ইউনিয়ন ব্যাংকের রাজধানীর মতিঝিলের হাটখোলা শাখায় এক তুঘলকি কাণ্ড ঘটে গেছে। কয়েকজন গ্রাহকের অজান্তে তাঁদের নামে ঋণ মঞ্জুর করে নিজেদের পকেটে ভরার অভিযোগ উঠেছে কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এ কারণে শাখাটির ব্যবস্থাপককে ইতিমধ্যে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রকৃত ঘটনা উদ্‌ঘাটনে তদন্তও শুরু করেছে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়। এদিকে ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা ওই শাখার কর্মকর্তাদের গত বুধবার রাত ১০টা পর্যন্ত অবরুদ্ধ করে রাখেন। এরপরই বিষয়টি জানাজানি হয়।

যখন এ ঘটনা ঘটে, তখন ব্যাংকটি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ইউনিয়ন ব্যাংক এস আলম গ্রুপের দখলে ছিল। গ্রুপটির কর্ণধার সাইফুল আলমের মাত্র ২৪ বছর বয়সী ছেলে আহসানুল আলমকে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান করা হয়েছিল। পরে চেয়ারম্যান হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো.

সেলিম উদ্দিন।

গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংকটির পর্ষদ ভেঙে স্বতন্ত্র পরিচালকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে ইসলামী ও এক্সিম ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মু. ফরীদ উদ্দীন আহমদকে। ইতিমধ্যে ব্যাংকটিতে এমডি হিসেবে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. হুমায়ুন কবির। তাঁরা এখন অনিয়ম খুঁজে বের করার পাশাপাশি ব্যাংকটিকে উদ্ধারের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

যেটা হয়েছে, সেটা ২০১৩ সালে শুরু হয়েছে। আমি এক বছর দায়িত্বে ছিলাম। আমার সময়ে এমন ঋণ হয়েছে ৮ লাখ টাকা। এটা যেভাবেই হোক ব্যাংককে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।জাকির হোসেন, সাবেক ব্যবস্থাপক, হাটখোলা শাখা, ইউনিয়ন ব্যাংক।

ইউনিয়ন ব্যাংকের হাটখোলা শাখাটি ঢাকার মতিঝিলের ইত্তেফাক ভবনের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত। ব্যাংক প্রতিষ্ঠার বছর ২০১৩ সালে এ শাখা চালু করা হয়। শাখাটিতে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বে ছিলেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা। তাঁরা নানা সময়ে শাখাটি থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে এস আলমকে সুবিধা দেন। এখন শাখাটির আমানতের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। ঋণের সিংহভাগ বিভিন্ন নামে এস আলম গ্রুপ নিয়ে গেছে বলে ব্যাংকটির তদন্তে উঠে এসেছে। ফলে এটি গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে সমস্যায় পড়েছে।

ইউনিয়ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, কয়েকজন গ্রাহকের নামে ঋণ রয়েছে—এমন খবর এর মধ্যে জানাজানি হয়ে গেছে। যদিও তাঁরা ঋণের টাকা পাননি। গত কয়েক দিনে এমন ১২-১৫ জন গ্রাহক ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাঁদের নামে প্রায় এক কোটি টাকা ঋণের সন্ধান মিলেছে। এ জন্য তাঁরা ঋণ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার দাবি জানিয়েছেন ব্যাংকের কাছে। তবে ব্যাংক এতে রাজি হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে বুধবার ওই গ্রাহকেরা শাখাটির কর্মকর্তাদের আটকে রাখেন। ২০২৩ সালে এ শাখার ব্যবস্থাপক ছিলেন জাকির হোসেন। তাঁকে ইতিমধ্যে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া আগে কর্মরত ছিলেন, এমন কয়েকজন কর্মকর্তাকেও বরখাস্ত করা হয়েছে।

জানতে চাইলে জাকির হোসেন গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেটা হয়েছে, সেটা ২০১৩ সালে শুরু হয়েছে। আমি এক বছর দায়িত্বে ছিলাম। আমার সময়ে এমন ঋণ হয়েছে ৮ লাখ টাকা। এটা যেভাবেই হোক ব্যাংককে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

এ নিয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকটির বর্তমান শাখা ব্যবস্থাপক এ এন এম সাদান জাহান প্রথম আলোকে বলেন, অনেকের নামে ঋণ রয়েছে। কিন্তু তাঁরা ঋণ পাননি বলে জানাচ্ছেন। প্রধান কার্যালয় বিষয়টি তদন্ত করছে। এরপরই পুরো তথ্য পাওয়া যাবে।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৮৭ শতাংশ। এই ব্যাংকের ৯০ শতাংশ ঋণ বিভিন্ন নামে এস আলম গ্রুপ নিয়ে গেছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে ইউনিয়ন ব্যাংকের সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) তহবিলের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে এর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি দুটি মামলা হয়েছে। একটি মামলায় ২০২২ ও ২০২৩ সালে দরিদ্রদের মধ্যে ত্রাণের কম্বল বিতরণের নামে অতিরিক্ত বিল দেখিয়ে প্রায় ২৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়, ৭ লাখ ৮৫ হাজার কম্বলের বিপরীতে অতিরিক্ত বিল দেখিয়ে এ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।

মামলায় মোকাম্মেল হক চৌধুরী ছাড়াও ব্যাংকটির সাবেক দুই চেয়ারম্যান আহসানুল আলম এবং মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিনকেও আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোল্লা ফজলে আকবর, সাবেক পরিচালক মারজিনা শারমিন, মো. রাশেদুল আলম, শওকত হোসেন, মোহাম্মদ ফজলে মোরশেদ, হালিমা বেগম, ওসমান গণি, মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, মোহাম্মদ মোস্তান বিল্লাহ, সাবেক স্বতন্ত্র পরিচালক মো. আবদুল কুদ্দুস ও মো. আবদুস সালামকে আসামি করা হয়েছে।

একই মামলায় ব্যাংকটির হেড অব এফএডি ও সিএফও রুহুল আমিন, হেড অব পিআরডি এ কে এম জহির উদ্দীন ইকবাল চৌধুরী, সিনিয়র ক্যাশ অফিসার মো. বোরহান উদ্দীন চৌধুরী, ক্যাশ ইনচার্জ আবদুল হালিম এবং অপারেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ রাশিদ শহীদও আসামি। নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী সানি এন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটর জনি মিয়াকেও আসামি করা হয়েছে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এস আলম গ র প ২০১৩ স ল কর মকর ত ম হ ম মদ গ র হক র র ব যবস ল আলম

এছাড়াও পড়ুন:

ইসরায়েলের হামলায় নিহত ফিলিস্তিনি ফুটবলের ‘পেলে’

ফিলিস্তিন জাতীয় দলের সাবেক ফরোয়ার্ড সুলেইমান আল–ওবেইদ ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছেন। গাজার দক্ষিণাঞ্চলে মানবিক সাহায্য পেতে অপেক্ষমাণ ফিলিস্তিনি জনতার ওপর ইসরায়েলি বাহিনী হামলা চালালে প্রাণ হারান ৪১ বছর বয়সী এই ফুটবলার। ফিলিস্তিন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (পিএএফ) গতকাল তাদের ওয়েবসাইটে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সুলেইমানের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে।

আরও পড়ুনবন্ধু সুয়ারেজ ও ‘দেহরক্ষী’ দি পলে কোয়ার্টার ফাইনালে মেসির মায়ামি৫ ঘণ্টা আগে

পিএএফের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘গাজা উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলে মানবিক সাহায্যের জন্য অপেক্ষমাণ মানুষের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় শহীদ হয়েছেন জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড় ও বিচ সার্ভিসেস দলের তারকা সুলেইমান আল–ওবেইদ। ফিলিস্তিন ফুটবলে সুলেইমান “দ্য গ্যাজেল (হরিণ)”, “দ্য ব্লাক পার্ল (কালো মুক্তা)”, “হেনরি অব প্যালেস্টাইন” এবং “পেলে অব প্যালেস্টাইন ফুটবল” নামে পরিচিত ছিলেন। পাঁচ সন্তান রেখে মারা গেছেন ফিলিস্তিন ফুটবলের এই পেলে।’

গাজায় জন্ম নেওয়া সুলেইমান সার্ভিসেস বিচ ক্লাবের হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন। এরপর পশ্চিম তীরে গিয়ে সেখানকার ক্লাব আল আমারি ইয়ুথ সেন্টারে ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত খেলেন। ২০১০–১১ মৌসুমে ফিলিস্তিনের প্রথম পেশাদার ফুটবল লিগ জেতেন সুলেইমান। আল আমারি ছেড়ে আল শাতিয়া ক্লাবে এক মৌসুম খেলেন সুলেইমান। এরপর গাজা স্পোর্টস ক্লাবের হয়ে সাউদার্ন গভর্নরেটস প্রিমিয়ার লিগে ২০২৬–১৭ মৌসুমে ১৭ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। পরের মৌসুমে আল খাদামা ক্লাবের হয়েও লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন।

আরও পড়ুনলা লিগায় সর্বোচ্চ বেতন পাওয়া ১০ ফুটবলার৬ ঘণ্টা আগে

পিএএফের বিবৃতিতে আরও জানানো হয়, দুর্দান্ত গতি ও দক্ষতার জন্য ২০০৭ সালে ফিলিস্তিন জাতীয় দলে জায়গা করে নেন সুলেইমান। ২০১৩ সালে জাতীয় দলের হয়ে শেষ ম্যাচটি খেলার আগে ২৪ ম্যাচে করেন ২ গোল। এর মধ্যে সুলেইমানের বিখ্যাত গোলটি ২০১০ সালে পশ্চিম এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন চ্যাম্পিয়নশিপে। ইয়েমেনের বিপক্ষে ‘সিজর্স কিকে’ চোখধাঁধানো গোলটি করেছিলেন।

সুলেইমানের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কিংবদন্তি এরিক ক্যান্টোনা নিজের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডলে লিখেছেন, ”‘সাহায্য পাওয়ার আশায় রাফায় অবস্থান করার সময় ফিলিস্তিন জাতীয় দলের তারকা সুলেইমান আল–ওবেইদকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। তাকে “ফিলিস্তিনের পেলে” ডাকা হতো। আমরা তাদের আর কত গণহত্যা করতে দেব? ফিলিস্তিন মুক্ত হোক।’”

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘লম্বা ক্যারিয়ারে সুলেইমান আল–ওবেইদ ১০০–এর বেশি গোল করে ফিলিস্তিন ফুটবলের অন্যতম উজ্জ্বল তারকায় পরিণত হয়েছিলেন।’ তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে খেলাধুলা ও স্কাউটিং–সংশ্লিষ্ট পরিবারে শহীদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৬৬২, যেটা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের নির্মূলীকরণ যুদ্ধের মাধ্যমে শুরু হয়। ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন–সংশ্লিষ্ট মৃত মানুষের সংখ্যা ৩২১। এর মধ্যে রয়েছেন খেলোয়াড়, কোচ, প্রশাসক, সংগঠক, রেফারি ও ক্লাবের বোর্ড সদস্য।’

তবে গত ২৩ জুলাই পিএএফের এক্সে করা পোস্টের বরাত দিয়ে ফুটবলপ্যালেস্টাইন ওয়েবসাইট জানিয়েছে, গত ৬৬৯ দিনে ইসরায়েলের হামলায় ৪০০–এর বেশি ফুটবলার নিহত হয়েছেন। সেই পোস্টে তখন জানানো হয়েছিল, সর্বশেষ ৬৫৬ দিনে খেলাধুলা ও স্কাউটিং–সংশ্লিষ্ট ৮০০–এর বেশি নিহত হয়েছেন ইসরায়েলের হামলায়।

গত ২৯ জুলাই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ফিলিস্তিন অলিম্পিক কমিটি জানিয়েছে, শুধু জুলাই মাসেই গাজা ও দখলকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের হামলায় ৪০ জন ফিলিস্তিনি অ্যাথলেট নিহত হয়েছেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ‘একেকটি দিন যায় আর ফিলিস্তিনের ক্রীড়াঙ্গনে বিয়োগান্ত ঘটনার নতুন অধ্যায় যোগ হয়।’

গাজায় গণহত্যামূলক যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ৬১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নাগরিক মারা গেছেন। আহত হয়েছেন দেড় লাখের বেশি; তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু বলে জানিয়েছে ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম প্রেসটিভি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাংলা লোকগানের রিয়েলিটি শো ‘ম্যাজিক বাউলিয়ানা’ শুরু হচ্ছে আবার
  • ইসরায়েলের হামলায় নিহত ফিলিস্তিনি ফুটবলের ‘পেলে’
  • শাহবাগীরা বিগত সময়ে ফ্যাসিবাদের বৈধতা দিয়েছে: সাদিক কায়েম