ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি বলেছেন, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মাধ্যমে পাকিস্তানে হামলা চালিয়ে ভারত প্রত্যাঘাতের অধিকার প্রয়োগ করেছে। পেহেলগামের হত্যাকাণ্ডের পর সীমান্ত পার থেকে আরও সম্ভাব্য হামলা ঠেকানোর পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদী কাঠামো ধ্বংস করাই ছিল এই হামলার উদ্দেশ্য।

গতকাল নয়াদিল্লির স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টায় অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে এই ব্রিফিংয়ে মিশ্রি এ কথা বলেন। এতে আরও উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় সেনা ও বিমানবাহিনীর দুই নারী কর্মকর্তা কর্নেল সোফিয়া কুরেশি ও উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং।

এদিকে নরেন্দ্র মোদির সরকার আজ বৃহস্পতিবার একটি সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছে। পাশাপাশি আজ বেলা ১১টায় ভারতের মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা কমিটির (সিসিএস) বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে।

ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ভারত যে প্রত্যাঘাত করেছে, তা পরিমিত, সমানুপাতিক, দায়িত্বশীল ও যা ছড়িয়ে পড়বে না, এমন। ভারতের লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসবাদীদের অবকাঠামো ভেঙে দেওয়া, যাতে সন্ত্রাসীদের সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পাঠানো ঠেকানো যায়।

এতে প্রতিরক্ষা বিভাগের দুই নারী মুখপাত্র কর্মকর্তা বলেন, মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১টা ৫ মিনিট থেকে শুরু করে রাত দেড়টা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণরেখা ও আন্তর্জাতিক সীমান্তের ওপাশে মোট ৯টি সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে ভারতীয় বাহিনী হামলা চালিয়ে ধ্বংস করেছে।

ব্রিফিংয়ে পাকিস্তান অংশে ধ্বংস করা ঘাঁটির ছবিও দেখান কর্মকর্তারা। ওই দুই কর্মকর্তা বলেন, অপারেশন সিঁদুর কোনো পাকিস্তানি সেনা ঘাঁটির ওপর আক্রমণ করেনি। সাধারণ মানুষকেও নিশানা করা হয়নি। বেছে বেছে নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সেগুলো ধ্বংস করা হয়েছে।

আজ সর্বদলীয় বৈঠক

মোদি সরকার আজ বৃহস্পতিবার একটি সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছে। পাশাপাশি আজ বেলা ১১টায় ভারতের মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা কমিটির (সিসিএস) বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠেয় এই বৈঠকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।

গতকাল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশটির রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি তাঁকে ‘অপারেশন সিঁদুর’ সম্পর্কে অবহিত করেন। রাষ্ট্রপতি ভবন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে এ কথা জানিয়েছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মোদি তাঁর নির্ধারিত তিন-দেশীয় ইউরোপ সফর বাতিল করেছেন। এই সফরে তাঁর ১৩ থেকে ১৭ মে পর্যন্ত ক্রোয়েশিয়া, নরওয়ে ও নেদারল্যান্ডস সফরের কথা ছিল। নরওয়েতে অনুষ্ঠেয় নর্ডিক সম্মেলনেও তাঁর অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংও রাশিয়ায় ‘ভিক্টরি ডে’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের পরিকল্পনা বাতিল করেছেন। তাঁর পরিবর্তে প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী সঞ্জয় শেঠ ওই অনুষ্ঠানে ভারতীয় প্রতিনিধিত্ব করবেন।

অজিত দোভালের হুঁশিয়ারি

পিটিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের নয়টি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর পর গতকাল ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল আন্তর্জাতিক মহলে যোগাযোগ শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁদের বলেছেন, ভারতের উত্তেজনা বাড়ানোর কোনো ইচ্ছা নেই। তবে ইসলামাবাদ উত্তেজনা বৃদ্ধি করলে ভারত ‘দৃঢ়ভাবে পাল্টা জবাব’ দিতে প্রস্তুত।

অজিত দোভাল তাঁদের ভারতের পদক্ষেপ ও বাস্তবায়নের পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত করেছেন, যা ছিল ‘পরিমিত, উসকানিহীন এবং নিয়ন্ত্রিত’। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সঙ্গে কথা বলেছেন।

সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেছেন, রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সের্গেই শোইগু, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পলিটব্যুরোর সদস্য এবং চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের কূটনৈতিক উপদেষ্টা এমানুয়েল বোনের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে। আরও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে।

‘সশস্ত্র বাহিনীর জন্য গর্বিত’

পাকিস্তানে সামরিক হামলা চালানোর জন্য ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রশংসা করেছেন প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা ও দেশটির পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী। আল-জাজিরা জানায়, গতকাল সকালে এক এক্স পোস্টে রাহুল লেখেন, ‘আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য গর্বিত।’

ইন্ডিগোর ১৬৫ ফ্লাইট বাতিল

ভারতের অন্যতম উড়োজাহাজ সংস্থা ইন্ডিগো জানিয়েছে, ১৬৫টি ফ্লাইট তারা বাতিল করেছে। পাকিস্তান সীমান্তের কাছের কাশ্মীরসহ ১১টি এলাকায় এসব ফ্লাইট চলাচল করার কথা ছিল। এসব তথ্য জানিয়ে রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, ইন্ডিগো দিনে ২ হাজার ২০০ ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে। তা ছাড়া এয়ার ইন্ডিয়া, এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস এবং স্পাইসজেটের মতো সংস্থাগুলোও ফ্লাইটে রদবদল, স্থগিত বা বাতিল করেছে।

যুদ্ধকালীন মহড়া

গত সোমবার ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন রাজ্যে যুদ্ধকালীন মহড়ার নির্দেশ দিয়েছে। গতকাল থেকে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ২৪৪ জেলায় এই মহড়া চালানো হবে। যুদ্ধ বাধলে নাগরিকদের প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে কী কী করণীয়, তা নিয়ে নাগরিকদের সতর্ক করতেই এই মহড়া চালানো হচ্ছে। ১৯৭১ সালের পর কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রথমবার এ ধরনের মহড়ার নির্দেশ দিল।

গত ২২ এপ্রিল ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাঁদের প্রায় সবাই পর্যটক। এই হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতা আছে বলে দাবি করেছে নয়াদিল্লি। পাকিস্তান তা জোরালোভাবে নাকচ করেছে। এর পর থেকে উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছিল।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব ত ল কর ছ কর মকর ত ধ ব স কর পরর ষ ট উপদ ষ ট অন ষ ঠ বল ছ ন কর ছ ন মন ত র ফ ল ইট সরক র গতক ল

এছাড়াও পড়ুন:

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় বাংলাদেশের ঝুঁকি

পারমাণবিক শক্তির অধিকারী নয় সার্কের এমন সদস্য দেশ, যারা ভারতের চারপাশে অবস্থিত তারা হলো– বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপ। এ দেশগুলো কাশ্মীরসৃষ্ট সংকটে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় আরও কোনঠাসা হয়ে পড়বে। এর ফলে সার্ক ঘিরে আঞ্চলিক সহযোগিতা আরও অচলাবস্থার মুখে পড়বে।


দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়লে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য ছোট দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে। সবচেয়ে ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশ। সেখানে সম্প্রতি ভারতসমর্থিত শেখ হাসিনা সরকারকে সরিয়ে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে, যারা ব্যাপক মেরূকরণ সামাল দিচ্ছে। সেখানে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট অনেক বেশি। এর পেছনে কাজ করছে ভারতের হস্তক্ষেপ ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় প্রদান। অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক ‘ম্যান্ডেট’ কম। তারা নাগরিক সমাজের উল্লেখযোগ্য অংশের কাছ থেকে আরও বেশি জাতীয়তাবাদী ও ভারতবিরোধী অবস্থান গ্রহণের জন্য ব্যাপক চাপে পড়বে। একইসঙ্গে ভারত হয়তো বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি কূটনৈতিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করবে, যা ঢাকাকে অধিকতর ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। 


শ্রীলঙ্কার সরকার মনে হচ্ছে সতর্ক নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করবে, যদিও নীরবে ভারতের আঞ্চলিক নিরাপত্তা অবস্থানকে সমর্থন করবে। তবে কাশ্মীর সংঘাতের তীব্রতা বাড়লে শ্রীলঙ্কার মুসলিম কমিউনিটিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, বিশেষত যদি বিষয়টি মুসলিম জনগোষ্ঠীর দমনপীড়নের অংশ হিসেবে উপস্থাপিত হয়। এসব অভ্যন্তরীণ গতিপ্রকৃতি সেই সরকারকে অস্থিতিশীল করে দিতে পারে, যারা ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করছে। 


নেপাল চাইবে ভারত ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে, কিন্তু নেপালের নিরপেক্ষতাকে ভারত সন্দেহের চোখে দেখবে। ভূমিসংক্রান্ত বিবাদ ও সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে কাঠমান্ডুর অবস্থানের কারণে উবয় দেশের মধ্যে এমনিতেই উত্তেজনা চলছে। এর মধ্যে আরও কূটনৈতিক চাপ নেপালকে নাজুক করে ফেলতে পারে। ভারতে নেপালের বড় শ্রমশক্তিও তার অর্থনৈতিক নির্ভরতার প্রতীক, যা নেপালকে বিবেচনায় নিতে হবে।


ভুটান সম্ভবত নীরবে ভারতকে সমর্থন করবে, কারণ ভারতের সঙ্গে দেশটির গভীর কৌশলগত চুক্তি আছে। তবে, ভারতীয় সামরিক তৎপরতা কমলে চীন বিবদমান উত্তর সীমান্তে কার্যক্রম জোরদার করতে পারে। এদিকে কাশ্মীর সংকট উত্তেজনা বাড়ালে মালদ্বীপে ইসলামী সেন্টিমেন্ট বাড়তে পারে। কৌশলগত পর্যায়ে ভারত মহাসাগরে সামরিকায়ন বেড়ে গেলে তা মালদ্বীপের পরিসর সংকীর্ণ করে ফেলতে পারে। 
সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে, কাশ্মীর সংকট আঞ্চলিক যূথবদ্ধতা কঠিন করে তুলবে। এতে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন হ্রাস পাবে এবং দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক শক্তিহীন রাষ্ট্রগুলোর নিরপেক্ষতায় অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিবাদ বেড়ে যাবে।

তাছাড়া এটি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলেও প্রভাব ফেলবে। চীনের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষার প্রচেষ্টায় ভারতকে মূল শক্তি হিসেবে দেখে ওয়াশিংটন, বিশেষত কোয়াডের মতো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে। ভারত-পাকিস্তানের প্রলম্বিত সংকট ভারতের কৌশলগত মনোযোগকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে পশ্চিম সীমান্তে সরিয়ে দেবে। এতে অঞ্চলটিতে নিরাপত্তা প্রদানকারী হিসেবে ভারতের ভূমিকাও সীমিত করবে।


রুদাবেহ শহিদ: আটলান্টিক কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়া সেন্টারের অনাবাসিক ফেলো; আটলান্টিক কাউন্সিল থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক


 

সম্পর্কিত নিবন্ধ