মামলা করে বিপাকে নির্যাতিত ছাত্রের বাবা
Published: 2nd, July 2025 GMT
গাজীপুরের কালীগঞ্জে মাদরাসা ছাত্র নির্যাতনের ঘটনায় থানায় মামলা দায়েরের পর বিপাকে পড়েছেন ভুক্তভোগী ছাত্রের বাবা মো. মোশারফ শেখ। বিভিন্ন মহল থেকে মামলা প্রত্যাহারের জন্য তাকে চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। এমনকি তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।
বুধবার (২ জুলাই) বিকেলে এ প্রসঙ্গে কথা হয় মামলার বাদী মো.
মোশারফ শেখ অভিযোগ করে বলেন, “এখন আমাকে মামলা তুলে নিতে বিভিন্নভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, যদি আমি হুজুরকে জেল থেকে বের করে না দেই, তাহলে উল্টো আমার নামে মামলা দেওয়া হবে। শুনেছি তারা ৩৬ জনের একটি তালিকা করছে, যাদের নামে মামলা দিয়ে সব খরচ আমার ঘাড়ে চাপানো হবে। এমনকি তারা ভুয়া ভিডিও বানিয়ে প্রচার করছে যে, আমি ও আমার স্ত্রী ছেলেকে মেরে মাদরাসায় পাঠিয়েছি। তারা আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে।’’
তারা মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে জানিয়ে ভুক্তভোগী এই বাবা বলেন, ‘‘আমাকে জোর করে মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করার চেষ্টা করছে। যাতে আমি বলি ‘হুজুর মারে নাই, বরং আমরাই ছেলেকে মেরেছি’। তারা হুজুরকে মুক্ত করতে আমাকে বলির পাঁঠা বানাতে চায়।”
ভুক্তভোগী পরিবার এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আলউদ্দিন বলেন, ‘‘মামলার বাদী কিংবা তার পক্ষ থেকে আমাদের কাছে কেউ লিখিত বা মৌখিকভাবে কোনো অভিযোগ করেননি। তবে যদি মামলার বাদীকে কোনো পক্ষ মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়, মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করে বা প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করলেই আমরা প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’’
এদিকে, বুধবার (২ জুলাই) বিকালে কালীগঞ্জের ফুলদী নূরে মদিনা হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার প্রাঙ্গণে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ মো. জাকারিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা ষড়যন্ত্রমূলক ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং তার নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনটি যৌথভাবে আয়োজন করে কালীগঞ্জ ইমাম পরিষদ, কওমি ওলামা পরিষদ এবং তানযীমুল মাদারিসিল কওমিয়া। তারা মামলাটি প্রত্যাহার ও শিক্ষক জাকারিয়ার মুক্তি নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
উল্লেখ্য, ফুলদী নূরে মদিনা হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানায় মো. আবু বক্কর সিদ্দিক (৮) নামে এক ছাত্রকে বস্তায় ভরে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে ওই মাদরাসার শিক্ষক হাফেজ মো. জাকারিয়া শেখের (২৯) বিরুদ্ধে। শনিবার (২৮ জুন) সকালে ঘটনার পর ভুক্তভোগী ছাত্রের বাবা মো. মোশারফ শেখ বাদী হয়ে কালীগঞ্জ থানায় শিশু আইন ২০১৩-এর ৭০ ধারায় মামলা করেন।
রফিক//
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
সৌদি বিশ্বকাপ ২০৩৪ : বাংলাদেশি জনশক্তির বড় সুযোগ
ফিফার প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়েছেন– ২০৩৪ সালে ফিফা বিশ্বকাপ হবে সৌদি আরবে। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে লাখো সৌদি নাগরিকের উল্লাস শুধু ফুটবলপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ নয়; বরং দেশটির অর্থনৈতিক রূপান্তরের সম্ভাবনার উদযাপন। কয়েক বছর ধরেই সৌদি আরব অর্থনীতিকে তেলনির্ভরতা থেকে বহুমুখী করার চেষ্টা চালাচ্ছে। পর্যটন ও ক্রীড়া খাতের বিকাশে বিপুল বিনিয়োগ করছে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে সৌদিতে নিয়ে আসা, এমনকি লিওনেল মেসিকে নেওয়ার প্রচেষ্টা– এ সবই তাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। হজ ব্যবস্থাপনার মতো জটিল বিষয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার প্রমাণ করে– সৌদি আরব আধুনিক রাষ্ট্র গড়ার পথে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ‘ভিশন ২০৩০’ সৌদির অর্থনৈতিক রূপান্তরের মূল চালিকাশক্তি। এই মহাপরিকল্পনার অধীনে নিওম, কায়েদিয়া, দিরিয়াহ, রোশন, কিং সালমান পার্কের মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এসব প্রকল্পের লক্ষ্য অত্যাধুনিক শহর, বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র, বিনোদন হাব এবং পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ, যা সৌদি অর্থনীতিকে নতুন খাতে প্রসারিত করবে। একসময় তেলের ওপর ভিত্তি করে অর্থনীতির চাকা ঘুরলেও এখন তারা অন্যান্য প্রকল্পের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
২০৩৪ সালের বিশ্বকাপ আয়োজন সৌদি আরবে বিপুল দক্ষ জনবলের চাহিদা তৈরি করবে। বর্তমানে ৩০ লক্ষাধিক বাংলাদেশি শ্রমিক সৌদিতে কর্মরত। কিন্তু দেশটির কঠোর শ্রমনীতি ও প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান ব্যবহারে তাদের আয়ের সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে। আগে নির্মাণ খাতে বিপুলসংখ্যক অদক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন থাকলেও প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সেই সুযোগ কমে আসছে। কাতার বিশ্বকাপে স্টেডিয়াম নির্মাণে বাংলাদেশের কর্মীদের বড় অংশগ্রহণ থাকলেও দক্ষতার অভাবে তারা উচ্চ পর্যায়ের পদে কাজ করার সুযোগ পাননি।
দুঃখজনক, বাংলাদেশি জনশক্তির বেশির ভাগই অদক্ষ হওয়ায় তারা প্রবাসে ভালো বেতনে কাজ করতে পারেন না। বিশেষত ইংরেজি ও আরবিতে দক্ষতার অভাবে কাজে দক্ষ হয়েও ভালো পদে যেতে পারেন না। অনেক সময় দালালদের মাধ্যমে প্রতারিত হয়ে কম বেতনের বা অস্তিত্বহীন চাকরির ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসার ঘটনাও ঘটে। শ্রম আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং ভাষাবিষয়ক বাধা তাদের সমস্যা আরও বাড়িয়ে তোলে।
২০৩৪ সালের বিশ্বকাপ আয়োজন সামনে রেখে বৈশ্বিক বড় বড় ব্র্যান্ড সৌদিতে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারিত করবে। ফলে ব্যবস্থাপনা, হিসাবরক্ষণ, আইটি, স্বাস্থ্যসেবা, প্রকৌশলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘হোয়াইট কলার’ বা উচ্চমানের চাকরির সুযোগ তৈরি হবে। পর্যটন খাতে ট্যুর গাইড, হোটেল ম্যানেজমেন্ট, রিসেপশনিস্টসহ বিভিন্ন পদে বিপুসংখ্যক কর্মীর প্রয়োজন হবে। পরিবহন খাতেও দক্ষ ড্রাইভারের চাহিদা বাড়বে। এখানেই বাংলাদেশের জন্য লুকিয়ে আছে বিশাল সম্ভাবনা। আমাদের বিপুলসংখ্যক মাদ্রাসা-শিক্ষিত তরুণ আরবি ভাষায় পারদর্শী। তাদের যদি সঠিক ইংরেজি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ট্যুর গাইড, অনুবাদক বা রিসেপশনিস্ট হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তা হবে অভাবনীয় পরিবর্তন। একইভাবে ইলেকট্রিক্যাল, প্লাম্বিং, এইচভিএসি টেকনিশিয়ান, ওয়েল্ডার, ফ্যাব্রিকেটর, মেশিন অপারেটর, ফুড সাপ্লাই বা নিরাপত্তা কর্মী– এসব খাতে লাখো তরুণকে আধুনিক কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলা সম্ভব। এমনকি বুয়েটসহ দেশের নামকরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্র্যাজুয়েটদের জন্য সৌদির নির্মাণ খাত হতে পারে ইউরোপ বা আমেরিকার বিকল্প কর্মক্ষেত্র। এই মেগা প্রকল্পগুলোতে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার, স্থপতি, প্রজেক্ট ম্যানেজার, কারিগরি বিশেষজ্ঞের চাহিদা থাকবে।
আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ তরুণ শিক্ষাজীবন শেষ করেন। অথচ তাদের মধ্যে প্রায় ৯ লাখই চাকরির বাইরে থেকে যান। দেশের এই বিশাল বেকারত্বের সমাধান হতে পারে বৈশ্বিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশি তরুণদের যুক্ত করা। কিন্তু দুঃখজনক, দক্ষ জনবল রপ্তানির জন্য সরকারের এখনও সুসংগঠিত জাতীয় কৌশল নেই। ভারত, পাকিস্তান, এমনকি নেপালের মতো দেশও সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ‘হোয়াইট কলার’ বা উচ্চমানের চাকরিতে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ফিফা বিশ্বকাপ ২০৩৪ সামনে রেখে দেশব্যাপী সমন্বিত ও কার্যকর দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা জরুরি। এ পরিকল্পনায় সৌদি আরবের বাজারের চাহিদা অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
আরবি জানা তরুণদের ইংরেজিতে দক্ষ করে তোলার ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে, যাতে তারা আন্তর্জাতিক মানের সেবা দিতে পারে এবং উচ্চ পদে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় যোগাযোগ দক্ষতা অর্জন করে।
ড্রাইভিং (ভারী ও হালকা উভয়), ইলেকট্রিক্যাল, হোটেল ম্যানেজমেন্ট, পর্যটন, নির্মাণ নকশা, আইটি সাপোর্ট, স্বাস্থ্যসেবা সহকারী– এসব খাতে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। এসব প্রশিক্ষণ হাতে-কলমে এবং আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে।
বুয়েটসহ আমাদের প্রকৌশল ও ব্যবস্থাপনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সৌদি আরবের বড় বড় প্রকল্পের সংযোগ স্থাপন করতে হবে। সরাসরি নিয়োগ প্রক্রিয়া বা ইন্টার্নশিপের সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে। সৌদি আরবে একটি স্থায়ী বাংলাদেশি কনসালট্যান্সি সেবা চালু করা যেতে পারে, যা দক্ষ ও শিক্ষিত তরুণদের সঠিক কর্মসংস্থানে সহায়তা করবে। এ ছাড়া বিদেশে যাওয়ার আগে শ্রমিকদের জন্য সৌদি আরবের শ্রম আইন, সংস্কৃতি ও কর্মপরিবেশ সম্পর্কে বিস্তারিত কর্মসূচির আয়োজন করা উচিত।
২০৩৪ সালের বিশ্বকাপের মতো একটি আন্তর্জাতিক আয়োজন সামনে রেখে আমাদের সামনে দুটি পথ খোলা: হয় আমরা এই বিশাল সুযোগ হাতছাড়া করব, নয়তো দূরদর্শী পদক্ষেপ নিয়ে আমাদের তরুণদের জন্য সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করব।
সময় এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার। সময় এখন কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানোর। সরকারের দ্রুত পদক্ষেপই পারে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে নতুন মাত্রা যোগ করতে।
আকরাম হুসাইন: সাবেক ডাকসু নেতা
hossaincf@gmail.com