প্রমত্তা পদ্মা, যে নদী ঘিরে রয়েছে হাজারো গল্পগাথা, জীবন-জীবিকার গল্প আরও কত কী! পদ্মা নদী আর মানুষের জীবনের সাতসুর যেন মিলেমিশে একাকার। স্রোতস্বিনী পদ্মা চলার পথে স্রোতধারায় তার পার্শ্ববর্তী জনপদ করেছে সমৃদ্ধ, উর্বর। চলার পথে পদ্মা তার পুরো এলাকাকেই করেছে জীববৈচিত্র্য আর বন্যপ্রাণীর সম্পদে পরিপূর্ণ। তেমনই একটি অঞ্চল নিম্ন পদ্মা অববাহিকা অঞ্চল; যা বাংলাদেশের ২২টি বায়োইকোলজিক্যাল অংশের একটি। সেখানকার বন্যপ্রাণীর গল্প আমাদের অনেকের কাছেই একেবারে অজানা।
বৃহত্তর ফরিদপুর (ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ জেলার কিছু অংশ), বরিশাল, বৃহত্তর যশোর (যশোর, মাগুরা, নড়াইল), বৃহত্তর কুষ্টিয়া (কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর), রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, পাবনা জেলার সমন্বয়ে গঠিত নিম্ন পদ্মা অববাহিকা অঞ্চল। এখানে যেমন রয়েছে জলাভূমিসমৃদ্ধ বাঁওড়, বিল, খাল, নদীসমৃদ্ধ বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল; ঠিক তেমনিভাবে বিভিন্ন ছোট বন, মানব বসতির আশপাশের বাগানসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ; যা আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে অসংখ্য বন্যপ্রাণীর।
আমার মাস্টার্সের থিসিস ছিল ঝিনাইদহের মারজাত বাঁওড়ে, যা বাংলাদেশের বাঁওড়ের বন্যপ্রাণী নিয়ে প্রথম গবেষণামূলক কাজ।
পাশাপাশি বর্তমানে ফরিদপুর, রাজবাড়ী, ঢাকা, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুরের পদ্মা নদীর চরগুলোতে কাজ করেছি পাখিদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে।
সাত বছর ধরে করা এই কাজগুলো থেকে বের হয়ে এসেছে নতুন অনেক তথ্য। এ গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের এই বায়োইকোলজিক্যাল অঞ্চলে এখন টিকে আছে ২৬৭ প্রজাতির পাখি; যা আমাদের দেশের মোট পাখি প্রজাতির ৪০ শতাংশ। পদ্মা ও যমুনার মিলিত প্রবাহ, এখানে সৃষ্টি করেছে জলাভূমির এক বৈচিত্র্য। বিল, বাঁওড়, ছোট-বড় নদী, নদীর চর, প্লাবনভূমি, ছনের বনসহ বিভিন্ন ধরনের জলাভূমির উপস্থিতির কারণে এ জেলায় ঠাঁই পেয়েছে অসংখ্য জলাশয়কেন্দ্রিক পাখি।
জলাভূমিগুলোর সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী হাঁস। বাংলাদেশে মোট বুনোহাঁসের প্রজাতি ৩০টি, এর মধ্যে পরিযায়ী ২৩টি। ফরিদপুরে দেখা মেলে ১৫টির। শহরের কাছাকাছি এক জলাভূমিতে দেখা পেলাম অসংখ্য বালিহাঁসের। শীতে নদী ও বড় বিল, বাঁওড়গুলোতে দেখা মেলে মৌলবি হাঁস, সিঁথি হাঁস, গিরিয়া হাঁস, দাগি রাজহাঁস, বুনো রাজহাঁস, খুন্তে হাঁস, পিয়াং হাঁসসহ অসংখ্য পরিযায়ী বুনোহাঁস দলের। পাশাপাশি নদী ও বিল-বাঁওড়ে দেখা মেলে বড় খোঁপা ও ছোট ডুবুরির। পাশাপাশি বিল, জলা, প্লাবনভূমি, ছনের ক্ষেতগুলোতে নিয়মিত দেখা মেলে কোড়া, কালেম, ঝিল্লি ও ডাহুকের।
পুরো গঙ্গা প্লাবনভূমির জলাভূমিগুলো বিভিন্ন প্রজাতির বগা-বগলা, ধূসর বক, লালচে বক, হট টিটি, জলপিপি, বাটান, জিরিয়া, চ্যাগা, খঞ্জন, মাছরাঙায় পরিপূর্ণ। এ ছাড়া নদীকেন্দ্রিক চরগুলো উল্টোঠুঁটি, চ্যাগা, জিরিয়া, বাটান, জৌরালি, ডানলিন, চা-পাখিসহ শীতে অজস্র সৈকত পাখিতে পরিপূর্ণ হয়। জলাশয়গুলো কেন্দ্র করে এখানে বসবাস করছে শিকরা, মধুবাজ, পা-লম্বা তিসি বাজ, শাহীন, ঈগল, কাবাসিসহ বিভিন্ন প্রজাতির শিকারি পাখির। পুরো এলাকাটি কেন্দ্র করে রয়েছে শকুন পরিযানের পথ। এখানে আরও রয়েছে বিপন্ন প্রজাতির দেশি গুটি ঈগল, বড় গুটি ঈগল, শাহি ঈগল পাখির বসবাস। জলাভূমি, জলজ প্রাণী, বিশেষ করে মাছ, ব্যাঙ, সরীসৃপের প্রাচুর্যতায় এই এলাকায় শিকারি পাখির আনাগোনা বেশি। গঙ্গা প্লাবনভূমির শিকারি পাখির মধ্যে অন্যতম হলো কাটুয়া চিল। সাদা আর নীলচে কালো রঙের মিশ্রিত পালক এবং লাল চোখ পাখিটি দিয়েছে অনন্য এক সৌন্দর্য। এই পাখি গঙ্গা প্লাবনভূমি এলাকার গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দেশক পাখি।
বিভিন্ন প্রজাতির মাছরাঙা, সুঁইচোরা, কোয়েলের দেখা মেলে জলাশয়ের আশপাশে এবং প্লাবনভূমি, জলা ও ঘাসভূমিতে। এ ছাড়া আছে কুবো, বাতাসি, আবাবিল জাতীয় পাখি।
প্যাঁচা এ এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ পাখি, খুঁড়লে প্যাঁচা, খয়রা শিকরে প্যাঁচা, নিম প্যাঁচা, লক্ষ্মী প্যাঁচা, হুতুম প্যাঁচার দেখা মেলে নিয়মিত। এ ছাড়া শীতে চর এলাকায় দেখা মেলে পরিযায়ী ছোটকান প্যাঁচার। কৃষিপ্রধান এলাকা হওয়ার এই প্যাঁচারা ফসলের ক্ষেতের ইঁদুর খেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কৃষি অর্থনীতিতে।
তৃণভূমি, ঘাসভূমি, ফসলের ক্ষেত, চরাঞ্চল, বাগিচায় ঘুঘু জাতীয় পাখিদের বৈচিত্র্যময়তা দেখা যায়। এর মধ্যে তিলা ঘুঘু ও গোলা পায়রা সর্বত্রই দেখা যায়। ইউরেশীয় কণ্ঠী ঘুঘু এবং লাল রাজঘুঘুর দেখা মেলে চর এবং ফসলের ক্ষেতে সব থেকে বেশি। বাগানগুলোতে পাতি শ্যামা ঘুঘু, হলদে পা হরিয়াল ও কমলাবুক হরিয়ালের দেখা মেলে।
কোকিল জাতীয় পাখিরা গায়ক পাখি না হলেও তাদের মোহনীয় সুরলহরি আমাদের সব সময় আকৃষ্ট করে রাখে। বিশেষ করে করুণ পাপিয়া, পাতি চোখ গেল, গ্রীষ্মের বউ কথা কও কিংবা চাতক পাখি। ফরিদপুরে সব মিলিয়ে আট প্রজাতির কোকিল জাতীয় পাখির দেখা মেলে। শীতে ১২০ প্রজাতির অধিক পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে, আর গ্রীষ্মে চার প্রজাতির গ্রীষ্ম পরিযায়ী পাখির। তাই বলা যায়, এই এলাকা পরিযায়ী পাখিদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে মোট বিলুপ্তপ্রায় পাখির সংখ্যা ৩৮। আমাদের গঙ্গা প্লাবনভূমিতে টিকে আছে ১৮টি বিপন্ন প্রজাতির পাখি; যা বাংলাদেশের বিপন্ন পাখির মোট সংখ্যার প্রায় অর্ধেক।
আমাদের এখন প্রয়োজন বিস্তৃত গবেষণার। নগরায়ণের আগ্রাসনে বিপন্ন হচ্ছে পাখির আবাস। এখনই পদক্ষেপ না নিলে এই অঞ্চল থেকে হারিয়ে যাবে সমৃদ্ধ এক পাখির রাজ্য। v
লেখক: সহকারী একান্ত সচিব, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প ল বনভ ম আম দ র পর য য় জল ভ ম
এছাড়াও পড়ুন:
আবার ‘লাস্ট মিনিট শো’, জন্মদিনের রাতে স্লটকে জয় উপহার ফন ডাইকের
লিভারপুল ৩–২ আতলেতিকো মাদ্রিদ
জন্মদিনের রাতে এর চেয়ে ভালো উপহার আর কী হতে পারে!
রেফারি শেষ বাঁশি বাজাতেই মাঠে ঢুকে পড়লেন আর্নে স্লট। লিভারপুলের সমর্থকেরা তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে থাকলেন, দল জেতায় অভিনন্দনও জানালেন। মুখে চওড়া হাসি নিয়ে হাত নেড়ে স্লট সেই অভিবাদনের জবাব দিলেন।
ভার্জিল ফন ডাইকের সঙ্গে আলিঙ্গনের সময় স্লটকে একটু বেশিই খুশি মনে হলো। কারণ, লিভারপুল অধিনায়ক ফন ডাইক ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত না হলে তাঁর বিশেষ রাতটা যে অনেকটাই পানসে হয়ে যেত!
২০২৫–২৬ মৌসুমে শেষ মুহূর্তে জয়সূচক গোল করাকে অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছে লিভারপুল। যেটিকে বলা হচ্ছে লাস্ট মিনিট শো, কয়েকটি সংবাদমাধ্যম নাম দিয়েছে স্লট টাইম।
এবার সেই শো–এর নায়ক ফন ডাইক। যোগ করা সময়ের দ্বিতীয় মিনিটে তাঁর হেডারেই আতলেতিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে ড্রয়ের পথে থাকা ম্যাচটা ৩–২ গোলে জিতে চ্যাম্পিয়নস লিগে শুভসূচনা করল লিভারপুল।
এ নিয়ে এই মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে টানা পাঁচ ম্যাচ জিতল লিভারপুল। সবকটি ম্যাচে অলরেডরা জয়সূচক গোল করল ৮০ মিনিটের পর; এর তিনটিই যোগ করা সময়ে।