অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে সম্ভাবনার দ্বার
Published: 13th, May 2025 GMT
প্রকৃতি সংরক্ষণ, প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা এবং মানুষকে প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে আসার লক্ষ্য নিয়ে মূলত ইকোপার্ক গড়ে তোলা হয়। ফলে ইকোপার্ককে ঘিরে গড়ে ওঠে একটি পর্যটনকেন্দ্রও। কিন্তু দেশের ইকোপার্কগুলোর কোনো কোনোটির অবস্থা এত করুণ যে সেগুলোকে পর্যটনকেন্দ্র বলাটা দুষ্কর হয়ে যায়। এমন একটি ইকোপার্ক হলো বরগুনার তালতলীতে অবস্থিত টেংরাগিরি ইকোপার্ক। এ পর্যটনকেন্দ্র থেকে পর্যটকেরা দিন দিন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বিষয়টি হতাশাজনক।
বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত টেংরাগিরি ইকোপার্ক একসময় দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্র ছিল। ২০১০-১১ ও ২০১১-১২ অর্থবছরে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ‘ইকো ট্যুরিজমের সুযোগ বৃদ্ধি’ কর্মসূচির আওতায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জীববৈচিত্র্য ও উপকূলীয় বনসম্পদে ভরপুর পার্কটি গড়ে তোলা হয়। যার পেছনে ব্যয় হয় ২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ১৩ হাজার একরের বেশি আয়তনের এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে গড়ে তোলা হয় ১৬টি কাঠের সেতু, বনভোজনের জন্য স্থান, পাকা রাস্তা, শৌচাগার, বিশ্রামাগার। বন্য প্রাণীর নিরাপদ আবাস তৈরি করে সেখানে অবমুক্ত করা হয়েছিল বাঘ, হরিণ, কুমির, বানরসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণী।
শুরুতে কয়েক বছর ভালোভাবেই চলেছিল ইকোপার্কটি। পরবর্তী সময়ে রক্ষণাবেক্ষণ ও যত্নের অভাবে অবকাঠামোগুলো নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করে। কাঠের সেতু ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে, রাস্তার ইট উঠে গিয়ে চলাচলে ভোগান্তি সৃষ্টি করছে। শৌচাগারগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, প্রাণী সংরক্ষণের জন্য নির্মিত গ্রিল ভেঙে গেছে, দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। দর্শনার্থীদের চলাচলের জন্য সাড়ে চার কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটিও এখন বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। ২০২০ সালে সোনাকাটা খালের ওপর একটি সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হলেও নকশারর জটিলতায় তা এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। এসব কারণে বর্তমানে পার্কে মাসে মাত্র ৩০০-৪০০ দর্শনার্থী আসেন, যেখানে একসময় তা ছিল ৮০০-৯০০ জন।
রেঞ্জ কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে ইকোপার্কটি সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছেন। নতুন প্রকল্প গ্রহণ করে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে, নয়তো টেংরাগিরির সম্ভাবনা ধ্বংস হয়ে যাবে। ইকোপার্ককে ঘিরে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছিল, সেটিও এখন স্থিমিত হয়ে গেছে। ফলে ইকোপার্কটি অবহেলায় নষ্ট হলে শুধু রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় নয়, স্থানীয় অর্থনীতির জন্যও বড় ক্ষতি।
সরকারি ও স্থানীয় উদ্যোগে টেংরাগিরি ইকোপার্ককে ঢেলে সাজানো এখন সময়ের দাবি। রক্ষণাবেক্ষণ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ইকোপার্কটি পর্যটকবান্ধব করে গড়ে তোলা হোক।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
গ্রামে চলে না কোনো গাড়ি, তবে সেই গ্রামে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ‘কেব্ল কার’
ইউরোপের দেশ সুইজারল্যান্ডের একটি পাহাড়ি গ্রাম মারেন। মধ্যযুগীয় এ গ্রাম অনেক দিনই বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। গ্রামটিতে যাওয়ার জন্য প্রচলিত কোনো যানবাহন নেই। তবে এখন কেব্ল কারের বদৌলতে ভ্রমণকারীরা ৪৩০ জন বাসিন্দার ওই গ্রামে পৌঁছাতে পারছেন। এগুলো বিশ্বের সবচেয়ে ঢালু পথের কেব্ল কার। গত বছরের শেষের দিকে ভ্রমণবিষয়ক সাংবাদিক শিখা শাহ ওই গ্রামে গিয়েছিলেন। সেখানকার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিবিসিতে একটি ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন তিনি।
বছরের শেষের দিকে তীব্র শীতের দিনে জেনেভা থেকে তিন ঘণ্টার ট্রেনযাত্রা করে লাউটারব্রুনেনে পৌঁছান শিখা। এটি মধ্য সুইজারল্যান্ডের ইন্টারলাকেন ও জুংফ্রাউ পর্বতমালার মাঝখানে অবস্থিত এক গ্রাম। এখান থেকেই শুরু মারেন নামের পাহাড়ি গ্রামের পথে যাত্রা।
শিখা লিখেছেন, স্টেচেলবার্গ গাড়ি পার্কিং এলাকায় পৌঁছানোর পরপরই তাঁকে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে কাচ দিয়ে ঘেরা কেবিনে (কেব্ল কার) তুলে নেওয়া হয়। কেব্ল কারে বসে নিচের দিকে থাকা কটেজগুলোকে গল্পের বইয়ের মতো লাগছিল। চারপাশটা পাহাড় ও তুষারময় পাইনগাছে ঘেরা।
মারেনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, একসময় গ্রামের বাসিন্দাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহের জন্য তিন ঘণ্টা পাহাড় বেয়ে নিচে নামতে হতো। এরপর জিনিসপত্র নিয়ে তাঁরা আবার ওপরে উঠে আসতেন। ১৮৯১ সালে একটি সরু রেলপথ চালু হয়। রেলপথটি মারেনকে কাছের পাহাড়ি গ্রাম গ্রুটশালপ এবং লাউটারব্রুনেনের সঙ্গে যুক্ত করে। ১৯৬৫ সালে একটি সিঙ্গেলট্র্যাক কেব্লওয়ে চালু হয়। ওই পথে বাসিন্দারা গাড়িবিহীন আরেক নিরাপদ গ্রাম গিমেলওয়াল্ড পর্যন্ত পৌঁছাতে পারতেন।
মারেনে কয়েকটি ছোট ছোট রাস্তা আছে। রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি অতিথিশালা ও রেস্তোরাঁ। সেখানে বিখ্যাত চিজ-ড্রাই সসেজসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার ও পানীয় পরিবেশন করা হয়। এ ছাড়া সেখানকার কিছু ছোট ছোট দোকানে বিক্রি হয় পোস্টকার্ড, উন্নত মানের সুইস চকলেট, ঘড়িসহ বিভিন্ন ধরনের স্মারক।তবে এখন সুইজারল্যান্ডের বার্নিজ ওবারল্যান্ড অঞ্চলে অবস্থিত ছোট গ্রামটির সঙ্গে বহির্বিশ্ব এবং নিচের দিকের উপত্যকার সরাসরি সংযোগ তৈরি হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে ঢালু কেব্ল কার শিলথর্নবান চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে ভ্রমণপিপাসুরা এখন সেখানে যেতে পারছেন। এই কেব্ল কার মাত্র ৪ মিনিটে যাত্রীদের ৭৭৫ মিটার ওপরে নিয়ে যায়। আর যাত্রাপথে সুইস আল্পসের চমকপ্রদ সব দৃশ্য উপভোগ করা যায়।
মারেন ১৩ শতকের পুরোনো একটি গ্রাম। এখানে আছে পাথর ও কাঠের তৈরি ঐতিহ্যবাহী সব কটেজ। তাকালে মনে হয়, গ্রামটি যেন পাহাড়ের প্রান্তভাগে ঝুলছে। এর এমন অনন্য অবস্থানের কারণে প্রকৌশলীরা কখনো এটিকে সড়কের মাধ্যমে বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত করতে পারেননি।
মারেনের স্থানীয় বাসিন্দা মাইকেল আবেগলেন বলেন, ‘স্কুলে যেতে কেব্ল কার ব্যবহার করাকে অনেকের কাছে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। কিন্তু আমার জন্য এটি দৈনন্দিন এক অভ্যস্ততার বিষয় ছিল। সাধারণ প্রয়োজনীয় জিনিস ও পরিষেবাগুলোর বেশির ভাগই অবশ্য মারেনে পাওয়া যায়। কিন্তু যখনই আমাদের চিকিৎসক, নাপিত বা দন্তচিকিৎসকের প্রয়োজন হয়, তখন আমাদের নেমে উপত্যকার দিকে যেতে হয়, সেখানে অনেকের গাড়ি পার্ক করা থাকে।’
আবেগলেনের মতে, স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্য যে কজন সারা বছর ধরে ওই গ্রামে থাকেন, তাঁরা একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। এখানে যাঁরা বেড়ে ওঠেন, তাঁদের প্রায় সবার সঙ্গেই পরিচয় হয়ে যায়। এখানে খুব ঘনিষ্ঠ ও শক্তিশালী একটি সম্প্রদায় রয়েছে।
আবেগলেন আরও বলেন, ‘কিছু কিছু অতিথি তো প্রায় স্থানীয়দের মতোই। কারণ, তাঁরা প্রতিবছরই মারেনে বেড়াতে আসেন।’
মারেনে কয়েকটি ছোট ছোট রাস্তা আছে। রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি অতিথিশালা ও রেস্তোরাঁ। সেখানে বিখ্যাত চিজ-ড্রাই সসেজসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার ও পানীয় পরিবেশন করা হয়। এ ছাড়া সেখানকার কিছু ছোট ছোট দোকানে বিক্রি হয় পোস্টকার্ড, উন্নত মানের সুইস চকলেট, ঘড়িসহ বিভিন্ন ধরনের স্মারক।
মারেনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো হোটেল মারেন প্যালেস। ১৮৭৪ সালে তৈরি হওয়া এই ভবনকে ‘সুইজারল্যান্ডের প্রথম প্রাসাদ’ হিসেবে ডাকা হয়। এখানে একসময় স্কিয়িং জগতের বিভিন্ন তারকা এবং হলিউড অভিনেত্রী রিটা হেওয়ার্থসহ বহু তারকাকে আতিথেয়তা দেওয়া হয়েছে। সৌন্দর্য আর জাঁকজমকে ভরপুর এই হোটেলের বলরুমটি ২০ শতকে উচ্চবিত্ত সমাজের আড্ডাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল।মারেনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো হোটেল মারেন প্যালেস। ১৮৭৪ সালে তৈরি হওয়া এই ভবনকে ‘সুইজারল্যান্ডের প্রথম প্রাসাদ’ হিসেবে ডাকা হয়। এখানে একসময় স্কিয়িং জগতের বিভিন্ন তারকা এবং হলিউড অভিনেত্রী রিটা হেওয়ার্থসহ বহু তারকাকে আতিথেয়তা দেওয়া হয়েছে। সৌন্দর্য আর জাঁকজমকে ভরপুর এই হোটেলের বলরুমটি ২০ শতকে উচ্চবিত্ত সমাজের আড্ডাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল।
আকারে ছোট হলেও মারেন গ্রামটি শীতকালীন এক বড় ক্রীড়াকেন্দ্র। একসময়ের নিস্তব্ধ এই গ্রাম ১৮০০-এর দশকের শেষ দিকে বদলে যায়। তখন ব্রিটিশ স্কিয়িং–জগতের মানুষেরা এই গ্রামে এসে এর প্রকৃতি আর স্কি ঢাল দেখে মুগ্ধ হন।
গ্রামের বাসিন্দা বার্নার্ড লান বলেন, তাঁর প্রপিতামহ হেনরি লান প্রথম ১৮৯০-এর দশকে মারেনে আসেন এবং এর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন। এরপর তিনি সেখানকার সৌন্দর্য দেখাতে ব্রিটিশ পর্যটকদের সেখানে নিয়ে যান। আর্নল্ড লান এবং তাঁর স্ত্রী মেবেল সেখানে বসবাস শুরু করেন।
আর্নল্ডের আগমন ১৯২৪ সালে কান্দাহার স্কি ক্লাব গঠনের পথও খুলে দেয়। ১৯৩০ সালে দেশের প্রথম স্কি স্কুল মারেনে চালু হয়। এক বছর পর ১৯৩১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই ছোট্ট গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আলপাইন বিশ্ব স্কি চ্যাম্পিয়নশিপ।
স্থানীয়রা বলছেন, মারেন শুধু স্কি করার জন্যই পরিচিত নয়। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই এলাকা জনপ্রিয় প্যারাগ্লাইডিং গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।
বার্নার্ডের স্ত্রী জুলিয়া লান মারেনে বিভিন্ন পরিবার ও নারীদের পর্বতারোহণে নেতৃত্ব দেন। তাঁর মতে, মানুষ এখানে কেনাকাটা বা দর্শনীয় স্থান ঘুরতে আসেন না; বরং স্কিয়িং, হাইকিংসহ নানা কিছু করার মধ্য দিয়ে জীবনের অভিজ্ঞতা নিতে আসেন।