প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন: আস্থার সংকট, নাকি প্রহসন? এ প্রশ্ন বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গভীর এক আলোচনার জন্ম দেয়। নির্বাচন যে একটি দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর মেরুদণ্ড, তা নিশ্চিত। তবে যখন নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়, তখন তা গণতন্ত্র নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলতে পারে। সত্যি কথা বলতে গেলে, বাংলাদেশের বিগত কয়েকটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ছিল এবং এর ফলে নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের আস্থা কমে গেছে। নির্বাচনের ফলাফল, ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া, নির্বাচনকালীন সহিংসতা, ভোট ডাকাতি, দিনের ভোট রাতে এবং জাল ভোট প্রদান সম্পর্কিত বিভিন্ন অভিযোগ অনেক সময় বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।


প্রহসনের নির্বাচন বলতে আমরা এমন একটি নির্বাচনকে বুঝি, যেখানে নির্বাচন প্রক্রিয়া নৈতিক এবং আইনগতভাবে সঠিক হয় না এবং সেই নির্বাচনে জনগণের মতামত বা ভোটের কোনো মূল্য থাকে না। অর্থাৎ একটি নির্বাচন– যেটি শুধু একটি নাটক বা উপসর্গের মতো হাস্যকর হয়, যেখানে ফল আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে এবং জনগণের ভোটের মাধ্যমে কোনো বাস্তব পরিবর্তন ঘটানোর সুযোগ থাকে না। ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া একতরফা হয়ে যেতে পারে, যেখানে কিছু মানুষ বা পক্ষ ভোটে জালিয়াতি করে এবং ভোটের প্রকৃত ফল পরিবর্তন করা হয়। সহিংসতা, হুমকি এবং ভয়ভীতি দেখানো হয়, যাতে জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে না পারে। অনেক ক্ষেত্রে বিরোধী দল বা প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন না বা তাদের ভোটাররা ভয় পেয়ে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন।


 বাংলাদেশেও একাধিক নির্বাচনে প্রশ্নবিদ্ধতা ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, যেমন ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন। এসব নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা এবং নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি আস্থা কমে গেছে। এর ফলে নির্বাচনকালীন সহিংসতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দেশের আন্তর্জাতিক ইমেজও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সার্বিকভাবে ‘প্রহসনের নির্বাচন’ শব্দটি নির্বাচনের প্রতি জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা ভঙ্গ করে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া দুর্বল করে দেয়। এ ধরনের নির্বাচন জনগণের মনে একটি অনুভূতি তৈরি করে যে, নির্বাচনে ভোট দেওয়ার কোনো অর্থ নেই এবং ফল আগেই নির্ধারিত। এর ফলে নির্বাচনের প্রতি জনগণের আগ্রহ ও অংশগ্রহণ কমে যেতে পারে। বারবার প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হওয়ার ফলে জনগণের মধ্যে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা কমে যাচ্ছে। যখন নির্বাচনকে সঠিক, নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছভাবে আয়োজন করা হয় না, তখন জনগণের মধ্যে হতাশা, অবিশ্বাস এবং অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতিতে ভোটারদের উৎসাহ কমে যায় এবং তারা মনে করে যে তাদের ভোটের কোনো মূল্য নেই।


এমন একটি পরিবেশে নির্বাচন প্রক্রিয়া সংস্কারের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দলগুলো এবং সরকার সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে, যাতে জনগণের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা যায় এবং তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহী হয়। নির্বাচনী সংস্করণ, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও ফলাফল ঘোষণায় স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা সুনিশ্চিত করা গেলে হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে।


প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন থেকে উত্তরণের জন্য নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। নির্বাচন কমিশন যদি রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে এবং তারা ন্যায্যভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে, তবে নির্বাচনের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরে আসবে। কমিশনের সদস্যদের নিয়োগ প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হতে হবে, যাতে কোনো পক্ষের প্রভাব না পড়ে। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগণের আস্থা গড়তে তাদের কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা দরকার। নির্বাচন পরিচালনার প্রতিটি স্তরে পর্যবেক্ষক সংস্থা, যেমন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল, স্থানীয় সাংবাদিকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। এভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জালিয়াতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর নজরদারি করা সম্ভব হবে। নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার প্রক্রিয়া এবং ভোট গণনা স্বচ্ছ হওয়া জরুরি, যাতে জনগণ তা নিয়ে সন্দিহান না হয়। ভোটারদের স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার পরিবেশ নিশ্চিত করা অন্যতম একটি বিষয়। নির্বাচনের সময় সহিংসতা, ভয়ভীতি বা হুমকি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। নির্বাচনী কেন্দ্রগুলোতে সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির জন্য পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিরপেক্ষভাবে কাজের পরিবেশ দেওয়া দরকার, যাতে কোনো দল বা গোষ্ঠী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে না পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহিষ্ণুতা এবং শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা উচিত। রাজনৈতিক দলগুলো যাতে একে অপরকে সম্মান করে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে, তার জন্য একটি সম্মানজনক পরিবেশ তৈরি করা খুবই জরুরি। 
দলগুলোর মধ্যে আলোচনার সুযোগ বাড়ানো এবং শক্তিশালী বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হলে নির্বাচনের ফলাফল আরও গ্রহণযোগ্য হবে। জনগণের মধ্যে ভোটদানে সচেতনতা তৈরি করা জরুরি। ভোটারদের ভোট দেওয়ার গুরুত্ব এবং তাদের অধিকার সম্পর্কে শিক্ষিত করতে হবে, যাতে তারা জানে যে তাদের একটি ভোট দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ গড়ে তুলতে সমাজে রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিবর্তন প্রয়োজন। সবাইকে জানাতে হবে, শুধু নির্বাচনে অংশগ্রহণই নয়; নির্বাচনের সুষ্ঠুতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা একটি বড় দায়িত্ব। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের কারণে দেশ এবং জনগণের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আরও কিছু সুস্থ চিন্তাধারাসহ উল্লিখিত বিষয়গুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করলে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সুষ্ঠুতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। জনগণের মধ্যে নির্বাচনের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে এনে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা যাবে এবং ভবিষ্যতে নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাবে।


প্রহসনের নির্বাচন গণতন্ত্রের পরিপন্থি। এটি জনগণের অধিকার হরণ করে এবং একটি দেশকে একনায়কতন্ত্রের দিকে ঠেলে দেয়। একটি সুস্থ ও কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন অবাধ, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। জনগণের সত্যিকার মতামতই হতে হবে শাসনের ভিত্তি।


জুয়েল হাসান: প্রকৌশলী


 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক ন শ চ ত কর ন র ব চনক র জন ত ক প রহসন পর ব শ র জন য গ রহণ ফল ফল দলগ ল

এছাড়াও পড়ুন:

মোমবাতি প্রজ্বালনে শহীদদের স্মরণ করলো ছাত্রদল, ৩৬ দিনের কর্মসূচি উদ্বোধন

জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও মোমবাতি প্রজ্বালনের মাধ্যমে ঐতিহাসিক জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণ করেছে ছাত্রদল। ছাত্র জনতার বিজয়ের বর্ষপূর্তি উদযাপন উপলক্ষে সোমবার রাত ১২টার পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘আলোয় আলোয় স্মৃতি সমুজ্জ্বল’ শিরোনামে এ কর্মর্সূচি পালন করেন সংগঠনটির বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মী। একইসঙ্গে তারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ৩৬ দিনব্যাপী কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।

মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক উপদেষ্টা আমানুল্লাহ আমান, সাবেক ছাত্রদল সভাপতি আসিফুজ্জামান রিপন, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব, সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসিরসহ সংগঠনের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।

বক্তব্যে রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘এটি শুধু মোমবাতি প্রজ্বলন নয়, গণতন্ত্রের নতুন যাত্রার সূচনা। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একসময় ছিলো ভয় আর আতংকের প্রতীক; আজ তা আশার আলো ছড়াচ্ছে। শেখ হাসিনা ছাত্রদের কণ্ঠ স্তব্ধ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। আজকের এই আলোক প্রজ্বালনের মাধ্যমে আমাদের ৩৬ দিনের কর্মসূচির শুভ সূচনা হলো।’

আমানুল্লাহ আমান বলেন, ‘জুলাই মাসে ছাত্রদলের এই আয়োজন ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বহন করে। একদিনে এই আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। হাজারো মানুষের রক্ত ও ত্যাগের মাধ্যমে এটি গঠিত হয়েছে। আজ আমরা খুনি হাসিনামুক্ত বাংলাদেশ দেখছি। শহীদ ওয়াসিম ও সাঈদের রক্ত বৃথা যাবে না।’ 
ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন বলেন, ‘চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদল সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং শতাধিক নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন। তাঁদের আত্মত্যাগ জাতি কখনও ভুলবে না।”

ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে। কিন্তু ছাত্রদল রাজপথে এককভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। হামলা-মামলার সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছে ছাত্রদলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরাই।’

এই কর্মসূচির মাধ্যমে ছাত্রদলের নেতৃত্বে শুরু হলো ৩৬ দিনব্যাপী একাধিক আন্দোলন-প্রচারণা ও স্মরণ কর্মসূচি। যা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশব্যাপী বিস্তৃত থাকবে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি। 
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মোমবাতি প্রজ্বালনে শহীদদের স্মরণ করলো ছাত্রদল
  • মোমবাতি প্রজ্বালনে শহীদদের স্মরণ করলো ছাত্রদল, ৩৬ দিনের কর্মসূচি উদ্বোধন
  • গণতান্ত্রিক উত্তরণ কোন পথে?
  • ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের জন্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার গুরুত্ব অপরিসীম 
  • চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকসু নির্বাচনের দাবি: ‘নতুন কোনো বন্দোবস্ত নেই, সবই প্রহসন’
  • রিমান্ড শেষে সাবেক সিইসি হাবিবুল আউয়াল কারাগারে
  • রিমান্ড শেষে সাবেক সিইসি হাবিবুল আউয়াল আবার আদালতে
  • অনড় অবস্থান নয়, নমনীয়তাই রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি
  • জুলাই যোদ্ধাদের সঠিক মর্যাদা দিতে হবে: রিজভী
  • একনায়কতান্ত্রিক প্রবণতার দিকে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা