পূর্বজদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে সৃষ্ট বৈরিতা সময়ের সঙ্গে রূপ নেয় ভয়াবহ গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে। পরবর্তী সময়ে এই দ্বন্দ্ব গোষ্ঠীর গণ্ডি পেরিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। সৃষ্টি হয় সংঘাতের প্রেক্ষাপট। যেখানে দাঁড়িয়ে গত ২৫ বছরে একের পর এক সহিংসতায় ঝরেছে প্রাণ। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন শতাধিক মানুষ।

গত সোমবার আরও একবার প্রাণঘাতী সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলা সদর এলাকায়; যার নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় সেই দুটি গোষ্ঠীর দুই সদস্যের স্বার্থের দ্বন্দ্ব। তারা হলেন– স্থানীয় সাংবাদিক, নবীগঞ্জ উপজেলা গণঅধিকার পরিষদের (জিওপি) সহসভাপতি ও সাবেক যুবলীগ নেতা আশাইদ আলী আশা এবং নবীগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পৌর বিএনপির সদস্য সেলিম তালুকদার। অথচ এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার বহু সাধারণ মানুষ। হামলা-পাল্টা হামলায় তছনছ হয়ে গেছে গোটা সদর এলাকা।

আশাইদ আলী এবং সেলিম তালুকদারের বিবাদের জেরে সংঘাত শুরু হয় আনমনু ও তিমিরপুর গ্রামের বাসিন্দাদের মাঝে। আনমনু, রাজাবাদ, নোয়াপাড়াসহ কয়েকটি গ্রাম এক পক্ষে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে ছিল পূর্ব তিমিরপুর, পশ্চিম তিমিরপুর ও চরগাঁওয়ের আশপাশের কয়েক গ্রামের বাসিন্দা। পরিকল্পনা করে সংঘর্ষে জড়ায় গ্রামবাসী। এতে গোটা সদর শহর এলাকায় হামলা ও ভাঙচুর শুরু হয়। নিহত হন একজন, আহত শতাধিক। এক পর্যায়ে এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। এখনও ১৪৪ ধারা জারি বহাল রয়েছে। 

কোথা থেকে শুরু

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় কয়েকজন প্রবীণ বাসিন্দা জানান, এই দুটি গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব শুরু বহু বছর আগে থেকে। এক সময় আনমনুসহ তার আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারা ছিল জেলে সম্প্রদায়ের। অন্যদের সামাজিক পরিচয় ছিল সামাজিক বাঙাল। বাঙালরা জেলে সম্প্রদায়ের সদস্যদের একটু অন্য রকম বিবেচনা করত। সামাজিকভাবে এই শ্রেণিবৈষম্যের চর্চা থেকে শুরু সংকটের। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক কোন্দল ও প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায়ই এই দুই গোষ্ঠীর মাঝে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে।

পরিসংখ্যান ও তথ্য যা বলছে

গত ২৫ বছরের পরিসংখ্যান ও তথ্য বলছে, তাদের মাঝে বহু জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে চারবার ঘটেছে ভয়াবহ সংঘাতের ঘটনা। এতে আহত হয়েছেন কয়েক শতাধিক মানুষ। দু’পক্ষের হামলা, ভাঙচুরে স্থানীয় বহু ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়েছেন। এবারও সে ঘটনা ঘটেছে। 

গোষ্ঠী দুটির সংঘাতে প্রথম নিহতের ঘটনা ঘটে ২০০১ সালে। সে সময় সংঘর্ষে চরগাঁও গ্রামের তছকির আলী নামে একজন নিহত হন। ২০১৪ সালে শহরের সিএনজিচালিত অটোরিকশা স্টেশন নিয়ে বড় সংঘাতে জড়ায় দু’পক্ষ। ২০২৪ সালে নবীগঞ্জ শহরের রাজা কমপ্লেক্সে ভাঙচুরের ঘটনায় শতাধিক লোক আহত হন। সর্বশেষ সোমবার ঘটে চতুর্থ দফা সংঘর্ষ। শহরজুড়ে চালানো হয় ধ্বংসযজ্ঞ। পুলিশের হিসাবে, গত ২৫ বছরে এ উপজেলায় হামলা ও সংঘর্ষে খুন হয়েছেন দুইজন ও আহত হয়েছেন কয়েক শতাধিক মানুষ। 

গত ৬ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নবীগঞ্জে প্রতিবছর বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। যার প্রায় প্রতিটির নেপথ্যে রয়েছে এই দুই গোষ্ঠীর সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা। সোমবারের ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শীদের কয়েকজন জানান, বেশ কিছু দিন ধরে দৈনিক আলোকিত সকাল পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি আশাইদ আলী আশা ও হবিগঞ্জের সময় পত্রিকার প্রকাশক ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সেলিম তালুকদারের মধ্যে পেশাগত ও প্রেস ক্লাব নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। এর ধারাবাহিকতায় আশাইদ আলী আশাকে ৪ জুলাই নবীগঞ্জ উপজেলা সদরের মধ্যবাজারে পেয়ে সেলিম তালুকদারের শ্যালক ফারছু তালুকদার বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়ান। 

গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বে সাধারণের কান্না

নবীগঞ্জ হাই স্কুলের সামনে মুদি ব্যবসায়ী রিন্টু দাশ জানান, তিনি গরিব মানুষ। কারও পক্ষে না। তারপরেও তাঁর ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।

নিহত ফারুকের চাচা সাবেক পৌর কাউন্সিলর আলাউদ্দিন বলেন, এমন মৃত্যু কারও কাম্য নয়। সবাই একটু সংযত থাকলে এ সংঘাত এড়ানো যেত। পৌরসভার সাবেক মেয়র ছাবির আহমেদ চৌধুরী বলেন, সংঘর্ষে নবীগঞ্জ শহরের দেড় শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ থেকে হাসপাতাল-ক্লিনিকও রক্ষা পায়নি।

হবিগঞ্জ পুলিশ সুপার এমএনএস সাজেদুর রহমান বলেন, সংঘর্ষে একজন মারা গেছেন। অনেকেই আহত।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র দ বন দ ব ত র ঘটন শত ধ ক স ঘর ষ হয় ছ ন ব যবস উপজ ল সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

নবীগঞ্জে ঘোষণা দিয়ে সংঘর্ষে দুই গ্রামের মানুষ, ১৪৪ ধারা জারি

হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ শহরে দুই গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে শতাধিক ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি হাসপাতাল ও যানবাহন। গত চারদিন ধরে চলা এসব সংঘর্ষের ঘটনায় এলাকাজুড়ে বিরাজ করছে ব্যাপক উত্তেজনা। সর্বশেষ আজ সোমবার সকালেও ঘোষণা দিয়ে তুমুল সংঘর্ষে জড়ায় আনমনু ও তিমিরপুর গ্রামের লোকজন। পরে ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন।

স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, আজ সকালে উভয় গ্রামের মানুষ সংঘর্ষের প্রস্তুতিমূলক সভা আয়োজন করে। সভা থেকে সংঘর্ষের সময় নির্ধারণ করা হয়। পরে পূর্বঘোষিত সময় অনুযায়ী বিকেল ৩টার দিকে সংঘর্ষে জড়ায় দুই গ্রামের হাজারো মানুষ। এ সময় তাদের হাতে দেশীয় অস্ত্রসহ লাঠিসোটা দেখা যায়। সংঘর্ষে উভয়পক্ষের কয়েক শতাধিক নারী-পুরুষ আহত হয়েছেন। তবে নিহতের খবর পাওয়া যায়নি। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সংঘর্ষের সময় শহরের মধ্যে দুই শতাধিক দোকানপাটে ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়। আগুন দেওয়া হয় কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। বিকেল তিনটায় শুরু হওয়া সংঘর্ষ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত চলে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যৌথবাহিনী। 

এর আগে গত শুক্রবার রাতের সংঘাতের পর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে শহরের পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও শনিবার সকাল থেকে আবার উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আনমনু গ্রামের লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নবীগঞ্জ শহর ও আনমনু পয়েন্টে জড়ো হতে থাকলে আতঙ্কে দোকানপাট বন্ধ করে দেন ব্যবসায়ীরা। এর জেরে শহরে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। রোববার সকালে ও রাতে সংঘর্ষ ও চোরাগোপ্তা হামলা হয়। অবশেষে আজ সোমবার সকালে উভয় গ্রামের লোকজন পূর্বপ্রস্তুতিমূলক সভা করে সংঘর্ষে জড়ায়।

নবীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শেখ মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা বিষয়টি সমাধানের আহ্বান জানিয়েছি। সংঘর্ষ ও লুটপাটের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি। পুরো বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে রয়েছে। শহরের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় অতিরিক্ত পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • হবিগঞ্জে দফায় দফায় সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক আহত
  • নবীগঞ্জে ঘোষণা দিয়ে সংঘর্ষে দুই গ্রামের মানুষ, ১৪৪ ধারা জারি