বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার কথা বললে এক করুণ চিত্র ভেসে ওঠে। বহু মানুষ এখনো জানে না, কখন ডাক্তার দেখানো জরুরি; কীভাবে একটি ছোট অসুখ বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। অনেকেই ভাবেন, ওষুধই সব সমস্যার সমাধান, কিংবা দামি চিকিৎসা মানেই ভালো চিকিৎসা। আবার কারও কারও কাছে পুরোনো কুসংস্কারই শেষ কথা।

সরকারি হাসপাতালগুলোতেও যে সেবা মেলে, তা অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রতুল। অসংখ্য রোগী, কম ডাক্তার, সরঞ্জামের অভাব, আর তদারকির ঘাটতি—সব মিলে মানুষের আস্থা হারিয়ে গেছে। তার ওপরে আবার নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে সেই তথাকথিত চিকিৎসকদের রমরমা ব্যবসা, যাঁদের হাতে নেই কোনো প্রশিক্ষণ, নেই কোনো নিয়মকানুনের বাধ্যবাধকতা।

সাধারণ মানুষও অনেক সময় সঠিক তথ্যের অভাবে জানতেই পারে না, কোথায় গিয়ে তারা সঠিক সেবা পাবে। এ কারণে ভুল চিকিৎসা, স্বাস্থ্যঝুঁকি আর হতাশার এক চক্র বারবার ফিরে আসে।

অনেক দিন ধরেই এসব সমস্যার সমাধানে নানান প্রচারণা চালানো হয়েছে। ‘হাত ধুয়ে খাও’, ‘টিকা নাও’, ‘ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাবেন না’—এসব স্লোগান পোস্টারে, টেলিভিশনে বা মাইকিংয়ে বারবার বলা হয়েছে। কিছুটা সচেতনতা এসেছে ঠিকই, কিন্তু পরিবর্তন গভীরে গিয়ে পৌঁছাতে পারেনি।

কারণ, এসব প্রচারণা অনেক সময় সাধারণ মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ ছিল না। কোথাও ভাষা ছিল কঠিন, কোথাও বাস্তবতা থেকে দূরে। আর গভীর সমস্যা, যেমন স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা বা দায়িত্বহীনতার সংস্কৃতি, সেগুলোর তো কোনো সমাধানই আসেনি।

এমন প্রেক্ষাপটে ভাবুন তো, যদি পরিবর্তনের শক্তি আসে আমাদের শিশুদের হাত ধরে? যদি স্কুলের ছোট্ট ছেলেমেয়েরা হয়ে ওঠে তাদের পরিবারের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য স্বাস্থ্যদূত?

তৃতীয় শ্রেণির একটি ছেলে বাড়ি ফিরে তার বাবাকে বোঝাচ্ছে, কেন বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। বা নবম শ্রেণির একটি মেয়ে তার মাকে শেখাচ্ছে, গর্ভাবস্থায় নিয়মিত চেকআপের গুরুত্ব। এমন ছোট ছোট মুহূর্তই বড় পরিবর্তনের ভিত্তি হতে পারে।

আসুন, এই স্বপ্নটি একটি গল্পের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করি।

রিনা সকালবেলা উঠেই বইয়ের ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত। ক্লাস থ্রিতে পড়ে সে, তবে আজ তার মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা। আজ শুধু বাংলা বা অঙ্কের ক্লাস নয়, তাদের শিক্ষক বলেছিলেন নতুন একটা জিনিস শেখাবেন—স্বাস্থ্য নিয়ে।

রিনা জানে না ঠিক কী শিখবে, তবে মনে মনে ভীষণ খুশি।

স্কুলের মাঠটা রিনার খুব প্রিয়। হালকা বাতাসে দোল খেতে থাকা বুনো ঘাসের গন্ধে ভরে থাকে চারপাশ। সে আর তার বন্ধুরা দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লাসরুমে ঢোকে। শিক্ষক হাসিমুখে আসেন, সঙ্গে নিয়ে আসেন এক মজার ছবি আঁকা বই। বইটায় দেখা যাচ্ছে এক মেয়ে হাত ধুচ্ছে, এক ছেলে ফোটানো পানি পান করছে, আরেকজন তার মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে যাচ্ছে।

প্রয়োজন শুধু শিক্ষকদের কিছুটা প্রশিক্ষণ, স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের সহযোগিতা, আর সবচেয়ে বড় কথা, এক টুকরা বিশ্বাস—শিশুরা পারে, যদি সুযোগ দেওয়া হয়। আর এ বিপ্লব বাস্তবায়নে দরকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সঙ্গে নিয়ে পথচলা

রিনারা সেদিন শেখে হাত ধোয়া কেবল অভ্যাস নয়, এটি রোগ থেকে বাঁচার এক বড় ঢাল। তারা শেখে বিশুদ্ধ পানি কীভাবে শরীরের বন্ধু। শিক্ষক গল্পের ছলে বলেন, ‘তোমাদের হাতের মধ্যেই আছে তোমার পরিবারের সুস্থতার চাবি।’ রিনা মন দিয়ে শোনে, যেন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ সে আজ পাচ্ছে।

স্কুলে গড়ে উঠেছে ওয়েলবিইং ক্লাব। সেখানে শিক্ষক আর ছাত্ররা মিলে পরিকল্পনা করবে কীভাবে গোটা স্কুল, এমনকি পুরো গ্রামকে সচেতন করা যায়। কেউ নাটক করবে ডায়াবেটিস নিয়ে, কেউ ছবি এঁকে দেখাবে বিশুদ্ধ পানির গুরুত্ব, আবার কেউ হয়তো পুরো গ্রামে একটি স্বাস্থ্য মেলার আয়োজন করবে। এই ছেলেমেয়েরা শিখবে, কীভাবে দল বেঁধে কাজ করতে হয়, কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে নিজের বক্তব্যে মানুষকে বিশ্বাসী করে তুলতে হয়।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে রিনা মাকে দেখে টিউবওয়েল থেকে পানি তুলছেন। মাকে থামিয়ে সে বলে, ‘মা, পানি ফুটিয়ে খেতে হবে।’ মা হেসে বলে, ‘তুই আবার এত বড় কথা শিখলি কোথা থেকে?’ রিনা গম্ভীর হয়ে উত্তর দেয়, ‘স্কুলে শিখেছি মা, এতে আমাদের পেটের অসুখ হবে না।’ মায়ের চোখে মৃদু বিস্ময়, তারপর একধরনের গর্বের ঝিলিক।

এই ছোট্ট কথোপকথনের মাধ্যমে বদলে যেতে শুরু করে রিনার ছোট্ট জগৎ। দিনের পর দিন, স্কুলের ‘ওয়েলবিইং ক্লাব’-এ রিনা আরও নতুন নতুন জিনিস শেখে। সে শেখে টিকাদান কেন জরুরি, মায়েদের গর্ভাবস্থায় কেন নিয়মিত চেকআপ করা দরকার, আর কেন ডাক্তার না দেখিয়ে নিজে নিজে ওষুধ খাওয়া বিপজ্জনক। কখনো ছবির মাধ্যমে, কখনো নাটক করে, কখনো আবার ছোট ছোট কবিতা বানিয়ে তারা এই সব শেখে ও শেখায়।

স্কুলের বড় ভাইবোনেরা মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, গ্রামের মাঠে একটি স্বাস্থ্য মেলা হবে। রিনা আর তার বন্ধুরা সেখানে একটা নাটক করবে—‘শুদ্ধ পানির রাজ্যে রাজার গল্প’। রাজা সব প্রজাদের বলবে কেবল ফোটানো পানি খেতে। সেই মেলায় রিনা মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রথমবারের মতো সাহস করে সবাইকে বলবে—‘ভালো স্বাস্থ্য মানে ভালো জীবন।’ তার কথায় মেলা ভরে উঠবে করতালিতে।

তারা স্কুলের বাইরেও এই শিক্ষার প্রভাব ছড়িয়ে দেবে। সমবয়সী ক্লাব তৈরি করবে, যেখানে তারা একে অপরকে শেখাবে। কোনো একটি পরিবার যখন দেখে তাদের সন্তান স্বাস্থ্য সম্পর্কে কথা বলছে, তখন প্রতিবেশীরাও কৌতূহলী হবে।

একেকটি শিশু হয়ে উঠবে নিজের পরিবারে, নিজের পাড়ায় পরিবর্তনের আলোকবর্তিকা। ছোট ছোট এই আলোকবর্তিকাগুলো মিলেই গড়ে উঠবে একটি সচেতন নেটওয়ার্ক।

রিনা দেখতে পায়, তার কথা কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে। তার বাবা, যিনি আগে গ্রামের ওঝা, গ্রাম্য ডাক্তার বা ওষুধের দোকানের কর্মীর কথায় বিশ্বাস করতেন, এখন শহরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার কথা ভাবছেন। তার ছোট ভাইও এখন স্কুল থেকে ফিরেই হাত ধুয়ে খাবার খায়।

রিনা অনুভব করে, পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। ছোট্ট ছোট্ট কথায়, কাজে, বিশ্বাসে। একদিন ক্লাসে শিক্ষক একটি বড় কথা বলেন, ‘তোমরাই হবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যবীর।’ রিনা অবাক হয়। সে ভাবতেই পারেনি, তার মতো একটা ছোট মেয়ে এমন বড় দায়িত্ব পেতে পারে। কিন্তু যখন সে নিজের চারপাশে দেখে কতটা বদল এসেছে, তখন সে নিজের ভেতর একটা সাহস অনুভব করে।

এই গল্প শুধু রিনার নয়। সারা দেশে হাজার হাজার রিনা, সোহাগ, লিজা, মিজান—তারা সবাই এই পরিবর্তনের অংশ। তারা নিজেদের পরিবারের স্বাস্থ্য সচেতনতায় আলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তারা পুরোনো ভুল ধারণাকে প্রশ্ন করছে। তারা শিখছে আর শেখাচ্ছে।

আর এই পুরো পরিবর্তন শুরু হয়েছে খুব ছোট্ট একটি কাজ দিয়ে—স্কুলে স্বাস্থ্যশিক্ষা। এতে নতুন কোনো বিশাল বাজেট লাগেনি, বিশাল কোনো বিল্ডিং গড়তে হয়নি। শুধু দরকার হয়েছে বিশ্বাস, সাহস আর একটু মমতা—ছোটদের বড় করে দেখার মনোভাব।

দেশের কয়েকটি জেলায় শুরু হয়েছে এই পথচলা। শিক্ষকেরা প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা আসছেন স্কুলে গল্প বলতে। ছাত্রছাত্রীরা নেতৃত্ব নিচ্ছে, তাদের কথার জোর বাড়ছে। পাইলট প্রকল্পের ফলাফল দেখাচ্ছে, যেখানে এই উদ্যোগ চালু হয়েছে, সেখানে হাত ধোয়ার অভ্যাস বেড়েছে, টিকা গ্রহণের হার বেড়েছে এবং চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষিত ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আরও বড়। যদি এই মডেল সফল হয়, তবে পুরো বাংলাদেশেই ছড়িয়ে দেওয়া হবে এই স্বপ্ন-স্কুলের প্রতিটি ছাত্রছাত্রী হবে স্বাস্থ্য সচেতনতার অগ্রদূত।

রিনাদের হাত ধরেই বাংলাদেশ বদলে যাবে। হয়তো ১০ বছর পর, রিনা বড় হয়ে কোনো হাসপাতালে কাজ করবে বা নিজের পরিবার সামলাবে। কিন্তু তার ভেতরে গেঁথে থাকবে সেই ছোট্ট শিক্ষার বীজ—ভালো স্বাস্থ্য মানে ভালো জীবন।

যখন তার মেয়ে স্কুল থেকে এসে বলবে, ‘মা, টিকা নিতে ভুলবে না,’ তখন রিনা মনে মনে হাসবে। মনে পড়বে আজকের এই দিনের কথা, যখন সে প্রথমবার হাত ধোয়ার গুরুত্ব শিখেছিল, বিশুদ্ধ পানির গল্প শুনেছিল। মনে পড়বে সেই শিক্ষক, যে একদিন বলেছিলেন—‘তুমি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যবীর।’

এভাবেই, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়বে জ্ঞানের আলো। একেকটি শিশুর চোখে দেখা যাবে একটুকরা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। আর একদিন, পুরো বাংলাদেশ হবে এমন এক দেশ, যেখানে প্রত্যেক নাগরিক জানবে, বুঝবে এবং দাবি করবে—ভালো স্বাস্থ্য সবার অধিকার।

রিনা আর তার বন্ধুরা এই নতুন বাংলাদেশের প্রথম আলো। তারা হার মানবে না, থেমে থাকবে না। তাদের ছোট ছোট পায়ে ভর করেই এগিয়ে আসবে একটি সুস্থ, সচেতন, নতুন বাংলাদেশ।

স্বপ্ন রিনার গল্পকে বাস্তবে রূপদান করা কঠিন কিছু নয়। এই পদ্ধতি খুব বেশি খরচসাপেক্ষও নয়। বিদ্যমান স্কুলব্যবস্থার ভেতরেই এই উদ্যোগ চালানো সম্ভব। প্রয়োজন শুধু শিক্ষকদের কিছুটা প্রশিক্ষণ, স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের সহযোগিতা, আর সবচেয়ে বড় কথা, একটুকরা বিশ্বাস—শিশুরা পারে, যদি সুযোগ দেওয়া হয়। আর এ বিপ্লব বাস্তবায়নে দরকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সঙ্গে নিয়ে পথচলা।

যদি আমরা আমাদের ছোট্ট ছেলেমেয়েদের ওপর ভরসা রাখি, যদি তাদের হাতে স্বাস্থ্য সচেতনতার দীপ্ত মশাল তুলে দিই, তবে তারাই ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য বিপ্লবের কারিগর হবে। তারা ভুল ধারণা ভাঙবে, সঠিক তথ্য ছড়াবে আর সাহসের সঙ্গে দাবি তুলবে—ভালো স্বাস্থ্যসেবা তাদের অধিকার।

কারণ, শিশুরা যখন বলে, পরিবার শোনে। তারা অযথা তর্ক করে না, তাদের কথা বিশ্বাস করা হয় সহজে। তারা একধরনের সরল, স্বচ্ছ বিশ্বাস নিয়ে কথা বলে, যা কোনো পোস্টার বা বিজ্ঞাপনে সম্ভব নয়। একটা মেয়ে যখন তার মাকে হাসপাতালে যেতে অনুরোধ করে, সেই মায়ের মনে দ্বিধা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সে হয়তো যাবে। একটা ছেলে যখন তার দাদাকে বোঝায় যে গ্রামের হাতুড়ে চিকিৎসকের বদলে প্রশিক্ষিত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, দাদার মনে প্রশ্ন আসবে—‘হয়তো ছেলেটাই ঠিক বলছে।’

তাদের কণ্ঠস্বর হবে বদলের বার্তা। একটি শিশু যখন তার মায়ের হাত ধরে হাসপাতালের দিকে এগিয়ে যাবে, সেটাই হবে একটি নতুন দিনের সূচনা। একটি পরিবার যখন স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন হবে, সেটাই হবে একটি নতুন সমাজ গঠনের প্রথম ধাপ। আর এই সমাজ—এটি হবে এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে প্রত্যেক নাগরিক জানবে, চাইবে এবং পাবে তার প্রাপ্য স্বাস্থ্যসেবা।

ড.

সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক; আহ্বায়ক, অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস বাংলাদেশ (এএইচআরবি)

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র পর ব র র সবচ য় যখন ত র র বন ধ দরক র ব যবস র একট

এছাড়াও পড়ুন:

গাজায় ৪৮ ঘণ্টায় তিন শতাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল

ইসরায়েলি বাহিনী গত ৪৮ ঘণ্টায় গাজায় ২৬ জায়গায় ‘রক্তাক্ত গণহত্যা’ চালিয়েছে। এতে অন্তত তিন শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের বরাতে এই তথ্য জানিয়েছে আলজাজিরা।

মিডিয়া অফিসের তথ্যানুসারে, গাজায় বৃহস্পতিবার ভোর থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় অন্তত ৭৩ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৩৩ জন নিহত হয়েছেন ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত উদ্যোগ গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণ কেন্দ্রগুলোতে।

এছাড়া ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ গাজার আল-মাওয়াসিতে একটি তাঁবুতে হামলা চালিয়ে ১৩ জনকে হত্যা করেছে। পাশাপাশি গাজা শহরের পশ্চিমে বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত মুস্তাফা হাফেজ স্কুলে হামলায় নিহত ১১ জন নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন অনেকে।

আরো পড়ুন:

গাজায় ‘গণহত্যার অর্থনীতি’ থেকে লাভবান মাইক্রোসফট-অ্যামাজনসহ যত কোম্পানি

ইসরায়েলের প্রধান বিমানবন্দর লক্ষ্য করে হুতিদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী গত ৪৮ ঘণ্টার অভিযানে আশ্রয়কেন্দ্র, উদ্বাস্তু ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল, বাজার, পরিবারিক ঘরবাড়ি, জরুরি খাদ্য সংগ্রহ করতে যাওয়া বেসামরিক মানুষদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে।

দেইর আল-বালাহ থেকে আলজাজিরার রিপোর্টার তারেক আবু আজযুম জানান, “আমি এমন অনেক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছি যারা ত্রাণ নিতে গিয়ে বেঁচে ফিরেছেন। তারা বলছিলেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের হঠাৎ কোনো সতর্কতা ছাড়াই গুলিবর্ষণে ঝাঁঝরা করে দেয়া হয়। এখানে চারদিকে আতঙ্ক, চিৎকার এবং মরদেহ- সবমিলিয়ে একটি বিভীষিকাময় দৃশ্য।”

তিনি আরো জানান, গোলাগুলির ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে, চিকিৎসাকর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেননি। সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে, জিএইচএফ পরিচালিত বিতরণকেন্দ্রগুলোতে মোতায়েন করা বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীরা ক্ষুধার্ত মানুষদের লক্ষ্য করে বুলেট ও স্টান গ্রেনেড ব্যবহার করছেন।

 

এপিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে দুজন মার্কিন কন্ট্রাক্টর নাম গোপন রাখার শর্তে জানিয়েছেন, তারা এই মিশনের অব্যবস্থাপনা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে মর্মাহত হয়ে মুখ খুলেছেন। তাদের দাবি, যেসব নিরাপত্তা কর্মীকে ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়েছে তাদের অনেকেই অযোগ্য, যাচাই ছাড়াই আনা হয়েছে আর তারপরও তাদের ভারী অস্ত্রে সজ্জিত করা হয়েছে এবং দেখে মনে হয়েছে, তারা যা ইচ্ছা তাই করার উন্মুক্ত লাইসেন্স নিয়ে এসেছেন।

মঙ্গলবার অক্সফাম, সেইভ দ্য চিলড্রেন ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো ১৩০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা জিএইচএফ-কে অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। জিএইচএফ ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলার সুবিধা করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে এসব বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ।

এনজিওগুলো বলেছে, ইসরায়েলি বাহিনী ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ‘নিয়মিতভাবে’ খাবারের জন্য ঘুরতে থাকা বেসামরিকদের ওপর গুলি চালাচ্ছে।

মে মাসের শেষ দিক থেকে গাজায় জিএইচএফের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে তাদের কেন্দ্রগুলোতে খাদ্য ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে ৬০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং প্রায় ৪০০০ জন আহত হয়েছেন।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় এ পর্যন্ত ৫৬ হাজার ৬৪৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং এক লাখ ৩৪ হাজার ১০৫ জন আহত হয়েছেন।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ