বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে। কানাডা প্রবাসী মিডফিল্ডার শমিত সোম এখন অফিসিয়ালি বাংলাদেশের হয়ে মাঠে নামার সবুজ সংকেত পেয়েছেন বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার কাছ থেকে। বহু প্রতীক্ষিত এই অনুমোদনের ফলে আগামী মাসে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচেই বাংলাদেশের জার্সিতে হয়ে যেতে পারে তার আন্তর্জাতিক অভিষেক।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হলেও শমিত সোম বেড়ে উঠেছেন কানাডায়। পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ারে মূলত কানাডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে। সেখানকার ক্লাব কাভালরি এফসিতে খেলেই আলোচনায় আসেন তিনি। চলতি মে মাসের শুরুতেই তিনি কানাডা সকার অ্যাসোসিয়েশন থেকে ছাড়পত্র পান, যা ছিল বাংলাদেশের হয়ে খেলার জন্য প্রথম ধাপ। এরপর গত ৫ মে হাতে পান বাংলাদেশের পাসপোর্ট।

এই ধারাবাহিক প্রস্তুতির মাঝেই আসে সবচেয়ে বড় সুখবর, ফিফার কাছ থেকে আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশ প্রতিনিধিত্বের আনুষ্ঠানিক অনুমতি। যার অর্থ, এখন আর কোনও বিধিনিষেধ নেই। বাংলাদেশ জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপাতে শমিত একেবারে প্রস্তুত।

আরো পড়ুন:

কালবৈশাখী ঝড়ের পর আলোকস্বল্পতায় স্থগিত ফেডারেশন কাপের ফাইনাল

হামজা ও শমিতের পর লাল-সবুজের জার্সি পরতে যাচ্ছেন সান্ডারল্যান্ডের মিচেল

শুধু কাগজে-কলমেই নয়, মাঠের পারফরম্যান্সেও নিজেকে প্রমাণ করে চলেছেন শমিত। কাভালরির হয়ে গত ম্যাচে তিনি প্রথমবারের মতো অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পরে খেলতে নামেন। ইয়র্ক ইউনাইটেডের বিপক্ষে ২-১ গোলে জয় পাওয়া সেই ম্যাচে পুরো সময়জুড়ে সেন্ট্রাল মিডফিল্ড সামলান দৃঢ়তার সঙ্গে। যদিও গোল বা অ্যাসিস্টে নাম ওঠেনি। তবুও ম্যাচজুড়ে তার গেম রিডিং, বল কন্ট্রোল এবং ডিফেন্সিভ কভারেজ ছিল নজরকাড়া।

এমন পারফরম্যান্সের কারণেই সপ্তাহের সেরা একাদশে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। যা প্রমাণ করে— শুধু কোথায় খেলেন সেটা নয়, দক্ষতার কারণেই তিনি আজ জাতীয় দলের নজরে।

বাংলাদেশ জাতীয় দল এখন এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। এই সময় দলে একজন দক্ষ, পরিণত মিডফিল্ডারের সংযুক্তি দলের রক্ষণ ও আক্রমণের ভারসাম্যে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। শমিত সোম সেই ঘাটতি পূরণের বাস্তব সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছেন।

আগামী ১০ জুন সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ঢাকায় হতে যাওয়া হোম ম্যাচে তার অভিষেক নিয়ে রয়েছে প্রবল আশাবাদ। কোচিং স্টাফ থেকে শুরু করে সমর্থকরা তাকিয়ে আছেন নতুন এই মুখ কীভাবে দেশের ফুটবলে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারেন।

ঢাকা/আমিনুল

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ফ টবল ফ টবল

এছাড়াও পড়ুন:

পাহাড় থেকে পৃথিবীর পথে 

পিঠে থুরুং (ঝুড়ি) বাঁধা এক জুমিয়া নারী। মাথায় পাগড়ির বা শিরস্ত্রাণের মতো একটা ট্যাংক। ছবির পরিসরজুড়ে বিশালাকৃতির সেই নারীর চারপাশে বন্দুকধারী অসংখ্য ছায়ামূর্তি। তাদের আকৃতি নারীর তুলনায় বহুগুণ খর্বকায়। ট্যাংকের নল দিয়ে সেসব ছায়ামূর্তির ওপর পড়ছে পাতা আর ফুল।

শিল্পী জয়দেব রোয়াজা কালি ও কলমে এই ছবি এঁকেছিলেন ২০২৩ সালে। তাঁর অন্য সব ছবির মতোই এটিও পাহাড়ের সমকালীন অবস্থাই কেবল তুলে ধরে না; বরং তাকে ভীষণভাবে ছাপিয়ে যায়। বাস্তবতা পেরিয়ে জাদুবাস্তবতার সীমায় এসে দাঁড়ায়। মানুষের জীবন, সংগ্রাম আর প্রকৃতি সব ভেঙেচুরে কবিতার একটি পঙ্‌ক্তির ভেতরে যেন প্রবেশ করে।

১৯৭৩ সালে খাগড়াছড়ির খামারপাড়ার একটি ত্রিপুরা পরিবারে জন্ম জয়দেব রোয়াজার। মা নীহারিকা ত্রিপুরা আর বাবা হিরণ্ময় রোয়াজা। হিরণ্ময় মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে একটি হাসপাতালে চাকরি করতেন। শান্ত নিরিবিলি পাড়ার বাসিন্দা তাঁরা। পাহাড়, ঝিরি, ঝরনা আর জুমখেত দেখতে দেখতে বড় হওয়া। স্কুলে কবিতার বইয়ের ইলাস্ট্রেশন নকল করে খাতায় আঁকতেন। কবিতার চেয়ে ভালো লাগত ইলাস্ট্রেশন। শেষে এই ভালো লাগারই জয় হলো। বাংলাদেশের এই সময়কার এক উজ্জ্বল শিল্পী জয়দেব। তাঁর শিল্পকর্মের পরিচিতি ছড়িয়েছে সারা বিশ্বে। 

একনজরে জয়দেব

চারুকলার নতুন মাধ্যম পারফরম্যান্স আর্ট। জয়দেব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই এই মাধ্যমের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই ধারার শিল্পীরা নিজের শরীরকেই করে তোলেন ক্যানভাস। সঙ্গে থাকে নানা প্রকাশভঙ্গি। পারফরম্যান্স করতে গিয়ে ছবি আঁকা ছাড়েননি তিনি। চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের যেমন স্টোরিবোর্ড, তেমনি জয়দেবের পারফরম্যান্সের প্রতিটি ভঙ্গির ছবি আঁকা থাকে তাঁর স্কেচ খাতায়। এভাবেই দুই মাধ্যমকে যুক্ত করেছেন নিজের ধরনে। পাশাপাশি বড় ক্যানভাসেও ছবি আঁকেন। কালি ও কলমেই সিদ্ধহস্ত তিনি।

ভারতের কোচি বিয়েনাল, হংকং আর্ট বেজেল, অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে এশিয়া প্যাসিফিক ট্রায়েনিয়ালে অংশ নিয়েছেন তিনি। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ১১টির বেশি দেশে তিনি পারফরম্যান্স করেছেন। হয়েছে চিত্র প্রদর্শনীও। যুক্তরাজ্যের লন্ডনের টেট মডার্ন মিউজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট, চীনের হংকংয়ের এম প্লাস, ফ্রান্সের প্যারিসের ক্যাডিস্ট ফাউন্ডেশন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবির গুগেনহাইম, ভারতের নয়াদিল্লির কিরণ নাদার মিউজিয়ামসহ বিশ্বের খ্যাতনামা বহু জাদুঘরে তাঁর শিল্পকর্ম রক্ষিত আছে। বাংলাদেশে তাঁর শিল্পসংগ্রহ রয়েছে সামদানি আর্ট ফাউন্ডেশন এবং দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনে। শিল্পবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রকাশনা আর্ট রিভিউ এশিয়া, আর্ট নিউজ, ফোর্বস এবং ভারতীয় দৈনিক দ্য হিন্দু পত্রিকায় তাঁর শিল্পকর্মের সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। আবুধাবির গুগেনহাইম মিউজিয়াম জয়দেবের একটি শিল্পকর্ম বেশ ভালো দামে কিনে নিয়েছে। বর্তমানে তিনি মুম্বাইভিত্তিক ঝাভেরি কনটেমপোরারি গ্যালারির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। 

পাহাড় আর ঝিরির পথে পথে

খাগড়াছড়ি আর রাঙামাটির ঝিরি পথে বা কাপ্তাই হ্রদের নির্জনতায় সময় কাটে জয়দেব রোয়াজার। আন্তর্জাতিক খ্যাতি এলেও জীবন কাটান পাহাড়ি জুমিয়াদের মতো। কখনো মাছ ধরতে চলে যান জেলেদের সঙ্গে। আবার কখনো ঝিরি পথে হেঁটে হেঁটে দিন কাটে তাঁর। রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার কামিলাছড়ি গ্রামে নির্জন হ্রদের ধারে গড়ে তুলেছেন স্টুডিও। সেখানে সপ্তাহের দুই দিন কাটে তাঁর। পাহাড় ও পাহাড়ের মানুষজনকে নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা বুনে তোলেন ক্যানভাসে।

জয়দেব দেশের শিল্পীসমাজ ও শিল্পবোদ্ধাদের জগৎ থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করেন। তাঁর কথায়, ঢাকা তাঁকে কখনো টানে না। দু-এক দিন ঢাকা বা দেশের বাইরে থাকলে হাঁপিয়ে ওঠেন। ভাবেন, কখন ফিরবেন পাহাড়ে। 

সম্প্রতি কামিলাছড়িতে তাঁর স্টুডিওতে গিয়ে দেখা গেল আট ফুট দীর্ঘ একটি ক্যানভাসে কাজ করছেন তিনি। তিনতলা স্টুডিওর বারান্দায় এসে দাঁড়ালে অবারিত নীল হ্রদের হাতছানি। হ্রদের পাড়ে ঢেউখেলানো পাহাড়ের সারি। সেদিকে তাকালে আচ্ছন্ন হয়ে যেতে হয়। বারান্দায় বসে কথায় কথায় জানালেন নির্জন এই পাহাড়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে ছবি বিক্রির টাকায় এই স্টুডিও গড়ে তুলেছেন। স্ত্রী হাসনাহেনা পরশের সঙ্গে মিলে জঙ্গল পরিষ্কার করেছেন। একটাই চাওয়া, একটু আড়াল, একটু নির্জনতা। ছবি আঁকার জন্য এটুকু পরিসর চেয়েছেন জীবন থেকে। 

জয়দেব রোয়াজা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পাহাড় থেকে পৃথিবীর পথে