‘কল–কাণ্ডের’ পর সভাপতি–সম্পাদকের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে, বিব্রত নেতারা
Published: 23rd, May 2025 GMT
সিলেটে বিএনপির রাজনীতিতে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদির ও আরিফুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে দুটি বলয় রয়েছে। এই দুই বলয়ে আবার রয়েছে বেশ কয়েকটি উপবলয়ও। দুই পক্ষের উপবলয়ের নেতাদের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে ভেতরে ভেতরে দ্বন্দ্ব থাকলেও সেটা প্রকাশ্যে আসেনি। এবার ‘কল–কাণ্ডে’ মুক্তাদির পক্ষের উপবলয়ের দ্বন্দ্ব-বিভেদের বিষয়টিও প্রকাশ্যে এল।
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিএনপির নেতাদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের একটি মতবিনিময় সভা ছিল। সভা চলাকালে মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরীর মুঠোফোনে সিলেট সিটি করপোরেশনের আওয়ামী লীগদলীয় সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর ‘কল’ এসেছে, এমন তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে সমালোচনায় সরব হয় বিএনপির নেতা-কর্মীদের একটি অংশ।
তবে ইমদাদ হোসেন অভিযোগ অস্বীকার করে ঘটনার জন্য মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী ও তাঁর অনুসারীদের অভিযুক্ত করেন। এরপরই ফেসবুকে দুই পক্ষের অনুসারীরা পাল্টাপাল্টি স্ট্যাটাস দেওয়ার পাশাপাশি একে অন্যকে দোষারোপ করতে থাকেন। এমন পরিস্থিতির মধ্যে নগরের একটি রেস্তোরাঁয় অনুসারী নেতাদের নিয়ে সভা করেছেন ইমদাদ হোসেন। ওই সভা নিয়ে নতুন করে আলোচনা তৈরি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেজাউল হাসান কয়েস লোদী ও ইমদাদ হোসেন চৌধুরী কর্মীদের কাছে মুক্তাদির বলয়ের নেতা হিসেবে পরিচিত। এ দুজনই মুক্তাদিরের ঘনিষ্ঠজন। উভয়েই সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পেতে আগ্রহী। মূলত একই পদে মনোনয়নপ্রত্যাশী হওয়ার জেরেই দুজনের মধ্যে ভেতরে ভেতরে দূরত্ব ছিল। ‘কল–কাণ্ডের’ মধ্য দিয়ে এ দূরত্ব ও দ্বন্দ্ব-বিভেদ প্রকাশ্যে এসেছে।
বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত মঙ্গলবার ব্যবসায়ীদের মতবিনিময় সভার এক পর্যায়ে মাগরিবের নামাজে যান ইমদাদ। এ সময় তাঁর মুঠোফোনটি অন্য একজনের কাছে ছিল। তখন ইমদাদের মুঠোফোনে একটি কল আসে এবং ডিসপ্লেতে দেখা যায়, ‘আনোয়ারুজ্জামান ইউকে’। এ দৃশ্য সেখানে থাকা কয়েকজন তাঁদের মুঠোফোনে ধারণ করেন। সভা শেষে সন্ধ্যায় ফেসবুকে এর স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই ইমদাদের মুঠোফোনে লন্ডনে অবস্থানরত সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামানের কল দেওয়া নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।
আরও পড়ুনসিলেটে বিএনপি নেতার ফোনে আ.লীগের সাবেক মেয়রের ‘কল’, ফেসবুকে সমালোচনা২১ মে ২০২৫
এ নিয়ে ওই রাতেই জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে নিজের ব্যাখ্যা দেন ইমদাদ হোসেন। তিনি দাবি করেন, যুক্তরাজ্যে থাকা অবস্থায় ৮ থেকে ১০ বছর আগে আনোয়ারুজ্জামানের মুঠোফোন নম্বর তাঁর মুঠোফোনে স্টোর হয়ে থাকতে পারে। তবে কখনো আনোয়ারুজ্জামানের সঙ্গে তাঁর কথা হয়নি। কয়েস লোদী ও তাঁর অনুসারীরা ইমদাদকে জড়িয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছেন বলেও তিনি সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন।
সংবাদ সম্মেলনের পর বিএনপির একটা অংশ ইমদাদ হোসেনের সমালোচনায় মুখর হন। তাঁদের অভিযোগ, গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আনোয়ারুজ্জামান লন্ডনে চলে যান। তিনি কেন মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদককে কল করবেন? নিশ্চয়ই তাঁর (ইমদাদ) সঙ্গে আনোয়ারুজ্জামানের সখ্য, আঁতাত কিংবা যোগাযোগ আছে। বিষয়টির তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। নতুবা দলের তৃণমূলে ভুল বার্তা যাবে।
তবে গত বুধবার সন্ধ্যায় ইমদাদ হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো প্রযুক্তির ব্যবহার করে কিংবা কাউকে দিয়ে আনোয়ারুজ্জামানের ফোন থেকে এ কল করানো হয়েছে। পরে কয়েস লোদীর দুজন অনুসারী ফোনকলের সে ছবি তুলে আমার জনপ্রিয়তা ও ইমেজকে বিনষ্ট করতে ষড়যন্ত্র করে ফেসবুকে ছড়িয়েছে।’
এদিকে বিএনপির ওয়ার্ড পর্যায়ের কয়েকজন নেতা জানান, কল–কাণ্ডের পর ইমদাদ হোসেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে গত বুধবার সন্ধ্যায় নগরের বারুতখানা এলাকার একটি রেস্তোরাঁ মিলনায়তনে জরুরি সভা ডাকেন। এতে তিনি মহানগর বিএনপির নেতা এবং ৪২টি ওয়ার্ডের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবদের আমন্ত্রণ জানান। তবে মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতিসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা এতে আমন্ত্রণ পাননি। ইমদাদের বিরুদ্ধে দলের একটা অংশ ষড়যন্ত্র করছে বলে ওই সভায় অভিযোগ আনেন কয়েকজন নেতা। পুরো সভাটি কয়েকটি ফেসবুক আইডি থেকে লাইভও করা হয়। রাত ১০টার দিকে কেন্দ্রীয় বিএনপির সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জি কে গউছ ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ্ সিদ্দিকী মুঠোফোনে কল করে ইমদাদকে ওই সভা বন্ধ করতে বলেন। পরে সে সভা তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করা হয়।
আরও পড়ুনজুবাইদা রহমানকে প্রার্থী হিসেবে চেয়ে নগরজুড়ে পোস্টার, বিএনপিতে নানা আলোচনা১৬ মে ২০২৫ইমদাদ হোসেনের ডাকা ওই বৈঠকে বিএনপির ওয়ার্ড পর্যায়ের কয়েকজন নেতা মহানগর বিএনপির পরিচিতি সভা কিংবা বর্ধিত সভা না-হওয়ার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ সময় বক্তব্যে কেউ কেউ মহানগর বিএনপির কমিটিকে ‘অকার্যকর’ বলেও উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বক্তব্যে ‘সাবেক মেয়রের ফোনকলের’ বিষয়টি ফেসবুক ও গণমাধ্যমে প্রচার করে ‘দলকে হাসির খোরাক বানানোয়’ সংশ্লিষ্ট দলীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানানো হয়।
বৈঠকে বক্তারা অভিযোগ করেন, ওয়ার্ড পর্যায়ের কারও মতামত না নিয়ে সম্প্রতি এক রাতে মহানগরের ছয়টি থানায় আহ্বায়ক কমিটি অগঠনতান্ত্রিকভাবে তৈরি করা হয়েছে। মহানগরের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে মতবিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ এসব বিষয় ফেসবুক বা গণমাধ্যমে প্রচার করে দলকে হাসির পাত্রে পরিণত করা হচ্ছে। কারও মুঠোফোনের ব্যক্তিগত জিনিসকে অযথা প্রচারণার বিষয়বস্তু করে সংগঠনকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। সব ঘটনার তদন্তসাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
এদিকে ইমদাদ হোসেনের ব্যক্তিগত সভা আহ্বানকে ‘ধৃষ্টতাপূর্ণ’ বলে মন্তব্য করেছেন মহানগর বিএনপির এক নেতা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লোদীর অনুসারী ওই নেতা বলেন, ‘সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামানের সঙ্গে ইমাদাদ হোসেনের সম্পর্ক ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা হয়ে তিনি কীভাবে আড়ালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের নেতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, এটা দলের অনেকের প্রশ্ন। এ ছাড়া তিনি যে সভা ডেকেছেন, সেখানে তাঁর উপস্থিতিতেই মহানগর বিএনপির কমিটিকে অকার্যকর এবং মহানগর ছয়টি থানা কমিটি গঠনের বিষয়টিকে অগঠনতান্ত্রিক বলা হয়েছে। অথচ তিনি নিশ্চুপ ছিলেন। এটা দুঃখজনক।’
যোগাযোগ করলে রেজাউল হাসান কয়েস লোদী বলেন, ‘ইমদাদ হোসেনের সভা আহ্বানের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আর দুই দিন ধরে যা ঘটছে, এ-সম্পর্কিত কোনো বিষয়ে কথা বলতেও আমি আগ্রহী নই।’
কয়েস লোদীর এক অনুসারী বলেন, কিছুদিন আগে সিলেটে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর বাসায় কে বা কারা ভাঙচুর চালিয়েছিল। এ ঘটনায় তিনি লন্ডনে সংবাদ সম্মেলন করে এককভাবে কয়েস লোদীকে দায়ী করেছেন। সিলেট থেকে নাকি কেউ একজন তাঁকে (আনোয়ারুজ্জামান) এমন তথ্য দিয়েছেন। এখন আবার বিএনপি নেতা ইমদাদ হোসেন তাঁর কল–কাণ্ডের দায়ও কয়েস লোদীকেই দিচ্ছেন। এটা কোনো যোগসূত্র কি না, তা খোলাসা করা উচিত।
অন্যদিকে ইমদাদের অনুসারীদের দাবি, ইমদাদ মহানগর বিএনপির নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। কর্মী-সমর্থকদের কাছে তাঁর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে। এর বিপরীতে কয়েস লোদী ঘটনাচক্রে অনির্বাচিত ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। দলের একজন শীর্ষ নেতার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করায় দোষীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জি কে গউছ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যক্তিগত জিনিস দলের ওপর চাপানোর সুযোগ নেই। ব্যক্তিগত দায় ব্যক্তিকেই বহন করতে হবে, এর সঙ্গে সংগঠনকে যুক্ত করার সুযোগ নেই। ব্যক্তিগত কোনো বিষয়ে দলের সবাইকে ডেকে সভা করার সুযোগ নেই। ঐক্যের বিকল্প নেই। তাই আমরা দলের সবাইকে ঐক্য ধরে রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি। তবে পুরো বিষয়টি (কল–কাণ্ড এবং এটা ঘিরে পরবর্তী কার্যক্রম) অনাকাঙ্ক্ষিত ও বিব্রতকরও।’
আরও পড়ুনহঠাৎ লন্ডন সফরে সিলেটের সাবেক মেয়র আরিফুল, নানা আলোচনা০১ মে ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইমদ দ হ স ন র ব এনপ র ন ত কল ক ণ ড র পর য য় র র অন স র কয় স ল দ প রক শ য কর ম দ র দ বন দ ব ন ইমদ দ কজন ন ত ইমদ দ র ফ সব ক কর ছ ন নগর র গঠন ক ব যবস ব ষয়ট র একট
এছাড়াও পড়ুন:
আলোচনায় ডেপুটি হাইকমিশনার শাবাব, দেশে ফেরার নির্দেশ
দ্য হেগে বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার (স্থানীয়) শাবাব বিন আহমেদকে দেশে ফেরার নির্দেশ দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বৃহস্পতিবার (২২ মে) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাকে কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে বদলি করা হয়েছিল।
যোগদান করার আগেই তিনি কলকাতা মিশনে কোরবানি দেওয়ার প্রথা বন্ধের নির্দেশ দেন। এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সমালোচনার মুখে তাকে কলকাতা মিশনে বদলির আদেশ বাতিল করে দেশে ফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আরো পড়ুন:
পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে আসাদ আলম সিয়ামের নাম শোনা যাচ্ছে
দুই দিন পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজ উদ্ধার
কোরবানি বন্ধের নির্দেশনা দেওয়ার পর গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে শাবাব নিজের অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দিয়ে জানান, হোস্ট কান্ট্রির (ভারত) আস্থা অর্জন করাটা আমাদের জন্য জরুরি। এই আস্থা অর্জনের জন্যই তিনি এ নির্দেশনা দিয়েছেন।
কলকাতা মিশনে কোরবানি করার রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কলকাতা মিশনে কোরবানি হয়ে আসছে। প্রতি বছরই পাঁচ থেকে সাতটি গরু এবং ছাগল কোরবানি করা হয়। এই কোরবানির গোশতের একটি বড় অংশ বিভিন্ন এতিমখানায় পাঠানো হয়। এছাড়া মিশনের চারপাশে বসবাসকারী মুসলিমদের মাঝেও কোরবানির গোশত বিতরণ করা হয়।
শাবাব বিন আহমেদ একজন কূটনীতিক হিসেবে নেদারল্যান্ডসে ১ বছর ৯ মাস কর্মরত ছিলেন। তার বাবা ১৯৭৩ ব্যাচের একজন কর্মকর্তা এবং কট্টর আওয়ামী সমর্থক।
ঢাকা/হাসান/মেহেদী