ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কসংক্রান্ত বিশৃঙ্খলা আমাদের ইতিমধ্যেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়েছে। এ শিক্ষাগুলো শুধু আমেরিকার অর্থনীতিকেই নয়, ট্রাম্পকে বোঝার ক্ষেত্রেও সহায়ক। এসব শিক্ষা কাজে লাগিয়ে অন্য দেশগুলো যদি নিজেদের পাল্টা শুল্কব্যবস্থা ঠিকভাবে সাজায়, তাহলে তারা ট্রাম্পের চাপে নতিস্বীকার না করে বরং তাঁর ক্ষমতা অনেকটাই খর্ব করতে পারবে।

প্রথম যে বিষয়টা বোঝা গেছে, তা হলো, আমেরিকার অর্থনীতি যতটা শক্তিশালী বলে মনে হয়, বাস্তবে তা ততটা নয়। কারণ, বাস্তব খাত (যেমন উৎপাদন ও বাণিজ্য) আর আর্থিক খাত (যেমন শেয়ারবাজার, বন্ডবাজার) একে অপরের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। বাণিজ্য ও উৎপাদনের ভবিষ্যৎ সংকট নিয়ে যখন ভয় ছড়ায়, তখন তা শেয়ারবাজার, বন্ডবাজার ও মুদ্রাবাজারে চোখের নিমেষে ছড়িয়ে পড়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ব্যবস্থার প্রধান দুর্বলতা হলো যখন শেয়ারবাজারে বড় ধস নামে, তখন উচ্চ পরিমাণে ঋণ নেওয়া ও প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন হেজ ফান্ডগুলো টিকতে না পেরে হঠাৎ করে নগদ অর্থ জোগাড়ের জন্য সরকারি বন্ডসহ নানা সম্পদ বিক্রি করে দেয়। এ কারণে বাজারে ব্যাপক আতঙ্ক ও অস্থিরতা দেখা দেয়। এই হঠাৎ অস্থিরতার সম্ভাবনাই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে অন্য অনেক দেশের তুলনায় বেশি দুর্বল করে তোলে। দ্বিতীয় যে শিক্ষা আমরা পেয়েছি, তা হলো ট্রাম্প যতই দাম্ভিক ও হুমকির ভঙ্গিতে কথা বলুন না কেন, বাস্তবে তিনি ভেতরে-ভেতরে দুর্বল। যখন তাঁর আরোপিত শুল্ক তাঁর ধনী বন্ধুদের ব্যবসায়িক স্বার্থে আঘাত হানে, তখন তিনি পিছু হটেন। 

এখন প্রশ্ন হলো, অন্যান্য দেশ কীভাবে এই দুই দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে পারে?

এ প্রশ্নের জবাব নিশ্চয়ই ওয়াশিংটনে গিয়ে ট্রাম্পের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়ানোর মধ্যে (যেমনটা ইতিমধ্যে প্রায় ৭৫টি দেশের প্রতিনিধিরা করেছেন বলে জানা গেছে) নেই। এটি শুধু যে মর্যাদাহানিকর তা-ই নয়; বরং তা একেবারেই কোনো কাজে আসবে না। কারণ, এতে ট্রাম্প নিজের ক্ষমতা আরও বেশি করে অনুভব করেন এবং এক দেশের বিরুদ্ধে আরেক দেশকে লাগিয়ে খেলা দেখানোর সুযোগ পান। 

উল্টোটা যদি হয়, অর্থাৎ অন্য দেশগুলো যদি সহযোগিতা না করে, তাহলে ধরে নিতে হবে তারা কার্যত নিজেদের পিঠে মারার জন্য ট্রাম্পের হাতে লাঠি তুলে দিচ্ছে। প্রশ্ন হলো, বিশ্ববাণিজ্যের মাত্র ১৫ শতাংশ যাঁর দখলে, তিনি কীভাবে বাকি ৮৫ শতাংশকে জিম্মি করে ফেলেন?

আরও খারাপ বিষয় হলো, ট্রাম্প যদি কোনো দেশের দুর্বলতা টের পান, তাহলে তিনি সেই দেশের ওপর আরও কঠিন শর্ত চাপিয়ে দেন। তাঁর সঙ্গে করা চুক্তিগুলো যে কার্যকর হবে, তা নিয়েও সন্দেহ থাকে। কারণ, তিনি নিজে প্রায়ই এসব চুক্তিকে পাত্তা দেন না। সেই অর্থে এসব চুক্তি আসলে কাগজের ওপর সইস্বাক্ষর ছাড়া আর কিছু নয়। আরও সহজ করে বললে ট্রাম্পকে মোকাবিলা করতে হলে মাথা নিচু করে যাওয়ার কোনো মানে হয় না; বরং তাঁর দুর্বল জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সেখানে আঘাত করলেই ফল পাওয়া যাবে। 

ট্রাম্পকে মোকাবিলার অনেক ভালো কৌশল হলো, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করা। এতে আমেরিকার প্রকৃত দুর্বলতা প্রকাশ পাবে, ট্রাম্পের ধনী বন্ধুদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে এবং শেষমেশ ট্রাম্পকে তা আবারও পিছু হটতে বাধ্য করবে। 

যদি অন্যান্য দেশ কোনো ধরনের আলোচনায় না যায় এবং ট্রাম্পের শুল্কনীতির জবাবে সমান মাত্রায় পাল্টা শুল্ক আরোপ করে, তাহলে ট্রাম্পের ওপর এই চাপ প্রয়োগ করা সম্ভব। যদি অনেক দেশ একসঙ্গে এই কৌশল নেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র একা হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, বিশ্ববাণিজ্যের মাত্র ১৫ শতাংশের অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। বাকি ৮৫ শতাংশ যেসব দেশ, তারা যদি একজোট হয়ে প্রতিক্রিয়া জানায়, তাহলে তাদেরই লাভ হবে। 

তবে কিছু অর্থনীতিবিদ পাল্টা শুল্ক আরোপের যুক্তির বিরোধিতা করেন। মুক্তবাণিজ্যের প্রচলিত মত হলো, যে দেশ শুল্ক আরোপ করে, সে দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই অন্য দেশগুলোর একই পথে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া উচিত হবে না। কিন্তু এই যুক্তি রাজনৈতিক বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেয় না। বাস্তবতা হলো, যখন অন্য দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক বসায়, তখন তারা আমেরিকার রপ্তানি খাতে চাপ সৃষ্টি করে। এর ফলে আমেরিকার ভেতরে এমন এক চাপগোষ্ঠী তৈরি হবে, যারা ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ বন্ধের দাবি তুলবে। 

যদি দেশগুলো একসঙ্গে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব রপ্তানিনির্ভর খাত (বিশেষত হাইটেক ও ডিজিটাল পরিষেবা খাত) কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলোর ওপর সর্বোচ্চ চাপ তৈরি করা সম্ভব। এতে ট্রাম্পের শুল্কনীতির বিরুদ্ধে আমেরিকার অভ্যন্তরে সফল বিরোধিতার সম্ভাবনা বাড়বে।

একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন ও বাণিজ্যব্যবস্থায় বড় ধরনের ক্ষতি হবে, যা আবারও আর্থিক বাজারকে নাড়া দেবে। এটিই আগেরবার ট্রাম্পকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল।

তবে যুক্তিপূর্ণ নীতি নির্ধারণ করা যত সহজ, সেটি বাস্তবে সংগঠিত করা তত সহজ নয়। এখানে একটি ক্ল্যাসিক ‘সমষ্টিগত কর্মের সমস্যা’ দেখা দেয়। খুব কম দেশই এগিয়ে এসে ঝুঁকি নিতে চায়; কারণ, এতে তারা যুক্তরাষ্ট্রের রোষানলে পড়তে পারে। কিন্তু যদি অনেক দেশ একত্র হয়, তাহলে ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষে প্রত্যেককে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা আর থাকবে না। কারণ, পুরো বিশ্বকে একসঙ্গে শাস্তি দিতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রেরই বিপুল ক্ষতি হবে।

উল্টোটা যদি হয়, অর্থাৎ অন্য দেশগুলো যদি সহযোগিতা না করে, তাহলে ধরে নিতে হবে তারা কার্যত নিজেদের পিঠে মারার জন্য ট্রাম্পের হাতে লাঠি তুলে দিচ্ছে। প্রশ্ন হলো, বিশ্ববাণিজ্যের মাত্র ১৫ শতাংশ যাঁর দখলে, তিনি কীভাবে বাকি ৮৫ শতাংশকে জিম্মি করে ফেলেন?

এই সমষ্টিগত সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। চীন ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক বসিয়ে পথ দেখিয়েছে। যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এতে যোগ দেয়, তাহলে দুটি বড় শক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে প্রকটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে এবং অন্য দেশগুলোও এই জোটে যোগ দেওয়ার উৎসাহ পাবে। এর ফলে ট্রাম্প প্রশাসন আরও একঘরে হবে, আমেরিকার অর্থনীতিতে বড় আঘাত আসবে, অথচ বিশ্বের অন্য দেশগুলো কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তখন আবার ট্রাম্প চোখ নামিয়ে ফেলতে বাধ্য হবেন।

পল দো গ্রাউয়ে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের ইউরোপিয়ান পলিটিক্যাল ইকোনমির চেয়ারপ্রফেসর

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম র ক র দ র বলত ব যবস থ আর থ ক দ র বল র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

পাহাড়, সমুদ্র, চা–বাগান—একসঙ্গে দেখা যায় যে উপজেলায়

ছবি: প্রথম আলো

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সব সিম লক রেখে কিস্তিতে স্মার্টফোন বিক্রির সুযোগ পাচ্ছে অপারেটররা
  • আগামী বছর নির্বাচনের পর বিশ্ব ইজতেমা: ধর্ম উপদেষ্টা
  • শাহরুখের ব্যাপারে সাবধান করলেন জুহি চাওলা
  • শাহরুখের অজানা এই সাত তথ্য জানেন?
  • পাহাড়, সমুদ্র, চা–বাগান—একসঙ্গে দেখা যায় যে উপজেলায়