ই-কমার্স অর্থনীতি বাজেটে অগ্রাধিকারের সময় এখন
Published: 5th, May 2025 GMT
বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের অর্থনীতির স্বপ্ন বাস্তবায়নে অগ্রসর, তখন সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাতগুলোর একটি হলো ই-কমার্স। এই খাতের উদ্যোক্তা, কর্মসংস্থান, প্রযুক্তিনির্ভরতা ও বৈশ্বিক বাজার সংযোগ—সব মিলিয়ে এটি এখন আর বিকল্প নয়, বরং নতুন অর্থনীতির কেন্দ্রে চলে এসেছে। এ কারণে এই মুহূর্তে ‘ই-কমার্স অর্থনীতি’ ধারণাটিকে জনপ্রিয় করা ও বাজেট প্রণয়নে সেই আলোকে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।
ভিশন ২০৩০ ও ই-কমার্স অর্থনীতি
ভিশন ২০৩০-এ বাংলাদেশের লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল অর্থনীতি, কর্মসংস্থান বাড়ানো, তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করা ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নতুন খাত তৈরি। এই প্রতিটি লক্ষ্য পূরণে ই-কমার্স হতে পারে একটি প্রধান সহায়ক খাত। তাই বাজেট প্রস্তাবনায় ই-কমার্সকে একটি আলাদা অর্থনৈতিক খাত হিসেবে বিবেচনা করা দরকার—আমরা একে বলছি ই-কমার্স অর্থনীতি।
বর্তমান বাস্তবতা ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত
বাংলাদেশে প্রায় ৮০ হাজারের বেশি ই-কমার্স ও এফ-কমার্স ব্যবসা চলছে, যার বড় অংশ তরুণ ও নারী উদ্যোক্তা পরিচালনা করছেন (সূত্র: বেসিস ও ই-ক্যাব)। এই খাত থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৫-৬ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে (আঙ্কটাড ২০২৩)। ২০২২ সালে দেশের ই-কমার্স খাতের আকার দাঁড়ায় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা (বিটিআরসি ও গুগলের যৌথ প্রতিবেদন)।
ভারত ২০২৩ সালে ই-কমার্স থেকে ৮ হাজার ৩০০ কোটি ডলার এবং ভিয়েতনাম ১ হাজার ৪৫০ কোটি ডলার আয় করেছে। তাদের বাজেটে ই-কমার্স স্পেসিফিক সাবসিডি ও ফাইন্যান্স স্কিম রাখা হয় (সূত্র: বিশ্বব্যাংক ২০২৩)। বাংলাদেশে এখনো কোনো স্টার্টআপ তহবিল, কর ছাড় অথবা স্কিল সাপোর্ট নেই, যা ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা।
বাজেট ২০২৫-২৬: ই-কমার্স খাতের জন্য ৫টি বাস্তবভিত্তিক দাবিস্টার্টআপ ইনসেনটিভ ও ডিজিটাল ঋণ—ভারতীয় এসআইডিবিআইয়ের মতো মডেলে তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য কোল্যাটারাল-ফ্রি ই-কমার্স ব্যবসা ঋণ।
মাইক্রো উদ্যোক্তাদের জন্য ভ্যাট ছাড়/সহজ নিবন্ধন—টার্নওভার কর ২-৩ শতাংশ করে সহজ রিটার্ন পদ্ধতি চালু।
ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স রপ্তানি সহায়তা—কাস্টমস ডিজিটালাইজেশন, রপ্তানি কোড ও রপ্তানিকারক স্বীকৃতি।
ই-কমার্স দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প—প্রতিবছর ১ লাখ উদ্যোক্তা ও কর্মীকে শপিফাই, ডিজটাল লজিস্টিকস, প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফি ইত্যাদিতে প্রশিক্ষণ।
লেনদেন নিরাপত্তা ও ডিজিটাল লেনদেন প্রণোদনা—ডিজিটাল লেনদেনে ২ শতাংশ প্রণোদনা ও সাইবার ঝুঁকি মোকাবিলায় নিরাপত্তা বৃদ্ধি।
ই-কমার্সে দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ প্রস্তাব
শপিফাই বা ওয়েবসাইট তৈরি, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম বিপণন, প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফি ও মোবাইল এডিটিং, কাস্টমার সার্ভিস ও বিক্রয় যোগাযোগ, গুগল অ্যাডস ও সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (এসইও), ডিজিটাল লজিস্টিকস ও ফুলফিলমেন্ট, ইনভেনটরি ও অর্ডার ম্যানেজমেন্ট, ডেটা অ্যানালিটিকস ফর ই-কমার্স, অ্যামাজন, এটসি ও ইবে লিস্টিং ও ফুলফিলমেন্ট, ক্রস-বর্ডার ট্যাক্স ও কাস্টমস প্রসেসিং, পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবস্থাপনা ও রিফান্ড পলিসি, বিজনেস লাইসেন্সিং ও বিডিআইডি প্রসেস, ই-কমার্স আইন ও গ্রাহক অধিকার, উদ্যোক্তা শিক্ষা ও বিজনেস মডেলিং, গ্লোবাল মার্কেটপ্লেস আর্কিটেকচার ও অপারেশনস, প্রোডাক্ট ক্যাটালগ ম্যানেজমেন্ট ও মাল্টি-লিঙ্গুয়াল লিস্টিং, গ্লোবাল প্রাইসিং ও এক্সচেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি, কোয়ালিটি কন্ট্রোল ও স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন, ওয়্যারহাউস ও ইনভেনটরি অটোমেশন, স্মার্ট প্যাকেজিং ও সাসটেইনেবল শিপিং, রিটার্নস ও রিভার্স লজিস্টিকস, ক্রস-বর্ডার এক্সপোর্ট ডকুমেন্টেশন ও এইচএস কোড ব্যবস্থাপনা, ফ্রড ডিটেকশন ও রিস্ক মনিটরিং, কনজ্যুমার প্রটেকশন ও ডিজিটাল ল’কমপ্লায়েন্স, গ্লোবাল ডিজিটাল মার্কেটিং (এসইও, এসইএম, ই-মেইল, অ্যাফিলিয়েট), ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং ও সোশ্যাল কমার্স, ট্রাস্ট বিল্ডিং ও রেপুটেশন ম্যানেজমেন্ট, কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স অ্যানালিটিকস, লয়ালটি স্ট্র্যাটেজি ও ই-কমার্স সিআরএম, বিজনেস ইন্টেলিজেন্স ও ড্যাশবোর্ডিং, ভেন্ডর ম্যানেজমেন্ট ও স্ট্র্যাটেজিক সোর্সিং এবং ওমনিচ্যানেল ও ডিটুসি (ডাইরেস্ট টু কাস্টমার) এক্সিকিউশন।
এই মুহূর্তে যখন দেশের বাজেট প্রণয়নের প্রক্রিয়া চলছে, তখন ই-কমার্স খাতকে শুধু করযোগ্য নয়, নীতিসহায়ক ও প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে। ই-কমার্স অর্থনীতি যদি আজ বাজেটে জায়গা না পায়, তবে আমরা শুধু একটি সম্ভাবনাকে হারাবো না; বরং ভবিষ্যতের প্রবৃদ্ধির দিকটাই উপেক্ষা করব।
ড.
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ই কম র স অ র জন য ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
বিশ্বে বাংলাদেশি শরণার্থী পাঁচ বছর ধরে বাড়ছে
বিশ্বের নানা দেশে বাংলাদেশের নাগরিকদের শরণার্থী হওয়ার সংখ্যা বেড়ে চলেছে। গত পাঁচ বছরে, অর্থাৎ ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর বিশ্বের নানা প্রান্তে বাংলাদেশিদের শরণার্থী হওয়ার সংখ্যা বাড়ার হার ঊর্ধ্বমুখী। ২০২৪ সালে ২৮ হাজার ৪৭৩ জন বাংলাদেশি জাতিসংঘের কাছে শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন। একই বছর ১ লাখ ৮ হাজার ১৩১ বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। বাংলাদেশিদের সিংহভাগই ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলোতে নিজেদের শরণার্থী ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে নিবন্ধিত করেছেন।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের লোকজনের শরণার্থী ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হওয়ার সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এসব বাংলাদেশি নিজেদের শরণার্থী ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে ইউরোপের দেশ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালির পাশাপাশি ফিনল্যান্ড, জর্জিয়া, সাইপ্রাস, বসনিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোতেও নিবন্ধন করেছেন। আর উত্তর আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার পাশাপাশি দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, কোস্টারিকা, ইকুয়েডর, পাপুয়া নিউগিনির মতো দেশগুলোতে শরণার্থী ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে নিবন্ধিত করেছেন। এশিয়ার মধ্যে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, হংকংয়ের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডেও বাংলাদেশিরা নিবন্ধিত হয়েছেন। এমনকি ২০২৪ সালে পূর্ব আফ্রিকার দেশ সোমালিয়াতেও ৬ জন বাংলাদেশি নিজেকে শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত করেছেন।
সরকারি কর্মকর্তাদের মতে, বাংলাদেশিদের সিংহভাগই উন্নত জীবনের আশায় ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলোতে পাড়ি জমিয়ে নিজেদের শরণার্থী ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে নিবন্ধন করেছেন। শরণার্থী বা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করতে গেলে নিজ দেশে জীবনের ঝুঁকি থাকতে হয়। আবেদনকারী বাংলাদেশিদের বেশির ভাগই ওই সময়কালে (২০২০–২৪) দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছেন। তবে যাঁরা শরণার্থী হয়েছেন, তাঁদের একটি অংশ প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিকভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
তবে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তথ্যে যে চিত্র উঠে এসেছে, তাতে দেখা যায়, এদের বেশির ভাগই সুযোগসন্ধানী বা পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়েছেন। ২০২৩ সালে ২৪ হাজার ১২৬ বাংলাদেশি জাতিসংঘের কাছে শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন। এ ছাড়া ২০২২ সালে ২৩ হাজার ৯৩৫ জন, ২০২১ সালে ২২ হাজার ৬৭২ জন এবং ২০২০ সালে ১৮ হাজার ৯৪৮ জন বাংলাদেশি নিজেদের শরণার্থী দাবি করে জাতিসংঘের কাছে আবেদন করেন। পাশাপাশি ২০১৯ সালে শরণার্থী হিসেবে জাতিসংঘের কাছে বাংলাদেশিদের আবেদনের সংখ্যা ছিল ২২ হাজার ৭৬৬, ২০১৮ সালে ২১ হাজার ২২ এবং ২০১৭ সালে ১৬ হাজার ৭৮০।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাজে এক শ্রেণির তরুণদের ভেতরে যেকোনো পন্থায় বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা তীব্র হয়েছে। আর এ সুযোগই নিচ্ছে মানব পাচারকারী চক্র। গত কয়েক বছর অব্যাহতভাবে ভূমধ্যসাগরের লিবিয়া, তিউনিসিয়া ও ইতালির উপকূল থেকে বাংলাদেশের নাগরিকদের মৃত্যুর খবর নিয়মিত ঘটনা। ইউরোপগামী পাচারের বিভিন্ন রুট থেকে প্রতিনিয়তই উদ্ধার করা হচ্ছে বাংলাদেশের নাগরিকদের। পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে সবশেষ ইউক্রেন–রাশিয়ার যুদ্ধে বাংলাদেশের লোকজনের অংশগ্রহণ সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত ঘটনা। ইউরোপে উন্নত ভবিষ্যতের আশায় দেশ ছেড়ে যাওয়া লোকজন নিজেদের গন্তব্য দেখছেন এখন যুদ্ধের মাঠে। মানব পাচারকারীরা ইউরোপগামী লোকজনকে পাচার করে রুশ বাহিনীতে যুক্ত হতে বাধ্য করছে।
২০২৩ সালে ৭৫ হাজার ৮৬৭ জন বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। এ ছাড়া ২০২২ সালে ৬১ হাজার ২৯৮ জন, ২০২১ সালে ৬৫ হাজার ৪৯৫ এবং ২০২০ সালে ৬৪ হাজার ৬৩৬ জন বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। এ ছাড়া ২০১৯ সালে ৬২ হাজার ৮৬০ জন এবং ২০১৮ সালে ৬২ হাজার ৮৬০ জন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন।
কূটনীতিকেরা বলছেন, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী ও শরণার্থী হিসেবে বিদেশে চলে যাওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগই অর্থনৈতিক কারণে দেশ ছেড়েছেন। করোনা মহামারির সময় দেশে আয়ের সুযোগ কমে যাওয়া ও বৈধ পথে বিদেশে যাওয়া সংকুচিত হওয়ার পাশাপাশি ২০২৩ ও ২০২৪ সালে রাজনৈতিক সংঘাতময় পরিস্থিতিও এ প্রবণতা বাড়িয়েছে বলে তাঁদের মত।