প্রতিবেশী এক যুবকের সঙ্গে গত শুক্রবার পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় কলি আক্তারের (২২)। কিন্তু, হাতের মেহেদীর রং না শুকাতেই নববধূ গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা। মাদারীপুর সদর উপজেলার ঝাউদি ইউনিয়নের টুবিয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

নিহতের স্বজনেরা জানান, প্রায় পাঁচ বছর আগে টুবিয়া গ্রামের কাতার প্রবাসী আসলাম মাতুব্বরের (৩১) সঙ্গে কলির বিয়ে হয়। তাদের সংসারে একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। পারিবারিক কলহের জেরে দেড় মাস আগে আসলামের সঙ্গে কলির বিচ্ছেদ হয়। এরপর সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে আসেন কলি। গত শুক্রবার পারিবারিকভাবে কলির সঙ্গে প্রতিবেশী মন্নান খার ছেলে আলী খার (৩০) বিয়ে হয়। এর জেরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন আসলামের পরিবারের লোকজন। শনিবার (৩ মে) সকালে তারা কলিদের বাড়িতে এসে কলির কোল থেকে তার আড়াই বছরের ছেলেকে নিয়ে যান। এর জেরে ওই দিন সন্ধ্যায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন কলি।

আরো পড়ুন:

সাতক্ষীরায় কলেজছাত্রীর গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা

ফরিদপুরে ঋণের চাপে কৃষকের আত্মহত্যা

কলির বাবা সালাম খা বলেন, ‘‘মেয়ের অশান্তির কারণে আসলামের সঙ্গে ডিভোর্স করাই। গত শুক্রবার কলির অন্যত্র বিয়ে দিই। এই খবরে আসলামের পরিবারের লোকজন আমার নাতিকে জোড় করে তুলে নিয়ে যায়। মেয়ে এই ঘটনা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। এই ঘটনায় আসলাম ও তার পরিবারের সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি কলির ছেলেকে আমাদের কাছে ফেরত দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’’

মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো.

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘‘মায়ের কাছ থেকে শিশুকে নেওয়ার পরপরই এই ঘটনা ঘটেছে। নিহতের স্বজনদের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

এদিকে, এ ঘটনার পরই পালিয়েছে আসলামের পরিবারের লোকজন। তাই তাদের পক্ষের কারো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

ঢাকা/বেলাল/রাজীব

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র পর ব র র আসল ম র

এছাড়াও পড়ুন:

‘ইবার সব বাদি বালা বৈশাখ পাইছি, লস অইতো না’

বাঁধ নির্মাণে নানা গাফিলতির খবর থাকা সত্ত্বেও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার বোরো মৌসুমে ভালো ফলন পেয়েছেন হাওরের মানুষ। ঝুট-ঝামেলা ছাড়াই হাওরের অর্ধেকের বেশি ধান কাটা হয়ে যায় বৈশাখের প্রথম সপ্তাহে। দাম নিয়ে একটু চিন্তা থাকলেও ফসল মার যাওয়ার আলামত নেই। তাই সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের কিষানির মতো অনেকেই বলতে পারছেন, ‘বালা বৈশাখ পাইছি, লস অইতো না’। 

সাধারণত তিন বছরে একবার মার্চ মাসের চৈতালি ঢল আর এপ্রিল মাসের বৈশাখী ঢলে হাওরের ফসল তলিয়ে যায়। হাওর এলাকায় সাড়ে ১২ লাখ হেক্টর জমিতে বছরে একটিই ফসল। পাহাড়ি ঢলের কারণে কোনো বছর সেটা তলিয়ে গেলে সারাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যায়। হুমকিতে পড়ে জীবন-জীবিকা ও শিশুদের লেখাপড়া। আফালে আফালে (হাওরের ঢেউ) বাড়তে থাকে বাল্যবিয়ে, শিশুশ্রম ও অভ্যন্তরীণ অভিবাসন।

তবে ২০১৭ সালের পর গত চার-পাঁচ বছর হাওরে বড় ধরনের বালা-মুসিবত নজরে পড়েনি। বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুহার বাড়লেও (২৮ এপ্রিল প্রাণ হারানো ২১ জনের ১০ জনই হাওর এলাকার) ফসলের তেমন ক্ষয়ক্ষতির ছায়া ছিল না। চৈতালি বা বৈশাখী ঢলের আছর ঠেকানোর জন্য হাওরে প্রতিবছর শুকনো মৌসুমে ফসল রক্ষা বাঁধ দিতে হয়। মেরামত করতে হয় ফেব্রুয়ারির মধ্যেই। মার্চ মাস থেকে উত্তরের পাহাড়ে আগাম বৃষ্টি-বাদল শুরু হলেই পানির ঢল নামে হাওরে। সেটা মে মাস পর্যন্ত সামাল দেওয়ার জন্য এই বাঁধ ব্যবস্থাপনা।
গত পাঁচ বছর বাঁধের জোরেই হাওরের ফসল ঘরে উঠেছে– হলফ করে বলা যাবে না। এ বছরও অনেক জায়গায় ঠিকমতো কাজ হয়নি; গড়িমসি হয়েছে, দেরি হয়েছে, লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ে আগাম বাদল না হওয়ায় বেঁচে গেছি। আমরা জানি, হাওরের পানি আসা-যাওয়ার সময়ে হেরফের হলেই এখানকার নাজুক উৎপাদন প্রক্রিয়া মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। মাজা ভেঙে চাষি নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হতে পারে।

এসব কারণে হাওরের বাঁধগুলো নকশা অনুযায়ী সঠিক মানে ও সময়মতো তৈরি করা জরুরি। বাঁধের নির্মাণ ব্যবস্থাপনা নজরে রাখার জন্য হাওরের বিভিন্ন জনপদে গণসংগঠন গড়ে উঠছে। তারই একটি সুনামগঞ্জের পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থা ২০২২ সালে বাঁধগুলো নিয়ে জরিপ করে। দৈবচয়ন পদ্ধতিতে সুনামগঞ্জ জেলার ৭২২টি বাঁধের মধ্যে ১০৮টি বাঁধ পরিদর্শন করে। দেখা গেছে, ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখ পর্যন্ত (বাঁধের শতভাগ কাজ সম্পন্ন করার শেষ সময়সীমা) মাত্র ৮ শতাংশ বাঁধে মাটির কাজ সম্পন্ন হয়েছে; ঘাস লাগানো হয়েছিল মাত্র ৩ শতাংশ বাঁধে।
সংশোধিত নীতিমালায় ৫০ মিটার দূর থেকে বাঁধের মাটি আনার কথা থাকলেও ৩৫ শতাংশ বাঁধে এ নিয়ম মানা হয়নি। নির্মাণাধীন বাঁধে দুরমুশ ও নির্দিষ্ট ঢাল বজায় রাখার কাজও সঠিকভাবে হয়নি। এই গণকমিটি জরিপের ফল নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে গাফিলতির কারণ জানার চেষ্টা করছিল। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে– ১. প্রকল্প প্রাক্কলন ও পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) গঠনে বিলম্ব; ২. অর্থ ছাড়ে বিলম্ব; ৩. হাওর থেকে দেরিতে পানি নামা; ৪. ড্রেজারের স্বল্পতা; ৫. বাঁধের মাটির দুষ্প্রাপ্যতা; ৬. প্রকল্প গঠনে অনিয়ম।

ছয়টি কারণের পাঁচটিই বহুল আলোচিত। ৩ নম্বর কারণটি (দেরিতে পানি নামা) অপেক্ষাকৃত নতুন। অন্য কারণগুলোর সমাধান নিয়ত ভালো থাকলে সম্ভব। কিন্তু হাওরে পানি আটকে থাকলে, জলাবদ্ধতা হলে সেই বিষ নামানোর ওঝা মিলবে কোথায়? হাওরের পানি ভৈরব বাজারের কাছে মেঘনা দিয়ে চাঁদপুর হয়ে সাগরে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কথিত ‘আবুরা’ বা অল ওয়েদার সড়কের (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামে প্রায় ২৯ কিমি) কারণে হাওরের পানি আগের মতো গতিতে নেমে যাচ্ছে না। জমে থাকা পানি থেকে পলি নয়; বালু পড়ছে জমিতে। প্রায় ৮৭৪ কোটি টাকা খরচ করে ‘দৃষ্টিনন্দন’ অল ওয়েদার সড়কটি নির্মাণের আগে বর্ষা মৌসুমে ২৯ কিলোমিটার এলাকা দিয়ে পানি মুক্তভাবে প্রবাহিত হতো। এখন যে তিনটি বড় সেতু এবং ১৪টি ছোট-বড় কালভার্ট ও আরসিসি পুল দিয়ে পানি বেরোতে পারে, এর মোট দৈর্ঘ্য ১ কিলোমিটারেরও কম। পানির সনাতন ২৯ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের রাস্তা এখন কমে মাত্র ৮০০ মিটার!

বছর কয়েক আগে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন হিসাব করে বলেছিলেন, সংকুচিত হয়ে আসা পথে পথে এক বছরের পানি প্রবাহিত হতে ১৮ বছর লাগবে। প্রতিবছর সব পানি বেরও হয়ে যাবে না। প্রতিবছরই জমতে থাকবে। এক সময় হাওরের কৃষিজমি জলাভূমিতে পরিণত হবে। ধান চাষ তথা কৃষিকাজ বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেছিলেন, যখন প্রতিটি জনপদ এ রকম সড়ক দিয়ে সংযুক্ত করা হবে, তখন হাওর খণ্ড-বিখণ্ড আবদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হবে। প্রতিবছর মারাত্মক বন্যা পরিস্থিতি ও মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।
আশার বিষয়, নীতিনির্ধারকরা বিশেষজ্ঞদের কথায় কান দিতে শুরু করেছেন। সিদ্ধান্ত হয়েছে– আর আবুরা নয়। এখন হবে উড়াল সেতু। হাওরের পানির প্রবাহ, জীববৈচিত্র্য ঠিক রেখে গাড়িতে চড়তে হলে উড়াল পথ ছাড়া বিকল্প নেই। তবে নির্মাণ খরচ পথশুল্ক থেকে উঠিয়ে আনার সম্ভাবনা নেই। এ ধরনের অনিশ্চিত প্রকল্পে বিদেশিরা অর্থায়ন করে না। বলা বাহুল্য, আবুরা সড়কের খরচও রাজস্ব খাত থেকেই মেটানো হয়েছে। যেভাবেই হোক, হাওরকে রক্ষা করতে হলে সেখানে পানি জমতে দেওয়া ঠিক হবে না।
আশার গুড়ে বালি পড়ে, যখন শোনা যায় কিশোরগঞ্জের ভূত খোদ সুনামগঞ্জের ঘাড়ে চেপে বসেছে।   

‘আমরার জমি শেষ, ধানও শেষ’  
যখন কিশোরগঞ্জে হাওরের এক সড়ক নিয়ে সারাদেশে সমালোচনা; নীতিনির্ধারকরা ‘আর হবে না আর হবে না’ ছড়া কাটছেন; তখন সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার সাংহাই হাওরে ৪ কিলোমিটার লম্বা একই ধরনের সড়ক হচ্ছে। সরেজমিন দেখা গেছে, পূর্ব পাড়ের ডুংরিয়া গ্রাম থেকে হাওরের মাঝখান দিয়ে সড়কটি যাবে পশ্চিম পাড়ের হাসনাবাদ গ্রামে। প্রকল্পটি সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের একান্ত ইচ্ছায় নেওয়া। ডুংরিয়া তাঁর নিজ গ্রাম। হাওরের এ অংশে ডুংরিয়া, হাসনাবাদ, জামলাবাজ গ্রামের কৃষকদের জমি। উত্তরে উজানীগাঁও, মির্জাপুর, ফতেপুর গ্রামের কৃষকদের জমি। কৃষক ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, হাওরের মাঝখান দিয়ে এভাবে সড়ক হওয়ায় প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে বিপুল পরিমাণ ফসলি জমির ক্ষতি হচ্ছে। এতে বর্ষায় স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। উজানে দেখা দেবে জলাবদ্ধতা।   

বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম
সুনামগঞ্জের তাহিরপুরভিত্তিক গণসংগঠন হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতারাও বাঁধের কাজে অনিয়ম আর ধীরগতিতে অসন্তুষ্ট। তারা বলছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বরাবরই নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করে না। এ নিয়ে লাখ লাখ কৃষক উদ্বেগ ও আতঙ্কে থাকেন। হাওর-সংলগ্ন পাটলাই নদের পাড় কেটে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এক্সক্যাভেটর দিয়ে মাটি কাটায় নদী ও নদীপাড়ের (কান্দার) সারিবদ্ধ হিজল গাছগুলো হুমকিতে পড়েছে। শিকড় আলগা হয়ে যাওয়া এসব গাছ আগামীতে টিকবে কিনা, কে জানে! না টিকলে ভাঙন হবে দ্রুত আর অনিবার্য। টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের মন্দিয়াতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সানজু মিয়া সংবাদকর্মীদের জানান, ‘প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা কান্দার মাটি কেটে বরং ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে হাওরের ফসল রক্ষা স্থায়ী বাঁধকেই। যেভাবে কান্দা কেটে নেওয়া হচ্ছে, তাতে দু-এক বছরের মধ্যেই বাঁধের মাটি নিতে উঁচু জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে না।’

সাফাই মনিটরিং বন্ধ হোক 
অনিয়ম-দুর্নীতির খবর প্রচারিত হলে ঢাকঢোল পিটিয়ে সংবাদকর্মীদের নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পরিদর্শন টিম পাঠানো হয়। স্বাভাবিক কারণে অনিয়ম তাদের চোখে পড়ে না। এ ধরনের সাফাই পরিদর্শন অনিয়ম-দুর্নীতিকে আড়াল করে মাত্র। যেমন, বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের খবর প্রচারিত হলে ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের পাথারচাউলি হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ পরিদর্শনে যান পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন প্রতাপশালী সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার। যথারীতি কাজের অগ্রগতি দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন। কিন্তু তাঁর পরিদর্শনের তিন দিনের মাথায় বাঁধে ফাটল দেখা দেয়; হুমকির মুখে পড়ে ১৫০ হেক্টর জমির বোরো ধান।

উপায় কী?
বছর কয়েক আগে হাকালুকি হাওরে বাঁধ নির্মাণের নামে বিভিন্ন প্রজাতির আনুমানিক ২০ হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়। বলা বাহুল্য, এত গাছ চোখের নিমেষে কেটে ফেলা সম্ভব নয়। কিন্তু খবর হয় গাছগুলো মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পর। খবরদারি আর নজরদারিতে পরিকল্পিত গাফিলতি না থাকলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। সেই সময় ঢাকাভিত্তিক পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এ ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবিসহ পাঁচ দফা সুপারিশ করেছিল। সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল– ১. হাওরের বৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষায় সব ইজারা বাতিল; ২. হাওরের জলাভূমি ও প্রাণবৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনায় হাওরবাসীকে যুক্ত করা ও জনগোষ্ঠীভিত্তিক সংরক্ষণ উদ্যোগ; ৩. হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা ও ইকোসিস্টেম বজায় রাখতে পানি, উদ্ভিদ, ধান, ভাসমান ও ক্ষুদ্র অণুজীবের সুরক্ষা নিশ্চিত করা; ৪. কাটা গাছের জায়গায় নতুন করে গাছ লাগানো ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা।

এসব সুপারিশের পাশাপাশি বাঁধ নির্মাণে স্বচ্ছ ও সমাজভিত্তিক উপায় অনুসন্ধান করতে হবে। আশির দশকে দেশি-বিদেশি সংস্থার মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি ও জনগণকে সম্পৃক্ত করে বাঁধ নির্মাণের সফল প্রক্রিয়া চালু ছিল। বাঁধ নির্মাণে টাকা ছাড়ের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সে ব্যবস্থা এখন ইতিহাস। তখন বাঁধ নির্মাণে অবহেলা ও অনিয়মের কথা তেমন শোনা যেত না। বাঁধ মেরামত ও নির্মাণ হয়ে যেত সময়মতো। বেসরকারি সংস্থাগুলোর অনেকেরই এখন সেই সক্ষমতা আছে; সওদাগরি প্রতিষ্ঠানগুলোও করপোরেট দায় মেটাতে পারে এমন উদ্যোগের মাধ্যমে।
হাওরের কৃষকদের প্রয়োজন স্বল্প জীবনকালসম্পন্ন (১২০-১৪০ দিন), ঠান্ডাসহিষ্ণু ও উচ্চফলনশীল ধান, যার ফসল আগাম বন্যার আগেই ঘরে তোলা যায়। হাওরাঞ্চলের জন্য এমন জাতের ধান উদ্ভাবনে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও নেপাল থেকে ঠান্ডাসহিষ্ণু জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রি। চলমান গবেষণা ইতোমধ্যে নতুন জাতের সন্ধান দিতে পেরেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে উদ্ভাবিত জাতটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধু ধান ১০০’। হবিগঞ্জের নাগুড়ায় ব্রির জমিতে চারা উদ্ভাবনের পর ‘পরীক্ষণ প্লট’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে কিশোরগঞ্জের নিকলী হাওর, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার শিবপাশা বাকাটিয়ার হাওর, বানিয়াচং উপজেলার মকার হাওর, নবীগঞ্জ উপজেলার গুঙ্গিয়াজুরী হাওর, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর হাওর, শনির হাওর ও মাটিয়ান হাওর। এটি ব্রি-২৮ ধানের মতো দেড়শ দিনে ফসল কাটার উপযোগী হবে। অক্টোবরেই এর বীজতলা তৈরি করা যাবে। শীতে কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু পানি আটকে গেলে বা নামতে দেরি হলে এই উদ্ভাবন, গবেষণা হাওরের উপকারে লাগবে কি?

ধান-মাছের পাশাপাশি মানুষ
হারভেস্টার আসার আগে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করতে হতো হাওরবাসীদের। এখন সেই নির্ভরতা কমলেও শ্রমিক আসে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে। আসেন ‘জিরাতি’ তথা মৌসুমি অভিবাসী। 

জিরাতিরা ‘হাওরের অস্থায়ী বাসিন্দা’। কার্তিকে আসেন, চলে যান বৈশাখে। এদের অনেকেরই পূর্বপুরুষের জমিজিরাত আছে হাওরে। কেউবা সাল পত্তনি নিয়ে চলে আসেন হাওরে। থাকেন অস্থায়ী ঘর বানিয়ে ধান কাটা পর্যন্ত। বোরো মৌসুমে হাওরে ধানক্ষেতের মাঝখানে চোখে পড়ে অস্থায়ী ‘গ্রাম’ ও কুঁড়েঘর। আশপাশের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে গাছপালা কিংবা ছায়া নেই। নেই বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা কিংবা ঘুমানোর জায়গা। এক হিসাবে দেখা যায়, কিশোরগঞ্জের নিকলী, মিঠামইন, ইটনা ও অষ্টগ্রাম উপজেলায় বসবাস করেন প্রায় ৩০ হাজার জিরাতি। পরিবার নিয়ে হাওরের বুকেই তাদের ছয় মাসের কর্মযজ্ঞ। কার্তিকে হাওরে আসার সময় সঙ্গে আনেন কৃষি যন্ত্রপাতি, গবাদি প্রাণী, সামান্য আসবাব, রান্নার সরঞ্জাম, ডিজেলচালিত সেচ পাম্প, ছয় মাসের জ্বালানি কাঠ। জীবনের নানা ঝুঁকি নিয়ে বছরের ছয় মাস মাঠে পড়ে থাকেন। শিকার হন বজ্রপাতের। বাসের জন্য বানানো মাচার নিচেই রাখা হয় গবাদি প্রাণী। চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে বসবাস করা এসব মানুষের ভাগ্যে জোটে না পুষ্টিকর খাবার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের আহার মোটা ভাত আর মরিচ ভর্তা।

তবুও কেন আসেন? 
৫০-প্রায় কোরবান সরকার জানালেন, বর্ষায় তিনি থাকেন নেত্রকোনায়। কার্তিকে চলে আসেন নিকলী হাওরে। বাড়িতে তিনি গরুর দেখভাল করেন,  স্ত্রী হাস্নাবানু হাঁসের ঝাঁক নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাদের এই কর্মযজ্ঞ হচ্ছে বিস্তীর্ণ মাঠের মাঝখানে তিনটি ঘর ঘিরে, যেখানে তারা বাস করেন। কোরবান বলেন, ‘বাপ-দাদার জমি ছাইড়া যাইতে মন চায় না। তাই প্রতিবছর এমন সময়ে এখানে আসি। জিরাত করে যা পাই, তাই লইয়া বাড়িতে যাই।’
বারবার ফসল মার যাওয়ায় ২০১৭ সালের পর থেকে জিরাতিদের আগ্রহ কমতে থাকে। অনাবাদি থাকে অনেক জমি।   

শিশুর কথা
যে জিরাতিদের ছয় মাস হাওরে, ছয় মাস ডাঙায় কাটে, তাদের ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার কী হয়? তা নিয়ে আমাদের কোনো হায়-আফসোস আছে? চিন্তা নেই সেসব শিশুকে নিয়েও, যারা পরিবারের সঙ্গে সারাবছর হাওরে থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে লেখাপড়ায়। বৃষ্টি, ঢল, বন্যা ও বজ্রপাত মাথায় করে তাদের থাকতে হয়। বর্ষায় বিদ্যালয় বন্ধ। লাইনের নৌকা সব ঘাট ধরে না; ক্লাস অনিয়মিত। অনেক শিশুই মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে পারে না। তাই বাড়িতে বসিয়ে না রেখে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয় বাল্যকালে। সেখানে ভালো ফসল মানেই বেশি বাল্যবিয়ে। যাদের বাল্যবিয়ে হচ্ছে, যারা বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন, তাদের নিয়ে বেশি আলোচনা প্রয়োজন। তা কবে হবে, জানি না। কিন্তু হাওরকে চিন্তামুক্ত করতে হাওরবাসীর আকাঙ্ক্ষা জানা, তার ভিত্তিতে পথ খোঁজা জরুরি।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও শিক্ষক
wahragawher@gmail.com 
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ