শিশুদের হাত ধরে যেভাবে বদলে যেতে পারে স্বাস্থ্যসেবা
Published: 17th, May 2025 GMT
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার কথা বললে এক করুণ চিত্র ভেসে ওঠে। বহু মানুষ এখনো জানে না, কখন ডাক্তার দেখানো জরুরি; কীভাবে একটি ছোট অসুখ বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। অনেকেই ভাবেন, ওষুধই সব সমস্যার সমাধান, কিংবা দামি চিকিৎসা মানেই ভালো চিকিৎসা। আবার কারও কারও কাছে পুরোনো কুসংস্কারই শেষ কথা।
সরকারি হাসপাতালগুলোতেও যে সেবা মেলে, তা অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রতুল। অসংখ্য রোগী, কম ডাক্তার, সরঞ্জামের অভাব, আর তদারকির ঘাটতি—সব মিলে মানুষের আস্থা হারিয়ে গেছে। তার ওপরে আবার নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে সেই তথাকথিত চিকিৎসকদের রমরমা ব্যবসা, যাঁদের হাতে নেই কোনো প্রশিক্ষণ, নেই কোনো নিয়মকানুনের বাধ্যবাধকতা।
সাধারণ মানুষও অনেক সময় সঠিক তথ্যের অভাবে জানতেই পারে না, কোথায় গিয়ে তারা সঠিক সেবা পাবে। এ কারণে ভুল চিকিৎসা, স্বাস্থ্যঝুঁকি আর হতাশার এক চক্র বারবার ফিরে আসে।
অনেক দিন ধরেই এসব সমস্যার সমাধানে নানান প্রচারণা চালানো হয়েছে। ‘হাত ধুয়ে খাও’, ‘টিকা নাও’, ‘ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাবেন না’—এসব স্লোগান পোস্টারে, টেলিভিশনে বা মাইকিংয়ে বারবার বলা হয়েছে। কিছুটা সচেতনতা এসেছে ঠিকই, কিন্তু পরিবর্তন গভীরে গিয়ে পৌঁছাতে পারেনি।
কারণ, এসব প্রচারণা অনেক সময় সাধারণ মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ ছিল না। কোথাও ভাষা ছিল কঠিন, কোথাও বাস্তবতা থেকে দূরে। আর গভীর সমস্যা, যেমন স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা বা দায়িত্বহীনতার সংস্কৃতি, সেগুলোর তো কোনো সমাধানই আসেনি।
এমন প্রেক্ষাপটে ভাবুন তো, যদি পরিবর্তনের শক্তি আসে আমাদের শিশুদের হাত ধরে? যদি স্কুলের ছোট্ট ছেলেমেয়েরা হয়ে ওঠে তাদের পরিবারের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য স্বাস্থ্যদূত?
তৃতীয় শ্রেণির একটি ছেলে বাড়ি ফিরে তার বাবাকে বোঝাচ্ছে, কেন বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। বা নবম শ্রেণির একটি মেয়ে তার মাকে শেখাচ্ছে, গর্ভাবস্থায় নিয়মিত চেকআপের গুরুত্ব। এমন ছোট ছোট মুহূর্তই বড় পরিবর্তনের ভিত্তি হতে পারে।
আসুন, এই স্বপ্নটি একটি গল্পের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করি।
রিনা সকালবেলা উঠেই বইয়ের ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত। ক্লাস থ্রিতে পড়ে সে, তবে আজ তার মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা। আজ শুধু বাংলা বা অঙ্কের ক্লাস নয়, তাদের শিক্ষক বলেছিলেন নতুন একটা জিনিস শেখাবেন—স্বাস্থ্য নিয়ে।
রিনা জানে না ঠিক কী শিখবে, তবে মনে মনে ভীষণ খুশি।
স্কুলের মাঠটা রিনার খুব প্রিয়। হালকা বাতাসে দোল খেতে থাকা বুনো ঘাসের গন্ধে ভরে থাকে চারপাশ। সে আর তার বন্ধুরা দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লাসরুমে ঢোকে। শিক্ষক হাসিমুখে আসেন, সঙ্গে নিয়ে আসেন এক মজার ছবি আঁকা বই। বইটায় দেখা যাচ্ছে এক মেয়ে হাত ধুচ্ছে, এক ছেলে ফোটানো পানি পান করছে, আরেকজন তার মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে যাচ্ছে।
প্রয়োজন শুধু শিক্ষকদের কিছুটা প্রশিক্ষণ, স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের সহযোগিতা, আর সবচেয়ে বড় কথা, এক টুকরা বিশ্বাস—শিশুরা পারে, যদি সুযোগ দেওয়া হয়। আর এ বিপ্লব বাস্তবায়নে দরকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সঙ্গে নিয়ে পথচলারিনারা সেদিন শেখে হাত ধোয়া কেবল অভ্যাস নয়, এটি রোগ থেকে বাঁচার এক বড় ঢাল। তারা শেখে বিশুদ্ধ পানি কীভাবে শরীরের বন্ধু। শিক্ষক গল্পের ছলে বলেন, ‘তোমাদের হাতের মধ্যেই আছে তোমার পরিবারের সুস্থতার চাবি।’ রিনা মন দিয়ে শোনে, যেন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ সে আজ পাচ্ছে।
স্কুলে গড়ে উঠেছে ওয়েলবিইং ক্লাব। সেখানে শিক্ষক আর ছাত্ররা মিলে পরিকল্পনা করবে কীভাবে গোটা স্কুল, এমনকি পুরো গ্রামকে সচেতন করা যায়। কেউ নাটক করবে ডায়াবেটিস নিয়ে, কেউ ছবি এঁকে দেখাবে বিশুদ্ধ পানির গুরুত্ব, আবার কেউ হয়তো পুরো গ্রামে একটি স্বাস্থ্য মেলার আয়োজন করবে। এই ছেলেমেয়েরা শিখবে, কীভাবে দল বেঁধে কাজ করতে হয়, কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে নিজের বক্তব্যে মানুষকে বিশ্বাসী করে তুলতে হয়।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে রিনা মাকে দেখে টিউবওয়েল থেকে পানি তুলছেন। মাকে থামিয়ে সে বলে, ‘মা, পানি ফুটিয়ে খেতে হবে।’ মা হেসে বলে, ‘তুই আবার এত বড় কথা শিখলি কোথা থেকে?’ রিনা গম্ভীর হয়ে উত্তর দেয়, ‘স্কুলে শিখেছি মা, এতে আমাদের পেটের অসুখ হবে না।’ মায়ের চোখে মৃদু বিস্ময়, তারপর একধরনের গর্বের ঝিলিক।
এই ছোট্ট কথোপকথনের মাধ্যমে বদলে যেতে শুরু করে রিনার ছোট্ট জগৎ। দিনের পর দিন, স্কুলের ‘ওয়েলবিইং ক্লাব’-এ রিনা আরও নতুন নতুন জিনিস শেখে। সে শেখে টিকাদান কেন জরুরি, মায়েদের গর্ভাবস্থায় কেন নিয়মিত চেকআপ করা দরকার, আর কেন ডাক্তার না দেখিয়ে নিজে নিজে ওষুধ খাওয়া বিপজ্জনক। কখনো ছবির মাধ্যমে, কখনো নাটক করে, কখনো আবার ছোট ছোট কবিতা বানিয়ে তারা এই সব শেখে ও শেখায়।
স্কুলের বড় ভাইবোনেরা মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, গ্রামের মাঠে একটি স্বাস্থ্য মেলা হবে। রিনা আর তার বন্ধুরা সেখানে একটা নাটক করবে—‘শুদ্ধ পানির রাজ্যে রাজার গল্প’। রাজা সব প্রজাদের বলবে কেবল ফোটানো পানি খেতে। সেই মেলায় রিনা মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রথমবারের মতো সাহস করে সবাইকে বলবে—‘ভালো স্বাস্থ্য মানে ভালো জীবন।’ তার কথায় মেলা ভরে উঠবে করতালিতে।
তারা স্কুলের বাইরেও এই শিক্ষার প্রভাব ছড়িয়ে দেবে। সমবয়সী ক্লাব তৈরি করবে, যেখানে তারা একে অপরকে শেখাবে। কোনো একটি পরিবার যখন দেখে তাদের সন্তান স্বাস্থ্য সম্পর্কে কথা বলছে, তখন প্রতিবেশীরাও কৌতূহলী হবে।
একেকটি শিশু হয়ে উঠবে নিজের পরিবারে, নিজের পাড়ায় পরিবর্তনের আলোকবর্তিকা। ছোট ছোট এই আলোকবর্তিকাগুলো মিলেই গড়ে উঠবে একটি সচেতন নেটওয়ার্ক।
রিনা দেখতে পায়, তার কথা কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে। তার বাবা, যিনি আগে গ্রামের ওঝা, গ্রাম্য ডাক্তার বা ওষুধের দোকানের কর্মীর কথায় বিশ্বাস করতেন, এখন শহরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার কথা ভাবছেন। তার ছোট ভাইও এখন স্কুল থেকে ফিরেই হাত ধুয়ে খাবার খায়।
রিনা অনুভব করে, পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। ছোট্ট ছোট্ট কথায়, কাজে, বিশ্বাসে। একদিন ক্লাসে শিক্ষক একটি বড় কথা বলেন, ‘তোমরাই হবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যবীর।’ রিনা অবাক হয়। সে ভাবতেই পারেনি, তার মতো একটা ছোট মেয়ে এমন বড় দায়িত্ব পেতে পারে। কিন্তু যখন সে নিজের চারপাশে দেখে কতটা বদল এসেছে, তখন সে নিজের ভেতর একটা সাহস অনুভব করে।
এই গল্প শুধু রিনার নয়। সারা দেশে হাজার হাজার রিনা, সোহাগ, লিজা, মিজান—তারা সবাই এই পরিবর্তনের অংশ। তারা নিজেদের পরিবারের স্বাস্থ্য সচেতনতায় আলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তারা পুরোনো ভুল ধারণাকে প্রশ্ন করছে। তারা শিখছে আর শেখাচ্ছে।
আর এই পুরো পরিবর্তন শুরু হয়েছে খুব ছোট্ট একটি কাজ দিয়ে—স্কুলে স্বাস্থ্যশিক্ষা। এতে নতুন কোনো বিশাল বাজেট লাগেনি, বিশাল কোনো বিল্ডিং গড়তে হয়নি। শুধু দরকার হয়েছে বিশ্বাস, সাহস আর একটু মমতা—ছোটদের বড় করে দেখার মনোভাব।
দেশের কয়েকটি জেলায় শুরু হয়েছে এই পথচলা। শিক্ষকেরা প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা আসছেন স্কুলে গল্প বলতে। ছাত্রছাত্রীরা নেতৃত্ব নিচ্ছে, তাদের কথার জোর বাড়ছে। পাইলট প্রকল্পের ফলাফল দেখাচ্ছে, যেখানে এই উদ্যোগ চালু হয়েছে, সেখানে হাত ধোয়ার অভ্যাস বেড়েছে, টিকা গ্রহণের হার বেড়েছে এবং চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষিত ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আরও বড়। যদি এই মডেল সফল হয়, তবে পুরো বাংলাদেশেই ছড়িয়ে দেওয়া হবে এই স্বপ্ন-স্কুলের প্রতিটি ছাত্রছাত্রী হবে স্বাস্থ্য সচেতনতার অগ্রদূত।
রিনাদের হাত ধরেই বাংলাদেশ বদলে যাবে। হয়তো ১০ বছর পর, রিনা বড় হয়ে কোনো হাসপাতালে কাজ করবে বা নিজের পরিবার সামলাবে। কিন্তু তার ভেতরে গেঁথে থাকবে সেই ছোট্ট শিক্ষার বীজ—ভালো স্বাস্থ্য মানে ভালো জীবন।
যখন তার মেয়ে স্কুল থেকে এসে বলবে, ‘মা, টিকা নিতে ভুলবে না,’ তখন রিনা মনে মনে হাসবে। মনে পড়বে আজকের এই দিনের কথা, যখন সে প্রথমবার হাত ধোয়ার গুরুত্ব শিখেছিল, বিশুদ্ধ পানির গল্প শুনেছিল। মনে পড়বে সেই শিক্ষক, যে একদিন বলেছিলেন—‘তুমি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যবীর।’
এভাবেই, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়বে জ্ঞানের আলো। একেকটি শিশুর চোখে দেখা যাবে একটুকরা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। আর একদিন, পুরো বাংলাদেশ হবে এমন এক দেশ, যেখানে প্রত্যেক নাগরিক জানবে, বুঝবে এবং দাবি করবে—ভালো স্বাস্থ্য সবার অধিকার।
রিনা আর তার বন্ধুরা এই নতুন বাংলাদেশের প্রথম আলো। তারা হার মানবে না, থেমে থাকবে না। তাদের ছোট ছোট পায়ে ভর করেই এগিয়ে আসবে একটি সুস্থ, সচেতন, নতুন বাংলাদেশ।
স্বপ্ন রিনার গল্পকে বাস্তবে রূপদান করা কঠিন কিছু নয়। এই পদ্ধতি খুব বেশি খরচসাপেক্ষও নয়। বিদ্যমান স্কুলব্যবস্থার ভেতরেই এই উদ্যোগ চালানো সম্ভব। প্রয়োজন শুধু শিক্ষকদের কিছুটা প্রশিক্ষণ, স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের সহযোগিতা, আর সবচেয়ে বড় কথা, একটুকরা বিশ্বাস—শিশুরা পারে, যদি সুযোগ দেওয়া হয়। আর এ বিপ্লব বাস্তবায়নে দরকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সঙ্গে নিয়ে পথচলা।
যদি আমরা আমাদের ছোট্ট ছেলেমেয়েদের ওপর ভরসা রাখি, যদি তাদের হাতে স্বাস্থ্য সচেতনতার দীপ্ত মশাল তুলে দিই, তবে তারাই ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য বিপ্লবের কারিগর হবে। তারা ভুল ধারণা ভাঙবে, সঠিক তথ্য ছড়াবে আর সাহসের সঙ্গে দাবি তুলবে—ভালো স্বাস্থ্যসেবা তাদের অধিকার।
কারণ, শিশুরা যখন বলে, পরিবার শোনে। তারা অযথা তর্ক করে না, তাদের কথা বিশ্বাস করা হয় সহজে। তারা একধরনের সরল, স্বচ্ছ বিশ্বাস নিয়ে কথা বলে, যা কোনো পোস্টার বা বিজ্ঞাপনে সম্ভব নয়। একটা মেয়ে যখন তার মাকে হাসপাতালে যেতে অনুরোধ করে, সেই মায়ের মনে দ্বিধা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সে হয়তো যাবে। একটা ছেলে যখন তার দাদাকে বোঝায় যে গ্রামের হাতুড়ে চিকিৎসকের বদলে প্রশিক্ষিত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, দাদার মনে প্রশ্ন আসবে—‘হয়তো ছেলেটাই ঠিক বলছে।’
তাদের কণ্ঠস্বর হবে বদলের বার্তা। একটি শিশু যখন তার মায়ের হাত ধরে হাসপাতালের দিকে এগিয়ে যাবে, সেটাই হবে একটি নতুন দিনের সূচনা। একটি পরিবার যখন স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন হবে, সেটাই হবে একটি নতুন সমাজ গঠনের প্রথম ধাপ। আর এই সমাজ—এটি হবে এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে প্রত্যেক নাগরিক জানবে, চাইবে এবং পাবে তার প্রাপ্য স্বাস্থ্যসেবা।
ড.
সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক; আহ্বায়ক, অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস বাংলাদেশ (এএইচআরবি)
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র পর ব র র সবচ য় যখন ত র র বন ধ দরক র ব যবস র একট
এছাড়াও পড়ুন:
নারীর ডাকে নারীর সমাবেশ
পৃথিবীর যে কোনো ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা অসামান্য। বাংলার ইতিহাস এর বাইরে নয়। চব্বিশের অভূতপূর্ব জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল; যেখানে নারীরা ঢাল হয়ে বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে, মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে আন্দোলনের প্রধান শক্তির ভূমিকা পালন করেছেন, শহীদ হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। নির্মম সত্য হলো– আন্দোলন-সংগ্রামে নারীর মুখ প্রথম সারিতে থাকলেও পরবর্তী সময়ে তাদের অবদান স্বীকারের ক্ষেত্রে থাকে কাপর্ণ্য। জুলাই গণঅভ্যুত্থান তারই এক উদাহরণ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নারীবিদ্বেষী বক্তব্য এসেছে বিভিন্ন পক্ষ থেকে। এর বিপরীতে ন্যায্যতা-সমতার দাবিতে ‘নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা’ কর্মসূচি নেন সমাজের সচেতন নারীর একাংশ। তাদের আহ্বানে সব শ্রেণিপেশার মানুষ ১৬ মে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সমবেত হন।
সংসদ ভবন পেছনে রেখে সুন্দর সাজসজ্জাময় একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়। যেখানে জাতীয় সংগীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে এ অনুষ্ঠান শুরু হয়। বিদ্রোহে ফেটে পড়ে তাদের কথার স্বর, গান-নাটক এবং কথার ধ্বনিতে মুক্তির সুর। তাদের দাবিতে স্পষ্ট হয় ইনকিলাব-আজাদির কথা। সেখানে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর থেকে বাংলাদেশের পাহাড়-সমতলের নারীর প্রতি সমর্থন জানানো হয় এই মঞ্চ থেকে।
এই কর্মসূচিটি জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন অনেকেই। যেসব মানুষ হেঁটে যাচ্ছিলেন, তারাও বলছিলেন, ‘দরকার ছিল এমন আয়োজনের ...।’ পুরুষের অংশগ্রহণও ছিল চোখে পড়ার মতো। আয়োজকদের মতে, তাদের দাবি তো মানুষের দাবি, পুরুষের সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই; বিরোধ পিতৃতন্ত্রের সঙ্গে।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশন নারীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে ৪৩৩টি সুপারিশ পেশ করে। অন্য সব কমিশনের মতো এ কমিশনের সুপারিশেও ছিল আলোচনা-সমালোচনার উপাদান। দেখা যায়, এ কমিশন রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর লোকজন নানাভাবে নারীর প্রতি সহিংস মনোভাবের প্রকাশ ঘটায়। কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে সমালোচনার নামে নারীবিদ্বেষী অবস্থান ছিল সুস্পষ্ট। এর বিপরীতে বিভিন্ন ফোরামে নারীরা আলোচনা করেন নিজেদের মধ্যে। যে তরুণ সমাজ গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিল; সেই তরুণ সমাজের নারী প্রতিনিধিরাই এই নারী সমাবেশের ডাক দেন। তবে এই কমিশনের প্রতিবেদন মূল বিষয় ছিল না। এখানে শত শত বছর এ অঞ্চলের নারীর দুর্ভোগ, বঞ্চনা, বৈষম্যের বিরুদ্ধে নারীমুক্তির চেতনাও রয়েছে বিদ্যমান। এটিই এই আয়োজনের মূল বলে উল্লেখ করেছেন আয়োজকরা।
এমন এক জরুরি মুহূর্তের সাক্ষী হতে পেরে অনেকেই আনন্দিত। এমন একজন নারী এসেছেন চট্টগ্রাম থেকে, শাড়ি পরে হাতে লাঠি নিয়ে মিছিলে হাঁটছিলেন। তিনি তেমন কাউকেই চেনেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখে চলে এসেছেন। হাঁটতে হাঁটতে জানা গেল বয়স ৫০ ছুঁইছুঁই; নারী অধিকারের কথা শুনে চলে এসেছেন।
মঞ্চের প্রথমেই বসেছিলাম। আমার পরনে শার্ট, প্যান্ট, মাথায় ক্যাপ। পাশের নারী সুন্দর জামদানি শাড়ি পরে বসে আছেন, এই ভরদুপুরে। দরদর করে ঘাম ঝরছে, ব্যাগ থেকে গামছা বের করে দিলাম। তিনি নির্ভয়ে মুখ মুছে নিলেন। অন্যদিকে স্লিভলেস ব্লাউজে, টাঙ্গাইলের তাঁত কটনে বসে আছেন এক তরুণী। ঠিক হাতের ডান পাশেই বোরকা, নেকাব পরা এক নারী, কোলে শিশু। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের শহীদ পরিবারের মা-বোনও এসেছেন– অদ্ভুত সুন্দর এক মেলবন্ধন। মঞ্চে তখন নারীর প্রতি বৈষম্য, যৌন হয়রানি নিয়ে দুই নারী বলছিলেন। ছোটবেলায় বাবার বন্ধুর মাধ্যমে যৌন হয়রানির কথা যখন তিনি বলছিলেন; তখন অনেক নারীর চোখে জল। সানগ্লাস দিয়ে চোখের জল লুকানোর চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। কারণ এ তো সব নারীরই গল্প!
এ আয়োজনে নারীরাই সব করেছেন, স্লোগান দিয়েছেন নারীরা, ভলান্টিয়ারও তারাই ছিলেন। এখানে কোনো সংগঠন বা দলীয় ব্যানার আনার ওপর ছিল নিষেধাজ্ঞা। যেটি এ আয়োজনকে আরও সুন্দর-সাবলীল করে তুলেছে।
এ নারী সমাবেশের ঘোষণাপত্রে বলা হয়, এ আয়োজনে জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ও নিহতদের স্বজন, মানবাধিকার কর্মী, পেশাজীবী, শিল্পী, গার্মেন্টস শ্রমিক, চা-বাগানের শ্রমিক, যৌনকর্মী, প্রতিবন্ধী অধিকারকর্মী, হিজড়া, লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যময় ও অন্যান্য প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মানুষ, তরুণ-তরুণী, শিক্ষার্থী, আদিবাসী, অবাঙালি এবং আরও অনেকে– যারাই এ বাংলাদেশের প্রতিনিধি, তাদের অধিকার আদায় না হলে মানবিক, সাম্য, স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, বৈচিত্র্যময়তা ও সহনশীলতার বাংলাদেশ হবে না। এ আকাঙ্ক্ষাগুলো নিয়ে তাদের এ আয়োজন।
আমরা দেখেছি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই নারীর প্রতি সহিংস আচরণ। ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ কমেনি। যে নারীরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তারা আজ অনেকেই লোকচক্ষুর অন্তরালে। এগুলো সমাজ-রাষ্ট্রের চিত্র। এই চিত্রপট সামনে রেখে, নারীবান্ধব সমাজ তৈরি করতে নারীরা মতভিন্নতা সত্ত্বেও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দিয়েছেন এই মৈত্রী যাত্রায়।
এ দেশে কৃষি, মৎস্যজীবী ও গৃহকর্ম পেশায় নারীর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই কিন্তু আমরা জানি কৃষিকাজে নারীর অবদান অতুলনীয়। নারী যদি কৃষিকাজে প্রধান ভূমিকা না রাখতেন, তাহলে এ খাতে ধস নেমে যেত। এ ছাড়া নারী-পুরুষ একই কাজে অংশগ্রহণ করে নারীরা কম মজুরি পান। দলিত, হরিজন ও আদিবাসী নারীরা জাতিগত নিপীড়নের শিকার হন। বাংলাদেশের শতকরা ৯৬ ভাগ নারী আজও ভূমির মালিকানা থেকে বঞ্চিত। এশিয়ায় বাল্যবিয়ের শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। স্বামী বা সঙ্গীর হাতে নারী নির্যাতনের ঘটনায় বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ; প্রতিনিয়ত নারীরা বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। অহরহই প্রবাসী নারীশ্রমিক দেশে ফিরছেন লাশ হয়ে। এসব কাঠামোগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে নারীর এমন দলবদ্ধ লড়াই অনস্বীকার্য।
‘মৈত্রী যাত্রা’র ঘোষণাপত্রে বলা হয়– নারী, শ্রমিক, জাতিগত, ধর্মীয়, ভাষাগত সংখ্যালঘু, হিজড়া ও লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিচয়ের নাগরিকের রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কোনো শর্তাধীন নয়, হতে পারে না। এ মৌলিক বিষয়গুলো হুমকির মুখে রাখলে তা হবে অর্ধশতকের নারী আন্দোলন এবং জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ও ইনসাফের ধারণার পরিপন্থি। মৈত্রী যাত্রার দাবি– অধিকার ও ধর্মের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা তৈরি করতে না দেওয়ার জন্য এ আয়োজন। এর মধ্য দিয়ে জানান দেওয়া হয়, সরকার ও প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নারীবিষয়ক অবস্থান নজরদারিতে রাখা হবে। যে ক্ষমতা কাঠামো এসব জুলুমবাজি জিইয়ে রাখে, সেই কাঠামোকে ভাঙার ডাক দিয়েছেন নারীরা।
সমাবেশ শেষে তখন রাত হয়ে গেছে। সংসদ ভবন এলাকায় মেলা যেন ভাঙছে না। সবার ভেতর উৎসব উৎসব আমেজ। চা-কফি, ফুচকা-চটপটির আয়োজন চারপাশে। লম্বা মিছিলে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে ঠান্ডা পানিতে গলা ভেজাচ্ছেন অনেকে। কোনো কোনো পুরুষ আয়োজকদের ডেকে এমন আয়োজনের জন্য শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। জানা গেল, এক পুরুষ অংশগ্রহণকারী এসেছেন রাজশাহী থেকে, শুধু এ আয়োজনের জন্য। এমন আরও নানা লিঙ্গীয় পরিচয়ের মানুষ এক মিছিলে হেঁটেছেন, যেমনটা আমরা দেখেছি চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সময়। এ কর্মসূচির দাবিও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মতোই– একটি গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের, যেখানে সব মানুষের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে বৈষম্যবিরোধিতা ও সাম্যের যৌথ মূল্যবোধের ওপর। সমতা ও ন্যায্যতার পথে হাঁটবে আগামীর বাংলাদেশ। v