Samakal:
2025-07-09@23:37:11 GMT

গঙ্গা-প্লাবনভূমির পাখপাখালি

Published: 16th, May 2025 GMT

গঙ্গা-প্লাবনভূমির পাখপাখালি

প্রমত্তা পদ্মা, যে নদী ঘিরে রয়েছে হাজারো গল্পগাথা, জীবন-জীবিকার গল্প আরও কত কী! পদ্মা নদী আর মানুষের জীবনের সাতসুর যেন মিলেমিশে একাকার। স্রোতস্বিনী পদ্মা চলার পথে স্রোতধারায় তার পার্শ্ববর্তী জনপদ করেছে সমৃদ্ধ, উর্বর। চলার পথে পদ্মা তার পুরো এলাকাকেই করেছে জীববৈচিত্র্য আর বন্যপ্রাণীর সম্পদে পরিপূর্ণ। তেমনই একটি অঞ্চল নিম্ন পদ্মা অববাহিকা অঞ্চল; যা বাংলাদেশের ২২টি বায়োইকোলজিক্যাল অংশের একটি। সেখানকার বন্যপ্রাণীর গল্প আমাদের অনেকের কাছেই একেবারে অজানা।
বৃহত্তর ফরিদপুর (ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ জেলার কিছু অংশ), বরিশাল, বৃহত্তর যশোর (যশোর, মাগুরা, নড়াইল), বৃহত্তর কুষ্টিয়া (কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর), রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, পাবনা জেলার সমন্বয়ে গঠিত নিম্ন পদ্মা অববাহিকা অঞ্চল। এখানে যেমন রয়েছে জলাভূমিসমৃদ্ধ বাঁওড়, বিল, খাল, নদীসমৃদ্ধ বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল; ঠিক তেমনিভাবে বিভিন্ন ছোট বন, মানব বসতির আশপাশের বাগানসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ; যা আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে অসংখ্য বন্যপ্রাণীর। 
আমার মাস্টার্সের থিসিস ছিল ঝিনাইদহের মারজাত বাঁওড়ে, যা বাংলাদেশের বাঁওড়ের বন্যপ্রাণী নিয়ে প্রথম গবেষণামূলক কাজ। 
পাশাপাশি বর্তমানে ফরিদপুর, রাজবাড়ী, ঢাকা, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুরের পদ্মা নদীর চরগুলোতে কাজ করেছি পাখিদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে।
সাত বছর ধরে করা এই কাজগুলো থেকে বের হয়ে এসেছে নতুন অনেক তথ্য। এ গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের এই বায়োইকোলজিক্যাল অঞ্চলে এখন  টিকে আছে ২৬৭ প্রজাতির পাখি; যা আমাদের দেশের মোট পাখি প্রজাতির ৪০ শতাংশ। পদ্মা ও যমুনার মিলিত প্রবাহ, এখানে সৃষ্টি করেছে জলাভূমির এক বৈচিত্র্য। বিল, বাঁওড়, ছোট-বড় নদী, নদীর চর, প্লাবনভূমি, ছনের বনসহ বিভিন্ন ধরনের জলাভূমির উপস্থিতির কারণে এ জেলায় ঠাঁই পেয়েছে অসংখ্য জলাশয়কেন্দ্রিক পাখি।  
জলাভূমিগুলোর সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী হাঁস। বাংলাদেশে মোট বুনোহাঁসের প্রজাতি ৩০টি, এর মধ্যে পরিযায়ী ২৩টি। ফরিদপুরে দেখা মেলে ১৫টির। শহরের কাছাকাছি এক জলাভূমিতে দেখা পেলাম অসংখ্য বালিহাঁসের। শীতে নদী ও বড় বিল, বাঁওড়গুলোতে দেখা মেলে মৌলবি হাঁস, সিঁথি হাঁস, গিরিয়া হাঁস, দাগি রাজহাঁস, বুনো রাজহাঁস, খুন্তে হাঁস, পিয়াং হাঁসসহ অসংখ্য পরিযায়ী বুনোহাঁস দলের। পাশাপাশি নদী ও বিল-বাঁওড়ে দেখা মেলে বড় খোঁপা ও ছোট ডুবুরির। পাশাপাশি বিল, জলা, প্লাবনভূমি, ছনের ক্ষেতগুলোতে নিয়মিত দেখা মেলে কোড়া, কালেম, ঝিল্লি ও ডাহুকের।
পুরো গঙ্গা প্লাবনভূমির জলাভূমিগুলো বিভিন্ন প্রজাতির বগা-বগলা, ধূসর বক, লালচে বক, হট টিটি, জলপিপি, বাটান, জিরিয়া, চ্যাগা, খঞ্জন, মাছরাঙায় পরিপূর্ণ। এ ছাড়া নদীকেন্দ্রিক চরগুলো উল্টোঠুঁটি, চ্যাগা, জিরিয়া, বাটান, জৌরালি, ডানলিন, চা-পাখিসহ শীতে অজস্র সৈকত পাখিতে পরিপূর্ণ হয়। জলাশয়গুলো কেন্দ্র করে এখানে বসবাস করছে শিকরা, মধুবাজ, পা-লম্বা তিসি বাজ, শাহীন, ঈগল, কাবাসিসহ বিভিন্ন প্রজাতির শিকারি পাখির। পুরো এলাকাটি কেন্দ্র করে রয়েছে শকুন পরিযানের পথ। এখানে আরও রয়েছে বিপন্ন প্রজাতির দেশি গুটি ঈগল, বড় গুটি ঈগল, শাহি ঈগল পাখির বসবাস। জলাভূমি, জলজ প্রাণী, বিশেষ করে মাছ, ব্যাঙ, সরীসৃপের প্রাচুর্যতায় এই এলাকায় শিকারি পাখির আনাগোনা বেশি। গঙ্গা প্লাবনভূমির শিকারি পাখির মধ্যে অন্যতম হলো কাটুয়া চিল। সাদা আর নীলচে কালো রঙের মিশ্রিত পালক এবং লাল চোখ পাখিটি দিয়েছে অনন্য এক সৌন্দর্য। এই পাখি গঙ্গা প্লাবনভূমি এলাকার গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দেশক পাখি। 
বিভিন্ন প্রজাতির মাছরাঙা, সুঁইচোরা, কোয়েলের দেখা মেলে জলাশয়ের আশপাশে এবং প্লাবনভূমি, জলা ও ঘাসভূমিতে। এ ছাড়া আছে কুবো, বাতাসি, আবাবিল জাতীয় পাখি।
প্যাঁচা এ এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ পাখি, খুঁড়লে প্যাঁচা, খয়রা শিকরে প্যাঁচা, নিম প্যাঁচা, লক্ষ্মী প্যাঁচা, হুতুম প্যাঁচার দেখা মেলে নিয়মিত। এ ছাড়া শীতে চর এলাকায় দেখা মেলে পরিযায়ী ছোটকান প্যাঁচার। কৃষিপ্রধান এলাকা হওয়ার এই প্যাঁচারা ফসলের ক্ষেতের ইঁদুর খেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কৃষি অর্থনীতিতে। 
তৃণভূমি, ঘাসভূমি, ফসলের ক্ষেত, চরাঞ্চল, বাগিচায় ঘুঘু জাতীয় পাখিদের বৈচিত্র্যময়তা দেখা যায়। এর মধ্যে তিলা ঘুঘু ও গোলা পায়রা সর্বত্রই দেখা যায়। ইউরেশীয় কণ্ঠী ঘুঘু এবং লাল রাজঘুঘুর দেখা মেলে চর এবং ফসলের ক্ষেতে সব থেকে বেশি। বাগানগুলোতে পাতি শ্যামা ঘুঘু, হলদে পা হরিয়াল ও কমলাবুক হরিয়ালের দেখা মেলে। 
কোকিল জাতীয় পাখিরা গায়ক পাখি না হলেও তাদের মোহনীয় সুরলহরি আমাদের সব সময় আকৃষ্ট করে রাখে। বিশেষ করে করুণ পাপিয়া, পাতি চোখ গেল, গ্রীষ্মের বউ কথা কও কিংবা চাতক পাখি। ফরিদপুরে সব মিলিয়ে আট প্রজাতির কোকিল জাতীয় পাখির দেখা মেলে। শীতে ১২০ প্রজাতির অধিক পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে, আর গ্রীষ্মে চার প্রজাতির গ্রীষ্ম পরিযায়ী পাখির। তাই বলা যায়, এই এলাকা পরিযায়ী পাখিদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 
বাংলাদেশে মোট বিলুপ্তপ্রায় পাখির সংখ্যা ৩৮। আমাদের গঙ্গা প্লাবনভূমিতে টিকে আছে ১৮টি বিপন্ন প্রজাতির পাখি; যা বাংলাদেশের বিপন্ন পাখির মোট সংখ্যার প্রায় অর্ধেক।
আমাদের এখন প্রয়োজন বিস্তৃত গবেষণার। নগরায়ণের আগ্রাসনে বিপন্ন হচ্ছে পাখির আবাস। এখনই পদক্ষেপ না নিলে এই অঞ্চল থেকে হারিয়ে যাবে সমৃদ্ধ এক পাখির রাজ্য। v
লেখক: সহকারী একান্ত সচিব, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প ল বনভ ম আম দ র পর য য় জল ভ ম

এছাড়াও পড়ুন:

দুর্গতদের পার্শ্বে দাঁড়ান

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে মঙ্গলবার হইতে সূচিত বারিধারার কারণে ভোগান্তিতে নিপতিত দেশের লক্ষ মানুষ। বিশেষত উপকূলীয় অঞ্চলের অধিবাসীর দুর্ভোগ চরমে উপনীত। মাত্র এক বৎসরের ব্যবধানে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লাসহ চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলা পুনরায় প্লাবিত হইবার শঙ্কায় পড়িয়াছে।

ফসলি জমি ও আমনের বীজতলা নিমজ্জিত হওয়া; পুকুর ও খামারের মৎস্য ভাসিয়া যাওয়া; সড়কপথ জলমগ্ন হওয়ায় চলাচলে অসুবিধাসহ বহুমাত্রিক সংকট ইতোমধ্যে দৃশ্যমান। অতিবর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ফেনীর দুইটি নদীর বেড়িবাঁধের কয়েক স্থান ভাঙিয়া যাইবার কারণে অনেক গ্রাম প্লাবিত এবং গত বৎসরের ন্যায় পুনরায় বৃহদাকার বন্যার আশঙ্কার উদ্ভব হইয়াছে। 

গত বৎসর ফেনীর স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পর সরকারের তরফ হইতে বাঁধ সুরক্ষার অঙ্গীকার করা হইয়াছিল। অথচ ঐ ভয়াবহ বন্যার পরও গতানুগতিক বাঁধ সংস্কার পদ্ধতিমুক্ত হইতে পারেনি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। এই বৎসরও দায়সারা প্রকারে বাঁধ সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ হইয়াছে বলিয়া সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে আসিয়াছে। খোদ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাগণ বলিয়াছেন, এই প্রকার সংস্কার ও মেরামত কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্ষুদ্রাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা হইলেও গত বৎসরের আগস্টের ন্যায় বৃহদাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নহে। অথচ বন্যা নিয়ন্ত্রণে টেকসই বাঁধ নির্মাণের বিকল্প নাই।

কেবল ফেনীতেই নহে; সমগ্র দেশেই বাঁধ লইয়া অভিযোগের অন্ত নাই। অনিয়মের কারণে বৎসরে বাঁধ নির্মাণে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয় বটে; উহা টেকসই হয় না। নির্মাণজনিত ত্রুটি ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করিয়া বাঁধ নির্মাণের ফলে উহা মানুষকে বন্যা ও অন্যান্য দুর্যোগ হইতে সুরক্ষা দিতে অক্ষম।

সমকালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফেনীর বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে ২০০৬ সালে সূচিত ১৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে মুহুরী-কহুয়া-সিলোনিয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্প ২০১০ সালে সমাপ্ত হইবার পর কয়েক বৎসর বন্যামুক্ত ছিল এলাকাবাসী। ২০১৩ সালে আকস্মিক বন্যায় বাঁধের তিনটি স্থানে ভাঙন ধরিবার পর প্রতি বৎসরই বাঁধ ভাঙিতেছে। অভিযোগ রহিয়াছে, দুষ্টচক্র প্রতি বৎসর বাঁধ মেরামতের নামে অর্থ লোপাট করিতেছে। ভাঙনের পর পানি উন্নয়ন বোর্ড ও প্রভাবশালী মহল স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দিকে অগ্রসর না হইয়া অতি দ্রুততায় কোটি টাকা ব্যয়ে অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করে, যাহাতে পরের বৎসর পুনরায় বরাদ্দপ্রাপ্তি সহজ হয়। এই ক্ষেত্রে প্রতিবারই নির্দিষ্ট কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশপ্রাপ্তির অভিযোগ রহিয়াছে।

আমরা বারংবার বলিয়া আসিয়াছি, বর্ষার পূর্বেই টেকসই বাঁধ নির্মাণ করিতে হইবে। তবে বর্তমান ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে যেই দুর্ভোগের উদ্ভব, উহা হইতে তাৎক্ষণিক মানুষের মুক্তিও জরুরি। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাবাসীকে আশ্রয়কেন্দ্রে গমন বিষয়ে সচেতন করিতে হইবে। 

আমরা জানি, উপকূলীয় অঞ্চলের অধিবাসীরা বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রকার দুর্যোগ মোকাবিলা করিয়া জীবন ধারণ করিয়া থাকেন। সরকার তাহাদের স্বস্তির বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে অনেক সময় উহা প্রতিপালিত হয় না। আমরা মনে করি, সংগ্রামী এই সকল মানুষের পাশে সরকারকে দাঁড়াইতেই হইবে। তাহাদের জন্য টেকসই বাঁধ নির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের আবাসন নিশ্চিতকরণ এবং প্রয়োজনে তথাকার মানুষদের অধিক হারে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় লইতে হইবে। 
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ