শেরপুরের নালিতাবাড়ীর গারো পাহাড়ের কোলঘেঁষা গ্রামগুলোতে বইছে পরিবর্তনের হাওয়া। বনজ ও ফলদ গাছের ছায়ায় এত দিন ধরে পড়ে ছিল অব্যবহৃত জমি। সেসব জমিতে এখন চোখজুড়ানো কফিবাগান। শতাধিক কৃষক নিজেদের বাগানে লাগিয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার কফিগাছ। গাছে ধরছে থোকা থোকা লালচে কফি ফল। এই ফল সংগ্রহ করে রোস্টিংয়ের পর পৌঁছে যাচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে।

সীমান্তের গ্রামগুলোতে কফি চাষের মূল উদ্যোক্তা নালিতাবাড়ীর কৃষিবিদ সাজ্জাদ হোসেন। কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে বান্দরবানে দায়িত্ব পালনের সময় কফি চাষ দেখে অনুপ্রাণিত হন তিনি। পরে চাকরি ছেড়ে এলাকায় ফিরে স্থানীয় কৃষকদের নিয়ে কফি চাষ শুরু করেন।

সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকার মাটির আর্দ্রতা ও উর্বরতা শক্তি কফি চাষের উপযোগী।আবদুল ওয়াদুদ, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, নালিতাবাড়ী

কফির এই বাগানগুলো ছড়িয়ে আছে শেরপুরের নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী ৭টি ইউনিয়নের ২২টি গ্রামে। নিজের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সাজ্জাদ কৃষকদের কাছ থেকে কফির ফল সংগ্রহ করেন। কৃষি কার্যালয়ের সহায়তায় কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। কৃষকেরা বলছেন, এখান থেকে চাষ করা কফি যদি ঠিকমতো রপ্তানি করা যায়, তাহলে পাহাড়ি জনপদে কফিই হতে পারে টেকসই স্বপ্নের ফসল।

নালিতাবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল ওয়াদুদ প্রথম আলোকে বলেন, সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকার মাটির আর্দ্রতা ও উর্বরতা শক্তি কফি চাষের উপযোগী। এ অঞ্চলে ধারাবাহিক বৃষ্টিপাত ও মাটির গঠনবিন্যাস মিলে কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

যেভাবে চারা প্রস্তুত

বছর চারেক আগে নালিতাবাড়ীর খালভাঙা এলাকায় সাজ্জাদ হোসেন স্বল্প পরিসরে চারা উৎপাদন শুরু করেন। এখন তাঁর নিজস্ব ১২ একর জমিতে বছরজুড়ে কফির চারা প্রস্তুতের কাজ চলে। মূলত নভেম্বর মাসে চারা উৎপাদনের জন্য জমি প্রস্তুত করা হয়। বীজ রোপণের ২৮ থেকে ৪৫ দিনের ব্যবধানে পাতা গজায়। সেই সময় জমি ভিজিয়ে রাখতে হয়। চারা প্রস্তুত করতে ঠাণ্ডা ও রোদের প্রয়োজন হয়। এ সময় চারার ওপর পলিথিনের ছাউনি দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। পরে জমি থেকে সেই চারা পলিব্যাগে তোলা হয়। এ সময় চারা রোদ থেকে দূরে রাখতে হয়। এভাবে সাত মাস পলিব্যাগে রাখার পর কফির চারা ৬ থেকে ৭ ইঞ্চি লম্বা হয়। চারা লাগানোর তিন বছরের মধ্যেই ফল দেওয়া শুরু করে। চারা উৎপাদনে ২০ টাকা খরচ পড়ে। গত চার বছরে ৫০ হাজার কফিগাছ আগ্রহী চাষিদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণ করেছেন সাজ্জাদ হোসেন।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে জৈব প্রযুক্তিতে স্নাতকোত্তর করে কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন সাজ্জাদ হোসেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের রুমা উপজেলায় দায়িত্ব পালনকালে দার্জিলিং পাড়ায় কফি চাষ দেখে আগ্রহী হন। ২০২১ সালে পাঁচ কেজি কফি ফল সংগ্রহ করে নালিতাবাড়ীতে নিজেই চারা উৎপাদন শুরু করেন। চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি কফি চাষে মন দেন।

নালিতাবাড়ীর বেল তৈল গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা জালাল উদ্দিনের প্রায় দুই একর জমিতে মাল্টার বাগান রয়েছে। সেই বাগানে মাল্টা গাছের ফাঁকে ফাঁকে অব্যবহৃত জায়গায় ২০২২ সালে প্রায় ৮০০ কফি চারা রোপণ করেন। এসব গাছে এ বছর ফল ধরেছে। তাঁর বাগান থেকে প্রায় ৫০০ কেজি ফল বিক্রি করে তিনি ৭৫ হাজার টাকা পেয়েছেন।

কফি প্রস্তুত ও বাজারজাত

জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে কফিগাছে সাদা ফুল আসে। পরে সবুজ ফল পরিপক্ক হয়ে লাল হয়। নভেম্বর-ডিসেম্বরে ফল সংগ্রহ করে পেষণ যন্ত্রে চামড়া ছাড়ানো হয়, একেকটি ফল থেকে দুটি বিন পাওয়া যায়। ছয় কেজি তাজা ফল থেকে এক কেজি শাঁসযুক্ত বিন পাওয়া যায়। শাঁসযুক্ত ১ কেজি বিন প্রক্রিয়াজাত করে ৮৫০ গ্রাম রোস্টেড বিন তৈরি হয়। প্যাকেটজাত এক কেজি রোস্টেড কফি দুই হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এই কফি ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, বগুড়া, কক্সবাজার, শ্রীমঙ্গল ও ঢাকার বিভিন্ন কফিশপে বিক্রি হচ্ছে।

কাজুবাদাম ও কফি চাষ উন্নয়ন, গবেষণা, সম্প্রাসারণ প্রকল্পের পরিচালক মো.

শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারে আমদানি করা অনেক ব্র্যান্ডের কফি রয়েছে। আমরা খেয়ে দেখেছি, গারো পাহাড়ের পাদদেশে চাষ করা কফি মানসম্মত।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর মকর ত প রস ত ত উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

কাছের মানুষ পাশে থাকলে কঠিন যুদ্ধেও জেতা যায়, তার প্রমাণ বিসিএস ক্যাডার মালিহা

মালিহার মা আসমা বেগমের কথা না বললেই নয়। জন্ম মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার কলমা গ্রামে। ঢাকায় বড় হয়েছেন। বেগম বদরুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন।

১৯৯৩ সালে জগন্নাথ কলেজে (সে সময় কলেজ ছিল, ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় হয়) ভর্তি হন। এর এক বছর পর তাঁর বিয়ে হয়ে যায়।

একঝটকায় ঢাকার শিক্ষার্থী থেকে ঝিনাইদহের হরিশংকরপুর ইউনিয়নের বাকড়ি গ্রামের গৃহবধূ হয়ে গেলেন। আসমা বেগমের খুব ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করার।

স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার পাট চুকে গেল। চাকরির স্বপ্নের সমাপ্তি। মালিহা তাঁর মাকে সারাটা জীবন কেবল অন্যের জন্য করে যেতে দেখেছেন। বিনিময়ে মা পেয়েছে কেবল উপেক্ষা আর অবহেলা।

নতুন জীবন নতুন সংগ্রাম

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরই বিয়ে হয়ে যায় মালিহার। বিয়েতে মালিহার মায়ের কেবল একটা অনুরোধ ছিল পাত্র ও তাঁর মা-বাবার কাছে—তাঁর কন্যার লেখাপড়ার যাতে কোনো ত্রুটি না হয়। বিয়ের পর মায়ের ইচ্ছায়, স্বামীর পরামর্শে মালিহা ভর্তি হন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন ঝিনাইদহ সরকারি ভেটেনারি কলেজে।

মালিহা এই কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী। তখন কলেজটি ছিল শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। বর্তমানে কলেজটি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

২০১৯ সালের মার্চে ইন্টার্ন চলাকালীন মা হন মালিহা। মা হয়েও ভালোভাবে পড়াশোনা শেষ করেন। তারপর সময় নষ্ট না করে শুরু করেন চাকরির পড়াশোনা।

সারা জীবন কেবল চেয়েছি মায়ের কষ্টের ভাগ নিতে। কী করলে আমার মা একটু স্বস্তি পাবে। আমার স্বামী সব সময় আমার পাশে ছিলেন। আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। বলেছেন, “তুমি কেবল আবেগ নিয়ে কখনোই মায়ের পাশে দাঁড়াতে পারবা না। এ জন্য তোমার পায়ের নিচের মাটি শক্ত হতে হবে।” আমাকে আরও বলত, “আমার মতো স্টুডেন্টের যদি সরকারি চাকরি (ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার) হয়, তোমার কেন হবে না। তুমি আমার চেয়ে বেশি যোগ্য, বেশি পরিশ্রমী, তোমার আরও ভালো চাকরি হবে।”মুলকে সাদ মালিহা, লাইভস্টক ক্যাডার, ৪৪তম বিসিএসযে কান্না আনন্দের

মালিহার মামি শিক্ষা ক্যাডার হন। সে সময় থেকে তাঁর রঞ্জু মামা তাঁকে বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেন। মালিহা ২০২০ সাল থেকে চাকরির পড়াশোনা শুরু করেন। ২০২৫ সালে এসে প্রথম সরকারি চাকরি পান। যোগ দেন সরকারি ব্যাংকের অফিসার পদে।

এর কিছুদিন পর ৩০ জুন ৪৪তম বিসিএসের ফল প্রকাশ করে। তবে তখন ক্যাডার পদ আসেনি মালিহার। বেশ হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন।

লাইভস্টক ক্যাডারে ৬৮জন ‘রিপিট ক্যাডার’ ছিল। সেসব পুনর্মূল্যায়ন করে আবার যখন ৬ নভেম্বর নতুন ফল প্রকাশ করা হয়, তাতে নাম আসে মালিহার। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নপূরণ হয় তাঁর।

মালিহার মা আসমার নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন যেন মেয়ের ভেতর দিয়ে সত্য হয়ে ধরা দেয়। মালিহা যখন চাকরির সুখবর জানাতে মাকে ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে ‘আম্মুউউউ’ বলে একটা চিৎকার দিয়েছেন, মা আসমা বেগম ভয়েই অস্থির! নিশ্চয়ই মেয়ের কোনো বিপদ হয়েছে। এরপরই শুনলেন খবরটা। মা-মেয়ে দুজনেই ফোনের দুই পাশে কাঁদছেন, যে কান্না আনন্দের, প্রাপ্তির, সফলতার।

মামির শাড়ি আর ব্লেজার পরে বিসিএসের ভাইভা দিয়েছেন মালিহা

সম্পর্কিত নিবন্ধ