কুয়েটে এবার অন্তর্বর্তী উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি, অনাস্থা শিক্ষক সমিতির
Published: 21st, May 2025 GMT
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) অন্তর্বর্তী উপাচার্য অধ্যাপক মো. হযরত আলীর প্রতি অনাস্থা জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। কুয়েটের চলমান সংকট নিরসনে শিক্ষক সমিতি উপাচার্যকে দ্রুত পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে।
আজ বুধবার বেলা পৌনে তিনটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাকক্ষে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো.
সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত জানিয়ে সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমরা মনে করছি, এই সংকট সমাধানে উপাচার্য সক্ষম হবেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না থাকা, ছাত্র-শিক্ষক সবার দাবির প্রতি অবজ্ঞা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকের দায়িত্বে থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন না করায় শিক্ষকেরা মনে করেন, বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত উপাচার্য কুয়েটের দায়িত্ব পালনে অক্ষম। এমতাবস্থায় শিক্ষকেরা তাঁর প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করছেন।’
অধ্যাপক মো. ফারুক হোসেন আরও বলেন, চলমান সংকট দীর্ঘায়িত না করতে শিক্ষক সমিতি ভাইস চ্যান্সেলরকে সম্মানের সঙ্গে দ্রুত পদত্যাগ করার দাবি জানাচ্ছে। সেই সঙ্গে সরকারকে কুয়েটবান্ধব, যিনি সমস্যার সমাধান করে বিধিবিধান মেনে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন, এমন যোগ্যতার কোনো ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ দিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে শিক্ষক সমিতি।
শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এসব দাবি প্রকাশ করার জন্য আগামীকাল বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শিক্ষকেরা ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করবেন এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে প্রকৃত ঘটনা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা তুলে ধরে এর সমাধান চাইবেন।
এর আগে আজ বুধবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত পূর্বঘোষণা অনুযায়ী প্রশাসনিক ভবনে তৃতীয় দিনের মতো অবস্থান করেন শিক্ষক সমিতির সদস্যরা। তিন মাস আগের সংঘর্ষ ও শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় বিচারিক প্রক্রিয়া দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করার দাবিতে ওই কর্মসূচি পালন করা হয়। এ সময় শিক্ষার্থীদের একাংশ শিক্ষকদের কর্মসূচিতে হাজির ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্রগুলো জানিয়েছে, ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ও শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে সাত কর্মদিবসের মধ্যে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছিল শিক্ষক সমিতি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৬ মে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় শিক্ষক সমিতির দাবির সঙ্গে সংগতি রেখে প্রশাসন কিছু সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ পাঠানো হয়।
শিক্ষক সমিতি প্রশাসনের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানালেও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এটিকে প্রহসনমূলক পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। পরে একাডেমিক কার্যক্রম আবার চালু করা, একটি নতুন ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করা এবং আগে ঘোষিত পাঁচ দফা দাবি বাস্তবায়নের একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা ঘোষণার দাবিতে গত বৃহস্পতিবার প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের এই কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্য শৃঙ্খলা কমিটির সভা আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তের কথা আন্দোলনকারীদের জানান। উপাচার্যের এই সিদ্ধান্ত শিক্ষক সমিতিকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। ফলে শিক্ষক সমিতি আরও কঠোর অবস্থানে যাওয়ার ঘোষণা দেয়।
এসব বিষয়ে কুয়েটের অন্তর্বর্তী উপাচার্য মো. হযরত আলীর সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে সংঘর্ষে শতাধিক আহত হন। সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা শুরুতে পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন করলেও পরে তা উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে পরিণত হয়। আন্দোলনের মুখে সরকার উপাচার্যকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়।
আরও পড়ুনকুয়েটে দ্বিতীয় দিনের মতো শিক্ষক সমিতির অবস্থান কর্মসূচি, আবারও ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম২০ মে ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উপ চ র য অবস থ ন পদত য গ
এছাড়াও পড়ুন:
আশুরা: শোক, শিক্ষা ও আত্মত্যাগের চিরন্তন প্রতীক
স্মৃতি যখন রক্তাক্ত হয়, ইতিহাস তখন থমকে দাঁড়ায়। তেমনি এক গভীর শোক, শিক্ষা ও আত্মত্যাগের নাম আশুরা। হিজরি বছরের প্রথম মাস মহররম, আর এই মাসের ১০ তারিখকে বলা হয় আশুরা। এটি মুসলিম উম্মাহর কাছে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও হৃদয়বিদারক দিন।
আশুরার স্মৃতি শুধু শোকের নয়, এটি আদর্শ, আত্মত্যাগ এবং ন্যায়ের প্রতীক। এদিন মুসলমানদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়, সত্যের জন্য জীবন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করা যাবে না।
আশুরার তাৎপর্য বহুমাত্রিক। এটি যেমন নবীদের নানা বিজয় ও রহমতের দিন, তেমনি ইমাম হুসাইন (রা.)-এর নেতৃত্বে সংঘটিত কারবালার হৃদয় বিদারক আত্মত্যাগের স্মৃতি বহন করে। আশুরা আমাদের শেখায়, কীভাবে ধৈর্য, সাহস ও ঈমানের শক্তিকে ধারণ করে কঠিন সময়েও সত্যের পথে অটল থাকা যায়। এই দিনে রক্ত ঝরেছে, কিন্তু মাথা নোয়ানো হয়নি।
আরো পড়ুন:
সিকৃবির প্রধান ফটকের নাম ‘জুলাই ৩৬’
পাবিপ্রবিতে মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজমবিষয়ক কর্মশালা
হাদিস ও ইসলামী ইতিহাস অনুযায়ী, আশুরার দিনে বহু ঐশী ঘটনা ঘটেছে। মহান আল্লাহ এই দিনে বহু নবী ও উম্মতের প্রতি অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষণ করেছেন। এই দিনে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে- হযরত আদম (আ.)-এর তওবা কবুল হয়, ৪০ দিনের মহাপ্লাবনের পর হযরত নূহ (আ.)-এর নৌকা জুদি পাহাড়ে থেমে যায়, হযরত ইদ্রিস (আ.) আসমানে জীবন্তভাবে উত্তীর্ণ হন, হযরত ইব্রাহিম (আ.)–কে আগুনে ফেলার পর এই দিনে আগুন ঠান্ডা হয়ে যায়, হযরত আইয়ুব (আ.) দীর্ঘ রোগভোগের পর এই দিনে সুস্থ হন, হযরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান, হযরত দাউদ (আ.)–এর তওবা কবুল হয়, হযরত ইউসুফ (আ.) কূপ থেকে উদ্ধার হন, হযরত মূসা (আ.) বনি ইসরাইলকে লোহিত সাগর পার করান এবং ফেরাউন তার বাহিনীসহ সাগরে ডুবে যায়, হযরত ঈসা (আ.)–কে আসমানে উত্তোলন করা হয় ইত্যাদি।
এসব ঘটনাই আশুরার পবিত্রতা ও গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলে। এটি একদিকে রহমতের দিন, অন্যদিকে প্রতিবাদের দিন।
আশুরার সবচেয়ে মর্মস্পর্শী ও গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা হলো কারবালার যুদ্ধ। হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম, ইরাকের কারবালা প্রান্তরে ঘটেছিল ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ও আদর্শিক সংঘর্ষ। ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (রা.) ও তার পরিবার সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে রুখে দাঁড়ান অত্যাচারী শাসক ইয়াজিদের বিরুদ্ধে। ইয়াজিদ ছিল এক নিষ্ঠুর, অবৈধ ও ইসলামবিরোধী শাসক। তার জুলুম ও অবিচারের বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইন (রা.) মাথানত না করে সত্য ও ইনসাফের পক্ষে অবস্থান নেন।
তিনি মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা হলে কারবালায় সঙ্গীদেরসহ তাকে অবরুদ্ধ করা হয়। পানির পথ বন্ধ করে তাদের তৃষ্ণার্ত করে তোলা হয়। অবশেষে, আশুরার দিনে শুরু হয় ভয়ংকর যুদ্ধ। মাত্র ৭২ জন সাহসী সঙ্গী নিয়ে ইমাম হুসাইন (রা.) হাজার হাজার সৈন্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। একে একে সবাই শহীদ হন। শিশু, নারী, যুবক কেউ রেহাই পাননি।
৬ মাস বয়সী শিশু আলী আসগর পর্যন্ত তীরের আঘাতে প্রাণ হারায়। ইমাম হুসাইন (রা.) নিজেও শাহাদত বরণ করেন। এই ইতিহাস কোনো সাধারণ যুদ্ধের নয়, এটি আদর্শের, ঈমানের ও আত্মত্যাগের যুদ্ধ। সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোই মুসলমানের পরিচয়, আর আত্মত্যাগই সেই ঈমানের পরিপূর্ণতা। ইমাম হুসাইন (রা.) প্রমাণ করে গেছেন—সত্যের পথে মৃত্যুও গৌরবের।
আশুরার অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো এ দিনে রোজা রাখা। হিজরতের পূর্বেও রাসুলুল্লাহ (সা.) কুরাইশদের সঙ্গে মিলিত হয়ে আশুরার রোজা পালন করতেন। হিজরতের পর মদিনায় এসে তিনি দেখতে পান, ইহুদিরাও এদিন রোজা রাখে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলে তারা জানায়, এদিন হযরত মূসা (আ.) ফেরাউন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। তাই কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তারা রোজা রাখে। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “আমি তোমাদের অপেক্ষা মূসার অধিক নিকটবর্তী।” (সহীহ বুখারী: ২০০৪)
এরপর থেকে তিনি এ দিনে রোজা পালন করেন এবং সাহাবীদেরও পালনের নির্দেশ দেন। পরে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইচ্ছা প্রকাশ করেন, ইহুদিদের রীতি থেকে ভিন্নতা আনতে পরের বছর মহররমের ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ তারিখ রোজা রাখাবেন। কিন্তু তিনি পরের বছর ইন্তেকাল করেন।
তাই ইসলামী ফিকহবিদরা বলেন, আশুরার রোজা একদিন হলেও রাখা জায়েয। তবে ইহুদিদের অনুকরণ না করতে চাইলে ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ তারিখ দুইদিন রোজা রাখা উত্তম।
রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আশুরার দিন আল্লাহর কাছে আমি আশা করি, এদিনের রোজার মাধ্যমে গত বছরের গোনাহগুলো মাফ হয়ে যায়।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ১১৬২) এই হাদিসে দেখা যায় যে, আশুরার রোজা রাখা অত্যন্ত শুভ ও পুণ্যের কাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, এই রোজা মানবিক পাপের মোচন ঘটায়। অর্থাৎ, যিনি আশুরার রোজা রাখবেন, আল্লাহ তাকে অতীত বছরের সমস্ত পাপ থেকে মুক্তি দান করবেন।
আশুরার রোজা শুধু গোনাহ মাফের সুযোগই নয়, বরং এটি আত্মশুদ্ধির এক বিরাট মাধ্যম। এ দিনে রোজা রেখে মানুষ যেমন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করে, তেমনি আগের বছরের ভুল, পাপ ও গাফিলতির জন্য অনুশোচনা করে এবং নতুনভাবে জীবনে ভালো কিছু করার অঙ্গীকার করে। তাই এ রোজা শুধু ইবাদত নয়, বরং নিজেকে সংশোধনের এক মোক্ষম সুযোগ।
তাই আশুরার শিক্ষা হোক আমাদের জীবনের চালিকাশক্তি। আমরা যেন ইমাম হুসাইন (রা.)-এর মতো সাহসিকতা, ধৈর্য ও ত্যাগের আদর্শ ধারণ করে সমাজে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারি—এটাই হোক আশুরার প্রকৃত শিক্ষা ও প্রতিজ্ঞা।
(লেখক: শিক্ষার্থী, আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়)
ঢাকা/মেহেদী