বয়স্ক ভাতার কার্ডের কথা বলে সম্পত্তি লিখে নেওয়ার অভিযোগ
Published: 3rd, July 2025 GMT
বৃদ্ধ মা-বাবাকে বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দেওয়ার নামে প্রতারণা করে পাঁচ বিঘা সম্পত্তি লিখে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে দুই ছেলের বিরুদ্ধে।
বৃদ্ধ মা-বাবাকে কৌশলে সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে নিয়ে দলিলে স্বাক্ষর করিয়ে সব সম্পত্তি নেওয়ার পর তাদের শারীরিক নির্যাতন করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন বৃদ্ধ দম্পত্তি।
এমন ঘটনাটি ঘটেছে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বারুহাস ইউনিয়নের কুসুম্বী গ্রামে।
ভুক্তভোগী সানোয়ার হোসেন মন্ডল (৬৭) ও মোছা.
ন্যায্য অধিকার ও ভরণপোষণের সুব্যবস্থা নিশ্চিতের দাবিতে গত বুধবার (২ জুলাই) দুপুরে তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন বৃদ্ধ সানোয়ার হোসেন।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছেন, “আমি ও আমার স্ত্রী বর্তমানে চরম অবহেলা ও নির্যাতনের শিকার। আমার দুই ছেলে মোক্তার হোসেন ও মালিক হোসেন কৌশলে আমাদের সম্পত্তি তাদের নামে লিখে নিয়েছে। বর্তমানে আমাদের কোনো প্রকার ভরণপোষণ করছে না। আমরা বর্তমানে যে পুরোনো ঘরে বসবাস করছি, সেখান থেকে বের হওয়ার রাস্তাও তারা বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, বৈদ্যুতিক সংযোগও বিচ্ছিন্ন করেছে তারা। ফলে আমরা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে চরম দুর্ভোগে আছি।”
এই পরিস্থিতিতে স্ত্রীসহ নিজের ন্যায্য অধিকার, নিরাপত্তা ও ভরণপোষণের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী সানোয়ার হোসেন।
সানোয়ার হোসেন জানান, তার দুই সন্তান প্রায় তিন বছর আগে বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দেওয়ার কথা বলে তাড়াশ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে নিয়ে যান। সেখানে কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখার পর তারা কয়েকটি স্ট্যাম্পে টিপ সই নেন। পরে জানতে পারেন তার তিন বিঘা ফসলি জমি ও দুই বিঘা পুকুর দলিল করে নিয়েছেন দুই ছেলে।
বৃদ্ধের স্ত্রী মতিজান নেছা বলেন, “আমাদের বয়স হয়েছে, কোনো কাজ করতে পারি না। গ্রামের মানুষের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে যা পাই তাই দিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন চলছে। তার ওপর প্রতিনিয়ত ছেলে ও ছেলের বউদের শারীরিক-মানসিক নির্যাতনে বেঁচে থাকাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
এ ব্যাপারে স্থানীয় ইউপি সদস্য রাজিব সরকার রাজু জানান, কৌশলে বৃদ্ধের দুই ছেলে যৌথভাবে বাবা-মায়ের প্রায় পাঁচ বিঘা সম্পত্তি নিজেদের নামে রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন। এটা নিয়ে গ্রাম্য সালিশও হয়েছিল। কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি।
সম্পত্তি লিখে নেওয়া ও নির্যাতনের বিষয়ে অভিযুক্ত ছেলে মোক্তার ও মানিক হোসেন বলেন, “মা-বাবাকে নির্যাতন করি নাই। তারা নিজের ইচ্ছায় আমাদের নামে সম্পত্তি লিখে দিয়েছেন।”
তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুসরাত জাহান বলেন, “অভিযোগ পেয়েছি। এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি ওই অসহায় দম্পতিকে কীভাবে সহায়তা করা যায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে।”
ঢাকা/অদিত্য/এস
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
লরা উলভার্ট: হিমালয়ের চূড়ায় এক নিঃসঙ্গ শেরপা
লরা উলভার্ট- দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। বয়স মাত্র ছাব্বিশ, কিন্তু মনের দৃঢ়তায় যেন পাহাড়। এবারের ২০২৫ নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন প্রোটিয়া আশার একমাত্র আলোকবর্তিকা। নিজের একক নৈপুণ্যে, এক অসম্ভব সাহসিকতায় দলকে টেনে তুলেছিলেন ফাইনালের মঞ্চে।
সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলে ফেলেছিলেন ১৬৯ রানের অনবদ্য ইনিংস। যেন একক নাটকের একমাত্র নায়িকা তিনি। আর ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন হিমালয়ের মতো দৃঢ় হয়ে। একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন অনবদ্যভাবে। শতরান ছুঁয়ে যখন আকাশে ছুড়লেন ব্যাট, তখন মনে হচ্ছিল, স্বপ্নের ট্রফি যেন হাতের নাগালেই। কিন্তু ক্রিকেটের নির্মম বাস্তবতা! উলভার্ট যখন সাজঘরে ফিরলেন, ঠিক তখনই প্রোটিয়া শিবিরে নেমে এল নীরবতা। জয় হাতছাড়া হলো নিঃশ্বাস দূরত্বে।
আরো পড়ুন:
আরব আমিরাতকে ৪৯ রানে গুঁড়িয়ে ইতিহাস গড়ল যুক্তরাষ্ট্র
মিতালিকে ছাড়িয়ে ইতিহাস গড়লেন মান্ধানা
চোখের কোণে জলের কণা তখনও ঝলমল করছিল। সেটা ঘামের ছিল, নাকি অপূর্ণতার অশ্রু, তা কেউ জানে না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল, হৃদয়ের গভীরে আগুন জ্বলছে। একটা স্বপ্নের দগ্ধ ছাই হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা।
তবুও এই ব্যর্থতার মাঝেই উলভার্টের জয় আছে। বিশ্বকাপে তিন ফাইনাল, টানা তিনবার! এবং প্রতিবারই দলের একমাত্র ভরসা ছিলেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপে করেছেন ৯ ম্যাচে ৫৭১ রান, গড়ে ৭১.৩৭। যা নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক আসরে সর্বোচ্চ। এর আগে অ্যালিসা হিলির ৫০৯ রান ছিল শীর্ষে।
শুরুটা ছিল নিস্তরঙ্গ- প্রথম ম্যাচে মাত্র ৫, পরেরটিতে ১৪। কিন্তু ধীরে ধীরে আগুন জ্বলে উঠল তার ব্যাটে। ভারতের বিপক্ষে ৭০, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৬০, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯০, আর সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৯। প্রতিটি ইনিংস যেন নিজের সীমাকে ছাপিয়ে যাওয়া একেকটি যাত্রা।
তবে উলভার্টের কীর্তি শুধু এই বিশ্বকাপেই নয়। ২০২৩ ও ২০২৪ দুই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। প্রতিবারই দলকে তুলেছিলেন ফাইনালে। কিন্তু ভাগ্য যেন নিষ্ঠুরভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার দিক থেকে। তিনটি ফাইনাল, তিনটি পরাজয়।
তবু লরার গল্পটা হারের নয়- এ এক অনমনীয়তার গল্প, এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রার গল্প। যেমন শেরপা অক্সিজেনহীন উচ্চতায় পৌঁছে দেয় অন্যদের। কিন্তু নিজে ফিরে আসে নীরবে, তেমনি উলভার্টও দলের স্বপ্নগুলো কাঁধে তুলে বয়ে নিয়েছেন, একা।
ফাইনাল শেষে ভারতীয় খেলোয়াড়রাও যখন এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন, তখন বোঝা গেল; এই হার, এই অশ্রু, এই নীরবতা- সবই সম্মানের প্রতীক।
রবিবার ফাইনাল শেষে লরা বলেছেন অনেক কথা। সেখানে হাতাশার কিছু পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে প্রেরণা ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস।
“আমি মনে করি, ২০২৩ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের (নিউল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত) পর থেকেই আমাদের জন্য অনেক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। সেই সময় থেকেই ঘরোয়া পর্যায়ে কেন্দ্রীয় চুক্তির ব্যবস্থা চালু হয়। আমাদের দলের গভীরতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটা ছিল এক বিশাল পদক্ষেপ।”
“এরপরের (২০২৪ সালের) বিশ্বকাপটা আমাদের দলের নামটা বিশ্ব ক্রিকেটে আরও বড় করে তুলেছে, আমার তাই মনে হয়। এখন আমরা এমন একটি দল, যারা নিয়মিত ফাইনালে পৌঁছাচ্ছে। যেখানে আগে এটা একবারের সাফল্য বলেই ধরা হতো।”
“টানা তিনবার ফাইনালে উঠতে পারাটা সত্যিই গর্বের বিষয়। এটা প্রমাণ করে আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটে এবং দলীয় কাঠামোয় সঠিক দিকেই এগোচ্ছি। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের এই ফলেই আমরা এখানে পৌঁছেছি। আশা করি, আমরা এমন আরও ফাইনাল খেলতে থাকব… আর একদিন, হ্যাঁ, একদিন আমরা অবশ্যই একটা জিতব।”
টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স নিয়ে উলভার্ট বলেন, “আমার মনে হয়, আমাদের এই আসরটা অসাধারণ কেটেছে। ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানোই একটা বড় সাফল্য। আমরা পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ ক্রিকেট খেলেছি। এই বিষয়টা নিয়েই আমি সবচেয়ে বেশি গর্বিত।”
“একপর্যায়ে আমরা টানা পাঁচটা ম্যাচ জিতেছিলাম। যা আমাদের দলের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। দুই দলের মধ্যকার সিরিজগুলোতে আমরা সবসময় এই ধারাবাহিকতা পাই না। তাই বড় মঞ্চে, বড় টুর্নামেন্টে এমন পারফরম্যান্স দিতে পারাটা সত্যিই গর্বের। আমরা প্রমাণ করেছি, বড় আসরে দক্ষিণ আফ্রিকাও এখন বড় দল।”
সত্যিই তাই। লরার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা এখন বড় দল। হয়তো একদিন, কোনো এক প্রভাতে, লরা উলভার্ট সেই অধরা ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখবেন। কিন্তু আজকের দিনে, তিনি রয়েছেন বিশ্বকাপের হিমালয়ের চূড়ায়, এক নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে। যিনি নিজের কীর্তিতে চূড়ায় উঠেছেন।
ঢাকা/আমিনুল