বাংলাদেশের নদীগুলো কেবল জলপ্রবাহ নয়; আমাদের জীবনেরও অংশ। সেদিক থেকে নদী আমাদের ভালোবাসারও অংশ। একই সঙ্গে কখনও কখনও শোকের উৎস হিসেবেও হাজির হয় নদী। ২৩ মে আমার জীবনের তেমনি একটি দিন। ২০০৪ সালের ২৩ মে রাতে চাঁদপুরের কাছে মেঘনাসহ বিভিন্ন নদীতে চারটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবে যায়। মাদারীপুর থেকে ঢাকায় আসার পথে চাঁদপুরে ঝড়ের কবলে পড়া ‘এমভি লাইটিং সান’ লঞ্চের যাত্রী ছিলেন আমার মা আছিয়া খাতুন। ওই রাতেই এমভি দিগন্ত এবং এমএল মজলিশপুর নামে আরও দুটি লঞ্চ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। আমার মাসহ তিন শতাধিক যাত্রী ওই রাতে প্রাণ হারান। কিন্তু সেটাই লঞ্চ ডুবে প্রাণহানির শেষ ঘটনা ছিল না। গত ৫৪ বছরে নৌ দুর্ঘটনায় প্রায় ২০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, নৌযানের অনুপযুক্ত অবস্থা, আবহাওয়া উপেক্ষা– এসবই প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার কারণ। একেকটি দুর্ঘটনায় হারিয়ে যায় শত শত জীবন। অগণিত পরিবার বরণ করে নীরব শোক। সেই দিন থেকে ২০ বছর অতিক্রম করে গণসচেতনতার কাজ অব্যাহত রেখেছে নদী ও প্রাণ প্রকৃতি সুরক্ষা সংগঠন নোঙর ট্রাস্ট। পাশাপাশি ২৩ মেকে আমরা সরকারিভাবে জাতীয় নদী দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবি এবং ২০২৩ সালে চারটি সংগঠনের ঘোষণার মাধ্যমে আমরা দিবসটি পালন করে আসছি।

জাতীয় নদী দিবসে আমরা শুধু নদীর সৌন্দর্য নয়, সেই সব প্রাণের স্মৃতিও স্মরণ করি, যারা নদীপথে হারিয়ে গেছেন। নদীপথে নিহতদের স্মরণে ২৩ মে ‘জাতীয় নদী দিবস’ ঘোষণা করা আজ সময়ের দাবি। কারণ নদী শুধু প্রাণ নয়; নিরাপত্তারও প্রতীক হোক। নদী দখল-দূষণ নয়; শৃঙ্খলা আর মানবিকতা ফিরিয়ে আনুক আমাদের জীবন নদী। বলাবাহুল্য, জীবন ও নদী একে অপরের পরিপূরক। নদী হলো জীবনের প্রতীক। নদী ছাড়া আমাদের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। কৃষি, মৎস্য, পরিবহন, শিল্প, পানি সরবরাহ– সবকিছুর মূলেই আছে নদী। বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ, যার বুক চিরে প্রবাহিত হয়েছে শত শত নদী। এ নদীগুলো আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক।

নদীর স্রোত যেমন জীবনের গতি বহন করে, তেমনি নদীর স্থবিরতা মানে জীবনের সংকট। তাই নদীকে শুধু একটি প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে না দেখে একটি জীবন্ত সত্তা হিসেবে ভাবা জরুরি। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত (হাইকোর্ট বিভাগ) দেশের সব নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এই ঘোষণার ফলে নদীগুলোর আইনি অধিকার সৃষ্টি এবং নদীর ক্ষতি করা মানে একটি জীবন্ত সত্তার ক্ষতি করা বলে বিবেচিত হয়।

এই রায়ের মাধ্যমে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে নদীগুলোর আইনি অভিভাবক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এটি ছিল নদী রক্ষার ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই ঘোষণার পেছনে পরিবেশবাদী সংগঠন ‘নোঙর’সহ নানা সামাজিক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। নদীর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি এবং নদী দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের লক্ষ্যে ২৩ মে ‘জাতীয় নদী দিবস’ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস। এই দিনে সারাদেশে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে নদীর প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ব ও সচেতনতা প্রকাশ করা হবে। দিবসটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়– নদী শুধু প্রকৃতির উপাদান নয়; আমাদের প্রাণের অংশ।

দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে প্রায় সব নদী এখন দখল ও দূষণের শিকার। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীগুলোতে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। শিল্পবর্জ্য, গৃহস্থালির ময়লা, ড্রেনের পানি, প্লাস্টিক ও রাসায়নিক পদার্থ ফেলে নদীকে বিষিয়ে তোলা হচ্ছে। ফলে নদীর গভীরতা ও প্রবাহ কমছে; বন্যা ও জলাবদ্ধতা বাড়ছে; মাছ ও জলজ জীব মারা যাচ্ছে; মানুষ পাচ্ছে না বিশুদ্ধ পানি; কৃষি ও জীববৈচিত্র্য পড়ছে হুমকির মুখে। নদী আমাদের মা, আমাদের জীবন, আমাদের ভবিষ্যৎ। নদীকে বাঁচাতে হলে আইনের প্রয়োগ, সচেতনতা এবং সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন অত্যন্ত জরুরি।

সুমন শামস: চেয়াম্যান, নোঙর ট্রাস্ট

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: জ ত য় নদ দ র ঘটন জ বন র র জ বন আম দ র নদ গ ল

এছাড়াও পড়ুন:

‘আমি সাধারণত সব দোষ নিজের ওপর নিই’

আলো নিভে গেলে অনেকেই হারিয়ে যায়। কেউ কেউ আবার অন্ধকারের মধ্যে খুঁজে নেয় নতুন আলো। বলিউড অভিনেত্রী বাণী কাপুর তাদেরই একজন– যিনি ব্যর্থতার ধুলো থেকে নিজের ভেতর শক্তি খুঁজে বের করেছেন, নিরবধি যুদ্ধ করে গেছেন নিজের অবস্থান, পরিচয় ও স্বপ্নের জন্য। যে স্বপ্নের শুরুটা হয়েছিল অনেক দিন আগে থেকে। দিল্লির এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া বাণী কখনও ভাবেননি তাঁর মুখশ্রী একদিন হিন্দি সিনেমার বড়পর্দায় জায়গা করে নেবে।

মডেলিং দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, তবে তিনি জানতেন, তাঁর যাত্রাটা শুধু ক্যামেরার ফ্ল্যাশে থেমে থাকবে না। ২০১৩ সালে ‘শুদ্ধ দেশি রোমান্স’ সিনেমার মাধ্যমে বলিউডে অভিষেক হয় তাঁর। সুশান্ত সিং রাজপুত ও পরিণীতি চোপড়ার পাশে এক নবাগত হিসেবে তাঁর পারফরম্যান্স দর্শকের নজর কাড়ে। প্রথম ছবিতেই ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড জিতে নেন ‘সেরা নবাগত অভিনেত্রী’ হিসেবে।

ক্যারিয়ারের আকাশ তখনই যেন উন্মুক্ত হয়েছিল তাঁর সামনে। কিন্তু আকাশে উড়তে থাকা পাখির ডানায় কখনও কখনও ঝড় এসে ধাক্কা দেয়। ২০১৬ সালে মুক্তি পায় রণবীর সিংয়ের বিপরীতে তাঁর দ্বিতীয় বড় বাজেটের সিনেমা ‘বেফিকরে’। প্যারিসের অলিগলিতে নায়কের সঙ্গে বাণীর রোমান্স, নিখুঁত শরীরী ভাষা, সাহসী দৃশ্য– সব ছিল ছবিতে। এরপরও দর্শকের মন জয় করতে পারেনি সেটি। বাণীর জীবনেও শুরু হয় আত্মবিশ্লেষণের এক কঠিন অধ্যায়।

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি সাধারণত সব দোষ নিজের ওপর নিই। যখন ছবি চলে না, মনে হয় আমারই ভুল ছিল। কেমন যেন গিল্ট ফিলিং কাজ করত।’ বাণীর এই কথা শোনার পর মনে হয়, এই মেয়েটা শুধু অভিনেত্রী নন, তিনি একজন যোদ্ধাও। হতাশা তাঁকে ভেঙে ফেলেনি; বরং নতুন করে গড়েছে। এরপর ২০১৯ সালে ওয়ার সিনেমায় ছোট চরিত্রে দেখা গেলেও বাণী নিজের উপস্থিতি টিকিয়ে রাখেন। সত্যিকার অভিনয়ের পরিপক্বতা তিনি দেখান ‘চণ্ডীগড় কারে আশিকী’ সিনেমায়।

এ সিনেমায় তিনি এক ট্রান্সজেন্ডার নারীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। এ চরিত্রের জন্য সাহস লাগে। দর্শকের প্রতিক্রিয়াও ছিল মিশ্র। তবুও বাণী পিছপা হননি।

তিনি বলেন, ‘সবাই যখন নিরাপদ চরিত্রে কাজ করতে চায়, আমি সেখানে ঝুঁকি নিয়েছি। কারণ আমি জানি, শিল্প-সাহিত্য কখনও নিরাপদ জায়গায় জন্মায় না।’ তাঁর এ বক্তব্যে যেন তাঁর শিল্পীসত্তার ছায়া পড়ে। এ বছর বাণীর দুটি ভিন্নধর্মী সিনেমা মুক্তি পাওয়ার কথা থাকলেও মুক্তি পেয়েছে একটি। নাম ‘রেইড টু’। অন্যদিকে ‘আবির গুলাল’ রোমান্টিক কমেডি, যা রাজনৈতিক কারণে মুক্তি স্থগিত হয়েছে। 

বাণীর জীবনে নেই শুধু সাফল্যের পর সাফল্য; রয়েছে ব্যর্থতার ছায়ায় দাঁড়িয়ে নিজেকে নতুন করে খোঁজার গল্প। যিনি জানেন কীভাবে নিজেকে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে নিজের আত্মার গভীরতম ভয়কেও আলিঙ্গন করতে হয়। বলিউড তাঁকে যতটুকু দিয়েছে, তার চেয়েও বেশি নিজের ভেতর থেকে তিনি তুলে এনেছেন শক্তি। তিনি প্রমাণ করেছেন, নায়িকা শুধু পর্দায় নয়, জীবনের মঞ্চেও লড়াকু হয়ে উঠতে পারে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • রেনেসাঁসের আলোয় রবীন্দ্রনাথ
  • কোরবানির প্রস্তুতি 
  • ‘আমি সাধারণত সব দোষ নিজের ওপর নিই’