ট্রাম্পকে চোখ নামাতে বাধ্য করার সহজ পথ
Published: 4th, May 2025 GMT
ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কসংক্রান্ত বিশৃঙ্খলা আমাদের ইতিমধ্যেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়েছে। এ শিক্ষাগুলো শুধু আমেরিকার অর্থনীতিকেই নয়, ট্রাম্পকে বোঝার ক্ষেত্রেও সহায়ক। এসব শিক্ষা কাজে লাগিয়ে অন্য দেশগুলো যদি নিজেদের পাল্টা শুল্কব্যবস্থা ঠিকভাবে সাজায়, তাহলে তারা ট্রাম্পের চাপে নতিস্বীকার না করে বরং তাঁর ক্ষমতা অনেকটাই খর্ব করতে পারবে।
প্রথম যে বিষয়টা বোঝা গেছে, তা হলো, আমেরিকার অর্থনীতি যতটা শক্তিশালী বলে মনে হয়, বাস্তবে তা ততটা নয়। কারণ, বাস্তব খাত (যেমন উৎপাদন ও বাণিজ্য) আর আর্থিক খাত (যেমন শেয়ারবাজার, বন্ডবাজার) একে অপরের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। বাণিজ্য ও উৎপাদনের ভবিষ্যৎ সংকট নিয়ে যখন ভয় ছড়ায়, তখন তা শেয়ারবাজার, বন্ডবাজার ও মুদ্রাবাজারে চোখের নিমেষে ছড়িয়ে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ব্যবস্থার প্রধান দুর্বলতা হলো যখন শেয়ারবাজারে বড় ধস নামে, তখন উচ্চ পরিমাণে ঋণ নেওয়া ও প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন হেজ ফান্ডগুলো টিকতে না পেরে হঠাৎ করে নগদ অর্থ জোগাড়ের জন্য সরকারি বন্ডসহ নানা সম্পদ বিক্রি করে দেয়। এ কারণে বাজারে ব্যাপক আতঙ্ক ও অস্থিরতা দেখা দেয়। এই হঠাৎ অস্থিরতার সম্ভাবনাই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে অন্য অনেক দেশের তুলনায় বেশি দুর্বল করে তোলে। দ্বিতীয় যে শিক্ষা আমরা পেয়েছি, তা হলো ট্রাম্প যতই দাম্ভিক ও হুমকির ভঙ্গিতে কথা বলুন না কেন, বাস্তবে তিনি ভেতরে-ভেতরে দুর্বল। যখন তাঁর আরোপিত শুল্ক তাঁর ধনী বন্ধুদের ব্যবসায়িক স্বার্থে আঘাত হানে, তখন তিনি পিছু হটেন।
এখন প্রশ্ন হলো, অন্যান্য দেশ কীভাবে এই দুই দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে পারে?
এ প্রশ্নের জবাব নিশ্চয়ই ওয়াশিংটনে গিয়ে ট্রাম্পের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়ানোর মধ্যে (যেমনটা ইতিমধ্যে প্রায় ৭৫টি দেশের প্রতিনিধিরা করেছেন বলে জানা গেছে) নেই। এটি শুধু যে মর্যাদাহানিকর তা-ই নয়; বরং তা একেবারেই কোনো কাজে আসবে না। কারণ, এতে ট্রাম্প নিজের ক্ষমতা আরও বেশি করে অনুভব করেন এবং এক দেশের বিরুদ্ধে আরেক দেশকে লাগিয়ে খেলা দেখানোর সুযোগ পান।
উল্টোটা যদি হয়, অর্থাৎ অন্য দেশগুলো যদি সহযোগিতা না করে, তাহলে ধরে নিতে হবে তারা কার্যত নিজেদের পিঠে মারার জন্য ট্রাম্পের হাতে লাঠি তুলে দিচ্ছে। প্রশ্ন হলো, বিশ্ববাণিজ্যের মাত্র ১৫ শতাংশ যাঁর দখলে, তিনি কীভাবে বাকি ৮৫ শতাংশকে জিম্মি করে ফেলেন?আরও খারাপ বিষয় হলো, ট্রাম্প যদি কোনো দেশের দুর্বলতা টের পান, তাহলে তিনি সেই দেশের ওপর আরও কঠিন শর্ত চাপিয়ে দেন। তাঁর সঙ্গে করা চুক্তিগুলো যে কার্যকর হবে, তা নিয়েও সন্দেহ থাকে। কারণ, তিনি নিজে প্রায়ই এসব চুক্তিকে পাত্তা দেন না। সেই অর্থে এসব চুক্তি আসলে কাগজের ওপর সইস্বাক্ষর ছাড়া আর কিছু নয়। আরও সহজ করে বললে ট্রাম্পকে মোকাবিলা করতে হলে মাথা নিচু করে যাওয়ার কোনো মানে হয় না; বরং তাঁর দুর্বল জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সেখানে আঘাত করলেই ফল পাওয়া যাবে।
ট্রাম্পকে মোকাবিলার অনেক ভালো কৌশল হলো, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করা। এতে আমেরিকার প্রকৃত দুর্বলতা প্রকাশ পাবে, ট্রাম্পের ধনী বন্ধুদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে এবং শেষমেশ ট্রাম্পকে তা আবারও পিছু হটতে বাধ্য করবে।
যদি অন্যান্য দেশ কোনো ধরনের আলোচনায় না যায় এবং ট্রাম্পের শুল্কনীতির জবাবে সমান মাত্রায় পাল্টা শুল্ক আরোপ করে, তাহলে ট্রাম্পের ওপর এই চাপ প্রয়োগ করা সম্ভব। যদি অনেক দেশ একসঙ্গে এই কৌশল নেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র একা হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, বিশ্ববাণিজ্যের মাত্র ১৫ শতাংশের অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। বাকি ৮৫ শতাংশ যেসব দেশ, তারা যদি একজোট হয়ে প্রতিক্রিয়া জানায়, তাহলে তাদেরই লাভ হবে।
তবে কিছু অর্থনীতিবিদ পাল্টা শুল্ক আরোপের যুক্তির বিরোধিতা করেন। মুক্তবাণিজ্যের প্রচলিত মত হলো, যে দেশ শুল্ক আরোপ করে, সে দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই অন্য দেশগুলোর একই পথে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া উচিত হবে না। কিন্তু এই যুক্তি রাজনৈতিক বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেয় না। বাস্তবতা হলো, যখন অন্য দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক বসায়, তখন তারা আমেরিকার রপ্তানি খাতে চাপ সৃষ্টি করে। এর ফলে আমেরিকার ভেতরে এমন এক চাপগোষ্ঠী তৈরি হবে, যারা ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ বন্ধের দাবি তুলবে।
যদি দেশগুলো একসঙ্গে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব রপ্তানিনির্ভর খাত (বিশেষত হাইটেক ও ডিজিটাল পরিষেবা খাত) কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলোর ওপর সর্বোচ্চ চাপ তৈরি করা সম্ভব। এতে ট্রাম্পের শুল্কনীতির বিরুদ্ধে আমেরিকার অভ্যন্তরে সফল বিরোধিতার সম্ভাবনা বাড়বে।
একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন ও বাণিজ্যব্যবস্থায় বড় ধরনের ক্ষতি হবে, যা আবারও আর্থিক বাজারকে নাড়া দেবে। এটিই আগেরবার ট্রাম্পকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল।
তবে যুক্তিপূর্ণ নীতি নির্ধারণ করা যত সহজ, সেটি বাস্তবে সংগঠিত করা তত সহজ নয়। এখানে একটি ক্ল্যাসিক ‘সমষ্টিগত কর্মের সমস্যা’ দেখা দেয়। খুব কম দেশই এগিয়ে এসে ঝুঁকি নিতে চায়; কারণ, এতে তারা যুক্তরাষ্ট্রের রোষানলে পড়তে পারে। কিন্তু যদি অনেক দেশ একত্র হয়, তাহলে ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষে প্রত্যেককে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা আর থাকবে না। কারণ, পুরো বিশ্বকে একসঙ্গে শাস্তি দিতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রেরই বিপুল ক্ষতি হবে।
উল্টোটা যদি হয়, অর্থাৎ অন্য দেশগুলো যদি সহযোগিতা না করে, তাহলে ধরে নিতে হবে তারা কার্যত নিজেদের পিঠে মারার জন্য ট্রাম্পের হাতে লাঠি তুলে দিচ্ছে। প্রশ্ন হলো, বিশ্ববাণিজ্যের মাত্র ১৫ শতাংশ যাঁর দখলে, তিনি কীভাবে বাকি ৮৫ শতাংশকে জিম্মি করে ফেলেন?
এই সমষ্টিগত সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। চীন ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক বসিয়ে পথ দেখিয়েছে। যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এতে যোগ দেয়, তাহলে দুটি বড় শক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে প্রকটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে এবং অন্য দেশগুলোও এই জোটে যোগ দেওয়ার উৎসাহ পাবে। এর ফলে ট্রাম্প প্রশাসন আরও একঘরে হবে, আমেরিকার অর্থনীতিতে বড় আঘাত আসবে, অথচ বিশ্বের অন্য দেশগুলো কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তখন আবার ট্রাম্প চোখ নামিয়ে ফেলতে বাধ্য হবেন।
● পল দো গ্রাউয়ে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের ইউরোপিয়ান পলিটিক্যাল ইকোনমির চেয়ারপ্রফেসর
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম র ক র দ র বলত ব যবস থ আর থ ক দ র বল র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
আজ বন্ধু দিবস
‘‘বন্ধুত্ব গড়তে ধীর গতির হও। কিন্তু বন্ধুত্ব হয়ে গেলে প্রতিনিয়ত তার পরিচর্যা করো।’’— উক্তিটি সক্রেটিসের। সত্যকথা বলতে বন্ধুত্ব বাঁচে পরিচর্যায়। এ এমন এক সম্পর্ক যাকে অবহেলায় ফেলে রাখলে চলে না। আজ বিশ্ব বন্ধু দিবস।
কবে, কখন এই দিনটি প্রচলন হয়েছিলো তা নিয়ে নানা মত আছে। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত হলো, ‘‘১৯৩৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এক বন্ধুর আত্মত্যাগের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আগস্ট মাসের প্রথম রোববারকে ‘ফ্রেন্ডশিপ ডে’ ঘোষণা করে মার্কিন কংগ্রেস। এরপর ২০১১ সালে জাতিসংঘ ৩০ জুলাইকে বিশ্ব বন্ধু দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।’’
বাংলাদেশে আগস্ট মাসের প্রথম রোববার দিবসটি পালিত হয়। আবেগ-ভালোবাসায় পালিত হয় এই দিন। বন্ধুরা একে অপরকে উপহার দেন, একসঙ্গে সময় কাটান, স্মৃতি রোমন্থন করেন।
আরো পড়ুন:
৩০ বছরের হিমায়িত ভ্রুণ থেকে জন্ম নিলো জীবিত শিশু
ছবিটি দেখে মিলিয়ে নিন আপনি আবেগনির্ভর নাকি যুক্তিনির্ভর
জানা যায়, এই দিবসটি বাণিজ্যিক কারণে আরও বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ১৯৩০ সালের ২ আগস্ট বিশ্বখ্যাত উপহারসামগ্রী ও কার্ড বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান হলমার্কের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জয়েস হল বন্ধু দিবসের আয়োজন করেন। ওই আয়োজনের উদ্দেশ্য ছিলো যেন সবাই একসঙ্গে মিলে বন্ধুত্বের উৎসব পালন করতে পারেন।
কার্ড আদান-প্রদানের মাধ্যমে বন্ধু দিবস পালন করার চল শুরু হয়। যদিও আয়োেজনের পেছনে ছিলো- জয়েসের গ্রিটিংস কার্ড বিক্রির একটি কৌশল।
বন্ধু দিবস উদযাপন করার বিষয়ে বিশ্বের একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সময়ে-সময়ে উদ্যোগ নিয়েছে। ১৯৫৮ সালের ২০ জুলাই বিশ্বব্যাপী বন্ধুত্ব দিবস পালনের চিন্তা ডা. র্যামন আর্টেমিও ব্রাকোর মাথায় আসে। তিনি প্যারাগুয়ে শহরের পুয়ের্তো পিনাস্কোয়ে নিজের বন্ধুদের সঙ্গে নৈশভোজে বসেছিলেন তিনি। আর তিনিই বন্ধুদের সঙ্গে মিলে গড়ে তোলেন মেরি গ্রুপ ওয়ার্ল্ড ফ্রেন্ডশিপ ক্রুসেড।
এই সংস্থাটি জাতি, বর্ণ, ধর্ম, ভাষা, লিঙ্গ নির্বিশেষে নিঃস্বার্থ ও মানবদরদী বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এরপর ১৯৯৮ সালে রাষ্ট্রসংঘ তৎকালীন সাধারণ সচিব কফি আনানের স্ত্রীর নাম ন্যান লেগারগ্রেন উইনি দ্য পু কার্টুন চরিত্রকে বন্ধুত্বের দূত হিসেবে চিহ্নিত করেন।
১৯৫৮ সালের ৩০ জুলাই প্রথম ফ্রেন্ডশিপ ডে উদযাপিত হওয়ার পর ‘জেনারেল অ্যাসেম্বলি অব দ্য ইউনাইটেড নেশন’ ২০১১ সালের ৩০ জুলাই দিনটি আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস হিসেবে ঘোষণা করে রাষ্ট্রসংঘ। মূলত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, ধর্ম ইত্যাদি নির্বিশেষে বিভিন্ন দেশের মানুষের বন্ধুত্বের একটি শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস ঘোষণা করে।
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও এরপর ছড়িয়ে যায় দিবসটি। বন্ধু দিবসে বন্ধুদের ফুল, কার্ড, রিস্ট ব্যান্ড ইত্যাদি উপহার দিয়ে বন্ধুদের প্রতি ভালোবাসা জ্ঞাপন করা হয়। একেক দেশে একেক তারিখে বন্ধু দিবস পালিত হয়। যেদিনই হোক বন্ধু দিবস, আপনার জন্য এটি হতে পারে একটি বিশেষ দিন। অনেকদিন যে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় না, আজ দেখা করুন, পছন্দের জায়গায় আড্ডা দিন, খেতে পারেন একসঙ্গে হলে যে খাবারগুলো খেতেন প্রতিদিন।
বন্ধুত্ব মানে চির সবুজ এক সম্পর্ক । যা সময় গড়িয়ে গেলেও পুরোনো হয় না। বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবস আমাদের সবাইকে বন্ধুত্বের শক্তিকে মনে করিয়ে দেয়, সেই সঙ্গে বুঝিয়ে দেয় যে মানবতা আমাদের সবার এবং বন্ধুত্বের মাধ্যমেই একটি শান্তিপূর্ণ ও সংযুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব।
ঢাকা/লিপি