দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে চলনবিলের মিঠাপানির মাছ দিয়ে শুঁটকি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার বড় পাঙ্গাসি গ্রামের কবির শেখ (৪৮)। প্রতিবছর কার্তিক মাসে শুরু হওয়া শুঁটকি মৌসুমে তাঁর চাতালে ৩০ থেকে ৪০ নারী শ্রমিক কাজ করেন। তবে হঠাৎ বাজারে শুঁটকির দরপতনের কারণে এবার বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছেন তিনি। বর্তমানে তাঁর চাতালে মাত্র ১২ নারী শ্রমিক কর্মরত আছেন।
কবির শেখ বলেন, ‘হেই জ্ঞান অওয়ায় পর থাইক্যা প্রায় ৩০ বছরের বেশি সময় আগে বাবার আত (হাত) দইরা এই হুটকি (শুঁটকি) বানানের ব্যবসায় আইছি। এ্যাহুন এই ব্যবসা থাইক্যাই আমার পরিবারসহ আশপাশের অন্তত ৩৫ থেকে ৪০টি পরিবার চলে। এই লম্বা সময়ে কহুনও আমি হুটকির বাজার এমন খারাপ দেহি ন্যাই। এবারই প্রথম হুটকি বানায়া বড় অঙ্কের ট্যাহা লোকসান ওইছে। যদি এই হুটকি গুইল্যা রাহার মতো একটা গুদাম গর (ঘর) থাইকতো, তাইলে এই রহম লোকসানে পইড়তে অইতো না। এ অবস্থায় বেহেই ঋণগ্রস্ত অয়া হুটকির চাতাল বন্ধ কইরতে বাইদ্য (বাধ্য) ওইছেন।’
কবির শেখ বলেন, ‘প্রতিবছর কাতি (কার্তিক) মাসের প্রথম সপ্তাহ থাইক্যা হুটকি বানানের চাতাল শুরু অয়, চইত (চৈত্র) মাস পন্ত চলে। এ বছর বাজারে মাছ থাকায় গ্রামের মহাজনের কাছ থাইক্যা কিছু টেহা নিয়্যা বৈশাখ মাসেও চাতাল চালু রাখছিলাম।’
চাতালের শ্রমিকদের অবস্থাও শোচনীয়। চাকশা গ্রামের জয়নব খাতুন (৫২) বলেন, তাঁর স্বামী অসুস্থ, সংসারে আয় করার মতো কেউ নেই। দিনে ২০০ টাকা মজুরি পান, তাতেই কোনোমতে দিন চলে তাঁর।
একই গ্রামের ফিরুজা খাতুন (৪২) ও আলেয়া বেগম (৫২) বলেন, এই শুঁটকি মাছের চাতালে কাজ করে যে টাকা পান, তা দিয়েই তাঁদের পরিবার চলে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ১২ নারী শ্রমিক সেখানে কাজ করছেন। জেলেদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে আনা মাছ ধুয়ে আবর্জনা পরিষ্কার করা, মাছ কাটা ও শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকেরা। এর মধ্যে নারী শ্রমিকেরা বিলের তাজা টাকি মাছ কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে ধোয়ার পর লবণ মাখিয়ে মাচায় মেলে দিচ্ছেন। সকালে রোদে দেওয়া ভেজা মাছগুলোও কেউ কেউ এপিঠ–ওপিঠ উল্টে রাখছেন।
সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, চলনবিলের মিঠাপানির শুঁটকির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে এখানকার পুঁটি মাছের শুঁটকি ভারতেও জনপ্রিয়। চলনবিলের আয়তন ৮০০ বর্গমাইল, এটি চার জেলায় বিস্তৃত। বিল ছাড়া জেলার ১০টি নদী, অসংখ্য ডোবা–নালা–খাল থেকেও মাছ সংগ্রহ করে শুঁটকি তৈরি হয়। কিন্তু বাজার পরিস্থিতি ভিন্ন। এক মাস আগেও কারওয়ান বাজারে বড় পুঁটি মাছের শুঁটকি প্রতি কেজি ৭০০–৭৮০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৩৫০–৩৮০ টাকায়। মাঝারি ও ছোট আকারের শুঁটকির দামও প্রায় অর্ধেক কমেছে। এতে উৎপাদকেরা চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
শুঁটকি উৎপাদনকারী নুর মোহাম্মদ বলেন, এই অঞ্চলের মিঠাপানির মাছের স্বাদ বেশি। তাই ক্রমেই চলনবিলের শুঁটকির চাহিদা বাড়ছে। এ ছাড়া এখানকার শুঁটকি তৈরিতে লবণ ছাড়া অন্য কোনো রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয় না। তবে সংরক্ষণের জন্য গুদামের ব্যবস্থা না থাকায় চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে উৎপাদনকারীরা চরম লোকসানে পড়ছেন।
মৎস্য ব্যবসায়ী নওশের আলী জানান, অক্টোবর থেকে বিলের পানি কমতে শুরু করলে মাছ ধরার পরিমাণ বেড়ে যায়। তখন বেশি মাছ বাজারজাত করা সম্ভব না হওয়ায় একটি অংশ শুঁটকিতে রূপান্তর করা হয়। এতে চেলা, টাকি, শোল, চান্দা, পুঁটি, কই, চিংড়ি, রুই, কাতলাসহ নানা প্রজাতির দেশি মাছ ব্যবহৃত হয়।
শুঁটকি উৎপাদনকারী শাহ্ আলম বলেন, এই অঞ্চলে মাছ সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ জন্য তাঁরা সারা বছর শুঁটকি উৎপাদনের সুযোগ পাচ্ছেন না। যদি মাছ সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকত, তাহলে শুঁটকি উৎপাদনে তাঁরা বেশি লাভবান হতেন।
উল্লাপাড়া উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা আতাউর রহমান বলেন, এবার ৪০টির মতো চাতাল চালু ছিল। মাছের জোগানও ভালো ছিল। কিন্তু সীমান্ত জটিলতায় শুঁটকি ভারতে রপ্তানি না হওয়ায় বাজার পড়ে গেছে। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য এই অঞ্চলে শুঁটকি সংরক্ষণের জন্য গুদামের ব্যবস্থা থাকতে হবে। দাম কমলে সেখানে সংরক্ষণের পর দাম বাড়লে বাজারজাত করতে পারলে উৎপাদনকারীরা লাভবান হবেন। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে একটি প্রকল্প প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উৎপ দনক র ব যবস থ র ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
টেকসই অর্থনীতি গড়ে তুলতে প্রধান উপদেষ্টার পাঁচ প্রস্তাব
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে আরও কার্যকর অর্থায়নের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “চলুন আমরা এমন একটি মর্যাদা, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার অর্থনীতি গড়ে তুলি, যেখানে কেউ পিছিয়ে থাকবে না।”
এ বিষয়ে তিনি পাঁচটি অগ্রাধিকার তুলে ধরে বলেন, এগুলো কার্যকর করলে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য, বৈষম্য ও আর্থিক অস্থিরতার সমস্যা সমাধান সম্ভব হবে। অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, “আমাদের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর শোনার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। বাংলাদেশে আমরা বিশ্বাস করি দারিদ্র্য একজনের স্বপ্নের পথে বাধা হতে পারে না।”
বাসস লিখেছে, প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ‘টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্থিতিশীল বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রথম দ্বিবার্ষিক শীর্ষ সম্মেলন: টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে অর্থায়নের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়া তার জন্য গর্বের বিষয়, যেখানে সম্ভাবনা ও দায়িত্ব একসাথে রয়েছে। তিনি বলেন, চতুর্থ আন্তর্জাতিক অর্থায়ন সম্মেলনে নেওয়া অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য বছরে চার ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ ঘাটতি পূরণ করা চ্যালেঞ্জিং হলেও অপরিহার্য।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, "আমরা আমাদের ওপর নির্ভরশীল মানুষের কণ্ঠস্বর শোনার দায়িত্ব নিচ্ছি। বাংলাদেশে আমরা বিশ্বাস করি, দারিদ্র্য একজনের স্বপ্নের পথে বাধা হতে পারে না।”
তিনি বলেন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও সম্পদের ন্যায্য প্রবেশাধিকার হলো ন্যায়বিচারের মূল। একজন নারী যখন ব্যবসা শুরু করে, যুবসমাজ যখন সৌর শক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি পায়, বস্তিবাসী শিশু যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায় এবং পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা পায়, তখন পরিবর্তন বাস্তব ও টেকসই হয়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সেভিলে অঙ্গীকার একটি নতুন কাঠামো প্রদান করে, যা জোরদার করে দেশীয় সম্পদ উত্তোলন, অবৈধ অর্থ প্রবাহ প্রতিরোধ, উন্নয়ন ব্যাংকগুলোর ক্ষমতায়ন এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত করে।
তিনি পাঁচটি অগ্রাধিকারের কথা তুলে ধরেন, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্থায়নকে শক্তিশালী করবে:
১. ন্যায্যভাবে দেশীয় সম্পদ উত্তোলনে আন্তর্জাতিক সহায়তার সমর্থন থাকা প্রয়োজন। কর ব্যবস্থা প্রগতিশীল, স্বচ্ছ ও বহুজাতিক করপোরেশনগুলোর ন্যায্য অংশ নিশ্চিত করতে হবে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর সহযোগিতা কাঠামোর আলোচনায় এই বৈষম্য দূর করতে হবে।
২. নবীন অর্থায়ন ও সামাজিক ব্যবসা যৌক্তিক অর্থায়ন এবং এমন উদ্যোগ যারা লাভ পুনরায় সমস্যার সমাধানে বিনিয়োগ করে, চাকরি, অন্তর্ভুক্তি ও মর্যাদা নিশ্চিত করে।
৩. বিশ্ব আর্থিক কাঠামো ও ঋণ শাসন সংস্কার; উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আরো শক্তিশালী কণ্ঠস্বর নিশ্চিত করতে হবে। ঋণকে কঠোরতা নয়, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের হাতিয়ারে রূপান্তর করতে হবে।
৪. স্বচ্ছতা, অবৈধ অর্থায়ন প্রতিরোধ ও নাগরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; জনগণ, বিশেষ করে যুবসমাজ, জানতে হবে কীভাবে সম্পদ ব্যবহার হচ্ছে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. সবচেয়ে দুর্বলদের জন্য বিনিয়োগের ত্বরান্বিতকরণ; স্থিতিশীল বাসস্থান, জলবায়ু-বান্ধব কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান নিশ্চিত করতে হবে।
ঢাকা/রাসেল