এবার উপাচার্যের বাসভবনের মূল ফটকে তালা, বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্নের হুঁশিয়ারি
Published: 7th, May 2025 GMT
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শুচিতা শরমিনের অপসারণের দাবিতে এবার তাঁর বাসভবনের মূল ফটকে তালা দিয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। আজ বুধবার দুপুরে নিরাপত্তাকর্মীদের বাইরে বের করে দিয়ে মূল ফটকে তালা লাগানো হয়। এ সময় বাসভবনের বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার হুঁশিয়ারি দেন শিক্ষার্থীরা। তবে উপাচার্য এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন।
আজ দুপুর ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় অবস্থান কর্মসূচি ও বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় প্রতিবাদী গান, স্লোগান ও উপাচার্যবিরোধী বক্তব্য দেওয়া হয়। বেলা দেড়টার দিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে যান এবং বাসভবনের নিরাপত্তাকর্মীদের বের করে দিয়ে মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন।
বাসভবনের ফটকে তালা দেওয়ার সময় শিক্ষার্থীরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, এরপরও যদি উপাচার্য পদত্যাগ না করেন, তবে বাসভবনের বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। পাশাপাশি বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হবে। এর আগের দিন মঙ্গলবার তাঁরা প্রশাসনিক ভবনের সব বিভাগের ফটকে তালা দেওয়ায় প্রশাসনিক কার্যক্রমে অচলাবস্থা তৈরি হয়। তবে একাডেমিক কার্যক্রম সচল আছে।
বিক্ষোভের সময় মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সুজয় শুভ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের আজমাইন শুভ ও আইন বিভাগের শহিদুল ইসলাম বক্তব্য দেন। তাঁরা বলেন, বর্তমান উপাচার্য অতীতে বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও দাবি বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি ক্যাম্পাসে একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন কায়েম করেছেন। এতে শিক্ষার্থীদের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় এখন নেতৃত্বের সংকটে ভুগছে। তাঁরা শিক্ষার্থীবান্ধব, গণতান্ত্রিক মানসিকতার, দক্ষ ও স্বচ্ছ একজন উপাচার্য চান। এই ‘ব্যর্থ’ উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হবে।
শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, উপাচার্যের পদত্যাগের আন্দোলন দমাতে বিভিন্ন হুমকি ও থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে প্রশাসন। এটা কখনোই কাম্য নয়। এর আগে যৌক্তিক দাবি নিয়ে আন্দোলন করায় গত ১৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এ জন্য এখন উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনে নেমেছেন তাঁরা।
১৬ ফেব্রুয়ারি উপাচার্যের অপসারণ ও ‘পাতানো’ সিন্ডিকেট সভা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ তাঁর বাসভবনের ফটক ভাঙচুর করে বিক্ষোভ করেন। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এরপর গত ১৩ এপ্রিল উপাচার্যের নির্দেশে রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক নোটিশে অধ্যাপক মুহসিন উদ্দীনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে তাঁকে সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যপদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
২৭ এপ্রিল অধ্যাপক মুহসিন উদ্দীনকে পুনর্বহাল, রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলামকে অপসারণসহ চার দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। তাঁরা রেজিস্ট্রারকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ দাবি করে কুশপুত্তলিকা দাহ করেন এবং রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে তালা দেন। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার (নিরাপত্তা) কে এম সানোয়ার পারভেজ ১০ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা ১০ থেকে ১২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে থানায় জিডি করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় গত শনিবার ঢাকায় সিন্ডিকেট সভায় মনিরুল ইসলামকে অপসারণ করা হয়। গত রোববার উপাচার্য শুচিতা শরমিন সংবাদ সম্মেলন করে ওই সিদ্ধান্তের কথা জানান। সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা মুচলেকা দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে করা মামলা ও জিডি প্রত্যাহার করা হবে বলে জানান। একই সঙ্গে সিন্ডিকেট সভায় ফ্যাসিবাদী সরকারের সমর্থক শিক্ষক–কর্মকর্তাদের চিহ্নিত ও ব্যবস্থা নিতে একজন সিন্ডিকেট সদস্যকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলেও জানান উপাচার্য।
উপাচার্যের সংবাদ সম্মেলনের পর দুপুরে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওই অংশ। এতে তাঁরা উপাচার্যের পদত্যাগ চেয়ে এক দফার আন্দোলনের কর্মসূচি দেন। চতুর্থ দিনের মতো আজ সেই দাবিতে উপাচার্যের বাসভবনে তালা দিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ব সভবন র ন উপ চ র য উপ চ র য র ল ইসল ম ম ল ফটক পদত য গ
এছাড়াও পড়ুন:
৩৫ বছর আগে সর্বশেষ চাকসু নির্বাচনে যা ঘটেছিল
১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ছিল বৃহস্পতিবার। সেদিন সকাল আটটা থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শুরু হয়, শেষ হয় বেলা সাড়ে তিনটায়। ভোট চলাকালেই বোঝা গিয়েছিল ১২ সংগঠনের ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’ বিপুল ভোটে জিততে চলছে। কেননা, শিক্ষার্থীরা এ প্যানেল নিয়ে ছিলেন বেশ উচ্ছ্বসিত।
নির্বাচনের পর ১০ ফেব্রুয়ারি ইত্তেফাক পত্রিকার প্রধান খবরের শিরোনাম ছিল—‘চাকসু নির্বাচনে ছাত্র ঐক্যের বিপুল বিজয়’। আর দৈনিক আজাদী পত্রিকার শিরোনাম ছিল—‘চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ছাত্র ঐক্যের ধস নামানো জয়’। খবরে বলা হয়, ৯৯টি পদের মধ্যে ৮৮টিতে জয় পায় সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য।
নির্বাচনের পর ছাত্রশিবির সংবাদ সম্মেলন করে। তারা কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ তোলে। যদিও সেসব অভিযোগ পরবর্তী সময় ‘হাওয়ায়’ মিলিয়ে যায়। ১০ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ঐক্যের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম নগরে বিজয় মিছিল বের করা হয়।
পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, ১০ ফেব্রুয়ারি বেলা দুইটার দিকে চট্টগ্রাম নগরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও শিক্ষার্থীরা সেই বিজয় মিছিলে অংশ নিতে শহীদ মিনারে যান। বিকেল চারটায় শুরু হয় বিজয় মিছিল। স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে নগরের বিভিন্ন সড়ক। মিছিলটি নিউমার্কেট, স্টেশন রোড, মোমিন রোড, আন্দরকিল্লা, লাল দিঘীরপাড় থেকে সন্ধ্যায় আবার শহীদ মিনারে ফিরে যায়। চাকসুর নির্বাচিত নেতারাও যোগ দেন ওই বিজয় মিছিলে। নির্বাচনে ছাত্র ঐক্যের বিজয়ে একই দিন মিছিল বের হয় কুমিল্লায়। পরদিন ১১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে শত মাইল দূরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও আনন্দমিছিল হয়।
সেদিন সভা চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৬টি বাসে শিক্ষার্থীরা জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসভবন ঘেরাও করেন। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য করা হয়েছিল মূলত শিক্ষার্থীদের চাপে। সর্বদলীয় সভায় ওই ঐক্য করার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর আমাদের ডাকা হয়।আজিম উদ্দিন আহমদ, সাবেক জিএস, চাকসুনির্বাচনের পর ছাত্রলীগ, জাতীয় ছাত্রলীগ, বিপ্লবী ছাত্রধারা, ছাত্রপরিষদ, ছাত্র পরিষদ, ইসলামী যুব সেনা, প্রগতিশীল মানবতাবাদী ছাত্রজোটসহ বিভিন্ন সংগঠন বিবৃতি দিয়ে অভিনন্দন জানায়। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘এই বিজয় স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রমনা শিক্ষার্থীদের বিজয়।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের তৎকালীন উপসহসভাপতি জিয়াউল আহসান সে সময় বিবৃতি দিয়ে বলেন, ‘এ বিজয় সারা দেশের ছাত্ররাজনীতিতে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার সূচনা করবে।’
সর্বদলীয় সভা শেষে ছাত্র ঐক্য
চাকসুর পঞ্চম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮১ সালে। এতে ভিপি ও জিএস পদে নির্বাচিত হন ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন নেতা জসিম উদ্দিন সরকার ও আবদুল গাফফার। ফলে ষষ্ঠ নির্বাচনেও ছাত্রশিবির ছিল ‘কনফিডেন্ট’। অর্থাৎ তারা জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ছিল। তবে ছাত্রশিবিরের বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়েছিল ১২টি ছাত্রসংগঠন। সবাই মিলে গড়ে তুলেছিল ঐক্যবদ্ধ মোর্চা- সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য।
যে ১২ সংগঠনের মধ্যে ঐক্য হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল ছাত্রলীগ (হাবিবুর রহমান-অসীম কুমার), জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ (আবদুস সাত্তার-মোশারফ হোসেন), ছাত্রলীগ (নাজমুল হক-শফি আহমেদ), ছাত্রলীগ (বজলুল রশীদ-আজম), জাতীয় ছাত্রলীগ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র মৈত্রী, ঐক্য সমিতি, ছাত্র ফেডারেশন, গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়ন।যে ১২ সংগঠনের মধ্যে ঐক্য হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল ছাত্রলীগ (হাবিবুর রহমান-অসীম কুমার), জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ (আবদুস সাত্তার-মোশারফ হোসেন), ছাত্রলীগ (নাজমুল হক-শফি আহমেদ), ছাত্রলীগ (বজলুল রশীদ-আজম), জাতীয় ছাত্রলীগ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র মৈত্রী, ঐক্য সমিতি, ছাত্র ফেডারেশন, গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়ন। এর মধ্যে নাজমুল হক ও শফি আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগ জাসদের সমর্থক ছিল।
সে সময় ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’ সহজেই তৈরি হয়নি। স্মৃতিচারণা করে চাকসুর সর্বশেষ জিএস আজিম উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের আগে জানুয়ারি মাসে একদিন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসভবনে সর্বদলীয় সভা হয়। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, বিএনপির নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) শাহ আলম, বাসদ নেতা বালাগাত উল্লাহ, জাসদ নেতা আবুল কালাম আজাদসহ অন্যান্য নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন।
আজিম উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সেদিন সভা চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৬টি বাসে শিক্ষার্থীরা জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসভবন ঘেরাও করেন। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য করা হয়েছিল মূলত শিক্ষার্থীদের চাপে। সর্বদলীয় সভায় ওই ঐক্য করার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর আমাদের ডাকা হয়।’
চাকসু ভবন