মাগুরায় গত বছরের ৪ আগস্ট জেলা বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে বোমা হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে মামলা হয়েছে। ১৮ মে মাগুরা সদর থানায় ফৌজদারি কার্যবিধি ও বিস্ফোরক আইনের বিভিন্ন ধারায় মামলাটি করেন মো. আবু তাহের নামের এক ব্যক্তি।

মামলায় আসামি হিসেবে মাগুরা–১ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের বাবা খন্দকার মাসরুর রেজাসহ ৭৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছেন আরও ১৫০ থেকে ২০০ জন।
মাগুরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো.

আইয়ুব আলী মামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৪ আগস্টের ঘটনায় ওই মামলা হয়েছে। তবে এ মামলায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তদন্ত চলছে।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আসামিরা পরস্পর সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী। তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা–কর্মী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলার সময় ঘটনার দিন ৪ আগস্ট বেলা ৩টার দিকে হাতবোমা, পিস্তল, শটগান, বন্দুক, রামদা, ছ্যানদা, চাপাতি, চায়নিজ কুড়াল, লোহার রড, শাবল, ককটেল বোমা, প্লাস্টিকের টবভর্তি পেট্রোল নিয়ে মাগুরা শহরের ইসলামপুরপাড়ায় অবস্থিত বিএনপি কার্যালয়ে এসে হামলা চালান। আসামিরা অফিসকক্ষের ভেতরে থাকা চেয়ার, টেবিল, আলমারিসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর করেন। পরে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, এ সময় কার্যালয়ের পশ্চিম পাশে অবস্থিত মাগুরা জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি প্রয়াত হাবিবুর রহমানের বসতবাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়।

মামলায় ১ নম্বর আসামি সাকিবের বাবা খন্দকার মাসরুর রেজার বিরুদ্ধে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে বিএনপি কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়ার হুকুম দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি ছাড়াও এ মামলায় উল্লেখযোগ্য আসামিরা হচ্ছেন জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ফজলুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাখারুল ইসলাম শাকিল, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মকবুল হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক শেখ রেজাউল ইসলাম, জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সাকিব হাসান প্রমুখ।

এদিকে মামলার আসামিদের মধ্যে অন্তত পাঁচজন দাবি করেছেন, তাঁরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। এমনকি তাঁরা কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে যাননি। তাঁরা ব্যবসা বা অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত। এই ব্যক্তিদের একজন মাগুরা শহরের সাহাপাড়ার বাসিন্দা টলস্টয় কাদির। তিনি ওই মামলার ৭ নম্বর আসামি। তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রীর সঙ্গে জেলা বিএনপির এক যুগ্ম আহ্বায়কের পৈতৃক জমিজমা নিয়ে বিরোধ রয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি এক যুবদল নেতার সঙ্গে তাঁর পেশাগত বৈরিতা তৈরি হয়েছে। আমার ধারণা, এসব কারণে স্ত্রীকে চাপে রাখতে আমাকে মামলায় আসামি করা হয়েছে।’

মামলার বাদী মো. আবু তাহের (৩১) মাগুরা সদর উপজেলার পাথরা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি নিজেকে বিএনপির একজন কর্মী এবং ওই কার্যালয়ের কেয়ারটেকার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। জানতে চাইলে আজ রোববার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার দিনও ছিলাম। দলীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে মামলা করতে দেরি হয়েছে। ঘটনার সময় যাঁরা ছিলেন, তাঁদেরকেই আসামি করা হয়েছে।’ তবে বিএনপির ওই কার্যালয়ে নিয়মিত যাতায়াত করা কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আবু তাহের দলীয় কার্যালয়ে কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বে ছিলেন না। তিনি সাবেক এক বিএনপি নেতার বাড়িতে কাজ করেন।

জানতে চাইলে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আলী আহমেদ আজ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলা বিএনপির কার্যালয়ে যাঁরা হামলা করেছিলেন, তাঁদের সবাইকে আইনে আওতায় আনতে হবে। তবে এর সঙ্গে জড়িত নন, এমন কাউকে আসামি করলে সেটা দুঃখজনক ব্যাপার।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব এনপ র আওয় ম ঘটন র

এছাড়াও পড়ুন:

হজের ইতিহাসে আক্রমণ ও ডাকাতি

রাজনৈতিক সংঘাত, মহামারি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও আগ্রাসী আক্রমণ এবং হজযাত্রীদের লুণ্ঠন হজের আয়োজনকে ব্যাহত করেছে। এই তৃতীয় পর্বে আমরা মঙ্গোল ও ক্রুসেডারদের আক্রমণ, সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণ এবং হজের পথে ডাকাতির প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।

মঙ্গোল ও ক্রুসেডারদের আক্রমণ

মঙ্গোল ও ক্রুসেডারদের আক্রমণ মুসলিম অঞ্চলগুলোতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে হজের পথকে বিপজ্জনক করে তুলেছিল। মঙ্গোলদের আক্রমণ ৬১৫ হিজরি (১২১৮ খ্রি.) সনে শুরু হয়, যখন তারা মঙ্গোলিয়া ও উত্তর চীন থেকে খোয়ারিজমীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। এই আক্রমণ ইরান, ইরাক এবং মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ধ্বংস করে দেয়। আবু শামা মাকদিসি (মৃ. ৬৬৫ হি.) তাঁর আয-যাইল আলা আর-রাওযাতাইন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে ৬১৭ হিজরি (১২২০ খ্রি.) সনে খোরাসান ও পারস্য অঞ্চল থেকে কেউ হজে যেতে পারেননি, কারণ মঙ্গোলদের ভয়ে পথ অনিরাপদ হয়ে পড়েছিল।

৬৩০ হিজরি (১২৩৩ খ্রি.) থেকে মঙ্গোলদের আক্রমণ ইরাকের দিকে মোড় নেয়, যা আব্বাসি খিলাফতের কেন্দ্র বাগদাদকে হুমকির মুখে ফেলে। ইমাম জাহাবি (মৃ. ৭৪৮ হি.) তাঁর তারিখ আল-ইসলাম গ্রন্থে বলেছেন যে এই সময়ে ইরাক থেকে হজ বন্ধ হয়ে যায়, কারণ মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাইকে যুদ্ধে অংশ নিতে হয়। আব্বাসি খলিফা মুস্তানসির বিল্লাহ (মৃ. ৬৪০ হি.) হজ ত্যাগ করে মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ফতোয়া পান। এই সিদ্ধান্ত হজ বন্ধের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল। ৬৫৬ হিজরি (১২৫৮ খ্রি.) সনে মঙ্গোলরা বাগদাদ দখল করে আব্বাসি খিলাফতের পতন ঘটায়, যা ইরাক থেকে হজ বন্ধের সময়কালকে আরও দীর্ঘায়িত করে।

ক্রুসেডারদের আক্রমণও হজের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। ৪৯২ হিজরি (১০৯৯ খ্রি.) সনে ক্রুসেডাররা ফিলিস্তিন ও শামের উপকূলীয় অঞ্চল দখল করে। ইবনে কাসির (মৃ. ৭৭৪ হি.) তাঁর আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে ৬২৪-৬২৭ হিজরি (১২২৮-১২৩১ খ্রি.) সনে শামের হাজিরা তিন বছর ধরে হজে যেতে পারেননি। ক্রুসেডারদের উপস্থিতি ও আইয়ুবি শাসনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব পথের নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে। এই আক্রমণগুলো হজের পথে ভয় ও অস্থিরতা ছড়িয়ে দেয়, যা হাজিদের যাত্রাকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছিল।

আরও পড়ুনহজের ইতিহাসে মহামারি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ২৪ মে ২০২৫কখনো কখনো শাসকেরাও লুটেরাদের সঙ্গে সমঝোতা করতেন। ৩৮৫ হিজরি সনে বদর ইবনে হাসানওয়াইহ কুর্দি (মৃ. ৪০৫ হি.) আসফার আরাবিকে ৫ হাজার দিনার প্রদান করেন, যাতে হাজিরা নিরাপদে যাত্রা করতে পারেন।

সামাজিক-অর্থনৈতিক বাধা

হজ পালনের জন্য অর্থনৈতিক সামর্থ্য এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফাতেমি ও আব্বাসিদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সময় মিসর ও ইরাকে অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। ইবনে জাওজি (মৃ. ৫৯৭ হি.) তাঁর আল-মুনতাজাম গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে ৪১১ হিজরি (১০২১ খ্রি.) সনে দক্ষিণ ইরাকের ওয়াসিতে যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের কারণে হজে গমন বন্ধ হয়ে যায়। এই অর্থনৈতিক সংকট হাজিদের জন্য পথের খরচ বহন করা অসম্ভব করে তুলেছিল।

৪৪১ হিজরি (১০৫০ খ্রি.) সনে বাগদাদে সুন্নি-শিয়া দাঙ্গা হয়, যা ইবনে কাসিরের বর্ণনা অনুযায়ী হজে যাতায়াত বন্ধের কারণ হয়। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক সংঘাত হাজিদের মধ্যে ভয় ও অনাস্থা সৃষ্টি করে, যার ফলে তাঁরা হজে যাওয়া থেকে বিরত থাকতেন।

ডাকাতি ও লুটপাট

আরব উপদ্বীপের মরুভূমি এবং অন্যান্য অঞ্চলের পথে বেদুইন ও অন্যান্য লুটেরা গোষ্ঠী হাজিদের কাফেলার ওপর হামলা চালাত। ইবনে আসির (মৃ.৬৩০ হি.) তাঁর আল-কামিল গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে ৩৮৪ হিজরি (৯৯৫ খ্রি.) সনে আসফার আরাবিকে নামক একজন বেদুইন নেতা হাজিদের পথ রোধ করে এবং তাদের সম্পদ দাবি করে। আলোচনার পর হাজিরা সময়ের অভাবে ফিরে আসেন এবং হজ পালন করতে পারেননি।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল ৪২৪ হিজরি (১০৩৪ খ্রি.) সনে। ফাসি (মৃ. ৮৩২ হি.) তাঁর শিফা আল-গারাম গ্রন্থে বলেছেন যে এই বছরে ইরাক ও মিসর থেকে হাজিরা বেদুইনদের ভয়ে হজে যেতে পারেননি। যাঁরা বসরা থেকে যাত্রা করেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও লুটেরারা বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁদের সম্পদ লুট করে।

কখনো কখনো শাসকেরাও লুটেরাদের সঙ্গে সমঝোতা করতেন। উদাহরণস্বরূপ, ৩৮৫ হিজরি (৯৯৬ খ্রি.) সনে বদর ইবনে হাসানওয়াইহ কুর্দি (মৃ.৪০৫ হি.) আসফার আরাবিকে ৫ হাজার দিনার প্রদান করেন, যাতে হাজিরা নিরাপদে যাত্রা করতে পারেন। ইবনে তাগরিবারদি (মৃ. ৮৭৪ হি.) এ ঘটনার উল্লেখ করে বলেছেন যে এটি একটি নিয়মিত রীতিতে পরিণত হয়েছিল।

আরও পড়ুনমদিনার হজ কার্যালয় যেন 'বাংলাদেশ'২২ জুন ২০২৪৬৫৬ হিজরি (১২৫৮ খ্রি.) সনে মঙ্গোলরা বাগদাদ দখল করে আব্বাসি খিলাফতের পতন ঘটায়, যা ইরাক থেকে হজ বন্ধের সময়কালকে আরও দীর্ঘায়িত করে।

ফিকহের দৃষ্টিকোণে ডাকাতির প্রভাব

হজের পথে ডাকাতি ও লুটপাট ফিকহের আলোচনায়ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে। ইমাম কাসানি (মৃ. ৫৮৭ হি.) তাঁর বাদাইউস সানাই গ্রন্থে বলেছেন যে পথে নিরাপত্তার অভাব হজের ফরজ হওয়াকে বাতিল করে। মালিকি ফকিহরা দীর্ঘ পথে ডাকাতির ঝুঁকির কারণে হজের বাধ্যবাধকতা স্থগিত করার ফতোয়া দিয়েছিলেন। ইবনে রুশদ (জাদ্দ) (মৃ. ৫২০ হি.) ও তুরতুশি (মৃ. ৫২০ হি.) বলেছেন যে পথের ঝুঁকি হজকে নিষিদ্ধ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।

 আল–জাজিরা ডট নেট অবলম্বনে

পর্ব-২: হজের ইতিহাসে মহামারি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ

পর্ব-১: হজের ইতিহাসে রাজনৈতিক ঘটনাচক্র

আরও পড়ুনসহজ ওমরাহ ৩০ জানুয়ারি ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ