প্রেম, পূজা ও প্রকৃতির কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নদীরও কবি। তাঁর কবিতা, সংগীত, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধে যেভাবে নদী প্রসঙ্গ, চরিত্র, উপমা হিসেবে উঠে এসেছে, তার তুলনা পাওয়া কঠিন। আর এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশ। কবির ঘনিষ্ঠ শিষ্য ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী লিখেছেন– ‘পদ্মা ও নদীময় বঙ্গ যে তাঁর কাব্যকে একটি বিশেষ দিকে প্ররোচিত করেছিল তাতে কারো সন্দেহ নাই’ (শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ, ১৯৭২)।
বর্তমান বাংলাদেশের তিনটি পরগনা ছিল ঠাকুর পরিবারের জমিদারি– বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার বিরাহিমপুর পরগনা, এর সদর কাছারি শিলাইদহে; বর্তমান নওগাঁ জেলার কালীগ্রাম পরগনা, এর সদর কাছারি পতিসরে; বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার সাজাদপুর পরগনা, এর সদর কাছারি বর্তমান শাহজাদপুরে। প্রথম পরগনাটি গঙ্গা বা পদ্মা অববাহিকায় এবং পরের দুই পরগনা ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা অববাহিকায় অবস্থিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক দশক (১৮৯১-১৯০১) এই তিনটি জমিদারি কমবেশি তদারক করেছেন। এ উপলক্ষে তিনি তিন এলাকায় সাধারণত নদীপথে পারিবারিক বজরা ‘পদ্মা’ নিয়ে ভ্রমণ করেছেন। সপরিবারে কুঠিবাড়ি তিনটিতে থেকেছেন। এর প্রভাব পড়েছে তার দর্শন ও সাহিত্যে। রবীন্দ্রসাহিত্যে নদনদীর প্রভাব নিয়ে প্রমথনাথ বিশী লিখেছেন– ‘বাংলাদেশের মতোই রবীন্দ্রনাথের কবিত্ব নদীমাতৃক’ (শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ, ১৯৭২)।
এটা ঠিক, রবীন্দ্র সাহিত্যে গঙ্গা ও পদ্মা প্রসঙ্গ সবচেয়ে বেশি আলোচিত। পূর্ববঙ্গের নদীপথে তাঁর ভ্রমণসঙ্গী পারিবারিক বজরাটির নাম ‘পদ্মা’ তিনিই রেখেছিলেন। ১৮৯৩ সালের ২ মে ‘ছিন্নপত্র’ লিখেছেন তিনি– ‘বাস্তবিক পদ্মাকে আমি বড় ভালোবাসি।’ কিন্তু ব্রহ্মপুত্র বা যমুনাও রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্যে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আক্ষেপের বিষয়, রবীন্দ্রনাথের গঙ্গা বা পদ্মা নিয়ে যত বেশি আলোচনা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা নিয়ে যেন ততখানিই কম। অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবস্থান, ভ্রমণ ও লেখালেখির বড় অংশজুড়ে রয়েছে ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা।
দুই.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলাদেশ’ কেবল তখনকার পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গেই সীমিত ছিল না। আসামও ছিল তার অংশ। গঙ্গা থেকে ব্রহ্মপুত্র সেই বৃহত্তর প্রদেশের সীমারেখা। ‘সাহিত্য পরিষৎ’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন– ‘ভাগীরথীর তীর হইতে ব্রহ্মপুত্রের তীর পর্যন্ত, সমুদ্রকূল হইতে হিমাচলের পাদদেশ পর্যন্ত, বাংলাদেশের সমস্ত প্রদেশ’। আর ভারতবর্ষ বোঝাতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ অনেকবারই সিন্ধু থেকে ব্রহ্মপুত্র উল্লেখ করেছেন।
‘গোঁফ এবং ডিম’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন– ‘ওই দেখো ভারতবর্ষেও স্বাধীনতা-সূর্য ধীরে ধীরে উত্থান করিতেছে, ওই দেখো সিন্ধু নদ হইতে ব্রহ্মপুত্র ও হিমালয় হইতে কন্যাকুমারী পর্যন্ত আলোকিত হইয়া উঠিতেছে’।
বাংলা প্রসঙ্গে ‘বিজয়া সম্মিলন’ প্রবন্ধে বলেছেন– ‘আজ সায়াহ্নে গঙ্গার শাখা-প্রশাখা বাহিয়া ব্রহ্মপুত্রের কূল-উপকূল দিয়া একবার বাংলাদেশের পূর্বে পশ্চিমে আপন অন্তরের আলিঙ্গন বিস্তার করিয়া দাও।’
যদিও রবীন্দ্রনাথের সেই বুদ্ধিবৃত্তিক প্রত্যাশা রাজনীতির মারপ্যাঁচে পূরণ হয়নি। এই অঞ্চলে এসেছিল ১৯০৫ সালের ‘বঙ্গভঙ্গ’। পূর্ববঙ্গকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভাগ করে আসামের সঙ্গে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ নাম দেওয়া হয়। এই দুই অংশের অভিন্ন নদী ব্রহ্মপুত্র। তার আগে ১৯০৪ সালে ‘বঙ্গবিভাগ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ সেই ব্রহ্মপুত্রকেই বাংলার ঐক্যের ধারা সাব্যস্ত করেন– ‘বাংলার পূর্বপশ্চিমকে চিরকাল একই জাহ্নবী তাঁহার বহু বাহুপাশে বাঁধিয়াছেন, একই ব্রহ্মপুত্র তাঁহার প্রসারিত ক্রোড়ে ধারণ করিয়াছেন।’ পরে অবশ্য সেই বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছিল। আরও পরে ১৯৪৭ সালে ফের বিভক্ত হয়েছিল বাংলা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ ঘটেছিল তার আগেই, ১৯৪১ সালে।
আগেই বলেছি, পারিবারিক জমিদারিসূত্রে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ভাটির অংশে, যা যমুনা নামে পরিচিত, রবীন্দ্রনাথের আগেই যাতায়াত ছিল। সেই তুলনায় ব্রহ্মপুত্রের উজানের দিকে তিনি অপেক্ষাকৃত পরে যান। দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ মোট তিন দফায় আসাম-মেঘালয় অংশ ভ্রমণ করেছিলেন; ১৯১৯, ১৯২৩, ও ১৯২৭ সালে। (টেগোর’স আসাম টাই, দ্য টেলিগ্রাফ, ১৪ ডিসেম্বর ২০১২)।
উজানের ব্রহ্মপুত্র প্রথমবার দর্শনেই এর পানিতে স্নান করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৯ সালের অক্টোবর মাসে। বর্তমান বাংলাদেশের বগুড়ার সান্তাহার জংশন থেকে ‘আসাম মেইল’ হয়ে তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ফুলকুমার, গঙ্গাধর, মানস, সঙ্কোশ পার হয়ে ব্রহ্মপুত্রের ডান তীরে কামরূপ জেলার আমিনগাঁও রেলস্টেশনে নেমেছিলেন। পথে পড়েছিল বর্তমান কুড়িগ্রামের যাত্রাপুর রেলস্টেশন। ব্রহ্মপুত্র পাড়ে সেই যাত্রাপুর এখনও বিখ্যাত সাপ্তাহিক হাট হিসেবে টিকে রয়েছে; যদিও ১৯২৬ সালের আগে খোদ রেলস্টেশনটি ব্রহ্মপুত্রগর্ভে বিলীন হয়। যাহোক, আমিনগাঁওয়ে ব্রহ্মপুত্রের পান্ডু ঘাটে ভেড়ানো ছিল গুয়াহাটি-গোয়ালন্দ রুটে চলাচলকারী একটি জাহাজ। সেখানে উঠে ব্রহ্মপুত্রের পানিতে স্নান সারেন। পরে এক চিঠিতে তিনি রানু অধিকারীকে এ প্রসঙ্গে লিখছেন– ‘ভূগোলে পড়া গেছে পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল, কিন্তু বন্যার ব্রহ্মপুত্রের ঘোলা স্রোতে সেদিন তিন ভাগ স্থল এক ভাগ জল। তাতে দেহ স্নিগ্ধ হল বটে কিন্তু নির্মল হল বলতে পারিনে।’ (শিলং যাত্রীর চিঠি, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২২ এপ্রিল ২০১৭)। সেবার তিনি শিলং থেকে সিলেট ভ্রমণেও এসেছিলেন।
কেবল নিবন্ধ, চিঠি ও ভ্রমণে নয়; রবীন্দ্রসাহিত্যেও ব্রহ্মপুত্র এসেছে নানাভাবে। আমরা দেখি, যে শিলং দেখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ পাহাড়ি ব্রহ্মপুত্র দেখেছিলেন, সেই শিলংয়ের পটভূমিতে লেখা ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে নায়ক অমিত নায়িকা লাবণ্যকে ‘বন্যা’ নাম দিয়ে নিজেকে ‘ব্রহ্মপুত্র’ নাম দিতে চান। বন্যা যাতে দু’কূল ভাসিয়ে নিতে পারে। ত্রিপুরা ও পূর্ববঙ্গের পটভূমিতে লেখা ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ব্রহ্মপুত্রের তীরে ক্ষুদ্র গ্রাম’ গুজুরপাড়া থেকে নদীটি রূপ বর্ণনা করেছেন– ‘পূর্বতীরে সূর্যোদয় হইতেছে, অরুণরেখা দেখা দিয়াছে। উভয় তীরের ঘন তরুস্রোতের মধ্য দিয়া, ছোটো ছোটো নিদ্রিত গ্রামগুলির দ্বারের কাছ দিয়া ব্রহ্মপুত্র তাহার বিপুল জলরাশি লইয়া অবাধে বহিয়া যাইতেছে।’
কবিতায় ব্রহ্মপুত্র আরও বেশি উদ্ধৃত, বলা বাহুল্য। যেমন পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থের বিশ্বশোক কবিতায় আমরা ব্রহ্মপুত্রের উল্লেখ পাই। বেদনার বন্যা ও প্রবাহ তুলে ধরতে তিনি ব্রহ্মপুত্রকে রূপক অর্থে নিয়েছেন। এখানে তিনি ব্রহ্মপুত্রকে ‘হৃদয়ের মহানদী’ আখ্যা দিয়ে এর ‘শাখাপ্রশাখায়’ ধাওয়ার কথা বলেছেন। নদী যে নিছক প্রবাহ নয়, বরং একটি অববাহিকা বা বেসিন, প্রতিবেশগত সেই সচেতনতার প্রমাণ আমরা এখানে পাই। যদিও রূপক অর্থে ব্রহ্মপুত্র এসেছে, এখানে নদীর প্রকৃত চরিত্রই ফুটে ওঠে– ‘অশ্রুধারার ব্রহ্মপুত্র/ উঠছে ফুলে ফুলে/ তরঙ্গে তরঙ্গে;/ সংসারের কূলে কূলে/ চলে তার বিপুল ভাঙাগড়া/ দেশে দেশান্তরে।’
যেমন এই নাট্য-কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন– ‘যেদিন হিমাদ্রিশৃঙ্গে নামি আসে আসন্ন আষাঢ়/ মহানদ ব্রহ্মপুত্র অকস্মাৎ দুর্দাম দুর্বার/ দুঃসহ অন্তরবেগে তীরতরু করিয়া উন্মূল/ মাতিয়া খুঁজিয়া ফিরে আপনার কূল-উপকূল।’ (কাহিনী)। ‘কদমাগঞ্জ’ থেকে মালদহে আসার পথে কদমা বোঝাই নৌকা ব্রহ্মপুত্র নদে ডুবে কীভাবে আসামের সদকি জেলার ‘হাংলু-ফিড়াঙ’ পবর্ত এলাকায় সরবতের স্রোত বয়েছিল, সে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের রয়েছে একটি মজার ছড়া। এই ছড়া রবীন্দ্রনাথের ‘ছড়া’ গ্রন্থভুক্ত যদিও সেটা প্রকাশ হয় তাঁর দেহাবসানের স্বল্পকাল পরে। ছড়াটি তিনি লিখেছিলেন মংপুতে অবস্থানকালীন, ১৯৪০ সালের মে মাসে (বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলী ষড়বিংশ খণ্ড)।
তিন.
ব্রহ্মপুত্রের অপর নাম যমুনা। রবীন্দ্রসাহিত্যেও সবচেয়ে বেশি যে নদীর নাম এসেছে, তা যমুনা। অবশ্য কারণ ভিন্ন, বাংলা ভাষায় ‘যমুনা’ বহুমাত্রিক বিশেষ্য। গোটা ভারতবর্ষে এই নামে যেমন একাধিক নদী রয়েছে, তেমনই প্রেমের প্রবাহের রূপকার্থেও ব্যবহৃত হয় যমুনা। এ ছাড়া পৌরাণিকভাবে যমুনা হচ্ছে রাধা ও কৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র। সেই যমুনা উত্তর ভারতে গঙ্গার সমান্তরালে প্রবাহিত; কৃষ্ণে জন্মভূমি মথুরা ও লীলাভূমি বৃন্দাবন এই নদীর তীরে অবস্থিত।
ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশে প্রবেশ করে প্রায় একই পয়েন্টে ডান তীরে তিস্তার সঙ্গে মিলিত এবং বাম তীরে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে বিভক্ত হওয়ার পর থেকে এর নাম ‘যমুনা’। পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পারিবারিক জমিদারির তিন পরগনার দুটিই এই যমুনা অববাহিকায়, আগেই বলেছি। তাঁর রচনাবলীতেও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার এই অংশ তথা যমুনা এবং এর উপনদী ও শাখা নদীগুলো বিশিষ্ট হয়ে আছে।
ব্রহ্মপুত্র-যমুনার শাখ ও উপনদীগুলোর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়েছে ইছামতী (ইচ্ছেমতী), বড়াল (বড়ল), ধলেশ্বরী, আত্রাই, হুড়াসাগর, করতোয়া নদী সঙ্গে। প্রসঙ্গত, তিনি ইছামতী ও ইচ্ছেমতী দুই নামই ব্যবহার করতেন। অন্যান্য নদী যেমন, বড়াল বা গড়াইয়ের ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে। কিন্তু এই নদী নিয়ে দুই নামে দুটি কবিতা রয়েছে। নদীর নামে তিনি আরও কবিতা লিখেছেন; কিন্তু একই নদীর নামে দুই কবিতা আর আছে বলে আমার জানা নেই। তার পরও রবীন্দ্রনাথের জীবনে ও দর্শনে নিঃসন্দেহে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছে তিস্তা।
চার.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ জীবনের কিছুদিন কেটেছে দার্জিলিং জেলার পাহাড়ি জনপদ মংপুতে। ম্যালেরিয়ার ওষুধ কুইনাইনের কাঁচামাল সিঙ্কোনা চাষ ও গবেষণার জন্য নির্ধারিত ওই পাহাড়। সেখানে স্বামীর কর্মসূত্রে বসবাসরত স্নেহভাজন লেখিকা মৈত্রেয়ী দেবীর আমন্ত্রণে ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে চারবার গিয়ে সর্বনিম্ন দুই সপ্তাহ থেকে সর্বোচ্চ দুই মাস অবস্থান করেন রবীন্দ্রনাথ। ওই সময়ের ওপর ভিত্তি করে মৈত্রেয়ী দেবীর বই রয়েছে– ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’।
কলকাতা বা কালিম্পং, যেখানে থেকেই মংপু যান না কেন, তিস্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছেই কবির। মংপুর প্রসঙ্গেই তিনি ‘অনুবাদ চর্চা’ প্রবন্ধে লিখেছেন– ‘১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে দার্জ্জিলিঙের কালিম্পং সাব্ডিভিসনে তিস্তা নদীর পূর্ব্বদিকে একটি নূতন কৃষিক্ষেত্রে সূচনা করা হইয়াছিল’।
এই বঙ্গে নদী ও নারীর তুলনা নেহাত কম নয়; বিশেষত কবি-সাহিত্যিকদের বদৌলতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও মংপু সফরকালে সেই তুলনা দিয়েছেন এভাবে– ‘কি, তোমাদের কলধ্বনি তো তিস্তাকে হার মানাল!’ (মংপুতে রবীন্দ্রনাথ, মৈত্রেয়ী দেবী, ১৯৪৩)।
মংপুর কুইনাইন কারখানার অধ্যক্ষ হিসেবে ডা. মনমোহন সেন যে সরকারি বাড়ি বরাদ্দ পেয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে বাড়িতে চারবার অতিথি হয়েছিলেন, সেখান থেকে সাত মাইল দূরে রিয়াঙ রেলস্টেশন। মংপুর পাশ দিয়ে বয়ে গিয়ে সেখানেই তিস্তার সঙ্গে মিলেছে রিয়াঙ ‘খলা’ তথা ছোট নদী। স্টেশনের নাম সেই প্রবাহ থেকেই উৎসারিত। ওই স্টেশনে তিস্তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ নিয়ে মৈত্রেয়ী দেবী সাক্ষ্য দিয়েছেন এভাবে– ‘ট্রেন আসতে তখনও কিছুক্ষণ দেরি ছিল, কোনো রকমে একটা ভদ্রগোছের হাতাওয়ালা চৌকি যোগাড় করে প্ল্যাটফর্মের কাঁকরের উপর ওঁকে বসানো হল। সামনে প্রকাণ্ড উদ্ধত পাহাড় গভীর অরণ্য বুকে করে দাঁড়িয়ে আছে, নীচে স্রোতস্বিনী কলভাষিণী নদী, মাঝখানে বসে আছেন জগতের মহাকবি, মহিমান্বিত স্তব্ধ সমাহিত মূর্তি। ধূসর রঙের জোব্বা পরা, মাথায় কালো টুপি, পথে সংগৃহীত এক গুচ্ছ সিন্কোনা ফুল হাতে। দূরের দিকে তাকিয়ে স্থির বসেছিলেন’ (মংপুতে রবীন্দ্রনাথ, ১৯৪৩)।
সেই স্টেশন থেকে ‘খেলনা ট্রেন’ সহযোগে শিলিগুড়ি যাওয়ার পথে রবীন্দ্রনাথের তিস্তা দেখার বর্ণনা– ‘তখন বর্ষা শুরু হয়েছে। স্রোতস্বিনী তিস্তার ঘোলা মেটে জল বড় বড় পাথরের চারিদিক পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরে চলেছে’ (মৈত্রেয়ী দেবী, মংপুতে রবীন্দ্রনাথ, ১৯৪৩)।
রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠেও রয়েছে তিস্তাসহ যমুনা অববাহিকার নদীগুলোর কথা– ‘শক্তিবাবু তাঁর নৌকো লাল রঙ ক’রে নিলেন। তার নাম দিলেন রক্তজবা। তিনি মাঝে মাঝে নৌকোয় ক’রে কখনো তিস্তা নদীতে কখনো আত্রাই নদীতে কখনো ইচ্ছামতীতে বেড়াতে যান।’ তিস্তার কথা আসবে আর সেখানে রংপুর আসবে না? রবীন্দ্রনাথের রচনাতেও তিস্তা প্রসঙ্গে রংপুরের কথা এসেছে। ‘মংপু পাহাড়ে’ কবিতায় তিনি লিখেছেন– ‘কুজ্ঝটিজাল যেই/ সরে গেল মংপু-র/ নীল শৈলের গায়ে/দেখা দিল রঙপুর/ ঐ ঢালু গিরিমালা, রুক্ষ ও বন্ধ্যা,/ দিন গেলে ওরই ’পরে জপ করে সন্ধ্যা।/ নিচে রেখা দেখা যায় ঐ নদী তিস্তার,/ কঠোরের স্বপ্নে ও মধুরের বিস্তার’।
পাঁচ.
সন্দেহ নেই, ব্রহ্মপুত্র বড় নদী। কেবল ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা-আসামের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নয়, তিব্বতের সভ্যতাকেও সংযুক্ত করেছে এই নদী। সেই অর্থে বলা চলে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সভ্যতার সংযোগসূত্র ব্রহ্মপুত্র। সভ্যতাভেদে তাই নদীটির ভিন্ন ভিন্ন নাম; সাঙপো, সিয়াঙ, বুঢ়া লুইত, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা।
বড় বড় নদনদী, যেগুলো একাধিক সভ্যতার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে, সেসব প্রবাহ সাধারণত কেন ‘পবিত্র’ বিবেচিত হয়, ব্রহ্মপুত্রকে উপলক্ষ করেই সেটার ব্যাখ্যা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এক নিবন্ধে লিখেছেন– ‘ভারতের সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি যত বড়ো বড়ো নদনদী আছে সবগুলি সেকালে পবিত্র বলে গণ্য হয়েছিল। কেন! কেননা এই নদীগুলি মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ-স্থাপনের উপায়স্বরূপ ছিল। ছোটো ছোটো নদী তো ঢের আছে– তাদের ধারার তীব্রতা থাকতে পারে; কিন্তু না আছে গভীরতা, না আছে স্থায়িত্ব। তারা তাদের জলধারায় এই বিশ্বমৈত্রীর রূপকে ফুটিয়ে তুলতে পারে নি। মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনে তারা সাহায্য করে নি। সেইজন্য তাদের জল মানুষের কাছে তীর্থোদক হল না’ (বিশ্বভারতী)।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রসঙ গ প রবন ধ অবব হ ক নদ গ ল হয় ছ ল কর ছ ন প রব হ অবস থ ভ রমণ
এছাড়াও পড়ুন:
রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মপুত্র-দর্শন
প্রেম, পূজা ও প্রকৃতির কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নদীরও কবি। তাঁর কবিতা, সংগীত, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধে যেভাবে নদী প্রসঙ্গ, চরিত্র, উপমা হিসেবে উঠে এসেছে, তার তুলনা পাওয়া কঠিন। আর এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশ। কবির ঘনিষ্ঠ শিষ্য ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী লিখেছেন– ‘পদ্মা ও নদীময় বঙ্গ যে তাঁর কাব্যকে একটি বিশেষ দিকে প্ররোচিত করেছিল তাতে কারো সন্দেহ নাই’ (শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ, ১৯৭২)।
বর্তমান বাংলাদেশের তিনটি পরগনা ছিল ঠাকুর পরিবারের জমিদারি– বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার বিরাহিমপুর পরগনা, এর সদর কাছারি শিলাইদহে; বর্তমান নওগাঁ জেলার কালীগ্রাম পরগনা, এর সদর কাছারি পতিসরে; বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার সাজাদপুর পরগনা, এর সদর কাছারি বর্তমান শাহজাদপুরে। প্রথম পরগনাটি গঙ্গা বা পদ্মা অববাহিকায় এবং পরের দুই পরগনা ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা অববাহিকায় অবস্থিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক দশক (১৮৯১-১৯০১) এই তিনটি জমিদারি কমবেশি তদারক করেছেন। এ উপলক্ষে তিনি তিন এলাকায় সাধারণত নদীপথে পারিবারিক বজরা ‘পদ্মা’ নিয়ে ভ্রমণ করেছেন। সপরিবারে কুঠিবাড়ি তিনটিতে থেকেছেন। এর প্রভাব পড়েছে তার দর্শন ও সাহিত্যে। রবীন্দ্রসাহিত্যে নদনদীর প্রভাব নিয়ে প্রমথনাথ বিশী লিখেছেন– ‘বাংলাদেশের মতোই রবীন্দ্রনাথের কবিত্ব নদীমাতৃক’ (শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ, ১৯৭২)।
এটা ঠিক, রবীন্দ্র সাহিত্যে গঙ্গা ও পদ্মা প্রসঙ্গ সবচেয়ে বেশি আলোচিত। পূর্ববঙ্গের নদীপথে তাঁর ভ্রমণসঙ্গী পারিবারিক বজরাটির নাম ‘পদ্মা’ তিনিই রেখেছিলেন। ১৮৯৩ সালের ২ মে ‘ছিন্নপত্র’ লিখেছেন তিনি– ‘বাস্তবিক পদ্মাকে আমি বড় ভালোবাসি।’ কিন্তু ব্রহ্মপুত্র বা যমুনাও রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্যে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আক্ষেপের বিষয়, রবীন্দ্রনাথের গঙ্গা বা পদ্মা নিয়ে যত বেশি আলোচনা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা নিয়ে যেন ততখানিই কম। অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবস্থান, ভ্রমণ ও লেখালেখির বড় অংশজুড়ে রয়েছে ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা।
দুই.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলাদেশ’ কেবল তখনকার পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গেই সীমিত ছিল না। আসামও ছিল তার অংশ। গঙ্গা থেকে ব্রহ্মপুত্র সেই বৃহত্তর প্রদেশের সীমারেখা। ‘সাহিত্য পরিষৎ’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন– ‘ভাগীরথীর তীর হইতে ব্রহ্মপুত্রের তীর পর্যন্ত, সমুদ্রকূল হইতে হিমাচলের পাদদেশ পর্যন্ত, বাংলাদেশের সমস্ত প্রদেশ’। আর ভারতবর্ষ বোঝাতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ অনেকবারই সিন্ধু থেকে ব্রহ্মপুত্র উল্লেখ করেছেন।
‘গোঁফ এবং ডিম’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন– ‘ওই দেখো ভারতবর্ষেও স্বাধীনতা-সূর্য ধীরে ধীরে উত্থান করিতেছে, ওই দেখো সিন্ধু নদ হইতে ব্রহ্মপুত্র ও হিমালয় হইতে কন্যাকুমারী পর্যন্ত আলোকিত হইয়া উঠিতেছে’।
বাংলা প্রসঙ্গে ‘বিজয়া সম্মিলন’ প্রবন্ধে বলেছেন– ‘আজ সায়াহ্নে গঙ্গার শাখা-প্রশাখা বাহিয়া ব্রহ্মপুত্রের কূল-উপকূল দিয়া একবার বাংলাদেশের পূর্বে পশ্চিমে আপন অন্তরের আলিঙ্গন বিস্তার করিয়া দাও।’
যদিও রবীন্দ্রনাথের সেই বুদ্ধিবৃত্তিক প্রত্যাশা রাজনীতির মারপ্যাঁচে পূরণ হয়নি। এই অঞ্চলে এসেছিল ১৯০৫ সালের ‘বঙ্গভঙ্গ’। পূর্ববঙ্গকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভাগ করে আসামের সঙ্গে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ নাম দেওয়া হয়। এই দুই অংশের অভিন্ন নদী ব্রহ্মপুত্র। তার আগে ১৯০৪ সালে ‘বঙ্গবিভাগ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ সেই ব্রহ্মপুত্রকেই বাংলার ঐক্যের ধারা সাব্যস্ত করেন– ‘বাংলার পূর্বপশ্চিমকে চিরকাল একই জাহ্নবী তাঁহার বহু বাহুপাশে বাঁধিয়াছেন, একই ব্রহ্মপুত্র তাঁহার প্রসারিত ক্রোড়ে ধারণ করিয়াছেন।’ পরে অবশ্য সেই বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছিল। আরও পরে ১৯৪৭ সালে ফের বিভক্ত হয়েছিল বাংলা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ ঘটেছিল তার আগেই, ১৯৪১ সালে।
আগেই বলেছি, পারিবারিক জমিদারিসূত্রে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ভাটির অংশে, যা যমুনা নামে পরিচিত, রবীন্দ্রনাথের আগেই যাতায়াত ছিল। সেই তুলনায় ব্রহ্মপুত্রের উজানের দিকে তিনি অপেক্ষাকৃত পরে যান। দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ মোট তিন দফায় আসাম-মেঘালয় অংশ ভ্রমণ করেছিলেন; ১৯১৯, ১৯২৩, ও ১৯২৭ সালে। (টেগোর’স আসাম টাই, দ্য টেলিগ্রাফ, ১৪ ডিসেম্বর ২০১২)।
উজানের ব্রহ্মপুত্র প্রথমবার দর্শনেই এর পানিতে স্নান করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৯ সালের অক্টোবর মাসে। বর্তমান বাংলাদেশের বগুড়ার সান্তাহার জংশন থেকে ‘আসাম মেইল’ হয়ে তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ফুলকুমার, গঙ্গাধর, মানস, সঙ্কোশ পার হয়ে ব্রহ্মপুত্রের ডান তীরে কামরূপ জেলার আমিনগাঁও রেলস্টেশনে নেমেছিলেন। পথে পড়েছিল বর্তমান কুড়িগ্রামের যাত্রাপুর রেলস্টেশন। ব্রহ্মপুত্র পাড়ে সেই যাত্রাপুর এখনও বিখ্যাত সাপ্তাহিক হাট হিসেবে টিকে রয়েছে; যদিও ১৯২৬ সালের আগে খোদ রেলস্টেশনটি ব্রহ্মপুত্রগর্ভে বিলীন হয়। যাহোক, আমিনগাঁওয়ে ব্রহ্মপুত্রের পান্ডু ঘাটে ভেড়ানো ছিল গুয়াহাটি-গোয়ালন্দ রুটে চলাচলকারী একটি জাহাজ। সেখানে উঠে ব্রহ্মপুত্রের পানিতে স্নান সারেন। পরে এক চিঠিতে তিনি রানু অধিকারীকে এ প্রসঙ্গে লিখছেন– ‘ভূগোলে পড়া গেছে পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল, কিন্তু বন্যার ব্রহ্মপুত্রের ঘোলা স্রোতে সেদিন তিন ভাগ স্থল এক ভাগ জল। তাতে দেহ স্নিগ্ধ হল বটে কিন্তু নির্মল হল বলতে পারিনে।’ (শিলং যাত্রীর চিঠি, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২২ এপ্রিল ২০১৭)। সেবার তিনি শিলং থেকে সিলেট ভ্রমণেও এসেছিলেন।
কেবল নিবন্ধ, চিঠি ও ভ্রমণে নয়; রবীন্দ্রসাহিত্যেও ব্রহ্মপুত্র এসেছে নানাভাবে। আমরা দেখি, যে শিলং দেখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ পাহাড়ি ব্রহ্মপুত্র দেখেছিলেন, সেই শিলংয়ের পটভূমিতে লেখা ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে নায়ক অমিত নায়িকা লাবণ্যকে ‘বন্যা’ নাম দিয়ে নিজেকে ‘ব্রহ্মপুত্র’ নাম দিতে চান। বন্যা যাতে দু’কূল ভাসিয়ে নিতে পারে। ত্রিপুরা ও পূর্ববঙ্গের পটভূমিতে লেখা ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ব্রহ্মপুত্রের তীরে ক্ষুদ্র গ্রাম’ গুজুরপাড়া থেকে নদীটি রূপ বর্ণনা করেছেন– ‘পূর্বতীরে সূর্যোদয় হইতেছে, অরুণরেখা দেখা দিয়াছে। উভয় তীরের ঘন তরুস্রোতের মধ্য দিয়া, ছোটো ছোটো নিদ্রিত গ্রামগুলির দ্বারের কাছ দিয়া ব্রহ্মপুত্র তাহার বিপুল জলরাশি লইয়া অবাধে বহিয়া যাইতেছে।’
কবিতায় ব্রহ্মপুত্র আরও বেশি উদ্ধৃত, বলা বাহুল্য। যেমন পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থের বিশ্বশোক কবিতায় আমরা ব্রহ্মপুত্রের উল্লেখ পাই। বেদনার বন্যা ও প্রবাহ তুলে ধরতে তিনি ব্রহ্মপুত্রকে রূপক অর্থে নিয়েছেন। এখানে তিনি ব্রহ্মপুত্রকে ‘হৃদয়ের মহানদী’ আখ্যা দিয়ে এর ‘শাখাপ্রশাখায়’ ধাওয়ার কথা বলেছেন। নদী যে নিছক প্রবাহ নয়, বরং একটি অববাহিকা বা বেসিন, প্রতিবেশগত সেই সচেতনতার প্রমাণ আমরা এখানে পাই। যদিও রূপক অর্থে ব্রহ্মপুত্র এসেছে, এখানে নদীর প্রকৃত চরিত্রই ফুটে ওঠে– ‘অশ্রুধারার ব্রহ্মপুত্র/ উঠছে ফুলে ফুলে/ তরঙ্গে তরঙ্গে;/ সংসারের কূলে কূলে/ চলে তার বিপুল ভাঙাগড়া/ দেশে দেশান্তরে।’
যেমন এই নাট্য-কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন– ‘যেদিন হিমাদ্রিশৃঙ্গে নামি আসে আসন্ন আষাঢ়/ মহানদ ব্রহ্মপুত্র অকস্মাৎ দুর্দাম দুর্বার/ দুঃসহ অন্তরবেগে তীরতরু করিয়া উন্মূল/ মাতিয়া খুঁজিয়া ফিরে আপনার কূল-উপকূল।’ (কাহিনী)। ‘কদমাগঞ্জ’ থেকে মালদহে আসার পথে কদমা বোঝাই নৌকা ব্রহ্মপুত্র নদে ডুবে কীভাবে আসামের সদকি জেলার ‘হাংলু-ফিড়াঙ’ পবর্ত এলাকায় সরবতের স্রোত বয়েছিল, সে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের রয়েছে একটি মজার ছড়া। এই ছড়া রবীন্দ্রনাথের ‘ছড়া’ গ্রন্থভুক্ত যদিও সেটা প্রকাশ হয় তাঁর দেহাবসানের স্বল্পকাল পরে। ছড়াটি তিনি লিখেছিলেন মংপুতে অবস্থানকালীন, ১৯৪০ সালের মে মাসে (বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলী ষড়বিংশ খণ্ড)।
তিন.
ব্রহ্মপুত্রের অপর নাম যমুনা। রবীন্দ্রসাহিত্যেও সবচেয়ে বেশি যে নদীর নাম এসেছে, তা যমুনা। অবশ্য কারণ ভিন্ন, বাংলা ভাষায় ‘যমুনা’ বহুমাত্রিক বিশেষ্য। গোটা ভারতবর্ষে এই নামে যেমন একাধিক নদী রয়েছে, তেমনই প্রেমের প্রবাহের রূপকার্থেও ব্যবহৃত হয় যমুনা। এ ছাড়া পৌরাণিকভাবে যমুনা হচ্ছে রাধা ও কৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র। সেই যমুনা উত্তর ভারতে গঙ্গার সমান্তরালে প্রবাহিত; কৃষ্ণে জন্মভূমি মথুরা ও লীলাভূমি বৃন্দাবন এই নদীর তীরে অবস্থিত।
ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশে প্রবেশ করে প্রায় একই পয়েন্টে ডান তীরে তিস্তার সঙ্গে মিলিত এবং বাম তীরে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে বিভক্ত হওয়ার পর থেকে এর নাম ‘যমুনা’। পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পারিবারিক জমিদারির তিন পরগনার দুটিই এই যমুনা অববাহিকায়, আগেই বলেছি। তাঁর রচনাবলীতেও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার এই অংশ তথা যমুনা এবং এর উপনদী ও শাখা নদীগুলো বিশিষ্ট হয়ে আছে।
ব্রহ্মপুত্র-যমুনার শাখ ও উপনদীগুলোর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়েছে ইছামতী (ইচ্ছেমতী), বড়াল (বড়ল), ধলেশ্বরী, আত্রাই, হুড়াসাগর, করতোয়া নদী সঙ্গে। প্রসঙ্গত, তিনি ইছামতী ও ইচ্ছেমতী দুই নামই ব্যবহার করতেন। অন্যান্য নদী যেমন, বড়াল বা গড়াইয়ের ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে। কিন্তু এই নদী নিয়ে দুই নামে দুটি কবিতা রয়েছে। নদীর নামে তিনি আরও কবিতা লিখেছেন; কিন্তু একই নদীর নামে দুই কবিতা আর আছে বলে আমার জানা নেই। তার পরও রবীন্দ্রনাথের জীবনে ও দর্শনে নিঃসন্দেহে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছে তিস্তা।
চার.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ জীবনের কিছুদিন কেটেছে দার্জিলিং জেলার পাহাড়ি জনপদ মংপুতে। ম্যালেরিয়ার ওষুধ কুইনাইনের কাঁচামাল সিঙ্কোনা চাষ ও গবেষণার জন্য নির্ধারিত ওই পাহাড়। সেখানে স্বামীর কর্মসূত্রে বসবাসরত স্নেহভাজন লেখিকা মৈত্রেয়ী দেবীর আমন্ত্রণে ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে চারবার গিয়ে সর্বনিম্ন দুই সপ্তাহ থেকে সর্বোচ্চ দুই মাস অবস্থান করেন রবীন্দ্রনাথ। ওই সময়ের ওপর ভিত্তি করে মৈত্রেয়ী দেবীর বই রয়েছে– ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’।
কলকাতা বা কালিম্পং, যেখানে থেকেই মংপু যান না কেন, তিস্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছেই কবির। মংপুর প্রসঙ্গেই তিনি ‘অনুবাদ চর্চা’ প্রবন্ধে লিখেছেন– ‘১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে দার্জ্জিলিঙের কালিম্পং সাব্ডিভিসনে তিস্তা নদীর পূর্ব্বদিকে একটি নূতন কৃষিক্ষেত্রে সূচনা করা হইয়াছিল’।
এই বঙ্গে নদী ও নারীর তুলনা নেহাত কম নয়; বিশেষত কবি-সাহিত্যিকদের বদৌলতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও মংপু সফরকালে সেই তুলনা দিয়েছেন এভাবে– ‘কি, তোমাদের কলধ্বনি তো তিস্তাকে হার মানাল!’ (মংপুতে রবীন্দ্রনাথ, মৈত্রেয়ী দেবী, ১৯৪৩)।
মংপুর কুইনাইন কারখানার অধ্যক্ষ হিসেবে ডা. মনমোহন সেন যে সরকারি বাড়ি বরাদ্দ পেয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে বাড়িতে চারবার অতিথি হয়েছিলেন, সেখান থেকে সাত মাইল দূরে রিয়াঙ রেলস্টেশন। মংপুর পাশ দিয়ে বয়ে গিয়ে সেখানেই তিস্তার সঙ্গে মিলেছে রিয়াঙ ‘খলা’ তথা ছোট নদী। স্টেশনের নাম সেই প্রবাহ থেকেই উৎসারিত। ওই স্টেশনে তিস্তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ নিয়ে মৈত্রেয়ী দেবী সাক্ষ্য দিয়েছেন এভাবে– ‘ট্রেন আসতে তখনও কিছুক্ষণ দেরি ছিল, কোনো রকমে একটা ভদ্রগোছের হাতাওয়ালা চৌকি যোগাড় করে প্ল্যাটফর্মের কাঁকরের উপর ওঁকে বসানো হল। সামনে প্রকাণ্ড উদ্ধত পাহাড় গভীর অরণ্য বুকে করে দাঁড়িয়ে আছে, নীচে স্রোতস্বিনী কলভাষিণী নদী, মাঝখানে বসে আছেন জগতের মহাকবি, মহিমান্বিত স্তব্ধ সমাহিত মূর্তি। ধূসর রঙের জোব্বা পরা, মাথায় কালো টুপি, পথে সংগৃহীত এক গুচ্ছ সিন্কোনা ফুল হাতে। দূরের দিকে তাকিয়ে স্থির বসেছিলেন’ (মংপুতে রবীন্দ্রনাথ, ১৯৪৩)।
সেই স্টেশন থেকে ‘খেলনা ট্রেন’ সহযোগে শিলিগুড়ি যাওয়ার পথে রবীন্দ্রনাথের তিস্তা দেখার বর্ণনা– ‘তখন বর্ষা শুরু হয়েছে। স্রোতস্বিনী তিস্তার ঘোলা মেটে জল বড় বড় পাথরের চারিদিক পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরে চলেছে’ (মৈত্রেয়ী দেবী, মংপুতে রবীন্দ্রনাথ, ১৯৪৩)।
রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠেও রয়েছে তিস্তাসহ যমুনা অববাহিকার নদীগুলোর কথা– ‘শক্তিবাবু তাঁর নৌকো লাল রঙ ক’রে নিলেন। তার নাম দিলেন রক্তজবা। তিনি মাঝে মাঝে নৌকোয় ক’রে কখনো তিস্তা নদীতে কখনো আত্রাই নদীতে কখনো ইচ্ছামতীতে বেড়াতে যান।’ তিস্তার কথা আসবে আর সেখানে রংপুর আসবে না? রবীন্দ্রনাথের রচনাতেও তিস্তা প্রসঙ্গে রংপুরের কথা এসেছে। ‘মংপু পাহাড়ে’ কবিতায় তিনি লিখেছেন– ‘কুজ্ঝটিজাল যেই/ সরে গেল মংপু-র/ নীল শৈলের গায়ে/দেখা দিল রঙপুর/ ঐ ঢালু গিরিমালা, রুক্ষ ও বন্ধ্যা,/ দিন গেলে ওরই ’পরে জপ করে সন্ধ্যা।/ নিচে রেখা দেখা যায় ঐ নদী তিস্তার,/ কঠোরের স্বপ্নে ও মধুরের বিস্তার’।
পাঁচ.
সন্দেহ নেই, ব্রহ্মপুত্র বড় নদী। কেবল ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা-আসামের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নয়, তিব্বতের সভ্যতাকেও সংযুক্ত করেছে এই নদী। সেই অর্থে বলা চলে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সভ্যতার সংযোগসূত্র ব্রহ্মপুত্র। সভ্যতাভেদে তাই নদীটির ভিন্ন ভিন্ন নাম; সাঙপো, সিয়াঙ, বুঢ়া লুইত, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা।
বড় বড় নদনদী, যেগুলো একাধিক সভ্যতার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে, সেসব প্রবাহ সাধারণত কেন ‘পবিত্র’ বিবেচিত হয়, ব্রহ্মপুত্রকে উপলক্ষ করেই সেটার ব্যাখ্যা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এক নিবন্ধে লিখেছেন– ‘ভারতের সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি যত বড়ো বড়ো নদনদী আছে সবগুলি সেকালে পবিত্র বলে গণ্য হয়েছিল। কেন! কেননা এই নদীগুলি মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ-স্থাপনের উপায়স্বরূপ ছিল। ছোটো ছোটো নদী তো ঢের আছে– তাদের ধারার তীব্রতা থাকতে পারে; কিন্তু না আছে গভীরতা, না আছে স্থায়িত্ব। তারা তাদের জলধারায় এই বিশ্বমৈত্রীর রূপকে ফুটিয়ে তুলতে পারে নি। মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনে তারা সাহায্য করে নি। সেইজন্য তাদের জল মানুষের কাছে তীর্থোদক হল না’ (বিশ্বভারতী)।