স্বাস্থ্যের সুপারিশ যুগোপযোগী বাস্তবায়নের নির্দেশনা নেই
Published: 10th, May 2025 GMT
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন এই খাতে গুণগত পরিবর্তন আনার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ ছাড়া সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে আইন সংস্কার, নতুন আইন তৈরিসহ মোটাদাগে ৩২টি সুপারিশ দিয়েছে। যদিও ৩২২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে সব মিলিয়ে প্রায় ২০০ সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো যুগোপযোগী, বাস্তবায়ন হলে ভঙ্গুর এ খাতের চেহারা পাল্টে যাবে। কিন্তু কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, সে বিষয়ে নির্দেশনা নেই প্রতিবেদনে। সুপারিশগুলো বাস্তবায়নযোগ্য, তবে সংখ্যায় অনেক বেশি। দুই বছরের মধ্যে এসব কাজ সম্পন্ন করা কঠিন।
পেশাদারিত্ব, দক্ষতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বিদ্যমান স্বাস্থ্য ক্যাডার পুনর্গঠনের মাধ্যমে প্রশাসনিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস গঠন করার একটি সুপারিশ এসেছে। এটা ভালো সুপারিশ। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে এটা বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এ জন্য রাজনৈতিক সরকার প্রয়োজন হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার আসবে, সংসদে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে।
চিকিৎসকরা রোগীকে ঠিকমতো সময় দেন না, এমন অভিযোগ অধিকাংশের। সেই ভাবনা থেকে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে সেবার মান বাড়ানোর জন্য রোগীকে কমপক্ষে ১০ মিনিট দেখবেন চিকিৎসক– এমন সুপারিশ এসেছে। তবে অনেক রোগীর জন্য ১০ মিনিটের বেশি সময় লাগে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। আবার অনেক ক্ষেত্রে কমও লাগতে পারে। তাই রোগীর সঙ্গে ১০ মিনিটই কথা বলতে হবে, এটা বেঁধে দেওয়া ঠিক হবে না। এতে সেবার মান নিশ্চিত হবে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না। সেবার মান নিশ্চিত করতে এর সঙ্গে আরও অনেক কিছু জড়িত। সেবার মান উন্নয়নে কার্যকর কমিউনিটি এডুকেশনও প্রয়োজন। বাংলাদেশে এটির অনেক অভাব রয়েছে।
জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক গঠনের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, এটা অবশ্যই ভালো দিক। এই নেটওয়ার্কের মধ্যে জাতীয় ফার্মেসি, জাতীয় ডায়াগনস্টিক ল্যাবরেটরি, জাতীয় রক্ত সঞ্চালন বিভাগ এবং জাতীয় অ্যাম্বুলেন্স নেটওয়ার্ক গঠন করতে হবে। এই পরিষেবাগুলো নির্ধারিত মানদণ্ড অনুযায়ী নিজ নিজ ক্ষেত্রে একটি একীভূত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সারাদেশে সংযুক্ত থাকবে। এটি বাস্তবায়ন হলে সেবার মান এমনিতেই বাড়বে। তবে এটি কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, তার কোনো দিকনির্দেশনা এর মধ্যে নেই। এটা বললে বা প্রস্তাব করলেই বাস্তবায়ন হয়ে যাবে, এমনটি নয়। এটার সুনির্দিষ্ট কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগীর সুরক্ষা নিশ্চিত ও সহিংসতা প্রতিরোধে মেডিকেল পুলিশ গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছে। এটি ভালো সুপারিশ। এ জন্য মেডিকেল পুলিশের আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এই পুলিশ বেসরকারি হাসপাতালে থাকবে কিনা– এ বিষয়ে প্রতিবেদনে কোনো কথা বলা হয়নি। আমাদের দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে সেবা নিয়ে থাকে।
এ ছাড়া আরও একটি যুগোপযোগী সুপারিশ এসেছে, বেসরকারি হাসপাতালে সেবামূল্য নির্ধারণ। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই খাতে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব হয়নি। প্রতিষ্ঠানভেদে এই সেবামূল্য নির্ধারণ করা হয়। চাইলেও এই খাত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে যদি আলাদা অতিরিক্ত মহাপরিচালক নিয়োগ দিয়ে এই খাতে সব সেবার মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া যায়, তাহলে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হবে। গোটা প্রতিবেদন পড়ে আমি যেটা বুঝেছি, তদারক বা তত্ত্বাবধান করার বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। হাসপাতালে সেবার মান বাড়াতে আমরা সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করলাম। যদি সঠিক তদারকি বা নজরদারি না করা যায়, তাহলে কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলবে না।
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নজরদারিতে না রাখলে আমরা তো বুঝতে পারবো না, তারা ঠিকমতো কাজ করছে কিনা। স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের মোট ৩২টি সুপারিশ দেখলাম। এসব সুপারিশের মধ্যে তদারকি ও পরিদর্শনের বিষয়ে কোনো আলোচনা নেই। বর্তমান স্বাস্থ্য খাতে এটার বড় ঘাটতি রয়েছে। সুপারিশেও উল্লেখযোগ্যভাবে মিসিং। এটা যদি না থাকে, যত সুপারিশ আসুক না কেন, কাজে আসবে না। এ ছাড়া নার্সিং ও পুষ্টির বিষয়টি উপেক্ষিত রয়েছে।
নতুন আরও একটি সুপারিশ এসেছে, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) বাইরে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে একটি কাউন্সিল গঠন করার কথা বলা হয়েছে। এটি কীভাবে পরিচালিত হবে, এ বিষয়ে তেমন কিছুই বলা হয়নি। এ ছাড়া চিকিৎসকদের কাছে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি পাঠিয়ে সরাসরি ওষুধের প্রচার চালানো বন্ধ করার সুপারিশ করেছে কমিশন। এখন থেকে ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু ডাক বা ই-মেইলের মাধ্যমে চিকিৎসকদের কাছে পণ্যের তথ্য পাঠাতে পারবে। এ ক্ষেত্রে নতুন ওষুধের বিষয়ে চিকিৎসকদের ধারণা দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা বাধা তৈরি করতে পারে। এটা আরও পরিষ্কার করে বলতে হবে। এক কথায় বলতে গেলে সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য, তবে বাস্তবায়নের নির্দেশনা জরুরি।
লেখক : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
শ্রুতিলিখন- তবিবুর রহমান
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স প র শ এস ছ ব সরক র এই খ ত র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
স্বাস্থ্যের সুপারিশ যুগোপযোগী বাস্তবায়নের নির্দেশনা নেই
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন এই খাতে গুণগত পরিবর্তন আনার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ ছাড়া সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে আইন সংস্কার, নতুন আইন তৈরিসহ মোটাদাগে ৩২টি সুপারিশ দিয়েছে। যদিও ৩২২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে সব মিলিয়ে প্রায় ২০০ সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো যুগোপযোগী, বাস্তবায়ন হলে ভঙ্গুর এ খাতের চেহারা পাল্টে যাবে। কিন্তু কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, সে বিষয়ে নির্দেশনা নেই প্রতিবেদনে। সুপারিশগুলো বাস্তবায়নযোগ্য, তবে সংখ্যায় অনেক বেশি। দুই বছরের মধ্যে এসব কাজ সম্পন্ন করা কঠিন।
পেশাদারিত্ব, দক্ষতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বিদ্যমান স্বাস্থ্য ক্যাডার পুনর্গঠনের মাধ্যমে প্রশাসনিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস গঠন করার একটি সুপারিশ এসেছে। এটা ভালো সুপারিশ। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে এটা বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এ জন্য রাজনৈতিক সরকার প্রয়োজন হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার আসবে, সংসদে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে।
চিকিৎসকরা রোগীকে ঠিকমতো সময় দেন না, এমন অভিযোগ অধিকাংশের। সেই ভাবনা থেকে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে সেবার মান বাড়ানোর জন্য রোগীকে কমপক্ষে ১০ মিনিট দেখবেন চিকিৎসক– এমন সুপারিশ এসেছে। তবে অনেক রোগীর জন্য ১০ মিনিটের বেশি সময় লাগে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। আবার অনেক ক্ষেত্রে কমও লাগতে পারে। তাই রোগীর সঙ্গে ১০ মিনিটই কথা বলতে হবে, এটা বেঁধে দেওয়া ঠিক হবে না। এতে সেবার মান নিশ্চিত হবে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না। সেবার মান নিশ্চিত করতে এর সঙ্গে আরও অনেক কিছু জড়িত। সেবার মান উন্নয়নে কার্যকর কমিউনিটি এডুকেশনও প্রয়োজন। বাংলাদেশে এটির অনেক অভাব রয়েছে।
জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক গঠনের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, এটা অবশ্যই ভালো দিক। এই নেটওয়ার্কের মধ্যে জাতীয় ফার্মেসি, জাতীয় ডায়াগনস্টিক ল্যাবরেটরি, জাতীয় রক্ত সঞ্চালন বিভাগ এবং জাতীয় অ্যাম্বুলেন্স নেটওয়ার্ক গঠন করতে হবে। এই পরিষেবাগুলো নির্ধারিত মানদণ্ড অনুযায়ী নিজ নিজ ক্ষেত্রে একটি একীভূত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সারাদেশে সংযুক্ত থাকবে। এটি বাস্তবায়ন হলে সেবার মান এমনিতেই বাড়বে। তবে এটি কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, তার কোনো দিকনির্দেশনা এর মধ্যে নেই। এটা বললে বা প্রস্তাব করলেই বাস্তবায়ন হয়ে যাবে, এমনটি নয়। এটার সুনির্দিষ্ট কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগীর সুরক্ষা নিশ্চিত ও সহিংসতা প্রতিরোধে মেডিকেল পুলিশ গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছে। এটি ভালো সুপারিশ। এ জন্য মেডিকেল পুলিশের আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এই পুলিশ বেসরকারি হাসপাতালে থাকবে কিনা– এ বিষয়ে প্রতিবেদনে কোনো কথা বলা হয়নি। আমাদের দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে সেবা নিয়ে থাকে।
এ ছাড়া আরও একটি যুগোপযোগী সুপারিশ এসেছে, বেসরকারি হাসপাতালে সেবামূল্য নির্ধারণ। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই খাতে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব হয়নি। প্রতিষ্ঠানভেদে এই সেবামূল্য নির্ধারণ করা হয়। চাইলেও এই খাত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে যদি আলাদা অতিরিক্ত মহাপরিচালক নিয়োগ দিয়ে এই খাতে সব সেবার মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া যায়, তাহলে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হবে। গোটা প্রতিবেদন পড়ে আমি যেটা বুঝেছি, তদারক বা তত্ত্বাবধান করার বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। হাসপাতালে সেবার মান বাড়াতে আমরা সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করলাম। যদি সঠিক তদারকি বা নজরদারি না করা যায়, তাহলে কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলবে না।
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নজরদারিতে না রাখলে আমরা তো বুঝতে পারবো না, তারা ঠিকমতো কাজ করছে কিনা। স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের মোট ৩২টি সুপারিশ দেখলাম। এসব সুপারিশের মধ্যে তদারকি ও পরিদর্শনের বিষয়ে কোনো আলোচনা নেই। বর্তমান স্বাস্থ্য খাতে এটার বড় ঘাটতি রয়েছে। সুপারিশেও উল্লেখযোগ্যভাবে মিসিং। এটা যদি না থাকে, যত সুপারিশ আসুক না কেন, কাজে আসবে না। এ ছাড়া নার্সিং ও পুষ্টির বিষয়টি উপেক্ষিত রয়েছে।
নতুন আরও একটি সুপারিশ এসেছে, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) বাইরে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে একটি কাউন্সিল গঠন করার কথা বলা হয়েছে। এটি কীভাবে পরিচালিত হবে, এ বিষয়ে তেমন কিছুই বলা হয়নি। এ ছাড়া চিকিৎসকদের কাছে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি পাঠিয়ে সরাসরি ওষুধের প্রচার চালানো বন্ধ করার সুপারিশ করেছে কমিশন। এখন থেকে ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু ডাক বা ই-মেইলের মাধ্যমে চিকিৎসকদের কাছে পণ্যের তথ্য পাঠাতে পারবে। এ ক্ষেত্রে নতুন ওষুধের বিষয়ে চিকিৎসকদের ধারণা দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা বাধা তৈরি করতে পারে। এটা আরও পরিষ্কার করে বলতে হবে। এক কথায় বলতে গেলে সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য, তবে বাস্তবায়নের নির্দেশনা জরুরি।
লেখক : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
শ্রুতিলিখন- তবিবুর রহমান