ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় টানা দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে থাকা আবদুল হামিদের দেশত্যাগ নিয়ে নানা বিতর্ক ও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। তিনি গত বুধবার রাতে থাইল্যান্ডের উদ্দেশে যাত্রা করেন। এ ঘটনায় চার পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করেছে পুলিশ সদর দপ্তর।

বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, আবদুল হামিদ বুধবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে থাই এয়ারওয়েজের ব্যাংককগামী একটি ফ্লাইটে যাত্রা করেন।

পারিবারিক একটি সূত্রে জানা গেছে, আবদুল হামিদ চিকিৎসার জন্য বিদেশ গেছেন। তাঁর সঙ্গে গেছেন ছোট ছেলে রিয়াদ আহমেদ ও শ্যালক ডা.

নওশাদ খান।

সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ছাত্র আন্দোলনে হামলা ও গুলি করার ঘটনায় কিশোরগঞ্জ থানায় করা একটি মামলার আসামি। মামলাটি করা হয়েছিল গত ১৪ জানুয়ারি। তাতে শেখ হাসিনা, তাঁর বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদসহ মোট ১২৪ জনকে আসামি করা হয়।

এ রকম একটি মামলার আসামি হয়েও সাবেক এই রাষ্ট্রপতি কীভাবে বিমানবন্দর দিয়ে বিদেশে গেলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই ঘটনা নিয়ে সরকার ও সরকারের বাইরে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিবিষয়ক মতবিনিময় সভায় যোগ দিতে দিনাজপুরে গিয়েছিলেন সরকারের স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। আবদুল হামিদের দেশত্যাগে সহায়তাকারীদের পদত্যাগ ও শাস্তির দাবিতে শতাধিক শিক্ষার্থী সেখানে উপদেষ্টার পথরোধ করে বিক্ষোভ করেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সেখানে বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগে সহায়তাকারীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, ‘তাঁদের (আবদুল হামিদকে বিদেশে যেতে সহায়তাকারীদের) কোনো অবস্থায় ছাড় দেওয়া যাবে না। আর যদি শাস্তির আওতায় না আনি, তাহলে আমি সে সময় চলে যাব।’

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এই ঘোষণার পর গতকাল রাত আটটার দিকে আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ইমিগ্রেশন পুলিশের একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহারের কথা গণমাধ্যমকে জানানো হয়। একই সঙ্গে আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে কিশোরগঞ্জের সদর থানার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) একজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার কথাও বলা হয়।

এরপর রাত ৯টার দিকে পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনায় অতিরিক্ত আইজিকে (প্রশাসন) প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া ওই ঘটনায় কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপারকে (এসপি) প্রত্যাহার করা হয়েছে।

দেশত্যাগের ঘটনার নেপথ্যে কী

আবদুল হামিদের দেশত্যাগের নেপথ্যের ঘটনা সম্পর্কে জানতে বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা এবং সরকারের এ-সংক্রান্ত তদারকির দায়িত্বে থাকা অন্তত ১২ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের কেউই নাম প্রকাশ করে এ ঘটনা সম্পর্কে কথা বলতে চাননি। তবে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে ঘটনা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া গেছে।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, আবদুল হামিদ বিমানবন্দরের ভিআইপি গেট ব্যবহার করে ফ্লাইটে উঠেছেন। ভিআইপি গেট ব্যবহার করার বিষয়টি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (সিভিল এভিয়েশন) অগোচরে হওয়ার সুযোগ নেই। ভিআইপি গেট ও লাউঞ্জ ব্যবহারকারীদের ওপর বিমানবন্দরে কর্তব্যরত বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার বাড়তি নজরদারি থাকে। কোনো একটি সংস্থার আপত্তি থাকলেও ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে বাধাহীনভাবে কারও দেশত্যাগের সুযোগ থাকে না।

ইমিগ্রেশন পুলিশের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আবদুল হামিদের দেশত্যাগে আদালতের কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও তাঁর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে কোনো চিঠি দেননি। কোনো গোয়েন্দা সংস্থারও আপত্তি ছিল না। এ কারণে আবদুল হামিদের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করা হয়েছে।

তবে ইমিগ্রেশন পুলিশের এমন বক্তব্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। এ ক্ষেত্রে তাঁদের বক্তব্য হলো, আদালতের নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও বিভিন্ন সংস্থার আপত্তির কারণে অনেকের বিদেশযাত্রা আটকে দেওয়া হয়। কোনো একটি সংস্থা আপত্তি করলেই কারও বাধাহীনভাবে দেশত্যাগের সুযোগ থাকে না। হত্যা মামলার আসামি হওয়ার পরও আবদুল হামিদের নাম কোনো সংস্থার তালিকায় কেন ছিল না, তা নিয়েও সমালোচনা রয়েছে।

পাশাপাশি এই আলোচনাও রয়েছে যে ইমিগ্রেশন হচ্ছে বিদেশযাত্রার অনুমতির শেষ ধাপ। কিন্তু বিমানবন্দরে আসার আগপর্যন্ত এ রকম একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির গতিবিধি সরকারের বিভিন্ন সংস্থার জানার কথা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ভিভিআইপি, ভিআইপি বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি দেশ ছাড়লে তাঁর বিষয়ে বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোতে কর্মরত ব্যক্তিরা তাঁদের ঊর্ধ্বতনদের জানিয়ে থাকেন।

তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, আবদুল হামিদের দেশত্যাগের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অবগত ছিলেন না।

আবদুল হামিদ ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। এরপর তিনি ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তাঁর মেয়াদ শেষে ২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন মো. সাহাবুদ্দিন। বঙ্গভবন ছাড়ার পর আবদুল হামিদ রাজধানীর নিকুঞ্জে তাঁর বাসায় উঠেছিলেন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আবদ ল হ ম দ র দ শত য গ র স ব ক র ষ ট রপত স বর ষ ট র কর মকর ত উপদ ষ ট সরক র র র ঘটন ভ আইপ ঘটন য় তদন ত আপত ত

এছাড়াও পড়ুন:

পানির জন্য সর্বাত্মক যুদ্ধের শঙ্কা

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চলমান সংঘাত ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান এই উত্তেজনার একটি প্রধান কারণ হলো, পানিসম্পদ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন। ভারত ইতোমধ্যেই চেনাব নদীর পানিপ্রবাহ কমিয়ে দিয়েছে। আর এতেই পাকিস্তান আরও সংকটে পড়েছে। এই পানি নিয়ে টানাপোড়েনে দুই দেশের সংঘাত সর্বাত্মক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

২২ এপ্রিল কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পাদিত দীর্ঘদিনের ‘সিন্ধু পানি চুক্তি’ থেকে সরে এসেছে ভারত। দেশটি চেনাবের পানিপ্রবাহও কমিয়ে দিয়েছে। এতে পাকিস্তান পানি সংকটের মুখে পড়েছে। এই অবস্থায় ইসলামাবাদ খুবই অসন্তুষ্ট। এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধও স্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।    

পানি চুক্তি স্থগিত করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি ভারত। গত বুধবার পাকিস্তানের ভূখণ্ডের ৯টি স্থানে সামরিক হামলা চালায় দেশটি। সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার পাশাপাশি সীমান্ত দিয়ে পারাপারও বন্ধ করেছে দুই দেশ। পাকিস্তানকে পানির সংকটে ফেলতে চায় ভারত। পানি চুক্তির সব বিধান নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায় দিল্লি।

১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তান বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় সিন্ধু পানি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল সিন্ধুর ব্যবস্থার পানিবণ্টন নিয়ন্ত্রণ করা। চুক্তি অনুসারে, ভারত পূর্বাঞ্চলের নদী রাবি, বিয়াসসহ তিনটি নদীর ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। অন্যদিকে পাকিস্তান পশ্চিমের 

তিনটি নদী সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব নদীর ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করে, যা দেশটির জলসম্পদের ৮০ শতাংশ প্রয়োজন মেটায়। চুক্তি অনুসারে কোনো পক্ষ এককভাবে চুক্তি থেকে সরে যেতে পারবে না। কিন্তু ভারত একতরফাভাবে চুক্তি থেকে সরে গেছে।   

নদীগুলোর পানিপ্রবাহের ধরন ও নদী নেটওয়ার্ক কাঠামো প্রক্রিয়া ভারতের অনুকূলে। এজন্য ভারত পানিপ্রবাহ কমিয়ে দিলে তা পাকিস্তানের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করায় পাকিস্তানের ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে। ভারত নদীগুলোর পানিপ্রবাহের তীব্রতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এতে পাকিস্তানে পানির ঘাটতি কিংবা বন্যা সৃষ্টি হতে পারে। 

জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে ওই সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হন। তাদের অধিকাংশই পর্যটক। ভারত এই হামলায় পাকিস্তানকে দোষারোপ করে। ভারতের জনগণের মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার দাবি উঠতে থাকে। এই অবস্থায় গত বুধবার ভারত পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এর আগে দেশটি পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত ঘোষণা করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে পানিপ্রবাহ বন্ধ করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। বিশ্বব্যাংকও পানি চুক্তি স্থগিত করার বিষয়ে ভারতের বিরোধিতা করেছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানিপ্রবাহ বন্ধ করা প্রকৃতির স্বাভাবিক চক্রে ব্যাঘাত ঘটানোর শামিল। এই পরিস্থিতির ফলাফল অত্যন্ত খারাপ হতে পারে। মানবসভ্যতা টিকে থাকার সঙ্গে যা সরাসরি জড়িত। এই অবস্থায় ভারতের পদক্ষেপে পাকিস্তান স্বাভাবিকভাবে ক্ষুব্ধ হতে বাধ্য। কারণ পানির প্রবাহ কমে গেলে নদীগুলো শুকিয়ে যাবে। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে দেখা দিতে পারে খরা, অনাবৃষ্টি কিংবা দুর্ভিক্ষ। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে পানিপ্রবাহ সংকটে উত্তপ্ত আবহাওয়া বিরাজ করে থাকে। 

ভারত-পাকিস্তানের এই জলযুদ্ধ শেষ পর্যন্ত পারমাণবিক যুদ্ধেও রূপ নিতে পারে। নিজ স্বার্থে প্রতিবেশী দেশের মধ্যে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দিলে সেই ক্ষতি ভারতের দিকেও পরিচালিত হতে পারে। এই জলযুদ্ধ বিশ্বের বড় বড় যুদ্ধের কারণে হতে দেখা গেছে। নীল নদের পানিপ্রবাহ নিয়ে যুদ্ধের ইতিহাস রয়েছে। জর্ডান নদীর প্রবাহ রোধ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতেরও একটি কারণ। সূত্র: আলজাজিরা, জিও নিউজ।  

সম্পর্কিত নিবন্ধ