‘হিন্দুত্ববাদী’ ও ‘ইসলামি’ দুটি দেশের সম্পর্কের রসায়ন
Published: 11th, January 2025 GMT
অতীতের মতোই আফগানিস্তানের উন্নয়নের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে দিল্লি প্রস্তুত। ভারত ও আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রসচিবদের এক বৈঠকের পর গতকাল বুধবার জানিয়েছে ভারত। দুবাইতে বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এদিন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি ও আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলভি আমির খান মুত্তাকির মধ্যে একটি বৈঠক হয়।
এ বৈঠকে ভারত জানায়, আফগানিস্তানের উন্নয়নে শামিল হতে দিল্লি প্রস্তুত। বিবৃতির ভাষায়, ‘পররাষ্ট্রসচিব আফগান জনগণের সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব এবং দুই দেশের জনগণের শক্তিশালী যোগাযোগের কথা তুলে ধরেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আফগান জনগণের জরুরি উন্নয়নমূলক প্রয়োজনে সাড়া দেওয়ার জন্য ভারতের প্রস্তুতির ওপর জোর দেন।’ দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ প্রতিনিধিদের মধ্যে এটিই প্রথম আনুষ্ঠানিক ও ঘোষিত বৈঠক।
আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে আফগানিস্তান থেকে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী দেশে ফিরে যায়, তখন ভারত প্রবল দ্বিধা ও উদ্বেগের মধ্যে ছিল। আফগানিস্তান নিয়ে ভারতের নীতি কী হবে, তা নিয়ে ছিল এ উদ্বেগ। একদিকে আফগানিস্তানে ভারতের সরকার ও বেসরকারি শিল্পপতিদের যে বিনিয়োগ আছে তা এবং সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো বাঁচানোর একটা তাগিদ ছিল; অন্যদিকে তালেবান নেতৃত্বাধীন ইসলামি আমিরাতের সরকারের সঙ্গে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকারের সম্পর্কের চরিত্র কী হবে, তা নিয়ে সরকার ও বিজেপির মধ্যেই ছিল নানান আলোচনা ও মতবিরোধ।
আফগানিস্তানের এই সরকারে এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা সরাসরি আল–কায়েদার সঙ্গে একসময় সম্পৃক্ত ছিলেন।
চীনের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্কের ক্রমে উন্নতি হচ্ছে। শুধু কূটনৈতিক নয়, ব্যবসায়িক স্তরেও তাদের সম্পর্ক ক্রমে দৃঢ় হচ্ছে।
কিন্তু এই সময়পর্বে (২০২১-২৪) দেখা যায়, চীনের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্কের ক্রমে উন্নতি হচ্ছে। শুধু কূটনৈতিক নয়, ব্যবসায়িক স্তরেও তাদের সম্পর্ক ক্রমে দৃঢ় হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ভারতও ধীরে ধীরে আফগানিস্তানের তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা শুরু করে।
মনে রাখা প্রয়োজন, আফগানিস্তানের এই সরকারে এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা সরাসরি আল–কায়েদার সঙ্গে একসময় সম্পৃক্ত ছিলেন। ফলে অন্য অনেক দেশের মতোই ভারত এখনো কাবুলে তালেবান শাসনকে স্বীকৃতি দেয় না। তালেবান ক্ষমতা দখলের পরে ভারত তার সব কূটনীতিককে প্রত্যাহার করে। কিন্তু এক বছর পর ২০২২ সালের জুনে ভারত তার কূটনৈতিক অফিস আবার চালু করে এবং একটি দল সেখানে মোতায়েন করে কাবুলে তার আনুষ্ঠানিক উপস্থিতি আবার প্রতিষ্ঠা করে।
এর প্রধান কারণ, ইসলামি আমিরাতের সরকারকে চীনের স্বীকৃতি থেকে ভারত বুঝতে পারে, অতীতে তাদের যারা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী বলেছে, তাদের সঙ্গে আলোচনায় না বসাটা এখন বড় ধরনের ভুল হবে। গোটা ২০২৩-২৪ সালে এ লক্ষ্যে কাজ করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ফল ফলতে শুরু করে গত নভেম্বরেএর ফলে গত নভেম্বর মাসের শেষের দিকে পশ্চিম ভারতের মুম্বাইয়ে আফগানিস্তানের অন্যতম কনস্যুলেট অফিসে অস্থায়ী কনসাল জেনারেল হিসেবে একরামউদ্দিন কামিল নামের এক ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছে ইসলামি আমিরাতের সরকার। কামিল ভারত সরকারের বৃত্তি পেয়ে দিল্লিতে অবস্থিত সাউথ এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে পিএইচডি করছেন।
নভেম্বর মাসের গোড়ায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাকিস্তান-আফগানিস্তান-ইরান বিভাগের দায়িত্বে থাকা যুগ্ম সচিব জে পি সিং কাবুলে গিয়ে ইসলামি আমিরাতের অস্থায়ী প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লা মহম্মদ ইয়াকুবের সঙ্গে দেখা করেন। মহম্মদ ইয়াকুব আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক ইতিহাসের প্রধান জাতীয় নায়ক মোল্লা মহম্মদ ওমরের সন্তান। ২০১৩ সালে মৃত্যু হয় মোল্লা ওমরের। কিন্তু সে দেশে তিনি এক কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন।
২০২১ সালে যুদ্ধে জয়ের পর তাই এখন মোল্লা ওমরকে জাতীয় নায়কের সম্মান দিচ্ছে আফগানিস্তান এবং তাঁর ছেলের সঙ্গে বৈঠক করতে হচ্ছে ভারতকে। জে পি সিং কাবুলে আমির খান মুত্তাকি এবং আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গেও বৈঠক করেন।
পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকএরপরই বুধবার মিশ্রি বৈঠক করলেন মুত্তাকির সঙ্গে। বৈঠক শেষে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। এ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ভারত আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তা প্রসারিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারত এ পর্যন্ত ৫০ হাজার মেট্রিক টন গম, ৩০০ টন ওষুধ, ভূমিকম্প–পরবর্তী পরিস্থিতিতে ২৭ টন ত্রাণ সহায়তা, ৪০ হাজার লিটার কীটনাশক, ১০ কোটি পোলিও টিকার ডোজ, ১৫ লাখ ডোজ কোভিড টিকা, মাদকাসক্তি ছাড়ানোর ১১ হাজার সামগ্রী ছাড়াও শীতবস্ত্র ও শিশুদের বিভিন্ন সামগ্রী পাঠানো হয়েছে।
স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে উন্নয়নের লক্ষ্যে এবং বিশেষত শরণার্থীদের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে ভারত সেখানে বড় ভূমিকা আগামী দিনে রাখতে চলেছে বলে জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ক্রিকেটের উন্নতিতেও ভারত আফগানিস্তানের পাশে দাঁড়াবে। এ ছাড়া বিবৃতিতে বলছে, আফগানিস্তানের জন্য মানবিক সহায়তার উদ্দেশ্যসহ বাণিজ্য ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে সহায়তার জন্য চাবাহার বন্দর ব্যবহারের বিষয়েও সমঝোতা হয়েছে।
বিবৃতির শেষ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আফগানিস্তান ভারতের নিরাপত্তার উদ্বেগের প্রতি তার সংবেদনশীলতার কথা জানিয়েছে। উভয় পক্ষ বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে চলার ব্যাপারে একমত হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত রাখতেও তারা সম্মত হয়েছে।
পাকিস্তান-আফগানিস্তান সম্পর্কের অবনতিতাৎপর্যপূর্ণভাবে আজ থেকে সাড়ে তিন বছর আগে আফগানিস্তান থেকে যখন যুক্তরাষ্ট্র বিদায় নিয়েছিল, সে সময় পাকিস্তানের প্রধান গোয়েন্দা বিভাগ আইএসআইয়ের (ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স) মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়েজ হামিদ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন।
গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে পূর্ব আফগানিস্তানে পাকিস্তানের বিমান হামলায় ৪৬ জন মারা গেছেন। নতুন বছরের শুরুতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর অন্তত ১২ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে উত্তর-পশ্চিম খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে। এর জন্য আফগান জঙ্গিদের দায়ী করছে পাকিস্তান। পাকিস্তান বলছে, তারা বাধ্য হয়েই মারছে জঙ্গিদের (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান ও আফগান তালেবান)।
আফগানিস্তানের বক্তব্য, পাকিস্তান জঙ্গি নিধনের নামে হত্যা করছে সাধারণ মানুষকে। বলাই বাহুল্য, সম্পর্কের দ্রুত অবনতি হয়েছে গত কয়েক মাসে এবং এখনো হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যবর্তী প্রায় ২ হাজার ৭০০ কিলোমিটার সীমান্তের বড় অংশই কার্যত যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
পাকিস্তানের বর্তমান সমস্যা অনেকটাই সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান ছাড়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যার মতো। আফগানিস্তানে আধুনিক জঙ্গিবাদ যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি) এবং আইএসআইয়ের সমঝোতার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের বিদায়ের (১৯৮৯) পর এই জঙ্গিবাদ ধীরে ধীরে আমেরিকা ও ইউরোপের বিরুদ্ধে কাজ করতে শুরু করে।
পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অনেকটা সেই রকম। ওয়াশিংটন পোস্ট বুধবারের তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘পাকিস্তানের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বারবার একটা অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগটি হলো তারা ২০ বছর ধরে আফগান তালেবানদের আশ্রয় দিয়েছে এবং সহ্য করেছে।’ অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিভিন্ন সময় তালেবানের পাশে দাঁড়িয়েছে ইসলামাবাদ। আবার অনেক সময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাহায্যও নিয়েছে। ফলে এখন পাকিস্তানকে এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে। কারণ, পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু সমস্যার চরিত্র একই। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ থেকে আরও খারাপ হচ্ছে।
আল–কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব–কন্টিনেন্ট (একিউআইএস) নামে আল–কায়েদার দক্ষিণ এশিয়া শাখা বাংলাদেশ নিয়ে ১৫ ডিসেম্বর ৪১ পাতার যে পুস্তিকা বের করেছে, সেখানে তারা পাকিস্তানকে প্রবল আক্রমণ করে বলেছে, পাকিস্তান ১৯৭১ সালে এটা ভুলে গিয়েছিল যে ‘গায়ের রং, বর্ণ এবং নিজের মতাদর্শ একটি ভিন্ন জাতির ওপরে চাপিয়ে তাকে দমিয়ে রাখা যায় না’। এ কারণেই বাংলাদেশ বিদ্রোহ করেছিল ১৯৭১ সালে।
কিন্তু পাকিস্তানের ‘স্বল্পসংখ্যক বিত্তবান মানুষ এবং সেনাবাহিনীর জেনারেল’ সেই একই পদ্ধতিতে দেশ পরিচালনা করে চলেছেন। সশস্ত্র ইসলামি সংগঠন আল-কায়েদা ২০২৪ সালে বিভিন্ন লেখায় বারবার বলেছে, ‘পাকিস্তান এখন একাধারে আফগান এবং অন্যদিকে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সেটাই করছে, যা তারা ১৯৭১ সালে বাঙালি এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে করেছিল। এর ফলে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলে নিয়মিত সেনাবাহিনীর সদস্য এবং সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছেন।’
পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেছেন, ‘পাকিস্তানের ভবিষ্যতের জন্য আমাদের এক হয়ে এখনই কাজে নামতে হবে।’ অর্থাৎ, তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান ও আফগান তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াইকে আরও জোরালো করতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই এটা বোঝা যাচ্ছে যে আগামী দিনে ওই অঞ্চলে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাতের তীব্রতা আরও বাড়বে।
ঠিক সেই একই সময়ে ভারতের বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের কর্তারা নিয়মিত ইসলামি আমিরাতের নেতৃত্বের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন, সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, চেষ্টা করছেন অতীতের আল–কায়েদা ও বর্তমানে ইসলামি আইনে বিশ্বাসী জনপ্রতিনিধিদের হাত ধরার। কোথাকার জল এখন কোথায় গড়ায়, সেটাই দেখার।
চীন ও বাংলাদেশের ভূমিকাভারতের পর্যবেক্ষকদের মধ্যে যাঁরা সার্বিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে বিশ্বের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে মিলিয়ে দেখতে অভ্যস্ত, তাঁদের একাংশের ধারণা, ভারতের আফগানিস্তানের সঙ্গে সৌহার্দ্য এবং সহযোগিতা বাড়ানোর প্রধান কারণ চীন। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলোর অন্যতম চীন গত এক থেকে দুই বছরে আফগানিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা ১২৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে গেছে। আফগানিস্তানের পণ্য ১০০ শতাংশ করমুক্ত করে চীনের বাজারে প্রবেশের অনুমতিও দিয়েছে বেইজিং।
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ের পরে চীন প্রথম ‘সুপারপাওয়ার’ হিসেবে সেখানে রাষ্ট্রদূত পাঠিয়েছে এবং আফগান রাষ্ট্রদূতকে বেইজিংয়ে স্বাগত জানিয়েছে। ফলে কিছুটা বাধ্য হয়েই দিল্লিকে হাত মেলাতে হয়েছে এমন এক সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যাঁরা শরিয়তে বিশ্বাসী, জিহাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং বিশ্বব্যাপী ইসলামি ভ্রাতৃত্বের বোধকে বারবার তাঁদের লড়াইয়ের ভিত্তি হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ভারতের হিন্দুবাদী বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার এবং তার দিকনির্দেশক সংগঠন হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ নির্দিষ্টভাবে এই চিন্তাভাবনার যে ঘোর বিরোধী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তা সত্ত্বেও মোল্লা ওমরের ছেলের সঙ্গে হাত মেলাতে হচ্ছে ভারতের পররাষ্ট্রসচিবকে। অভ্যন্তরীণ সামাজিক-রাজনৈতিক নীতি এবং বিদেশনীতির মধ্যে যে বিরোধ, তা মাঝেমধ্যে প্রকাশ্যে এসে নির্দিষ্ট রাষ্ট্রকে একটা ঘোর অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে যে ফেলে দেয়, এটা তার ভালো উদাহরণ।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের গণ–অভ্যুত্থানকেও এই সখ্যের একটা কারণ হিসেবে দেখছেন। ভারতে সার্বিকভাবে মনে করা হচ্ছে, আগামী কিছু বছর বাংলাদেশে পাকিস্তানের প্রভাব বাড়বে। ভারতের সাবেক কূটনীতিক এবং পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন না যে এই প্রভাব স্থায়ী হবে। এর কারণ আগামী দিনে পাকিস্তানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়বে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানের প্রভাব যে কিছুটা বাড়বে, তা অনস্বীকার্য। এটা মাথায় রেখেই পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তের প্রধান শত্রু আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার লক্ষ্যে এগোতে চাইছে ভারত।
তবে এর পাল্টা যুক্তি হলো আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার লক্ষ্যে মোটামুটিভাবে ২০২৩ সাল থেকেই ভারত সক্রিয়। আর বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বিদায় নিয়েছে ২০২৪-এর আগস্টে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, ভারত কি আগেই কিছুটা আন্দাজ করছিল যে হাসিনা সরকার অদূর ভবিষ্যতে টিকবে না এবং পূর্ব ও পশ্চিম দুই সীমান্তেই একটা অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হবে? আর সে কারণে আফগানিস্তানের সঙ্গে আগেই সম্পর্ক উন্নত করার ওপর জোর দিয়েছিল?
ভারতের এক সাবেক কূটনীতিবিদের মতে, ‘এটা একটু কন্সপাইরেসি থিওরির (ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব) মতো শোনাচ্ছে। তবে সে যা–ই হোক, উপমহাদেশসহ এশিয়ার রাজনীতির পট যে দ্রুত পাল্টাবে, সেটা আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ের পরে স্বাভাবিকভাবেই ভারত বুঝতে পেরেছিল। আমার ধারণা, সেটা মাথায় রেখেই কাবুলের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে সচেষ্ট হয়েছিল দিল্লি।’
আপাতত তাই পাকিস্তানকে ‘এনগেজড’ রাখতে দিল্লির তাস শরিয়তনির্ভর ইসলামি রাষ্ট্র আফগানিস্তান।
●শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
আরও বিস্তৃত হয়েছে শ্রমিকের সংগ্রামের জমিন
মে দিবস। পৃথিবীর খেটে খাওয়া মানুষের দিন। ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে আট ঘণ্টা শ্রমদিবসের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন শ্রমিকেরা। পুলিশের গুলিতে বহু মানুষ প্রাণ হারান। কিন্তু সেই রক্তের বিনিময়েই কাগজে–কলমে হলেও প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমের মর্যাদা, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা, ন্যায্য মজুরি ও সংগঠনের অধিকার। একসময় এসব দাবিই রূপ নেয় আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের ভিত্তিতে।
কিন্তু ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে আমরা যখন এই দিনে ফিরে তাকাই, তখন প্রশ্ন আসে, এখনো কি সেই সব দাবি প্রাসঙ্গিক? নাকি সময় পাল্টে দিয়েছে সব? এখন তো কাজের ধরনই বদলে গেছে—একদিকে অটোমেশন, অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়যাত্রা। উৎপাদনের পদ্ধতি যেভাবে বদলেছে, তাতে পুরোনো ধরনের শ্রমিক যেন ক্রমে অদৃশ্য হয়ে পড়ছেন।
আজকের দুনিয়ায় পুঁজি এক ক্লিকে দেশান্তরিত হয়, কারখানা গড়ে ওঠে যেখানে মজুরি কম এবং আইনের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল। মানুষ এখন আর কেবল শ্রমিক নয়; তাঁদের বলা হচ্ছে ‘ফ্রিল্যান্সার’, ‘কন্ট্রিবিউটর’, ‘পার্টনার’, ‘ডেলিভারি ম্যান’। কিন্তু আসলে, এদের অনেকেই এক নতুন ধরনের দিনমজুর; যাঁদের নেই নিরাপত্তা, নেই সুনির্দিষ্ট অধিকার। কাজ করছেন তাঁরা—কখনো রাস্তায় খাবার পৌঁছে দিয়ে, কখনো কম্পিউটারে চ্যাটবট প্রশিক্ষণ দিয়ে, আবার কখনো অ্যালগরিদম পরিশোধনে; কিন্তু কেউই প্রাতিষ্ঠানিক কর্মী নন। তাঁরা জানেন না যে তাঁদের কাজের ফল কোথায় যাবে, কীভাবে ব্যবহৃত হবে।
এই ব্যবস্থার একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে অ্যামাজন। তাদের গুদাম ও সরবরাহ চেইনে রোবট, ড্রোন ও এআই প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। শ্রমিকেরা সেখানে নির্ধারিত সময়ের বেশি কাজ করতে বাধ্য হন, মেশিনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। অথচ যখন তাঁরা সংগঠিত হতে চান, তখন কোম্পানির বিরুদ্ধে ওঠে লবিং, বিরোধিতা, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ। ২০২৩ সালে অ্যামাজনের একাধিক গুদামে ইউনিয়ন গঠনের চেষ্টাকে রুখে দিতে কোম্পানিটি কোটি কোটি ডলার খরচ করে আইনি দল গঠন করে।
মে দিবস আজও জীবিত; কিন্তু তার সংগ্রামের মাঠ আরও বিস্তৃত হয়ে গেছে। তা এখন শুধু কারখানার ফটক নয়; সার্ভার রুমে, ডেটা সেন্টারে, কোড লাইনে, ক্লাউড সিস্টেমে। কিন্তু যেখানেই হোক শ্রমিক তো সে–ই, যাঁর শ্রমে পৃথিবী চলে, যাঁকে ছাড়া কিছুই চলে নাশুধু অ্যামাজন নয়, গোটা দুনিয়াতেই শ্রমের এক নতুন রূপ তৈরি হচ্ছে—ডিজিটাল ও প্ল্যাটফর্মভিত্তিক শ্রম। এই ব্যবস্থায় শ্রমিকেরা কাজ করেন উবার, ফুডপান্ডা, আপওয়ার্ক বা ফাইভারের মতো অ্যাপে যুক্ত হয়ে। অথচ তাঁদের নেই কোনো কর্মস্থল, নেই কর্মঘণ্টার নিশ্চয়তা, নেই অসুস্থতার ছুটি বা পেনশনের মতো সামাজিক সুরক্ষা। বাস্তবে তাঁরা একা, বিচ্ছিন্ন। প্রতিযোগিতার চাপে তাঁদের ঠেলে দেওয়া হয় অনিরাপত্তার ভেতর।
২০২৩ সালের একটি আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশের অন্তত ৮০% গিগ-ওয়ার্কার দিনে ১০ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। অথচ তাঁদের দুই-তৃতীয়াংশ মাস শেষে কোনো নির্দিষ্ট ন্যূনতম মজুরি পান না। গ্লোবাল গিগ ইকোনমির এই বাস্তবতা বাংলাদেশেও দৃশ্যমান। আমাদের শহরগুলোয় এখন হাজারো বাইক বা সাইকেলচালক কাজ করছেন খাবার কিংবা পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য, কিন্তু তাঁরা কেউই প্রাতিষ্ঠানিক কর্মী নন।
এর পাশাপাশি আরও একটি বড় পরিবর্তন এনেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান। প্রশ্ন উঠেছে, এআই কি শ্রমিকের বন্ধু, না প্রতিদ্বন্দ্বী? যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার এক গবেষণা অনুযায়ী, আগামী ৫ বছরে এআই কমপক্ষে ৮০ কোটি মানুষের কাজের ধরন পাল্টে দেবে। এর মধ্যে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ সম্পূর্ণভাবে কাজ হারাতে পারেন। হোয়াইট-কলার পেশাগুলো যেমন হিসাবরক্ষণ, গ্রাহকসেবা, এমনকি সাংবাদিকতার কাজও এই প্রযুক্তির কারণে সংকটে পড়ছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০২৩ সালের ‘দ্য ফিউচার অব জবস’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৮ কোটি ৫০ লাখ কাজ হারিয়ে যাবে প্রযুক্তি ও অটোমেশনের কারণে। তবে একটা মৌলিক প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। যদি উৎপাদিত পণ্যের খরিদ্দার না থাকে, তাহলে উৎপাদন করে কীভাবে মুনাফা আসবে? আর শ্রমিক না থাকলে কিনবে কে? তবে একই সময়ে ৯ কোটি ৭০ লাখ নতুন ধরনের কাজের সৃষ্টি হতে পারে। কাজগুলো হবে ডেটা অ্যানালিটিকস, প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালনা এবং সৃজনশীল ও মানবিক দক্ষতানির্ভর কাজ। এই নতুন শ্রমিকদের অবস্থার কথা ওপরে বলা হয়েছে।
কিন্তু এই নতুন কাজের মালিকানা কার হাতে? শ্রমিকদের নয়, রাষ্ট্রেরও নয়—এই ক্ষমতা এখন করপোরেট অলিগার্কদের হাতে কেন্দ্রীভূত। যুক্তরাষ্ট্রে ইলন মাস্ক, জেফ বেজোস, মার্ক জাকারবার্গদের মতো প্রযুক্তি ধনকুবেররা শুধু প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রকই নন, তাঁরা রাজনীতিতেও সরাসরি প্রভাব ফেলছেন। করপোরেট লবিংয়ের মাধ্যমে আইন তৈরির পেছনে তাঁদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে; যেমন ট্যাক্স ছাড়, শ্রম আইন শিথিলকরণ বা প্রতিযোগিতা নীতির ধ্বংস।
বাংলাদেশেও দৃশ্যপট খুব আলাদা নয়। তৈরি পোশাকশিল্পে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যাঁরা দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতের ভিত্তি। কিন্তু তাঁরা এখনো ন্যূনতম মানবিক মজুরি পান না। গত বছর শ্রমিকেরা ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা মজুরি চাইলেও সরকার তা নামিয়ে ১২ হাজারে নিয়ে আসে। আন্দোলনের জবাবে আসে পুলিশি দমন, ধরপাকড়, ভয়ের পরিবেশ। মালিকেরা নতুন প্রযুক্তি বসিয়ে আরও কম শ্রমিক দিয়ে আরও বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করবেন। আগে–পরে এটা অবধারিত।
এই প্রেক্ষাপটে মে দিবস আজ আমাদের সামনে এক নতুন প্রশ্ন তোলে—শ্রমিক আসলে কে? তাঁর অধিকার কী? আর লড়াইটা কিসের জন্য?
যদি শ্রমিকের সংজ্ঞাই বদলে যায়, তাহলে লড়াইয়ের রূপও কি পাল্টাতে হবে না? একসময়ের আট ঘণ্টার কাজের দাবি এখন হয়তো পুরোনো মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে বহু মানুষ এখনো দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করছেন। কেউ কাজ পাচ্ছেন না, কেউ কাজ করেও মাস শেষে ঠিকমতো পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। কেউ এমন এক ধরনের ডিজিটাল শ্রম করছেন, যার নিয়ন্ত্রণ বা মালিকানা তাঁর নয়, তিনি জানেনই না যে কার জন্য কাজ করছেন।
তাই আজ মে দিবস শুধু অতীত স্মরণের দিন নয়—এটি ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনারও দিন। এটি নতুন ধরনের দাবির জায়গা—ডিজিটাল শ্রমের স্বীকৃতি, গিগ-ওয়ার্কারদের অধিকার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে জনসাধারণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি। আর অবশ্যই আমাদের মতো দেশে গায়ে খাটা শ্রমের ন্যায্য মজুরির দাবি।
মে দিবস আজও জীবিত; কিন্তু তার সংগ্রামের মাঠ আরও বিস্তৃত হয়ে গেছে। তা এখন শুধু কারখানার ফটক নয়, সার্ভার রুমে, ডেটা সেন্টারে, কোড লাইনে, ক্লাউড সিস্টেমে। কিন্তু যেখানেই হোক, শ্রমিক তো সে–ই, যাঁর শ্রমে পৃথিবী চলে, যাঁকে ছাড়া কিছুই চলে না।
এই সত্য যত দিন থাকবে, মে দিবস তত দিন থাকবে; নতুন প্রশ্ন নিয়ে, নতুন লড়াই নিয়ে।
জাভেদ হুসেন প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী