জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমের ফেসবুক পোস্টে মন্তব্য করায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী মো. নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ওই মন্তব্য করার পরদিন নাজমুলকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তারপর তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দেওয়া হয়েছে।

এ ঘটনায় ‘নিঃশর্ত ক্ষমা’ চেয়ে গত ২৭ মার্চ বিভাগীয় মামলার পরিপ্রেক্ষিতে চাওয়া ব্যাখ্যার জবাব দিয়েছেন নাজমুল হুদা।

নাজমুল মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাব শাখায় অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁকে গত ২০ ফেব্রুয়ারি সাময়িক বরখাস্ত করে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন-২ শাখায় সংযুক্ত করা হয়। নাজমুল আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ না দিয়েই সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

সাময়িক বরখাস্তের অফিস আদেশে সই করেছিলেন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব সৈয়দা সাদিয়া নূরীয়া। জানতে চাইলে তিনি আজ প্রথম আলোকে বলেন, অফিসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নাজমুল হুদাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সারজিস আলমের ফেসবুক পোস্টে একটি মন্তব্য করেন নাজমুল। পরদিন সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর বিধি ১২(১) অনুযায়ী তাঁকে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়।

সাময়িক বরখাস্তের অফিস আদেশে ‘অসদাচরণ’-এর অভিযোগ আনা হলেও সারজিস আলমের ফেসবুক পোস্টে মন্তব্য করার বিষয়টি সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। তবে সারজিস আলমের ফেসবুক পোস্টে নাজমুলের মন্তব্য করার বিষয়টি তাঁর বিরুদ্ধে করা বিভাগীয় মামলার অভিযোগনামায় উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে সারজিস আলমের পরিচয় হিসেবে জুলাই বিপ্লব ও ছাত্র–জনতার অভ্যুথানের অন্যতম সমন্বয়ক জনাব মো.

সারজিস আলম উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আপনার উপরোক্ত মন্তব্য বা বক্তব্য জাতীয় ঐক্য চেতনার পরিপন্থি, যা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রকে হেয়প্রতিপন্ন, জনমনে অসন্তোষ বা অপ্রীতিকর মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে মর্মে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ধরনের অবিবেচনাপ্রসূত বক্তব্যে মাননীয় উপদেষ্টা মহোদয়গণদের হেয় করা হয়েছে। প্রজাতন্ত্রের একজন দায়িত্বশীল সরকারি কর্মচারী হিসেবে আপনার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে এ ধরনের মন্তব্য বা বক্তব্য প্রদান সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী অসদাচরণের শামিল।’

বিভাগীয় মামলার নথি অনুযায়ী সারজিস আলমের ফেসবুক পোস্টে নাজমুল বলেছিলেন, ‘আপনারা স্বৈরাচারী সরকারের দোসরদের সচিব বানানোর জন্য ডিও দেন, আবার বড় বড় কথা বলেন ভাইয়া।’

এই মন্তব্যের জন্য বিধিমালার বিধান অনুযায়ী কেন সরকারি চাকরি থেকে নাজমুলকে বরখাস্ত করা হবে না অথবা অন্য কোনো উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা হবে না, তা অভিযোগনামা পাওয়ার ১০ কার্যদিবসের মধ্যে লিখিতভাবে তাঁকে জানাতে বলা হয়। আত্মপক্ষ সমর্থনে নাজমুল ব্যক্তিগত শুনানিতে অংশগ্রহণের ইচ্ছা পোষণ করেন কি না, তা–ও জানাতে বলা হয়।

মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শাহ আলম মুকুল বিভাগীয় মামলার নথিতে সই করেন। এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য আজ মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

নাজমুল হুদা বিভাগীয় মামলার জবাবে বলেছেন, সারজিস আলম তাঁর বিরুদ্ধে কোনো লিখিত অভিযোগ করেননি। অথচ সারজিস আলমের ফেসবুকে মন্তব্য করার কারণে তাঁকে অসদাচরণের অভিযোগে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

বিভাগীয় মামলায় আনা অন্যান্য অভিযোগেরও জবাব দেন নাজমুল। তিনি বলেন, সারজিস আলমের ফেসবুক পোস্টে কমেন্ট করার কারণে সরকার বিব্রত হয়ে থাকলে তিনি নিঃশর্ত ক্ষমা চান। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে সচেতন থাকবেন। পাশাপাশি তিনি ব্যক্তিগত শুনানির জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য অন য য় সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

হজ, কলেরা ও কোয়ারেন্টিন

হজ পবিত্র ধর্মীয় আচার হলেও ইতিহাসে এটি বারবার মহামারির কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আরব উপদ্বীপের হেজাজ অঞ্চল, বিশেষ করে মক্কা ও মদিনায়, বিভিন্ন সময়ে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, যার মধ্যে কলেরা ছিল অন্যতম। এই মহামারিগুলো রোধে কোয়ারেন্টিন বা সঙ্গনিরোধ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

মক্কায় মহামারি

মক্কায় মহামারির প্রথম লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় ইবনে কাসিরের আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে। ৯৬৮ সালে ‘আল-মাশরি’ নামক একটি মহামারি মক্কায় আঘাত হানে, যার ফলে অসংখ্য হজযাত্রী এবং তাঁদের বহনকারী উটের মৃত্যু হয়। এমনকি যাঁরা হজ পালন করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁরাও অল্প সময়ের মধ্যে মারা যান। এ ঘটনা মক্কার ইতিহাসে মহামারির প্রাথমিক প্রভাবের একটি উদাহরণ।

কলেরার প্রাদুর্ভাব

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির ফলে হজযাত্রা আরও সহজ ও ব্যাপক হয়। বাষ্পীয় জাহাজের প্রচলনের কারণে অধিক সংখ্যক হজযাত্রী স্বল্প সময়ে মক্কায় পৌঁছাতে শুরু করেন। তবে এটি সংক্রামক রোগের দ্রুত বিস্তারের সুযোগও তৈরি করে। এই সময়ে কলেরা বিশ্বব্যাপী মহামারি হিসেবে আবির্ভূত হয়, এবং হেজাজ অঞ্চলও এর প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল না।

কলেরা প্রথম ১৮১৭ সালে বাংলার যশোর অঞ্চলে (বর্তমান বাংলাদেশ) দেখা দেয় এবং দ্রুত ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৩৩ সালের মধ্যে এটি এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকায় মহামারি হিসেবে প্রভাব ফেলে, যার ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। আরব উপদ্বীপে কলেরার প্রথম প্রাদুর্ভাব ঘটে ১৮২১ সালে। ১৮৩১ সালে মক্কায় এই রোগ প্রথম আঘাত হানে, যার ফলে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ বা অন্তত ২০ হাজার হজযাত্রীর মৃত্যু হয়। এই মহামারি ভারতীয় হজযাত্রীদের মাধ্যমে মক্কায় ছড়ায় এবং অভূতপূর্ব দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করে। পরবর্তী সময়ে ১৮৪১, ১৮৪৭, ১৮৫১, ১৮৫৬-৫৭ ও ১৮৫৯ সালে কলেরা মক্কায় বহু হজযাত্রীর প্রাণ কেড়ে নেয়।

আরও পড়ুনবদর যুদ্ধক্ষেত্রে একটি দিন২০ জুলাই ২০২৩

কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা

তৎকালীন ওসমানিয়া সাম্রাজ্য, যারা হেজাজ অঞ্চলের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে ছিল, কলেরার বিস্তার রোধে ১৮৪০ সাল থেকে কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা প্রয়োগ শুরু করে। হেজাজের সীমান্ত এবং মক্কা ও মদিনার বিভিন্ন স্থানে কোয়ারেন্টিন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে হজযাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হতো এবং সংক্রমণের ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করা হতো।

ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আগত হজযাত্রীদের জন্য কোয়ারেন্টিন প্রক্রিয়া বিশেষভাবে কঠোর ছিল। এডেনে যাত্রাবিরতির পর, হজযাত্রীদের ইয়েমেনের উপকূলীয় কামারান দ্বীপে কোয়ারেন্টিন ক্যাম্পে নামানো হতো। স্বাস্থ্য পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে কোয়ারেন্টিনের সময়সীমা এক সপ্তাহ থেকে এক মাস পর্যন্ত হতে পারত। কোয়ারেন্টিন শেষে জাহাজ জেদ্দায় পৌঁছাত এবং পথে ইয়ালামলাম নামক স্থানে হজযাত্রীরা ইহরাম বাঁধতেন, যা ভারতীয় উপমহাদেশের মিকাত (হজের নিয়ত ও ইহরাম বাঁধার নির্ধারিত স্থান) হিসেবে পরিচিত।

আন্তর্জাতিক কলেরা সম্মেলন

কলেরা মহামারির বিশ্বব্যাপী বিস্তার এবং ব্যাপক প্রাণহানির প্রেক্ষাপটে ১৮৬৬ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো একটি আন্তর্জাতিক স্যানিটারি কনফারেন্সের আয়োজন করে, যা পরে ‘কলেরা কনফারেন্স’ নামে পরিচিত হয়। এই কনফারেন্সে ভারতীয় উপমহাদেশকে কলেরার উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে ভারত থেকে আগত হজযাত্রীদের ওপর কঠোর স্বাস্থ্য নজরদারি ও কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা আরোপ করা হয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলেরা মক্কায় ব্যাপক প্রাণহানির কারণ হলেও ওসমানীয় সালতানাতের কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারতীয় উপমহাদেশের হজযাত্রীদের মাধ্যমে কলেরার বিস্তার হলেও কোয়ারেন্টিন ক্যাম্প এবং স্বাস্থ্যবিধি প্রয়োগের মাধ্যমে এর প্রভাব কমানোর চেষ্টা করা হয়।

আরও পড়ুনবিরে শিফা: একটি অলৌকিক কুয়ার গল্প০৫ মে ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ