রাখাইন সংকটে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান জরুরি
Published: 15th, May 2025 GMT
রাখাইন রাজ্যের চলমান সংকট এবং জাতিসংঘের মানবিক করিডোর গঠনের আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এক নাজুক ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, মানবিক দায়বদ্ধতা, নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ এবং কূটনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য খোঁজা জরুরি হয়ে উঠেছে। একদিকে যেমন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবিক সংকট নিরসনে বাংলাদেশের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে, অন্যদিকে রয়েছে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত উদ্বেগ।
রাখাইনে নতুন বাস্তবতা
২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বর অভিযানের মুখে পালিয়ে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, যার বেশির ভাগ কক্সবাজারে অবস্থান করছে। এদের একটি অংশকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হলেও সমাধান এখনও সুদূরপরাহত। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে বহু বছর ধরেই আলোচনা চলমান। এরই মধ্যে রাখাইন রাজ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির ভারসাম্যে বড় রকমের পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে রাজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই বিদ্রোহী ‘আরাকান আর্মি’র নিয়ন্ত্রণে।
এই বাস্তবতা বাংলাদেশকে বিকল্প কূটনৈতিক চিন্তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের পাশাপাশি এখন নতুনভাবে অ-রাষ্ট্রীয় শক্তির সঙ্গেও যোগাযোগ ও সমঝোতার প্রশ্ন উঠেছে। ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের প্রেক্ষাপট নতুনভাবে চিন্তা করতে হচ্ছে।
জাতিসংঘের প্রস্তাব
সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের অনুরোধে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে রাখাইনে একটি মানবিক করিডোর গঠনে সম্মত হয়েছে। যদিও পরে এ ব্যাপারে প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, এ ব্যাপারে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
রাখাইনের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি যেভাবে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে, তাতে মানবিক করিডোর প্রয়োজনীয় ও মানবিক দায়িত্ব হিসেবেই বিবেচিত হতে পারে। একই সঙ্গে করিডোর ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হওয়ার আশঙ্কাও অস্বীকার করা যায় না। যদি করিডোর ব্যবহার করে নতুন করে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তাহলে বাংলাদেশকে নতুন মানবিক ও নিরাপত্তা সংকটে পড়তে হতে পারে।
মানবতা ও নিরাপত্তার সমন্বয়
বাংলাদেশ একদিকে মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত, অপরদিকে নিজ দেশের জনগণের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্বও তার অগ্রাধিকার। এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক ও পেশাদারিত্বনির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে।
জাতীয় নিরাপত্তা কেবল সামরিক বা সীমান্ত বিষয় নয়; এটি এখন রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও জনমনের মনস্তাত্ত্বিক নিরাপত্তার সঙ্গেও জড়িত। কাজেই জাতিসংঘের অনুরোধে করিডোর গঠনের মতো কৌশলগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কেবল আমলাতান্ত্রিক যুক্তি যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে সশস্ত্র বাহিনী, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, কূটনৈতিক মহল এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অভিমত প্রতিফলিত হবে।
গণমানুষের প্রত্যাশা
গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের জনমানসে নতুন প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। মানুষ এখন চায় রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশীদারিত্ব থাকুক; জবাবদিহি নিশ্চিত হোক এবং দেশের স্বার্থকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হোক। কেবল প্রশাসনিক স্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বিশেষত জাতীয় নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক নীতিমালার মতো সংবেদনশীল বিষয়ে জনগণের মধ্যে সন্দেহ ও শঙ্কা তৈরি করতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণমূলক সংস্কৃতির বিকাশ এবং নিরাপত্তা-বিষয়ক সিদ্ধান্তে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের চর্চা অতীব জরুরি।
অংশগ্রহণমূলক রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত
যে কোনো রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত তখনই টেকসই হয়, যখন তা একটি বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে গৃহীত হয়। রাখাইন ও রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান কেবল নৈতিক বা কূটনৈতিক নয়। এটি এখন একটি কৌশলগত জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু। ফলে করিডোর-বিষয়ক যে কোনো সিদ্ধান্ত যেন গণতান্ত্রিক চর্চা ও বিশেষজ্ঞ মতামতের আলোকে নেওয়া হয়– সেটিই প্রত্যাশা। বাংলাদেশ একটি দায়িত্বশীল, মানবিক ও প্রজ্ঞাবান জাতি হিসেবে নিজের অবস্থান আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরেছে। এই ভাবমূর্তি বজায় রাখতে হলে কেবল সদিচ্ছা নয়; প্রয়োজন পরিকল্পিত কৌশল, অংশগ্রহণমূলক নীতি এবং একটি সুসংহত নিরাপত্তা কাঠামো।
রাখাইন সংকট ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ধৈর্য ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এগিয়েছে। কিন্তু সময় এখন নতুন প্রেক্ষাপটে নতুন চিন্তা করার। জাতীয় নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বার্থ এখন কেবল অভ্যন্তরীণ নীতির বিষয় নয়, বরং তা আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালিত হতে হবে। আরাকান আর্মির উত্থান, চীন-ভারত-আসিয়ান প্রতিযোগিতা, বঙ্গোপসাগরীয় নিরাপত্তা জোট এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর চাপ– এসবই এখন বাংলাদেশের কূটনীতিকে আরও সতর্ক, সমন্বিত ও বাস্তববাদী হতে বাধ্য করছে।
মানবিক করিডোর যেমন একটি জরুরি ও সময়োপযোগী উদ্যোগ, তেমনি তা একটি দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা কৌশলের অংশ হিসেবেই দেখা দরকার। করিডোর দিয়ে যে মানবিক সহায়তা প্রবাহিত হবে, সেটি যেন সীমান্ত ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি না হয়– তা নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি করিডোরের কার্যকারিতা, পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের বিষয়গুলোও স্পষ্টভাবে পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।
দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যদি জাতিসংঘের অনুরোধে মানবিক করিডোর খুলে দেয়, তাহলে তা অবশ্যই হতে হবে সুনির্দিষ্ট শর্ত, সময়সীমা ও নিরাপত্তার গ্যারান্টির ভিত্তিতে। আর সেই সিদ্ধান্ত হতে হবে জাতীয় সংলাপ ও পেশাদারিত্বের সম্মিলনে, যাতে দেশের জনগণ, প্রতিরক্ষা সংস্থা এবং রাজনৈতিক অংশীদাররা তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে আস্থা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে সম্পৃক্ত হতে পারে।
আলাউদ্দীন মোহাম্মদ: যুগ্ম সদস্য সচিব,
জাতীয় নাগরিক পার্টি
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক টন ত ক টন ত ক ভ রস ম য র জন ত ক অবস থ ন র খ ইন সমন ব
এছাড়াও পড়ুন:
মোদিকে কাপুরুষ বললেন ইমরান খান
পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘কাপুরুষতা’র প্রতি প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য পাকিস্তানের জনগণ এবং সশস্ত্র বাহিনীকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। বুধবার এক্স-এ এক পোস্টে তিনি এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
কারাগারে আটক ইমরান খান সরাসরি তার এক্স অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে পারেন না। কারাগারে আইনজীবীর মাধ্যমে পাঠানো মন্তব্য তার দলের সংশ্লিষ্ট নেতা এক্স অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেন।
ইমরান খান বলেছেন, “আমি সবসময় বলেছি, এই দেশ আমার এবং সেনাবাহিনীও তাই। আমাদের সেনারা যেভাবে আকাশ ও স্থল উভয় ফ্রন্টেই মোদিকে পরাজিত করেছে, তেমনি পাকিস্তানের জনগণ, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায়, বিশ্বব্যাপী মোদি এবং আরএসএসের আখ্যানকে উন্মোচিত ও ভেঙে দিয়েছে।”
ইমরান বলেছেন, “পাকিস্তানের শিশু, মহিলা, বয়স্ক এবং বেসামরিক অবকাঠামোর মতো নিরীহ বেসামরিকদের লক্ষ্যবস্তু করে মোদি কাপুরুষতা প্রদর্শন করেছেন।”
তিনি আরো বলেছেন, “আমরা এই কাপুরুষোচিত হামলায় শহীদ বেসামরিক ও সামরিক কর্মীদেরপরিবারের সাথে পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করছি।”
ঢাকা/শাহেদ