩ সালের ৯ মে দাঙ্গার পর পিটিআইয়ের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন-পীড়ন শুরু হয়। পুলিশ পিটিআইয়ের হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের মধ্যে ১০০ জনের বেশি ব্যক্তিকে সামরিক আদালতে বিচার করা হয় এবং অনেককে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
যদিও এর আগেও সেনাবাহিনী অভ্যন্তরীণ দমন-পীড়নের অভিযোগের মুখে পড়েছে; তবে মারিয়া রশিদ বলেছেন, ইমরান খানের অপসারণের পর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছে, তা অভূতপূর্ব ছিল। তিনি বলেন, ‘এটি সেনাবাহিনীর মর্যাদাহানিকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে দিয়েছিল। এটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উত্থানের সময় ঘটে, যার ফলে সেনাবাহিনীর জন্য ন্যারেটিভ বা ভাষ্য নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল।’ তিনি যোগ করেন, ‘যদি আগে সেনাবাহিনীর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা থেকেও থাকে, ওই সময় তা কেবল ভয়ে পরিণত হয়েছিল।’
‘অপরিহার্য সামরিক বাহিনী’পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কেন্দ্রীয় ভূমিকা গড়ে উঠেছে ভারতের সঙ্গে বারবার যুদ্ধের মধ্য দিয়ে (১৯৪৮, ১৯৬৫, ১৯৭১ ও ১৯৯৯ সালে) যার মূল ইস্যু ছিল কাশ্মীর। উভয় দেশই সম্পূর্ণ কাশ্মীর দাবি করে। বাস্তবে কাশ্মীরের একটি অংশ পাকিস্তান এবং অপর অংশ ভারত নিয়ন্ত্রণ করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুহাম্মদ বদর আলমের মতে, ভারত থেকে আসা নিরন্তর হুমকির অনুভূতি সেই ‘মৌলিক কারণগুলোর’ একটি, যা সামরিক বাহিনীকে সমাজ, রাজনীতি ও শাসনে প্রাধান্য দিয়েছে।
১৯৯৯ সালে শেষ প্রচলিত যুদ্ধের পর থেকে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও ‘সন্ত্রাসবাদ’ ছড়ানোর অভিযোগ করেছে। বিশেষ করে ভারত অভিযোগ করে আসছে, পাকিস্তান ভারত-শাসিত কাশ্মীরে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিয়ে আসছে।
পাকিস্তান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে এবং বলে আসছে, তারা কাশ্মীরিদের শুধু নৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দেয়।
গত ২৫ বছরে ভারতে বহু হামলা হয়েছে। ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলায় ১৬০ জনের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিলেন। ভারত বলেছে, পাকিস্তানের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো এই হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেছিল।
ইসলামাবাদ স্বীকার করেছিল, হামলাকারীরা পাকিস্তানি হতে পারে, কিন্তু পাকিস্তান সরকার বা সামরিক বাহিনীর মদতেই মুম্বাই হামলা হয়েছিল—ভারতের এই অভিযোগ পাকিস্তান বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে এসেছে।
২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে আরও অবনতি হয়।
এর পর থেকে ভারত নিজ ভূখণ্ডে সশস্ত্র হামলার জবাবে ২০১৬, ২০১৯ এবং এখন (২০২৫ সালে) পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের ভেতরে হামলা চালিয়েছে।
লাহোরভিত্তিক বিশ্লেষক বদর আলম আল–জাজিরাকে বলেছেন, মোদির কঠোর অবস্থান পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে তাদের ক্ষমতার ন্যায্যতা প্রমাণ করতে সাহায্য করেছে। তিনি বলেন, ‘যত দিন পূর্ব দিক থেকে হুমকি থাকবে, তত দিন সামরিক বাহিনী অপরিহার্য থাকবে।’
বিবেকের যুদ্ধ?উভয় পক্ষই সাম্প্রতিক চার দিনের সংঘর্ষ সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী দাবি করেছে। পাকিস্তান পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করেছে এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধবিরতির গুরুত্ব তুলে ধরেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প কাশ্মীর ইস্যুর সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন, যা ভারতের মতে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই শুধু ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা যেতে পারে।
ভারত দাবি করেছে, তারা পাকিস্তানি ভূখণ্ডে গভীর আঘাত হেনেছে এবং এসব আঘাত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর আস্তানা ও সামরিক স্থাপনাগুলোকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
ইসলামাবাদভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক আরিফা নূর বলেছেন, ‘প্রতিবেশী দেশের’ সঙ্গে সংঘর্ষ নাগরিকদের রাষ্ট্র ও তার সশস্ত্র বাহিনীর পাশে দাঁড় করায়। এটি পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও যেমন সত্য, তেমনি অন্য যেকোনো দেশের জন্য সত্য।
পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বর্তমানে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রচুর সমর্থন পাচ্ছে সত্যি, কিন্তু এই জনসমর্থন দেশের ভেতরের রাজনীতিতে ঠিক কতটা প্রভাব ফেলবে, তা এখনই সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘সীমান্তে অবস্থিত পাঞ্জাবে সবচেয়ে বেশি সমর্থন দেখা গেছে। কিন্তু খাইবার পাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তানের মতো প্রদেশগুলো ভিন্নভাবে দেখতে পারে।’
খাইবার পাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তান উভয়ই দীর্ঘস্থায়ী সহিংসতা দেখেছে। সেখানকার সমালোচকেরা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ করেছেন, যা কিনা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী অস্বীকার করে আসছে।
আরিফা নূরের মতামতের প্রতিধ্বনি করে বদর আলম বলেছেন, জনসমর্থন প্রধানত পাঞ্জাব ও দেশের অন্যান্য শহুরে এলাকায় দৃশ্যমান ছিল।
আলম আরও বলেছেন, ইমরান খান এখনো জেলে থাকায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মূল সমর্থকদের চোখে সামরিক বাহিনীর ইমেজ কতটা পরিবর্তিত হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়।
জনপ্রিয়তা কি স্থায়ী হবে
বিশ্লেষকেরা সতর্ক করেছেন, আন্তর্জাতিক উত্তেজনার সময় ‘পতাকার চারপাশে একত্র হওয়ার’ প্রভাব স্পষ্ট হলেও নেতা ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনসমর্থন সাধারণত স্বল্পস্থায়ী হয়।
নিউইয়র্কের আলবানি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক নিলুফার সিদ্দিকি আল–জাজিরাকে বলেন, বর্তমান সংকট থেকে সামরিক বাহিনী কত দিন জনগণের সমর্থন উপভোগ করবে, তা স্পষ্ট নয়।
তিনি আরও বলেন, এটি অনেকটাই নির্ভর করছে ভারতের বক্তব্যের ওপর এবং তা উত্তেজনাপূর্ণ থাকবে কি না, তার ওপর।
সিদ্দিকি আরও যোগ করেছেন, পিটিআই আগে খুব কঠোর ভাষায় সেনাবাহিনীর সমালোচনা করত। এখন প্রশ্ন হলো, সেনাবাহিনীর এই জনপ্রিয়তা বাড়ার পর ভবিষ্যতে পিটিআই তাদের বক্তব্য কীভাবে সাজাবে?
যদি পিটিআই সেনাবাহিনীর সমালোচনা কমিয়ে দেয়, তাহলে সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের সমর্থন বজায় থাকতে পারে। কিন্তু যদি তারা আগের মতোই কঠোর সমালোচনা চালিয়ে যায়, তাহলে বর্তমান জনসমর্থন কমে যেতে পারে।
লন্ডনভিত্তিক লেখক রশিদ বলছেন, পাকিস্তানিদের জন্য আগামী দিনে বড় প্রশ্ন হবে, তারা সীমান্তে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের সম্পৃক্ততার মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে কি না। তিনি বলেন, ‘আমাদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রাজনীতিতে জড়িত থাকাকে সমালোচনা করতে হবে, কিন্তু একই সঙ্গে স্বীকার করতে হবে, সীমান্তে তাদের কর্মক্ষমতা এই মুহূর্তে প্রশংসনীয়।’
বদর আলম বলেন, ভারতের সঙ্গে এই সংকট থেকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকেও শিক্ষা নিতে হবে। তিনি বলেন, ‘সামরিক বাহিনীকে বুঝতে হবে, সাফল্যের জন্য জনসমর্থন প্রয়োজন। আমরা ভারতের সঙ্গে চিরস্থায়ী যুদ্ধে থাকতে পারি না। আমাদের অর্থনীতি ঠিক করতে হবে, না হলে এটি পাকিস্তানের অস্তিত্বের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে।
আবিদ হুসেইন আল–জাজিরা ইংলিশের ডিজিটাল সংবাদদাতা হিসেবে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে কর্মরত
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সশস ত র ব হ ন র ২০২৩ স ল র স ব ক র কর ইসল ম ব দ ইমর ন খ ন বদর আলম আল জ জ র র জন ত ত কর ছ ন য গ কর প রক শ বল ছ ন প ট আই স ঘর ষ কর ছ ল র জন য আম দ র সবচ য় হওয় র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ভারত যুদ্ধ লাগিয়ে যেভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি বাড়িয়ে দিল
২০২৩ সালের ৯ মে পাকিস্তানের বড় বড় শহরে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। তাঁরা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা পর্যন্ত করেছিলেন।
লক্ষ্যগুলোর মধ্যে ছিল রাওয়ালপিন্ডিতে সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর, লাহোরে একজন শীর্ষ সামরিক কমান্ডারের বাসভবন (যেটি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়) এবং আরও কিছু স্থাপনা ও স্মৃতিস্তম্ভ।
ওই বিক্ষোভকারীরা মূলত পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) সমর্থক ছিলেন। তাঁরা তাঁদের নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিলেন। ইমরান খানকে ইসলামাবাদ হাইকোর্টে দুর্নীতির অভিযোগে আটক করা হয়েছিল।
ইমরান খানকে ৪৮ ঘণ্টারও কম সময়ে মুক্তি দেওয়া হলেও ওই বিক্ষোভগুলোকে সেনাবাহিনীর আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হয়। পাকিস্তানে সেনাবাহিনীকে দীর্ঘদিন ধরে সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যারা প্রায় সব ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব বজায় রেখে আসছে।
এর ঠিক দুই বছর পর, ২০২৫ সালের ১১ মে, হাজার হাজার মানুষ আবার রাস্তায় নামেন। কিন্তু এবার তাঁরা মাঠে নামেন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নয়, বরং তাদের প্রশংসা করতে ও তাদের সমর্থন জানাতে।
গত সপ্তাহে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র সামরিক সংঘর্ষ হয়। উভয় পক্ষই একে অপরের স্থাপনাগুলোয় আক্রমণ চালায়। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর দুই দেশের মধ্যে এত বড় সংঘাত আর দেখা যায়নি।
প্রায় যুদ্ধের পর্যায়ে পড়া এই সংঘাতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ প্রভাব স্পষ্ট। সেটি হলো সেনাবাহিনীর প্রতি জনসমর্থন তীব্রভাবে বেড়েছে। সেনাবাহিনীকে ভারতীয় আগ্রাসন থেকে দেশকে রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
গ্যালাপ পাকিস্তানের একটি জরিপে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের ১১ থেকে ১৫ মে পর্যন্ত ৫০০ জনের বেশি উত্তরদাতার মধ্যে ৯৬ শতাংশ মনে করেন, পাকিস্তান এই সংঘর্ষে জয়ী হয়েছে।
আল–জাজিরাকে দেওয়া প্রাথমিক তথ্য ও জরিপের প্রবণতা অনুযায়ী, ৮২ শতাংশ মানুষ সেনাবাহিনীর কার্যক্রমকে ‘অত্যন্ত ভালো’ বলে মূল্যায়ন করেছেন। আর মাত্র ১ শতাংশের কম মানুষ অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ৯২ শতাংশ মানুষ বলেছেন, এই সংঘর্ষের কারণে তাঁদের সেনাবাহিনীর প্রতি ধারণা আরও ইতিবাচক হয়েছে।
‘কালো দিবস’ থেকে ‘ন্যায্য যুদ্ধের দিন’-এ রূপান্তরমার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরের দিন, ১১ মে পাকিস্তানের শহরগুলোয় মানুষ গাড়ি ও মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। তাঁরা জাতীয় পতাকা ওড়ান এবং সেনাবাহিনী, বিশেষ করে সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনিরের প্রশংসা করে পোস্টার বহন করেন। বাতাসে ছিল উল্লাস আর স্বস্তির আবেশ।
এর আগের চার দিন ধরে পাকিস্তান তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সঙ্গে এক উত্তেজনাপূর্ণ সামরিক সংঘর্ষে জড়িয়ে ছিল।
৭ মে ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সশস্ত্র হামলাকারীদের হাতে ২৬ বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার দুই সপ্তাহ পর ভারত এই হামলার জন্য ইসলামাবাদকে দায়ী করে পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এতে কমপক্ষে ৫১ জন নিহত হন, যাঁদের মধ্যে ১১ জন সেনাসদস্য ও বেশ কয়েকটি শিশু ছিল।
পরের তিন দিন ধরে এই দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ একে অপরের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও আর্টিলারি নিক্ষেপ করে। এটি উপমহাদেশের ১৬০ কোটি মানুষকে সর্বাত্মক যুদ্ধের কিনারায় নিয়ে যায়।
যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর পাকিস্তান সরকার ১০ মে তারিখটিকে ‘ন্যায্য যুদ্ধের দিন’ হিসেবে ঘোষণা করে। এটি ২০২৩ সালের ৯ মের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। ওই দিনকে সরকার ‘কালো দিবস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। কারণ, সেদিন ইমরান খানের সমর্থকেরা সরকারি ও বেসরকারি অবকাঠামোর বিরুদ্ধে সহিংসতা চালিয়েছিল।
যুদ্ধবিরতির ছয় দিন পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে ‘সামরিক ইতিহাসের স্বর্ণালি অধ্যায়’ বলে অভিহিত করেন।
প্রধানমন্ত্রী শরিফ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এটি পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর বিজয়, সেই সঙ্গে স্বনির্ভর, গর্বিত ও মর্যাদাশীল পাকিস্তানি জাতির বিজয়। সমগ্র জাতি সিসার প্রাচীরের মতো সশস্ত্র বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়েছে।’
তিনি এখানে ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের নাম ‘বুনইয়ান মারসুস’-এর উল্লেখ করেন, যা একটি আরবি বাক্যাংশ [‘বুনইয়ান মারসুস’ নামটি মূলত পবিত্র কোরআনের সূরা আস্-সাফ (৬১: ৪)-এর একটি আয়াত থেকে নেওয়া হয়েছে], যার অর্থ ‘সুদৃঢ়ভাবে গাঁথা সিসার প্রাচীর’ বা ‘অটলভাবে দাঁড়ানো সিসার প্রাচীর’।
২০২৩ সালের আগস্ট থেকে কারাগারে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তাঁর আইনজীবীদের মাধ্যমে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলে, সেনাবাহিনীর এখন আগের চেয়ে বেশি জনসমর্থন প্রয়োজন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তাঁর অ্যাকাউন্টে প্রকাশ করা এক বার্তায় ইমরান খান বলেন, ‘জাতির মনোবলই সশস্ত্র বাহিনীর শক্তি। এ জন্যই আমি সব সময় জোর দিয়ে বলেছি, আমাদের জনগণকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না এবং আমাদের বিচারব্যবস্থায় নতুন প্রাণ ফিরিয়ে আনতে হবে।’
২০২৩ সালের মে মাসে গ্রেপ্তারের পর দ্রুত মুক্তি পেলেও একই বছরের আগস্ট মাসে ইমরানকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি এখনো তাঁর স্ত্রী বুশরাসহ কারাগারে।
শ্রদ্ধা থেকে ভয়১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই দেশটির সেনাবাহিনী সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে রয়ে গেছে।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের (এসওএএস) রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক মারিয়া রশিদ বলেন, সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে ‘পাকিস্তানের ভৌগোলিক সীমানা এবং আদর্শিক সীমানার রক্ষক’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
এই আধিপত্য চারটি সামরিক অভ্যুত্থান এবং দশকজুড়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শাসনের মাধ্যমে সুদৃঢ় হয়েছে। ২০২২ সালে ছয় বছরের দায়িত্ব শেষে অবসর নেওয়ার আগে পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া তাঁর বিদায়ী ভাষণে স্বীকার করেছিলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী কয়েক দশক ধরে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে। তিনি ভবিষ্যতে সেনাবাহিনী পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করবে না বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
গত কয়েক বছরে জনসাধারণের সমর্থনে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব পরীক্ষার মুখে পড়েছে। ২০১৮ সালে ইমরান খান প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় বলেছিলেন, তাঁর সরকার এবং সেনাবাহিনী ‘একই লাইনে’ আছে। কিন্তু ইমরানের পূর্বসূরিদের মতোই সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে।
২০২২ সালের এপ্রিলে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে খানকে পদচ্যুত করা হয়। তবে আগের নেতাদের থেকে ভিন্নভাবে ইমরান খান প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেন এবং তাঁর অপসারণে সরাসরি সেনাবাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার অভিযোগ তোলেন। সেনাবাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্র বারবার জোরালোভাবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে।
২০২২ সালের নভেম্বরে জেনারেল আসিম মুনির সেনাপ্রধান হওয়ার পর এই দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়। খান ও তাঁর দল পিটিআই প্রতিবাদ শুরু করে। এর ফলে তাঁর ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহসহ কয়েক ডজন ফৌজদারি মামলা করা হয়।
২০২৩ সালের ৯ মে দাঙ্গার পর পিটিআইয়ের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন-পীড়ন শুরু হয়। পুলিশ পিটিআইয়ের হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের মধ্যে ১০০ জনের বেশি ব্যক্তিকে সামরিক আদালতে বিচার করা হয় এবং অনেককে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
যদিও এর আগেও সেনাবাহিনী অভ্যন্তরীণ দমন-পীড়নের অভিযোগের মুখে পড়েছে; তবে মারিয়া রশিদ বলেছেন, ইমরান খানের অপসারণের পর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছে, তা অভূতপূর্ব ছিল। তিনি বলেন, ‘এটি সেনাবাহিনীর মর্যাদাহানিকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে দিয়েছিল। এটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উত্থানের সময় ঘটে, যার ফলে সেনাবাহিনীর জন্য ন্যারেটিভ বা ভাষ্য নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল।’ তিনি যোগ করেন, ‘যদি আগে সেনাবাহিনীর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা থেকেও থাকে, ওই সময় তা কেবল ভয়ে পরিণত হয়েছিল।’
‘অপরিহার্য সামরিক বাহিনী’পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কেন্দ্রীয় ভূমিকা গড়ে উঠেছে ভারতের সঙ্গে বারবার যুদ্ধের মধ্য দিয়ে (১৯৪৮, ১৯৬৫, ১৯৭১ ও ১৯৯৯ সালে) যার মূল ইস্যু ছিল কাশ্মীর। উভয় দেশই সম্পূর্ণ কাশ্মীর দাবি করে। বাস্তবে কাশ্মীরের একটি অংশ পাকিস্তান এবং অপর অংশ ভারত নিয়ন্ত্রণ করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুহাম্মদ বদর আলমের মতে, ভারত থেকে আসা নিরন্তর হুমকির অনুভূতি সেই ‘মৌলিক কারণগুলোর’ একটি, যা সামরিক বাহিনীকে সমাজ, রাজনীতি ও শাসনে প্রাধান্য দিয়েছে।
১৯৯৯ সালে শেষ প্রচলিত যুদ্ধের পর থেকে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও ‘সন্ত্রাসবাদ’ ছড়ানোর অভিযোগ করেছে। বিশেষ করে ভারত অভিযোগ করে আসছে, পাকিস্তান ভারত-শাসিত কাশ্মীরে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিয়ে আসছে।
পাকিস্তান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে এবং বলে আসছে, তারা কাশ্মীরিদের শুধু নৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দেয়।
গত ২৫ বছরে ভারতে বহু হামলা হয়েছে। ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলায় ১৬০ জনের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিলেন। ভারত বলেছে, পাকিস্তানের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো এই হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেছিল।
ইসলামাবাদ স্বীকার করেছিল, হামলাকারীরা পাকিস্তানি হতে পারে, কিন্তু পাকিস্তান সরকার বা সামরিক বাহিনীর মদতেই মুম্বাই হামলা হয়েছিল—ভারতের এই অভিযোগ পাকিস্তান বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে এসেছে।
২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে আরও অবনতি হয়।
এর পর থেকে ভারত নিজ ভূখণ্ডে সশস্ত্র হামলার জবাবে ২০১৬, ২০১৯ এবং এখন (২০২৫ সালে) পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের ভেতরে হামলা চালিয়েছে।
লাহোরভিত্তিক বিশ্লেষক বদর আলম আল–জাজিরাকে বলেছেন, মোদির কঠোর অবস্থান পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে তাদের ক্ষমতার ন্যায্যতা প্রমাণ করতে সাহায্য করেছে। তিনি বলেন, ‘যত দিন পূর্ব দিক থেকে হুমকি থাকবে, তত দিন সামরিক বাহিনী অপরিহার্য থাকবে।’
বিবেকের যুদ্ধ?উভয় পক্ষই সাম্প্রতিক চার দিনের সংঘর্ষ সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী দাবি করেছে। পাকিস্তান পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করেছে এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধবিরতির গুরুত্ব তুলে ধরেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প কাশ্মীর ইস্যুর সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন, যা ভারতের মতে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই শুধু ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা যেতে পারে।
ভারত দাবি করেছে, তারা পাকিস্তানি ভূখণ্ডে গভীর আঘাত হেনেছে এবং এসব আঘাত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর আস্তানা ও সামরিক স্থাপনাগুলোকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
ইসলামাবাদভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক আরিফা নূর বলেছেন, ‘প্রতিবেশী দেশের’ সঙ্গে সংঘর্ষ নাগরিকদের রাষ্ট্র ও তার সশস্ত্র বাহিনীর পাশে দাঁড় করায়। এটি পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও যেমন সত্য, তেমনি অন্য যেকোনো দেশের জন্য সত্য।
পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বর্তমানে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রচুর সমর্থন পাচ্ছে সত্যি, কিন্তু এই জনসমর্থন দেশের ভেতরের রাজনীতিতে ঠিক কতটা প্রভাব ফেলবে, তা এখনই সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘সীমান্তে অবস্থিত পাঞ্জাবে সবচেয়ে বেশি সমর্থন দেখা গেছে। কিন্তু খাইবার পাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তানের মতো প্রদেশগুলো ভিন্নভাবে দেখতে পারে।’
খাইবার পাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তান উভয়ই দীর্ঘস্থায়ী সহিংসতা দেখেছে। সেখানকার সমালোচকেরা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ করেছেন, যা কিনা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী অস্বীকার করে আসছে।
আরিফা নূরের মতামতের প্রতিধ্বনি করে বদর আলম বলেছেন, জনসমর্থন প্রধানত পাঞ্জাব ও দেশের অন্যান্য শহুরে এলাকায় দৃশ্যমান ছিল।
আলম আরও বলেছেন, ইমরান খান এখনো জেলে থাকায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মূল সমর্থকদের চোখে সামরিক বাহিনীর ইমেজ কতটা পরিবর্তিত হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়।
জনপ্রিয়তা কি স্থায়ী হবে
বিশ্লেষকেরা সতর্ক করেছেন, আন্তর্জাতিক উত্তেজনার সময় ‘পতাকার চারপাশে একত্র হওয়ার’ প্রভাব স্পষ্ট হলেও নেতা ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনসমর্থন সাধারণত স্বল্পস্থায়ী হয়।
নিউইয়র্কের আলবানি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক নিলুফার সিদ্দিকি আল–জাজিরাকে বলেন, বর্তমান সংকট থেকে সামরিক বাহিনী কত দিন জনগণের সমর্থন উপভোগ করবে, তা স্পষ্ট নয়।
তিনি আরও বলেন, এটি অনেকটাই নির্ভর করছে ভারতের বক্তব্যের ওপর এবং তা উত্তেজনাপূর্ণ থাকবে কি না, তার ওপর।
সিদ্দিকি আরও যোগ করেছেন, পিটিআই আগে খুব কঠোর ভাষায় সেনাবাহিনীর সমালোচনা করত। এখন প্রশ্ন হলো, সেনাবাহিনীর এই জনপ্রিয়তা বাড়ার পর ভবিষ্যতে পিটিআই তাদের বক্তব্য কীভাবে সাজাবে?
যদি পিটিআই সেনাবাহিনীর সমালোচনা কমিয়ে দেয়, তাহলে সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের সমর্থন বজায় থাকতে পারে। কিন্তু যদি তারা আগের মতোই কঠোর সমালোচনা চালিয়ে যায়, তাহলে বর্তমান জনসমর্থন কমে যেতে পারে।
লন্ডনভিত্তিক লেখক রশিদ বলছেন, পাকিস্তানিদের জন্য আগামী দিনে বড় প্রশ্ন হবে, তারা সীমান্তে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের সম্পৃক্ততার মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে কি না। তিনি বলেন, ‘আমাদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রাজনীতিতে জড়িত থাকাকে সমালোচনা করতে হবে, কিন্তু একই সঙ্গে স্বীকার করতে হবে, সীমান্তে তাদের কর্মক্ষমতা এই মুহূর্তে প্রশংসনীয়।’
বদর আলম বলেন, ভারতের সঙ্গে এই সংকট থেকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকেও শিক্ষা নিতে হবে। তিনি বলেন, ‘সামরিক বাহিনীকে বুঝতে হবে, সাফল্যের জন্য জনসমর্থন প্রয়োজন। আমরা ভারতের সঙ্গে চিরস্থায়ী যুদ্ধে থাকতে পারি না। আমাদের অর্থনীতি ঠিক করতে হবে, না হলে এটি পাকিস্তানের অস্তিত্বের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে।
আবিদ হুসেইন আল–জাজিরা ইংলিশের ডিজিটাল সংবাদদাতা হিসেবে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে কর্মরত
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ