অস্ট্রেলিয়ায় লেবার পার্টি কেন বড় জয় পেল
Published: 5th, May 2025 GMT
শনিবার সন্ধ্যায় অস্ট্রেলিয়া আবারও তার রাজনৈতিক মঞ্চ, মসনদ, ক্ষমতা আর দায়িত্ব কার তা নতুন করে এঁকে ফেলল। ৮০ বছরের নির্বাচনী ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিরোধীদলীয় লিবারেল পার্টি এমন একটি বিপর্যয় দেখল, যার অভিঘাত শুধু একটি দল বা একজন নেতার নয়—এটা গোটা রক্ষণশীল রাজনীতির এক চরম আত্মসমালোচনার উপলক্ষ হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে অ্যান্থনি আলবানিজের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার সাধারণ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টির চমকপ্রদ বিজয় এটি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই লেবার পার্টি হয়ে উঠেছে আরও আত্মবিশ্বাসী, আরও দায়িত্বশীল।
কিন্তু ফলাফলের আগে চমকপ্রদ জয়-পরাজয় নিয়ে অস্ট্রেলিয়াজুড়ে ছিল অনিশ্চয়তার এক দোলাচল। সন্ধ্যা থেকে ভোটের ফলাফল আসামাত্রই টেলিভিশন পর্দায় চোখ রাখতেই দেখা গেল, কুইন্সল্যান্ডের ডিকসন আসনে ফলাফলের টালমাটাল সূচক হঠাৎ এক লাল রেখায় রঙিন হয়ে উঠেছে।
পিটার ডাটন, যিনি ২৪ বছর ধরে এই আসনের দাপুটে নেতা ছিলেন এবং অনেকের ধারণা ছিল এবারের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী—তিনি হেরে গেছেন। হারিয়েছেন এক নারী প্রার্থী, আলি ফ্রান্স, যিনি লেবার পার্টির হয়ে লড়ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিতে এটি ছিল এক প্রতীকী মুহূর্ত। পুরুষতান্ত্রিক নেতৃত্ব, রক্ষণশীল ভাবমূর্তি এবং ক্ষমতার যাওয়ার দম্ভ একটিমাত্র জনগণের রায়ে কীভাবে ধুলোয় মিশে যায়, তার এক বাস্তব উদাহরণ যেন এই ফলাফল।
অন্যদিকে দৃঢ় কিন্তু শান্ত কণ্ঠে যখন অ্যান্থনি আলবানিজ জাতির উদ্দেশে তাঁর বিজয় ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন সেখানে ছিল না কোনো জয়জয়কারের চিৎকার, বরং ছিল দায়িত্বের ভারগ্রস্ত এক কণ্ঠস্বর। তিনি বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রিত্ব আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দায়িত্ব।’ লেবার পার্টির জন্য এই জয় শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার নয়, এক অভ্যন্তরীণ আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ারও জয়। ৮৯টি আসনে জয়—যা আগের তুলনায় ১৪টি বেশি—এই ফল শুধু কৌশলের নয়, আদর্শিক অবস্থানেরও বহিঃপ্রকাশ।
এই নির্বাচনের ফলাফলে যেমন রয়েছে পরিসংখ্যানের বিস্ময়, তেমনি রয়েছে সামাজিক পরিবর্তনের স্পষ্ট ছাপ। ভোটাররা যেন বলেই দিয়েছেন—পুরোনো কথার মোড়ক আর বিশ্বাসযোগ্য নয়। মানুষের প্রত্যাশা এখন বদলেছে এবং রাজনীতিকে সেই বদলের প্রতিচ্ছবি হতে হবে।
লিবারেল পার্টির পতনের গল্পটা কিন্তু হঠাৎ ঘটেনি। এটা আসলে ধীরে ধীরে তৈরি হওয়া এক রাজনৈতিক নিঃসঙ্গতার ফল। বহুদিন ধরেই দেখা যাচ্ছিল, দলটি মূলত করপোরেট শ্রেণির সুবিধাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা উপেক্ষা করে তারা বারবার পাশ কেটে গেছে। অথচ এই পুরো দশকই অস্ট্রেলিয়ার মানুষ গরমে পুড়েছে, বন্যায় ভেসেছে, ঝড়ে ছিন্নভিন্ন হয়েছে। এই জলবায়ু সংকটে যারা চুপ থেকেছে, তারা যে ভোটারদের হৃদয়ে স্থান হারাবে, তা অনুমান করা কঠিন ছিল না।
তবে শুধু জলবায়ুই নয়। এই নির্বাচনের ভেতরে চাপা পড়ে ছিল নারীদের দীর্ঘ ক্ষোভ, অসম সামাজিক ন্যায়বিচার, অভিবাসীদের প্রতি অবহেলা এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। সংসদ ভবনের অভ্যন্তরে নারীদের হয়রানির ঘটনাগুলো লিবারেল পার্টির ভেতরের অবক্ষয় তুলে ধরেছিল। আর একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় যখন দ্রুত বেড়েছে—বাসাভাড়া থেকে শুরু করে সুপারমার্কেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যখন আকাশছোঁয়া, তখন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষ নিশ্চুপ থাকেনি।
যদিও লেবার পার্টি-ই ক্ষমতায় ছিল গত তিন বছর; তবু বাস্তবতা না এড়িয়ে এই অভিজ্ঞতাগুলোকে মাথায় রেখেই তাদের প্রচারণা সাজিয়েছিল—স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বাসস্থানের মতো মৌলিক বিষয়ে নজর দিয়েছে, যা সরাসরি মানুষ বিশ্বাস করেছে।
এদিকে অভিবাসন ও আদিবাসী অধিকার প্রশ্নে লিবারেল পার্টি প্রায় নির্লিপ্ত থেকে গেছে। ‘ভয়েস টু পার্লামেন্ট’ নামে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার যে প্রস্তাব, লেবার সেখানে শক্ত অবস্থান নিয়েছে, আর লিবারেল সেখানে ‘না’ বলেছে। সেই না-এর প্রতিধ্বনি এবার ব্যালট বাক্সে ফিরে এসেছে।
এই নির্বাচনের আরেক চমক অবশ্য স্বতন্ত্র প্রার্থীদের উত্থান। বিশেষ করে, ‘টিল ইনডিপেনডেন্টস’ নামে পরিচিত একঝাঁক প্রার্থী, যাঁরা মূলধারার দলগুলোর বাইরে থেকে এসে পরিবেশ, নারীর অধিকার ও স্বচ্ছতা নিয়ে সরব হয়েছেন—তাঁদের প্রতি ভোটারদের আস্থা বেড়েছে। তাঁরা দেখিয়েছেন, রাজনীতি মানেই দলবাজি আর ফাঁকা বুলি নয়, বরং জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক দায়িত্বও হতে পারে।
লেবার পার্টির এই জয়ের পেছনে অবশ্যই ব্যক্তিগত এক কৌশলী নেতৃত্বের নাম উঠে আসে—অ্যান্থনি আলবানিজ। তিনি রাজনীতির মঞ্চে চমক সৃষ্টি করেন না, মাইক হাতে গর্জে ওঠেন না। কিন্তু তাঁর বাম মধ্যপন্থা আদর্শ, স্থির ও ধৈর্যশীল মনোভাব অস্ট্রেলিয়ার জনগণের মধ্যে একধরনের আস্থা তৈরি করেছে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মেডিকেয়ার আরও সম্প্রসারিত হবে, উচ্চশিক্ষা আরও সহজলভ্য হবে এবং শিশুযত্নসহ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সবুজ, বাসযোগ্য ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা হবে।
এই ফলাফল বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা বহন করে এনেছে। লিবারেল জোট ক্ষমতায় এলে স্কিলড অভিবাসীদের সংখ্যা হ্রাস, ওয়ার্ক ভিসার শর্ত কঠোর হওয়া এবং স্টুডেন্ট ভিসার ফি বৃদ্ধি ও নিয়মে জটিলতা—সবচেয়ে বড় কথা, প্রায় ২৫ শতাংশ অভিবাসী হ্রাস—এই সবকিছুই অভিবাসীদের হতাশ করছিল। লেবার পার্টির নীতিগত অবস্থান অভিবাসীবান্ধব এবং এই সরকার ক্ষমতায় আসার ফলে বিশেষত স্বাস্থ্য, প্রবীণদের যত্ন এবং প্রযুক্তি খাতে দক্ষ অভিবাসীদের নতুন সুযোগ তৈরি হবে বলেই ধারণা।
তবে জয় মানেই সব সমস্যার সমাধান নয়। আলবানিজের সামনে এখন বিশাল এক দায়িত্ব—সাধারণ জীবনযাত্রার ব্যয় সংকোচন, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিশ্বমন্দার সম্ভাব্য ধাক্কা সামাল দেওয়া, গৃহনির্মাণ–সংকট ও জলবায়ু সংকটে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ। মানুষ ভোট দিয়েছে আশায় এবং সেই আশা পূরণ না হলে এই বিজয়ের উল্লাসও খুব তাড়াতাড়ি ফিকে হয়ে যেতে পারে।
আর লিবারেল পার্টির জন্য এখন আত্মসমালোচনার সময়। পুরোনো চাল আর পুরোনো মুখ নিয়ে তারা আগামীর রাজনীতিতে টিকতে পারবে না। নারীর নেতৃত্ব, সামাজিক ন্যায়বিচার ও জলবায়ু এবং অভিবাসনভাবনা নিয়ে যদি নতুন করে দল পুনর্গঠিত না হয়, তবে আগামী কয়েক দশকেও হয়তো ক্ষমতার মুখ দেখা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে।
অস্ট্রেলিয়ার এই নির্বাচনী ফলাফল তাই শুধু একটি সরকার নতুন করে ক্ষমতায় আসা কিংবা আরেকটির উত্থান নয়—এটি এক গভীর মানসিক পরিবর্তনের প্রতিফলন। রাজনীতির যে ভাষা গত শতকের দিকে চেয়ে তৈরি হয়েছে, সেই ভাষা আজ আর গ্রহণযোগ্য নয়। এখন মানুষ চায় সহানুভূতি, বাস্তবতা ও সমতার রাজনীতি। অস্ট্রেলিয়া সেটা করে দেখিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, বাকিরা এই বার্তা কতটা শুনতে পায়।
কাউসার খান, প্রথম আলোর সিডনি প্রতিনিধি ও অভিবাসন আইনজীবী
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র র জন ত আলব ন জ ক ষমত য র জন য ফল ফল জলব য
এছাড়াও পড়ুন:
তথ্য এখন জাতীয় নিরাপত্তার কৌশলগত অস্ত্র: পরিবেশ উপদেষ্টা
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, “জাতীয় নিরাপত্তা এখন কেবল অস্ত্রের ওপর নির্ভর করে না, এটি জনমতের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বিভ্রান্তিকর তথ্য একটি মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র; এটি মোকাবিলায় চাই সত্য, আস্থা এবং তথ্যভিত্তিক সচেতনতা।”
বুধবার (১৮ জুন) মিরপুরের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে (এনডিসি) অনুষ্ঠিত ‘অ্যাডভান্সিং ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট: ইউজ অফ ইনফরমেশন এজ এ পাওয়ারফুল স্ট্রাটেজিক টুল’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন।
সেমিনারটি যৌথভাবে আয়োজন করে এনডিসি এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিপিএসএস)।
আরো পড়ুন:
বন্যপ্রাণি সংরক্ষণে অবদানের জন্য পুরস্কার পাচ্ছে ৪ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে পরিবেশ উপদেষ্টা
উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ আমাদের ইতিহাসে এক ট্র্যাজেডি। ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল ভুল তথ্য ও ষড়যন্ত্র। আজকের দিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো গুজব ঠিক তেমনি জাতীয় নিরাপত্তা ও উন্নয়নকে হুমকির মুখে ফেলছে।”
তিনি বলেন, “তথ্যের স্বপ্রণোদিত প্রকাশ নিশ্চিত না হলে জনগণ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, ফলে গুজবই সমাজে চালিকা শক্তি হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রের প্রকল্পের খরচ জনগণের টাকায়। তাই জনগণের উচিত সেই প্রকল্প সম্পর্কে জানার অধিকার থাকা।”
উপদেষ্টা জলবায়ু সংকটকে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, “বৈশ্বিক উষ্ণতা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি আমাদের এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ডকে ডুবিয়ে দিতে পারে। তথ্য শুধু প্রযুক্তি দিয়ে নয়, লোকজ জ্ঞান দিয়েও গঠিত। অনেক ক্ষেত্রে গ্রামের মানুষদের পূর্বাভাস মডেলের চেয়েও বেশি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
উপদেষ্টা জানান, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশকে স্যাটেলাইটভিত্তিক তথ্য ও প্রশিক্ষণ সহায়তা দিতে প্রস্তুত। এখন প্রয়োজন সেই তথ্য বিশ্লেষণের সক্ষমতা গড়ে তোলা এবং তা সাধারণ মানুষের কাছে সহজভাবে পৌঁছে দেওয়া।
তিনি বলেন, “তথ্য যদি গোপন রাখা হয়, সত্য যদি দমন করা হয়, তাহলে আমরা টেকসই উন্নয়ন ও নিরাপত্তা দুটোই হারাব। এই আলোচনার মাধ্যমে আমরা যেন একটি তথ্যভিত্তিক, সুরক্ষিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়ার পথে আরও একধাপ এগিয়ে যেতে পারি।”
অন্যদের মাঝে বক্তব্য দেন, ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের কমান্ড্যান্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ শাহীনুল হক। এছাড়া চারজন অংশগ্রহণকারী মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
এতে ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা, কূটনীতিক, শিক্ষাবিদ, অংশগ্রহণকারী এবং উন্নয়ন পেশাদাররা উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/মেহেদী