মুন্সীগঞ্জে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে সেবা বঞ্চিত রোগী
Published: 24th, May 2025 GMT
প্রয়োজনীয় ওষুধ, চিকিৎসক ও লোকবলের অভাবে নিজেই অসুস্থ-অচল হয়ে পড়েছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আওতাধীন মুন্সীগঞ্জ সদরের মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রটি। বিগত কয়েক মাস ধরে নরমাল ডেলিভারি ছাড়া কোন প্রকার অস্ত্রোপচারের (সিজার রিয়ান অপারেশন) মাধ্যমে শিশু জন্মদানের কার্যক্রম হয়নি এখানে। এতে কেন্দ্রটিতে চিকিৎসা নিতে আসা প্রসূতি তাদের স্বজনরা হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
কর্তৃপক্ষ বলছে, গত ছয় মাসে এ কেন্দ্রটি নিরাপদ মাতৃত্বের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। কেন্দ্রটিতে গত দুই মাসে একটিও অস্ত্রোপচার (সিজার) হয়নি। স্বাভাবিক প্রসবের হারও ছিল হতাশাব্যঞ্জক। যে দুয়েকটি অস্ত্রোপচার হয়েছে তাও অসহায় গরিব রোগীদের নিজেদেরই বাইরে থেকে ওষুধ ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনিয়ে আনা হয়েছে। তাছাড়া দালালের খপ্পরে পড়ে রোগীরা প্রায়ই কেন্দ্রের আশপাশের ক্লিনিকে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
সরেজমিনে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, চিকিৎসাকেন্দ্রটিতে প্রতিদিন শতাধিক রোগী আসেন চিকিৎসা নিতে। কিন্তু চিকিৎসা না পেয়ে তাদের ফিরে যেতে হয়।
গত ছয় মাসে এখানে যা দুয়েকটি সিজারিয়ান অপারেশন হয়েছ, তাও রোগীর নিজ খরচে। এছাড়া নরমাল ডেলিভারি হয়েছে ২২৯ জনের। কোন লাইগেশন ও ভেসেকটমি হয়নি। কনডম ও জন্মনিয়ন্ত্রল পিল দেওয়া হয়নি। ইমপ্লান্ট গ্রহীতা ১৯১ জন ও আইইউডি গ্রহীতা ৪০ জন।
কেন্দ্রটিতে মেডিকেল অফিসার রয়েছেন মাত্র দুই জন, পরিবার কল্যাণ পরিদর্শীকা রয়েছেন দুই জন, একজন রয়েছেন ফিমেইল নার্স এটেন্ডেন্ট, একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও একজন অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার।
এখানে জেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে প্রতিদিন শতাধিক রোগী সেবা নিতে আসেন। তবে চরম বিড়ম্বনায় পড়ে সেবা ছাড়াই তাদের ফিরে যেতে হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা কর্মীর সংকট রয়েছে হাসপাতালটিতে। নানা অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি হাসপাতালের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ সেবা গ্রহীতাদের। ওয়ার্ডে রোগী নেই, বেড খালি পড়ে রয়েছে। লোকবল নিয়োগ না হওয়ায় নতুন ভবনে আইসিইউ ও সিসিইউসহ নানা ধরনের আধুনিক চিকিৎসা সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন এ অঞ্চলের মানুষ।
অকপটে এসব অভিযোগ স্বীকার করে হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ফারিয়া নুসরাত বলেন, “সিজারের কোন ওষুধ এখানে সাপ্লাই নেই। তাহলে আমরা কীভাবে ওষুধ ও সরঞ্জাম ছাড়া সিজার করব? তাই বাধ্য হয়েই রোগীদের নিজ খরচে বাইরে থেকে ওষুধ কিনে আনতে হচ্ছে।”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুপুর আড়াইটার পর চিকিৎসা কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। এখানে কোনো আল্ট্রাসনোগ্রাম হয় না। অন্যান্য জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষারও সুযোগ নাই। ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়ার কথা থাকলেও, বেলা আড়াইটার পর রোগীরা কোনো সেবা পান না।
এ বিষয়ে কেন্দ্রের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, আড়াইটার পর ওষুধ-পথ্যের কারণে ইচ্ছে থাকলেও তারা সেবা দিতে পারেন না। তাছাড়া লোকবলের অভাবে এখানে ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়াও সম্ভব না।
এদিকে, এ অচলাবস্থার সুযোগে দালালদের উৎপাত ব্যাপকহারে বেড়েছে। সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় রোগী নিয়ে টানা-হেঁচড়া। বৃহস্পতিবার (২২ মে) সকাল ১০টার পর থেকে প্রধান ফটকে জরুরি বিভাগের সামনে প্রথমে একজন ও পরে তার সঙ্গে আরও তিনজনকে যোগ দিতে দেখা গেল।
মুক্তারপুর থেকে আসা এক নারীকে ওই দালাল চক্রটি বাইরের কোনো ক্লিনিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছিল। এ প্রতিবেদক প্রথম ব্যক্তির পরিচয় জানতে চাইলে তিনি জানান, কাছেই তার নিজের ক্লিনিক আছে। তাছাড়া এখানেতো কোন ওষুধ নেই, সিজারও হয় না।
কেন্দ্রটির বহির্বিভাগে চিকিৎসকদের রুমে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নিয়োগকৃত দালালদের দৌরাত্ম্য চোখে পড়ার মতো। এমনকি খোদ ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরাই ডাক্তারদের সাথে আঁতাত করে দালালদের লালন-পালন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে ডাক্তার ও স্টাফদের বিরুদ্ধে। হাসপাতালটির প্রধান ফটক থেকে শুরু করে ইনডোর ও আউটডোরে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ওষুধ কোম্পানি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালদের দৌরাত্ম্যের কারণে কেন্দ্রটিতে রোগীদের প্রবেশ করাই দায় হয়ে পড়েছে। এছাড়া বাইরের লোকের এই অবাধ প্রবেশের সুযোগে রোগী ও স্বজনদের মোবাইল এবং টাকা চুরির মতো ঘটনা নিত্য ঘটে চলেছে। এসব ব্যপারে সব কিছু জেনেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ উদাসীন।
সরেজমিনে মুন্সীগঞ্জ সদরের মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের কর্তব্যরত চিকিৎসক ফারিয়া নুসরাতের চেম্বারে গিয়ে যদেখা যায়, সেখানে কয়েক জন লোক বসে আছেন। তারা সবাই ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি। তাদের কারো হাতে লাল-হলুদ খাম। কারো হাতে তাদের কোম্পানির ওষুধ, কলম ও প্যাড। ডাক্তারের দরজায় পাহারায় রত ক্লিনিক-ডায়গনস্টিক সেন্টারের দুজন দালাল। ডাক্তারের রুমে ঢুকতে চাইলে তারা বাধা দেন। তবে সংবাদকর্মী পরিচয় দিলে ভিতরে ঢুকতে দিয়ে তারা সটকে পড়েন।
রুমের ভিতরে গিয়ে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের পরিচয় জানতে চাইলে ডাক্তারের সামনেই তারা বীর দর্পে বলেন, “আমরা ওষুধ কোম্পানির লোক। আপার নির্দেশেই এখানে এই সময় প্রতিদিন আসি।” এ কথা বলেই চলে যান তারা। এদিকে, ডাক্তারের রুমের বাইরে ১০-১৫ জন রোগীর সিরিয়াল।
এসব দৃশ্য দেখে কর্তব্যরত চিকিৎসক ফারিয়া নুসরাতের কাছে এই প্রতিবেদক জানতে চান- অফিস টাইমে আপনি বাইরে রোগী দাঁড় করিয়ে রেখে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সময় দেন কেন?
জবাবে তিনি বলেন, “রোগী দেখার পাশাপাশি আমি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদেরও ভিজিট করার সময় দেই। তাছাড়া এখানেতো কোন ওষুধ নাই, সিজারও করা হয় না। শুধু নরমাল ডেলিভারি করা হয়। রোগীদের যেহেতু বাইরের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে নিতে হবে, তাই আমি ভালো কোম্পারি ওষুধই লিখে দেই।”
এ বিষয়ে মুন্সীগঞ্জ পরিবার পরিকল্পনার উপ পরিচালক মো.
তিনি আরো বলেন, “বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক, ক্লিনিক এবং ওষুধ কোম্পানির লোকদের দৌরাত্ম্যের অভিযোগ শুনেছি। নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোনো ধরনের অনিয়মের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হবে না।’’
উপ পরিচালক বলেন, “ওষুধ কোম্পানির দৌরাত্ম্য বেড়েছে। অভিযোগ পেয়েছি মাতৃসদনের ডাক্তার ও স্টাফরা এসব দালালদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন। ভবিষ্যতে যেনো এসব অপকর্ম তারা করতে না পারেন, সে ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের অবগত করা হবে। দালালদের প্রশ্রয় দিয়ে রোগী টানা-হেঁচড়া করে জোরপূর্বক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাবে, তা হতে দেওয়া যাবে না। এদের বিরুদ্ধে পুলিশ-প্রশাসনের মাধ্যমে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ঢাকা/এস
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ড য় গনস ট ক স ন ট র গনস ট ক স ন ট র র চ ক ৎসক ব যবস থ র পর চ পর ব র র জন য কল য ণ
এছাড়াও পড়ুন:
সাতক্ষীরায় প্রতিবন্ধী ছাত্রীকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে একজন গ্রেপ্তার
প্রতীকী ছবি