প্রতিবছরের মতো এবারও হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসল্লি পবিত্র হজ পালনের উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়ে যাচ্ছেন। হজযাত্রীদের বড় অংশই বয়স্ক। তাঁদের অনেকেরই আছে নানা ক্রনিক রোগ, যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, হাঁপানি ইত্যাদি। হজে গিয়ে যেন তাঁরা সুস্থ থাকতে পারেন, সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি। প্রতিবছর হজে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসল্লি অসুস্থ হয়ে পড়েন, অনেকে মারাও যান।
সংক্রমণ
হজে লাখ লাখ মুসল্লির সমাগম ঘটে। তাই এখানে যেকোনো সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া সহজ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ। কারণ, এই জীবাণু বাতাসে ড্রপলেট আকারে ছড়ায়। বয়স্ক ও ডায়াবেটিসের রোগীর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকে বলে সহজেই আক্রান্ত হতে পারেন। তাই ফ্লু, নিউমোনিয়া এড়াতে মুখে মাস্ক পরুন, বারবার হাত পরিষ্কার করুন। হাঁচি–কাশির আদবকেতা মেনে চলুন। সম্ভব হলে যাওয়ার আগে ফ্লু ও নিউমোনিয়ার টিকা দিয়ে নিন। আরেকটি জটিল সংক্রমণ হলো মেনিনজাইটিস বা মস্তিষ্কের পর্দার প্রদাহ, যা প্রাণঘাতী হতে পারে। এটিও ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ছড়ায়। হজে যাওয়ার আগে মেনিনজাইটিসের টিকা নেওয়া জরুরি। যেকোনো জ্বর, কাশি, জ্বরের সঙ্গে ঘাড় শক্ত হওয়া, শরীরে র্যাশ দেখা দিলে দ্রুত মেডিকেল ক্যাম্পের চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রস্রাবে সংক্রমণ হলে জ্বরের সঙ্গে প্রস্রাবে জ্বালা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক লাগবে।
ডায়রিয়া
বাইরের খাবার খেতে হয় বলে বদহজম বা ডায়রিয়া হতে পারে। এমন হলে মুখে খাওয়ার স্যালাইন খাবেন, বমি থাকলে শিরায় স্যালাইন নিতে হবে। ডায়রিয়া বা বমি হলে কী ওষুধ খাবেন, তা জেনে নিয়ে সঙ্গে বহন করুন। বাসি–পচা খাবার খাবেন না।
হজযাত্রীদের বড় অংশই বয়স্ক। হজে গিয়ে যেন তাঁরা সুস্থ থাকতে পারেন, সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি।পানিশূন্যতা
সৌদি আরবে অনেক গরম, তাই পানিশূন্যতা হতে পারে যে কারও। প্রচুর পানি পান করতে হবে। যদি মাথা ব্যথা করে, চোখ বসে যায় ও প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়, তবে বুঝবেন ডিহাইড্রেশন হচ্ছে। পানির সঙ্গে অন্যান্য তরলও পান করবেন। অনেকে টয়লেটে যাওয়ার ভয়ে পানি কম খান, যা একেবারেই ঠিক নয়। হিট স্ট্রোক এড়াতে ছাতা বা হ্যাট ব্যবহার করবেন। ঢিলেঢালা কাপড় পরবেন।
দীর্ঘমেয়াদি রোগে সতর্কতা
যাঁদের হাঁপানি আছে, তাঁরা যথেষ্ট ইনহেলার ও ওষুধ সঙ্গে নেবেন। ডায়াবেটিসের রোগীরা থার্মোফ্লাস্কে ইনসুলিন নিতে পারেন। গ্লুকোমিটারে মাঝেমধ্যে রক্তে শর্করা পরীক্ষা করবেন ও সে অনুযায়ী মাত্রা ঠিক করবেন। সঠিক সময়ে খাবার গ্রহণ করতে চেষ্টা করবেন। উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা রক্তচাপ মাপার যন্ত্র নিতে পারেন। অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার খেলে রক্তচাপ বাড়তে পারে।
পায়ের যত্ন
অনেক হাঁটতে হয় বলে পায়ে আঘাত, ঘা হতে পারে। সঠিক মাপের আরামদায়ক জুতা পরতে হবে। একাধিক জুতা সঙ্গে নেওয়া ভালো। খালি পায়ে হাঁটার জায়গায় মোজা পরে নেওয়া উচিত। বারবার অজু করার পর পায়ের আঙুলের ফাঁকগুলো মুছে নেবেন। পায়ে কোনো ক্ষত হলে অ্যান্টিবায়োটিক মলম লাগান বা ড্রেসিং করে নিন।
অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ, ইমেরিটাস অধ্যাপক, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ফিলিস্তিনকে শক্তিধর পশ্চিমাদের স্বীকৃতি, তবু চলছে জাতিগত নিধন
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে নতুন করে স্বীকৃতি দেওয়া পশ্চিমা দেশের তালিকা ক্রমেই বড় হচ্ছে। যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, পর্তুগালের পর এই স্বীকৃতি দিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশ ফ্রান্স। কিন্তু এমন পদক্ষেপের পরও ফিলিস্তিনের গাজায় থামছে না জাতিগত নিধন। সোমবারও ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৩৭ ফিলিস্তিনি।
যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগাল ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে রোববার। এর পর দিন সোমবার জাতিসংঘে এক অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ঘোষণা করেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। তিনি বলেন, গাজায় যুদ্ধ বন্ধ এবং হামাসের হাতে এখনো আটক থাকা ৪৮ জন জিম্মিকে মুক্ত করার সময় এসেছে।
বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা থেকে মাত্র কয়েক মুহূর্ত দূরে আছে উল্লেখ করে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমরা আর অপেক্ষা করতে পারি না।’
ইসরায়েলের ভূখণ্ডে ঢুকে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধারা যে হামলা চালান, তার নিন্দা জানিয়ে মাখোঁ বলেন, পাশাপাশি দুটি রাষ্ট্র তৈরির মাধ্যমে ওই এলাকায় শান্তি দেখতে চান তিনি। মাখোঁ বলেন, ‘কোনো কিছুই চলমান যুদ্ধের ন্যায্যতা তৈরি করে না।’
এর মধ্যে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া বিভিন্ন দেশের নাম উল্লেখ করেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। আন্দোরা, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, মোনাকো, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সান মারিনোসহ কয়েকটি দেশের নাম বলেন তিনি।
এ ছাড়া স্পেন, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে ও সুইডেন একই পথ অনুসরণ করতে যাচ্ছে বলেও জানিয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট।
১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রামের নেতা ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে এ নিয়ে জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্যদেশের দেড় শ’র বেশি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে বহুপ্রতীক্ষিত দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার আশা করছে পশ্চিমা দেশগুলো। ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংকট সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির মাধ্যমে যে শান্তিপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তার ভিত্তি ছিল এই দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান। যদিও ইসরায়েলের পশ্চিমা মিত্রদের অনাগ্রহের কারণে এ উদ্যোগ কখনো আলোর মুখ দেখেনি।
এখন ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের মিত্রদের দেওয়া এই স্বীকৃতি বাস্তবে বড় কোনো পরিবর্তন না আনলেও তা ফিলিস্তিনিদের প্রতি একটি শক্তিশালী নৈতিক বার্তা। এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন আরও জোরদার হলো। যদিও এসবের তোয়াক্কা না করে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ফিলিস্তিনে নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী।
সর্বশেষ প্রায় দুই বছর আগে গাজায় ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর থেকে সোমবার পর্যন্ত ৬৫ হাজার ৩৪৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ৬৬ হাজার ৭৯৫ জন। বহু মানুষ এখনো নিখোঁজ। শিশুদের নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্য অনুযায়ী, নিহত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে অন্তত ২০ হাজার শিশু রয়েছে।
এ তো শুধু হত্যার হিসাব। ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় গাজার প্রায় ৮০ শতাংশ ভবন হয় ধ্বংস, নাহয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের স্যাটেলাইট সেন্টার। সংঘাতের শুরু থেকে গত জুলাই পর্যন্ত করা তাদের হিসাবে গাজায় ২ লাখ ৪৭ হাজার ১৯৫ স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। এর মধ্যে হাসপাতাল ২১৩টি। আর স্কুল ১ হাজার ২৯টি। এসব স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিলেন বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস। এতে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। সেদিন থেকেই গাজায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ইসরায়েলের হামলার মুখে প্রাণ বাঁচাতে বারবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দা। এমনই একজন ফিলিস্তিনি নাবিল জাবের। তিনি বলেন, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির পরও হামলা থামছে না। এর জেরে ফিলিস্তিনিদের অধিকার বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ইসরায়েলে ওপর বড় কোনো চাপ আসবে বলে মনে করেন না তিনি।
পশ্চিম তীর দখলের পরিকল্পনা ইসরায়েলেরফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার শুরুটা হয়েছিল ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে। এতে সই করেছিলেন যুক্তরাজ্যের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর। ওই ঘোষণায় ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের জন্য একটি আবাস গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় দুই রাষ্ট্রভিত্তিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়।
একই পরিকল্পনায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও তা কখনো আলোর মুখ দেখেনি; বরং ইসরায়েল ক্রমেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য নির্ধারিত ভূখণ্ড দখলের দিকে এগিয়েছে। ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনের গাজা ও পশ্চিম তীর দখল করে নেয় তারা। ২০০৭ সালে গাজার দখলদারি ছেড়ে দিলেও পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি স্থাপন ক্রমেই বাড়িয়েছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলছেন, পশ্চিমা দেশগুলোর স্বীকৃতির জবাবে পশ্চিম তীরের কিছু অংশ ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। লক্ষ্য, ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র সৃষ্টির সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দেওয়া। গতকাল ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোতরিচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ‘ব্রিটেন বা অন্য দেশগুলোর আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার দিন শেষ হয়ে গেছে।’
পশ্চিম তীর দখলে ইসরায়েলের পরিকল্পনার কড়া সমালোচনা করেছে যুক্তরাজ্য। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভেট কুপার বিবিসিকে বলেছেন, পশ্চিম তীরের অংশ দখল না করতে ইসরায়েলকে সতর্ক করা হয়েছে।
পশ্চিম তীর দখলের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে মিত্র কয়েকটি দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। যেমন সংযুক্ত আরব আমিরাত। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আব্রাহাম অ্যাকর্ডের আওতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছিল আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও মরক্কো।
‘চারদিকে আতঙ্ক’গাজায় প্রায় দুই বছর ধরে ইসরায়েলের আগ্রাসনের মধ্যে দুই দফায় মাত্র দুই মাসের কিছুটা বেশি সময় যুদ্ধবিরতি ছিল। এরপরও যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা চলছিল। তবে সম্প্রতি হামাসের সঙ্গে আলোচনা থেকে সরে এসেছে ইসরায়েল। এমনকি যেখানে আলোচনা চলছিল, সেই কাতারেও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। তাদের ভাষ্য, হামাস নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে ওই হামলা ছিল।
এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা যখন ফিকে হয়ে আসছে, তখন গাজায় হামলা আরও বাড়িয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। গাজার দক্ষিণে রাফা ও খান ইউনিস এবং মধ্যাঞ্চলে দেইর আল–বালাহ তছনছ করার পর ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে উত্তরের গাজা নগরীতে স্থল অভিযান শুরু করেছে তারা। গতকালও গাজায় অন্তত ৩৭ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ জনই গাজা নগরীর বাসিন্দা।
নগরীর আল–শিফা হাসপাতালে দায়িত্বে রয়েছেন অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক সায়া আজিজ। আল–জাজিরাকে সায়া আজিজ বলেন, গতকাল এক হামলার পর রক্তে ভিজে গিয়েছিল চারপাশ। মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিল। চারদিকে শুধু আতঙ্ক।
এমন অমানবিকতার মধ্যে গাজা নগরী থেকে বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েল। প্রাণ বাঁচাতে উপত্যকার উত্তর থেকে দক্ষিণের দিকে পাড়ি জমাচ্ছেন হাজারো ফিলিস্তিনি। গতকাল পর্যন্ত সাড়ে চার লাখের বেশি মানুষ গাজা নগরী ছেড়েছেন বলে এএফপির খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। দক্ষিণে তাঁদের যে আল–মাওয়াসি এলাকায় ইসরায়েল যেতে বলেছে, সেখানেও হামলা হচ্ছে।
গাজা নগরীতে অভিযান শুরুর দিনেই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল জাতিসংঘের গঠন করা একটি আন্তর্জাতিক স্বাধীন কমিশন। তাতে বলা হয়েছে, উপত্যকাটিতে প্রায় দুই বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ইসরায়েল। এর আগে গাজায় ইসরায়েল জাতিগত নিধন চালাচ্ছে—এমন অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মামলা করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
জাতিসংঘের ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৪৮ সালের ‘জেনোসাইড কনভেনশনে’ পাঁচটি কর্মকাণ্ডকে জাতিগত নিধনমূলক হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। গাজায় চলমান ইসরায়েলের অভিযানের সময় তার মধ্যে চারটি কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে দেখা গেছে। এই জাতিগত নিধনে ইন্ধন দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুসহ কয়েকজন কর্মকর্তা।
অনাহার–অপুষ্টিতে বাড়ছে মৃত্যুহত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি গাজা অবরোধ করে সেখানে খাবার, পানি, চিকিৎসাসরঞ্জাম, জ্বালানিসহ জরুরি সেবা ও পণ্য প্রবেশে বাধা দিচ্ছে ইসরায়েল। এতে সেখানে মাসের পর মাস ধরে অনাহার–অর্ধাহারে রয়েছেন ফিলিস্তিনিরা। গত ২২ আগস্ট জাতিসংঘ-সমর্থিত খাদ্যনিরাপত্তা পর্যবেক্ষণবিষয়ক প্যানেলের (আইপিসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজা নগরীতে দুর্ভিক্ষ চলছে।
শুধু গাজা নগরী নয়, খাবারের জন্য হাহাকার উপত্যকাজুড়েই। গাজার স্থানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, সংঘাত শুরুর পর থেকে গত দুই বছরে অনাহারে গাজায় ৪৪০ জনের বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অন্তত ১৪৭ শিশু রয়েছে। এ ছাড়া জাতিসংঘের হিসাবে, গাজার মোট ২৬ হাজার শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। এর মধ্যে শুধু গাজা নগরীতে এই সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি।
খাবারের এই সংকটের মধ্যে বড় বিতর্ক শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল পরিচালিত সংস্থা গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণকেন্দ্রগুলো নিয়ে। এসব ত্রাণকেন্দ্রে খাবার সংগ্রহ করতে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্বিচার গুলি চালানো হচ্ছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত মাসের শেষ সময় পর্যন্ত ত্রাণ নিতে যাওয়া দুই হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল।
‘স্বীকৃতির পর নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে’২০১২ সাল থেকে জাতিসংঘের স্থায়ী পর্যবেক্ষক ফিলিস্তিন। বৈশ্বিক সংস্থাটিতে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত রিয়াদ মনসুর গতকাল গাজায় হামলা বন্ধে ইসরায়েলকে বাধ্য করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, যেসব দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে, তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে ইসরায়েলের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে।
রিয়াদ মনসুর আরও বলেন, ‘বিশ্বকে তাদের (ইসরায়েল) বলতে হবে, “যথেষ্ট হয়েছে। আপনাদের এই উন্মাদনার পথে আর চলতে দেওয়া হবে না। আপনাদের থামাতে যতটা সম্ভব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করব।”’ তিনি বলেন, ফিলিস্তিনিরা এখানেই থাকবে। তাদের অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই বাস্তবসম্মত হবে।
দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের লক্ষ্যে এবং দশকের পর দশক ধরে চলে আসা ফিলিস্তিন–ইসরায়েল সংকটের মধ্যে পশ্চিমাদের এই স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন কাতারের দোহা ইনস্টিটিউট অব গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক তামের কারমত। আল–জাজিরাকে তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে পশ্চিমারা ইসরায়েলের বড় সমর্থক ছিল। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে নিষ্ক্রিয় ছিল। অন্তত এখন এসে তারা নৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করছে। এটি গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে ভালো কিছুর জন্য একটি নতুন পথ তৈরি হচ্ছে।