বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার কথা বললে এক করুণ চিত্র ভেসে ওঠে। বহু মানুষ এখনো জানে না, কখন ডাক্তার দেখানো জরুরি; কীভাবে একটি ছোট অসুখ বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। অনেকেই ভাবেন, ওষুধই সব সমস্যার সমাধান, কিংবা দামি চিকিৎসা মানেই ভালো চিকিৎসা। আবার কারও কারও কাছে পুরোনো কুসংস্কারই শেষ কথা।

সরকারি হাসপাতালগুলোতেও যে সেবা মেলে, তা অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রতুল। অসংখ্য রোগী, কম ডাক্তার, সরঞ্জামের অভাব, আর তদারকির ঘাটতি—সব মিলে মানুষের আস্থা হারিয়ে গেছে। তার ওপরে আবার নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে সেই তথাকথিত চিকিৎসকদের রমরমা ব্যবসা, যাঁদের হাতে নেই কোনো প্রশিক্ষণ, নেই কোনো নিয়মকানুনের বাধ্যবাধকতা।

সাধারণ মানুষও অনেক সময় সঠিক তথ্যের অভাবে জানতেই পারে না, কোথায় গিয়ে তারা সঠিক সেবা পাবে। এ কারণে ভুল চিকিৎসা, স্বাস্থ্যঝুঁকি আর হতাশার এক চক্র বারবার ফিরে আসে।

অনেক দিন ধরেই এসব সমস্যার সমাধানে নানান প্রচারণা চালানো হয়েছে। ‘হাত ধুয়ে খাও’, ‘টিকা নাও’, ‘ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাবেন না’—এসব স্লোগান পোস্টারে, টেলিভিশনে বা মাইকিংয়ে বারবার বলা হয়েছে। কিছুটা সচেতনতা এসেছে ঠিকই, কিন্তু পরিবর্তন গভীরে গিয়ে পৌঁছাতে পারেনি।

কারণ, এসব প্রচারণা অনেক সময় সাধারণ মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ ছিল না। কোথাও ভাষা ছিল কঠিন, কোথাও বাস্তবতা থেকে দূরে। আর গভীর সমস্যা, যেমন স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা বা দায়িত্বহীনতার সংস্কৃতি, সেগুলোর তো কোনো সমাধানই আসেনি।

এমন প্রেক্ষাপটে ভাবুন তো, যদি পরিবর্তনের শক্তি আসে আমাদের শিশুদের হাত ধরে? যদি স্কুলের ছোট্ট ছেলেমেয়েরা হয়ে ওঠে তাদের পরিবারের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য স্বাস্থ্যদূত?

তৃতীয় শ্রেণির একটি ছেলে বাড়ি ফিরে তার বাবাকে বোঝাচ্ছে, কেন বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। বা নবম শ্রেণির একটি মেয়ে তার মাকে শেখাচ্ছে, গর্ভাবস্থায় নিয়মিত চেকআপের গুরুত্ব। এমন ছোট ছোট মুহূর্তই বড় পরিবর্তনের ভিত্তি হতে পারে।

আসুন, এই স্বপ্নটি একটি গল্পের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করি।

রিনা সকালবেলা উঠেই বইয়ের ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত। ক্লাস থ্রিতে পড়ে সে, তবে আজ তার মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা। আজ শুধু বাংলা বা অঙ্কের ক্লাস নয়, তাদের শিক্ষক বলেছিলেন নতুন একটা জিনিস শেখাবেন—স্বাস্থ্য নিয়ে।

রিনা জানে না ঠিক কী শিখবে, তবে মনে মনে ভীষণ খুশি।

স্কুলের মাঠটা রিনার খুব প্রিয়। হালকা বাতাসে দোল খেতে থাকা বুনো ঘাসের গন্ধে ভরে থাকে চারপাশ। সে আর তার বন্ধুরা দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লাসরুমে ঢোকে। শিক্ষক হাসিমুখে আসেন, সঙ্গে নিয়ে আসেন এক মজার ছবি আঁকা বই। বইটায় দেখা যাচ্ছে এক মেয়ে হাত ধুচ্ছে, এক ছেলে ফোটানো পানি পান করছে, আরেকজন তার মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে যাচ্ছে।

প্রয়োজন শুধু শিক্ষকদের কিছুটা প্রশিক্ষণ, স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের সহযোগিতা, আর সবচেয়ে বড় কথা, এক টুকরা বিশ্বাস—শিশুরা পারে, যদি সুযোগ দেওয়া হয়। আর এ বিপ্লব বাস্তবায়নে দরকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সঙ্গে নিয়ে পথচলা

রিনারা সেদিন শেখে হাত ধোয়া কেবল অভ্যাস নয়, এটি রোগ থেকে বাঁচার এক বড় ঢাল। তারা শেখে বিশুদ্ধ পানি কীভাবে শরীরের বন্ধু। শিক্ষক গল্পের ছলে বলেন, ‘তোমাদের হাতের মধ্যেই আছে তোমার পরিবারের সুস্থতার চাবি।’ রিনা মন দিয়ে শোনে, যেন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ সে আজ পাচ্ছে।

স্কুলে গড়ে উঠেছে ওয়েলবিইং ক্লাব। সেখানে শিক্ষক আর ছাত্ররা মিলে পরিকল্পনা করবে কীভাবে গোটা স্কুল, এমনকি পুরো গ্রামকে সচেতন করা যায়। কেউ নাটক করবে ডায়াবেটিস নিয়ে, কেউ ছবি এঁকে দেখাবে বিশুদ্ধ পানির গুরুত্ব, আবার কেউ হয়তো পুরো গ্রামে একটি স্বাস্থ্য মেলার আয়োজন করবে। এই ছেলেমেয়েরা শিখবে, কীভাবে দল বেঁধে কাজ করতে হয়, কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে নিজের বক্তব্যে মানুষকে বিশ্বাসী করে তুলতে হয়।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে রিনা মাকে দেখে টিউবওয়েল থেকে পানি তুলছেন। মাকে থামিয়ে সে বলে, ‘মা, পানি ফুটিয়ে খেতে হবে।’ মা হেসে বলে, ‘তুই আবার এত বড় কথা শিখলি কোথা থেকে?’ রিনা গম্ভীর হয়ে উত্তর দেয়, ‘স্কুলে শিখেছি মা, এতে আমাদের পেটের অসুখ হবে না।’ মায়ের চোখে মৃদু বিস্ময়, তারপর একধরনের গর্বের ঝিলিক।

এই ছোট্ট কথোপকথনের মাধ্যমে বদলে যেতে শুরু করে রিনার ছোট্ট জগৎ। দিনের পর দিন, স্কুলের ‘ওয়েলবিইং ক্লাব’-এ রিনা আরও নতুন নতুন জিনিস শেখে। সে শেখে টিকাদান কেন জরুরি, মায়েদের গর্ভাবস্থায় কেন নিয়মিত চেকআপ করা দরকার, আর কেন ডাক্তার না দেখিয়ে নিজে নিজে ওষুধ খাওয়া বিপজ্জনক। কখনো ছবির মাধ্যমে, কখনো নাটক করে, কখনো আবার ছোট ছোট কবিতা বানিয়ে তারা এই সব শেখে ও শেখায়।

স্কুলের বড় ভাইবোনেরা মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, গ্রামের মাঠে একটি স্বাস্থ্য মেলা হবে। রিনা আর তার বন্ধুরা সেখানে একটা নাটক করবে—‘শুদ্ধ পানির রাজ্যে রাজার গল্প’। রাজা সব প্রজাদের বলবে কেবল ফোটানো পানি খেতে। সেই মেলায় রিনা মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রথমবারের মতো সাহস করে সবাইকে বলবে—‘ভালো স্বাস্থ্য মানে ভালো জীবন।’ তার কথায় মেলা ভরে উঠবে করতালিতে।

তারা স্কুলের বাইরেও এই শিক্ষার প্রভাব ছড়িয়ে দেবে। সমবয়সী ক্লাব তৈরি করবে, যেখানে তারা একে অপরকে শেখাবে। কোনো একটি পরিবার যখন দেখে তাদের সন্তান স্বাস্থ্য সম্পর্কে কথা বলছে, তখন প্রতিবেশীরাও কৌতূহলী হবে।

একেকটি শিশু হয়ে উঠবে নিজের পরিবারে, নিজের পাড়ায় পরিবর্তনের আলোকবর্তিকা। ছোট ছোট এই আলোকবর্তিকাগুলো মিলেই গড়ে উঠবে একটি সচেতন নেটওয়ার্ক।

রিনা দেখতে পায়, তার কথা কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে। তার বাবা, যিনি আগে গ্রামের ওঝা, গ্রাম্য ডাক্তার বা ওষুধের দোকানের কর্মীর কথায় বিশ্বাস করতেন, এখন শহরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার কথা ভাবছেন। তার ছোট ভাইও এখন স্কুল থেকে ফিরেই হাত ধুয়ে খাবার খায়।

রিনা অনুভব করে, পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। ছোট্ট ছোট্ট কথায়, কাজে, বিশ্বাসে। একদিন ক্লাসে শিক্ষক একটি বড় কথা বলেন, ‘তোমরাই হবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যবীর।’ রিনা অবাক হয়। সে ভাবতেই পারেনি, তার মতো একটা ছোট মেয়ে এমন বড় দায়িত্ব পেতে পারে। কিন্তু যখন সে নিজের চারপাশে দেখে কতটা বদল এসেছে, তখন সে নিজের ভেতর একটা সাহস অনুভব করে।

এই গল্প শুধু রিনার নয়। সারা দেশে হাজার হাজার রিনা, সোহাগ, লিজা, মিজান—তারা সবাই এই পরিবর্তনের অংশ। তারা নিজেদের পরিবারের স্বাস্থ্য সচেতনতায় আলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তারা পুরোনো ভুল ধারণাকে প্রশ্ন করছে। তারা শিখছে আর শেখাচ্ছে।

আর এই পুরো পরিবর্তন শুরু হয়েছে খুব ছোট্ট একটি কাজ দিয়ে—স্কুলে স্বাস্থ্যশিক্ষা। এতে নতুন কোনো বিশাল বাজেট লাগেনি, বিশাল কোনো বিল্ডিং গড়তে হয়নি। শুধু দরকার হয়েছে বিশ্বাস, সাহস আর একটু মমতা—ছোটদের বড় করে দেখার মনোভাব।

দেশের কয়েকটি জেলায় শুরু হয়েছে এই পথচলা। শিক্ষকেরা প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা আসছেন স্কুলে গল্প বলতে। ছাত্রছাত্রীরা নেতৃত্ব নিচ্ছে, তাদের কথার জোর বাড়ছে। পাইলট প্রকল্পের ফলাফল দেখাচ্ছে, যেখানে এই উদ্যোগ চালু হয়েছে, সেখানে হাত ধোয়ার অভ্যাস বেড়েছে, টিকা গ্রহণের হার বেড়েছে এবং চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষিত ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আরও বড়। যদি এই মডেল সফল হয়, তবে পুরো বাংলাদেশেই ছড়িয়ে দেওয়া হবে এই স্বপ্ন-স্কুলের প্রতিটি ছাত্রছাত্রী হবে স্বাস্থ্য সচেতনতার অগ্রদূত।

রিনাদের হাত ধরেই বাংলাদেশ বদলে যাবে। হয়তো ১০ বছর পর, রিনা বড় হয়ে কোনো হাসপাতালে কাজ করবে বা নিজের পরিবার সামলাবে। কিন্তু তার ভেতরে গেঁথে থাকবে সেই ছোট্ট শিক্ষার বীজ—ভালো স্বাস্থ্য মানে ভালো জীবন।

যখন তার মেয়ে স্কুল থেকে এসে বলবে, ‘মা, টিকা নিতে ভুলবে না,’ তখন রিনা মনে মনে হাসবে। মনে পড়বে আজকের এই দিনের কথা, যখন সে প্রথমবার হাত ধোয়ার গুরুত্ব শিখেছিল, বিশুদ্ধ পানির গল্প শুনেছিল। মনে পড়বে সেই শিক্ষক, যে একদিন বলেছিলেন—‘তুমি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যবীর।’

এভাবেই, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়বে জ্ঞানের আলো। একেকটি শিশুর চোখে দেখা যাবে একটুকরা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। আর একদিন, পুরো বাংলাদেশ হবে এমন এক দেশ, যেখানে প্রত্যেক নাগরিক জানবে, বুঝবে এবং দাবি করবে—ভালো স্বাস্থ্য সবার অধিকার।

রিনা আর তার বন্ধুরা এই নতুন বাংলাদেশের প্রথম আলো। তারা হার মানবে না, থেমে থাকবে না। তাদের ছোট ছোট পায়ে ভর করেই এগিয়ে আসবে একটি সুস্থ, সচেতন, নতুন বাংলাদেশ।

স্বপ্ন রিনার গল্পকে বাস্তবে রূপদান করা কঠিন কিছু নয়। এই পদ্ধতি খুব বেশি খরচসাপেক্ষও নয়। বিদ্যমান স্কুলব্যবস্থার ভেতরেই এই উদ্যোগ চালানো সম্ভব। প্রয়োজন শুধু শিক্ষকদের কিছুটা প্রশিক্ষণ, স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের সহযোগিতা, আর সবচেয়ে বড় কথা, একটুকরা বিশ্বাস—শিশুরা পারে, যদি সুযোগ দেওয়া হয়। আর এ বিপ্লব বাস্তবায়নে দরকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সঙ্গে নিয়ে পথচলা।

যদি আমরা আমাদের ছোট্ট ছেলেমেয়েদের ওপর ভরসা রাখি, যদি তাদের হাতে স্বাস্থ্য সচেতনতার দীপ্ত মশাল তুলে দিই, তবে তারাই ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য বিপ্লবের কারিগর হবে। তারা ভুল ধারণা ভাঙবে, সঠিক তথ্য ছড়াবে আর সাহসের সঙ্গে দাবি তুলবে—ভালো স্বাস্থ্যসেবা তাদের অধিকার।

কারণ, শিশুরা যখন বলে, পরিবার শোনে। তারা অযথা তর্ক করে না, তাদের কথা বিশ্বাস করা হয় সহজে। তারা একধরনের সরল, স্বচ্ছ বিশ্বাস নিয়ে কথা বলে, যা কোনো পোস্টার বা বিজ্ঞাপনে সম্ভব নয়। একটা মেয়ে যখন তার মাকে হাসপাতালে যেতে অনুরোধ করে, সেই মায়ের মনে দ্বিধা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সে হয়তো যাবে। একটা ছেলে যখন তার দাদাকে বোঝায় যে গ্রামের হাতুড়ে চিকিৎসকের বদলে প্রশিক্ষিত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, দাদার মনে প্রশ্ন আসবে—‘হয়তো ছেলেটাই ঠিক বলছে।’

তাদের কণ্ঠস্বর হবে বদলের বার্তা। একটি শিশু যখন তার মায়ের হাত ধরে হাসপাতালের দিকে এগিয়ে যাবে, সেটাই হবে একটি নতুন দিনের সূচনা। একটি পরিবার যখন স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন হবে, সেটাই হবে একটি নতুন সমাজ গঠনের প্রথম ধাপ। আর এই সমাজ—এটি হবে এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে প্রত্যেক নাগরিক জানবে, চাইবে এবং পাবে তার প্রাপ্য স্বাস্থ্যসেবা।

ড.

সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক; আহ্বায়ক, অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস বাংলাদেশ (এএইচআরবি)

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র পর ব র র সবচ য় যখন ত র র বন ধ দরক র ব যবস র একট

এছাড়াও পড়ুন:

শাহরুখের ব্যাপারে সাবধান করলেন জুহি চাওলা

বলিউড বাদশা শাহরুখ খান। অভিনয় গুণে কোটি কোটি ভক্তের হৃদয়ে দোলা দিয়েছেন তিনি। দীর্ঘ অভিনয় ক্যারিয়ারে যশ-খ্যাতি যেমন পেয়েছেন, তেমনি আয় করেছেন মোটা অঙ্কের অর্থও। রবিবার (২ নভেম্বর) ৬০ বছর পূর্ণ করে একষট্টিতে পা দেবেন এই তারকা।  

অভিনয় ক্যারিয়ারে অনেক নায়িকার সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন শাহরুখ খান। তাদের মধ্যে অন্যতম জুহি চাওলা। ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’, ‘রামজানে’, ‘ডর’, ‘ইয়েস বস’, ‘ডুপ্লিকেট’সহ আরো কিছু জনপ্রিয় সিনেমা উপহার দিয়েছেন এই জুটি। একসঙ্গে অভিনয় ছাড়াও, এই দুই তারকা বাস্তব জীবনে খুবই ভালো বন্ধু। কেবল তাই নয়, ব্যবসায়ীক অংশীদারও তারা। 

আরো পড়ুন:

শাহরুখের অজানা এই সাত তথ্য জানেন?

পাকিস্তানের সন্ত্রাসী তালিকায় সালমান খান কেন?

বন্ধু শাহরুখের জন্মদিন উপলক্ষে হিন্দুস্তান টাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন জুহি। এ আলাপচারিতায় স্মৃতিচারণ তো করেছেনই, পাশাপাশি শাহরুখের বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছেন এই অভিনেত্রী।  

শাহরুখের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের বিষয়ে জুহি চাওলা বলেন, “আমি যখন প্রথম ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’ সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হই, তখন সহপ্রযোজক বিবেক ভাসওয়ানি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার নায়ক দেখতে আমির খানের মতো।’ আমি শাহরুখকে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। দেখি, শাহরুখের চুল চোখের ওপরে নেমে এসেছে। আর সে একেবারেই আমার কল্পনার সেই ‘চকলেট বয়’ নয়! যখন কাজ শুরু করি, তখন বুঝতে পারি, সে একদম নতুন অভিনেতাদের মতো নয়, সে পরিশ্রমী, দিনে তিন শিফটে কাজ করছে।” 

একটি ঘটনা বর্ণনা করে জুহি চাওলা বলেন, “আমার মনে আছে, ‘ইয়েস বস’ সিনেমার শুটিংয়ের সময়, কোনো দৃশ্য ঠিকমতো লেখা না থাকলে পরিচালক আজিজজি (আজিজ মির্জা) বলতেন, ‘শাহরুখ আসুক, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ রোমান্স আর মজার মিশেলে থাকা দৃশ্যগুলো আমাদের সবচেয়ে ভালো ছিল। সেই সূত্রেই আমরা অনেকগুলো সিনেমায় একসঙ্গে কাজ করেছি।” 

শাহরুখের পাশে অবস্থান করলে সাবধান থাকার কথার কথা বলেছেন জুহি। হাসতে হাসতে এ অভিনেত্রী বলেন, “শাহরুখের আশেপাশে থাকলে সাবধানে থাকবেন। কারণ সে কথা দিয়ে আপনাকে যেকোনো কিছু করাতে রাজি করিয়ে ফেলতে পারে। ওর কথাবলার ভঙ্গি এমন যে, আপনি ‘না’ বলতেই পারবে না। আমি ‘ডুপ্লিকেট’ সিনেমা করতে চাইছিলাম না, কারণ সেখানে আমার তেমন কিছু করার ছিল না। আমরা তখন আরেকটি সিনেমার শুটিং করছিলাম, আর শাহরুখ আমাকে সিঁড়িতে বসিয়ে দুই ঘণ্টা বোঝায় এবং আমি সিনেমাটিতে চুক্তিবদ্ধ হই। সে আপনাকে যেকোনো কিছু করতে রাজি করাতে পারে, তাই সাবধানে থাকবেন।” 

শাহরুখ খানের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়ে জুহি চাওলা বলেন, “অফস্ক্রিনে আমাদের সম্পর্কেও উত্থান-পতন রয়েছে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা কোনো না কোনোভাবে আমাদের যুক্ত রেখেছেন, এমনকি আইপিএলের মাধ্যমেও। আমাদের বন্ধন কোনো পরিকল্পনার ফল নয়, এটা একেবারেই ভাগ্যের ব্যাপার।” 

শাহরুখ খানের সঙ্গে আইপিএল দল কলকাতা নাইট রাইডার্সের (কেকেআর) সহ-মালিক জুহি ও তার স্বামী জয় মেহতা। এই দলের পেছনে জুহি বিনিয়োগ করেছেন ৬২৯ কোটি রুপি। বর্তমানে এই দলটির মূল্য আছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি রুপি। শাহরুখ খানের সঙ্গে ‘রেড চিলিস গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করেন জুহি। 

১৯৬৫ সালে ২ নভেম্বর ভারতের নয়াদিল্লিতে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শাহরুখ খান। তার শৈশবের প্রথম পাঁচ বছর কেটেছে ম্যাঙ্গালুরুতে। শাহরুখের দাদা ইফতিখার আহমেদ স্থানীয় পোর্টের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। যার কারণে সেখানে বসবাস করেন তারা। শাহরুখের বাবার নাম তাজ মোহাম্মদ খান, মা লতিফ ফাতিমা। 

দিল্লির হংসরাজ কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন শাহরুখ খান। তারপর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াতে গণযোগাযোগ বিষয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হন। কিন্তু অভিনয় জীবন শুরু করার কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দেন তিনি। তবে বলিউডে ক্যারিয়ার শুরুর দিকে দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-তে ভর্তি হন এই শিল্পী। 

১৯৯২ সালে ‘দিওয়ানা’ সিনেমার মাধ্যমে বলিউডে পা রাখেন শাহরুখ খান। রোমান্টিক ঘরানার এ সিনেমায় অভিনয় করে নজর কাড়েন তিনি। সিনেমাটিতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে সেরা নবাগত অভিনেতা হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেন শাহরুখ। 

একই বছর ‘চমৎকার’, ‘দিল আসনা হে’ ও ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’ সিনেমায় অভিনয় করেন শাহরুখ। তার পরের বছর ‘ডর’ ও ‘বাজিগর’ সিনেমায় অভিনয় করে নিজের জাত চেনান শাহরুখ। তার অভিনয়ের জাদুতে মুগ্ধ হন কোটি ভক্ত; পৌঁছে যান সাফল্যের চূড়ায়। তার অভিনয়ের খ্যাতি আরো বাড়তে থাকে যশরাজ ফিল্মসের সিনেমায় ধারাবাহিকভাবে অভিনয় করে। একের পর এক হিট সিনেমা দিয়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করেন শাহরুখ। যদিও তার এই সফলতার জার্নির গল্প মোটেও সহজ ছিল। আর সে গল্প সবারই জানা। 

অভিনয় ক্যারিয়ারে অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন শাহরুখ খান। তার মধ্যে মোট পনেরোবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। এর মধ্যে আটবার সেরা অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। হিন্দি সিনেমায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০০২ সালে তাকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করে ভারত সরকার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণ করেছেন মোট পাঁচবার। তবে শাহরুখ খানের ৩৩ বছরের অভিনয় ক্যারিয়ারে অধরা ছিল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। চলতি বছর ‘জওয়ান’ সিনেমার জন্য সেরা অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন শাহরুখ।

ঢাকা/শান্ত

সম্পর্কিত নিবন্ধ