ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে এক বন্দুক হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় ভারত মঙ্গলবার (৬ মে) রাতে পাকিস্তান ও পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের বিভিন্ন স্থানে বিমান হামলা চালিয়েছে। দিল্লি এই হামলার নাম দিয়েছে ‘অপারেশন সিঁদুর’। ভারতের দাবি, তারা পাকিস্তানে থাকা সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। তবে পাকিস্তান বলছে, এতে অন্তত ৩১ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৫৭ জন। তারা পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ও ইসরায়েলে নির্মিত ২৫টি হারপ ড্রোন ধ্বংসেরও দাবি করে।
এই হামলা এমন সময়ে ঘটল, যখন বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ-সংঘাত যেন এক স্বাভাবিক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। ইউক্রেন, গাজা, ইরান-ইসরায়েল কিংবা উত্তর কোরিয়া– প্রতিটি অঞ্চলে একে অপরের ওপর হামলা যেন রুটিন ঘটনায় পরিণত হয়েছে এবং এই সহিংসতাকে থামানোর মতো কার্যকর কূটনৈতিক প্রতিরোধ প্রায় অনুপস্থিত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ অতীতের ২০১৬ ও ২০১৯ সালের সামরিক অভিযানের তুলনায় অনেক বেশি আগ্রাসী। এ কারণে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াও আরও তীব্র হতে পারে। ইসলামাবাদ এই হামলাকে সরাসরি ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ বলে উল্লেখ করেছে। অভিযানের লক্ষ্যস্থল ছিল ৯টি এলাকা, যার মধ্যে চারটি পাকিস্তানের জনবহুল পাঞ্জাব অঞ্চলে– যেখানে ১৯৭১ সালের পর এবারই প্রথম ভারতীয় হামলা হয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, এ হামলার লক্ষ্য ছিল ভবিষ্যতের সন্ত্রাসী আক্রমণ ঠেকানো। তবে পাকিস্তান এটিকে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে দেখছে এবং পাল্টা জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠছে, এই পাল্টাপাল্টি হামলা কত দূর গড়াবে। বিশ্ব এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে যুদ্ধ যেন ‘নিষিদ্ধ’ নয়; বরং ‘গ্রহণযোগ্য’। রাশিয়া-ইউক্রেন, গাজা, ইরান-ইসরায়েল, ইয়েমেন– যেখানেই চোখ ফেরানো যায়, দেখা যাচ্ছে লাগাতার হামলা, পাল্টা হামলা ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের লঙ্ঘন। ইউক্রেনে যুদ্ধ চলছে তিন বছর ধরে; গাজায় ইসরায়েলি হামলায় প্রতিদিন প্রাণ হারাচ্ছে শত শত মানুষ;
এমনকি উত্তর কোরিয়ার সৈন্যরাও রাশিয়ায় যাচ্ছে বলে খবর রয়েছে। যুদ্ধের পরিধি বাড়ছে প্রতিনিয়ত।
ইয়েমেনেও ইসরায়েল হুতি বিদ্রোহীদের রকেট হামলার জবাবে সানা বিমানবন্দরে পাল্টা হামলা চালিয়েছে। এতে ছয়টি বিমান ধ্বংস হয়েছে এবং ক্ষয়ক্ষতি ছাড়িয়েছে ৫০ কোটি ডলার। গাজায় গতরাতে (৬ মে) ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছে ৫৯ জন, যাদের মধ্যে একটি স্কুলে আশ্রয় নেওয়া ২৭ জন নারী ও শিশু রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন বা ‘আনুপাতিক প্রতিক্রিয়া’র নীতিমালা যেন এখন অনেকটাই অনুপস্থিত। পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানে রয়েছে বা সক্রিয় নয়। এতে আক্রমণাত্মক নীতিকে বৈধতা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে অনেক দেশ। যুদ্ধ ও সংঘর্ষ যখন আরও বেড়েই চলেছে, তখন বিশ্বের প্রধান পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র তা থামাতে হয় অনিচ্ছুক নয়তো অক্ষম বলেই মনে হচ্ছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘তারা অনেক দিন ধরেই যুদ্ধ করছে।’ কথাটা শুনে মনে হয়েছে, তিনি বিষয়টি খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন না।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, যুদ্ধের এই ‘নতুন স্বাভাবিকতা’ ভারত ও পাকিস্তানের মতো পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীদের মধ্যে স্থায়ী সংঘাতে রূপ নিতে পারে। ভারতের সেনা ও বিমানবাহিনী পাকিস্তানের চেয়ে বড়, তবে উভয়েরই যুদ্ধক্ষমতা বিপজ্জনকভাবে বেশি। সীমান্তে ইতোমধ্যে গোলাগুলি চলছে। ভারত জানিয়েছে, তাদের সাতজন নিহত হয়েছে; পাকিস্তান বলছে, তাদের নিহত পাঁচজন। বর্তমানে ভারতের কাছে আনুমানিক ১৭০টি পারমাণবিক অস্ত্র, ১২ লাখের বেশি সেনা এবং ৫০০-এর বেশি যুদ্ধবিমান রয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের রয়েছে প্রায় সমানসংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্র, ৫ লাখ ৬০ হাজার সৈন্য এবং চার শতাধিক যুদ্ধবিমান।
পাকিস্তান এক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’ মিত্র ছিল। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাদের প্রত্যাহারের পর কার্যত সেই মিত্রতা পরিত্যক্ত হয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের বিশ্লেষক সামির পুরি বলেন, ‘গত তিন বছরে যুদ্ধ না করার যে ধারণা ছিল, তা বিলীন হয়ে গেছে। এখন এটা অনেক দেশের জন্য দৈনন্দিন বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। এতে বিশ্বের নানা সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে যুদ্ধকামীদের কল্পনার পরিধি আরও বিস্তৃত হয়েছে।’
সামির পুরির মতে, ‘ভারত হয়তো মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে সমালোচনা আসবে না। এলেও তা আন্তরিক হবে না; যা দেশটিকে আগের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রাসী করে তুলছে।’
গতকাল ছিল ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের বার্ষিকী। আশি বছর পর, রাষ্ট্রীয় আচরণের যে নিয়মকানুন ছিল, তা এমনভাবে ভেঙে পড়েছে যে যুদ্ধকে এখন আর নিষিদ্ধ কিছু মনে করা হয় না। বরং বলা যেতে পারে, এক নতুন বৈশ্বিক সংঘাতের যুগ শুরু হয়েছে। যাকে বলা যেতে পারে– এ এক ‘নতুন স্বাভাবিকতা’। v
[গার্ডিয়ান থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত]
ড্যান সাব্বাগ : যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান পত্রিকার প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সম্পাদক
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ইন্সপেক্টর-সুপারিনটেনডেন্ট পদবি ফেরাতে পেশাগত প্রোফাইল পরিবর্তন
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টম ও ভ্যাটের নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা তাদের পুরোনো পদবি ইন্সপেক্টর-সুপারিনটেনডেন্ট পদ পুনর্বহালের দাবিতে সোচ্ছার হয়েছেন। সম্প্রতি পদবি ফিরে পেতে এনবিআর চেয়ারম্যানকে চিঠি দেওয়ার পর এবার নিজেদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন পেশাগত প্রোফাইল পরিবর্তন করেছেন তারা। বৃহস্পতিবার এসব কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাকাএভ) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে রাজস্ব কর্মকর্তাদের সমমানের পদবি হলো সুপারিনটেনডেন্ট এবং সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাদের সমমানের পদবি হলো ইন্সপেক্টর। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০-১১ অর্থবছরে তাদের পুরোনো ইন্সপেক্টর ও সুপারিনটেনডেন্ট পদ পরিবর্তন করে যথাক্রমে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও রাজস্ব কর্মকর্তা পদবি দেওয়া হয়। পুরোনো এই পদ ফিরে পেতে এসব কর্মকর্তারা দেশব্যাপী গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করছে। বর্তমানে কাস্টম-ভ্যাটের প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি কর্মকর্তা এই দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন।
এর আগে বাকাএভ গত ৪ মে পুরোনো এ পদ পুনর্বহালের দাবিতে তারা এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বরাবর একটি চিঠি দিয়েছেন।
ওই চিঠিতে বলা হয়, ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমারসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সীমান্তে কাস্টমস বিভাগের ইন্সপেক্টর ও সুপারিনটেনডেন্টদের সঙ্গে কাজের সমন্বয়ে এমনকি সমুদ্রগামী জাহাজে কিংবা বিমানবন্দরে কার্যক্রমেও এনবিআরের রাজস্ব কর্মকর্তা ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তারা পরিচয় দিতে গিয়ে ‘পরিচয়সংকট’ বা আইডেন্টিটি ক্রাইসিস অনুভব করেন। কারণ, বিদেশি জাহাজের ক্যাপ্টেন বা বিমানের পাইলট সবার কাছে ইন্সপেক্টর ও সুপারিনটেনডেন্ট পদবিতে পরিচিত।
চিঠিতে বাকাএভের নেতারা বলেন, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ইন্সপেক্টর ও সুপারিনটেনডেন্ট পদবি কাস্টমসের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের গৌরব ও ঐতিহ্য বহন করে। এটি আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। তাই ইন্সপেক্টর ও সুপারিনটেনডেন্ট পদবি পুনর্বহাল করতে হবে।