অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং নৌ পরিবহন উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‍“জাতীয় নির্বাচন হবে কি হবে না, সেটা  আমার বিষয় না। নির্বাচন নিয়ে যাদের চিন্তা করার কথা তারা করবে। ইলেকশন কমিশন আছে তারা দেখবে। এ  নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই, আমার দায়িত্ব না। আমার বিষয় হলো, আমি চা শ্রমিকদের নিয়ে চিন্তা করব।”

শনিবার (১৭ মে) দুপুরে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে শ্রম দপ্তরে চা বাগান শ্রমিক ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ সব কথা বলেন।

সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “চা শ্রমিকদের বেতন ভাতা যা আছে, তা যথেষ্ট না। বাগানে চা উৎপাদনের খরচের চেয়ে অকশনে (নিলাম) চায়ের দাম কম পাচ্ছেন বাগান মালিকরা। এখন মালিকদের পকেটে যদি টাকা না থাকে তবে, জোর করে বেতন ভাতা আদায় করা যাবে না।”     

আরো পড়ুন:

‌‘পদ্মার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের সময় এসেছে’

কোরবানির সব হাটেই বসবে মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক: ফরিদা আখতার

তিনি  বলেন, “চা বাগান পরিদর্শনে আসা পর্যটকদের জন্য টিকিটের ব্যবস্থা করতে হবে। এই প্রবেশ ফির অর্থ ব্যয় হবে চা শ্রমিকদের কল্যাণে।”

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামানের সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন- কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানের পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ওমর মো.

ইমরুল মহসিন,  শ্রম অধিপ্তরের  অতিরক্তি পরিচালক শাহ আব্দুল তারিক, মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মো. ইসরাইল হোসেন, পুলিশ সুপার মো. এম কে এইচ জাহাঙ্গীর হোসেন, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কমিটির প্রধান উপদেষ্টা তপন দত্ত, বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি পংকজ কন্দ, সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজার, অর্থ সম্পাদক পরেশ কালিন্দী, গীতা রানী কানু ও লশমী গোয়ালা।

ঢাকা/আজিজ/মাসুদ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর উপদ ষ ট

এছাড়াও পড়ুন:

গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর: যাহা পাই তাহা চাই না

বাংলাদেশের রাজনীতির দিকে তাকালে রবীন্দ্রনাথের একুশ লাইনের ‘মরীচিকা’ কবিতাটির কথা মনে পড়ে যায়। শেষ স্তবকে কবি বলছেন: ‘যারে বাঁধি ধরে তার মাঝে আর/ রাগিণী খুঁজিয়া পাই না।/ যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই/ যাহা পাই তাহা চাই না।’ আমরা কি মরীচিকার পেছনে ছুটছি?

শৈশবে পাঠ্যবইয়ে মরীচিকার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। ধু–ধু মরুভূমিতে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত পথিক দূরে জলের দেখা পায়। তপ্ত বালুরাশির ওপর সূর্যের আলোর প্রতিফলন জলের বিভ্রম একসময় ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। আমরা যেন মরীচিকার পেছনে ছুটছি। কিছুতেই ধরতে পারছি না। রাজনীতিবিদেরা শিখিয়েছেন, তাঁদের কথা শুনলে, তাঁদের দেখানো পথে চললে আমরা সুখের সৈকতে পৌঁছে যাব। সেই থেকে আমরা হাঁটছি, ঘুরছি, দৌড়াচ্ছি; কিন্তু পথ আর শেষ হয় না। সুখের দেখা মেলে না।

নেতারা একটার পর একটা ইশতেহার দেন। কত সুন্দর সুন্দর নাম সেগুলোর। গণতন্ত্রের চারণভূমিতে পৌঁছাব, সমাজতন্ত্র এল বলে। সেখানে কোনো বৈষম্য নেই। দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকিতে পড়েছে। তাঁদের ভোট দিলে সার্বভৌমত্ব টিকে যাবে। তারপর আমাদের যা চাহিদা, সব মিটে যাবে। আমরা কত কিছু চাই। আমাদের চাওয়াগুলোর কী সুন্দর ভাষা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ: অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু,/ চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু।

দুই.

একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হলো। দেশ স্বাধীন হলো। মানুষ স্বাধীন হলো না। জন্মের পর থেকে দেখছি ‘ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি’। আন্দোলন, সরকার বদল, স্বপ্নভঙ্গ, আবার আন্দোলন, সরকার বদল, আবারও স্বপ্নভঙ্গ। এ এক বৃত্তাকার চক্র। যেখান থেকে শুরু, সেখানেই ফিরে আসা। বৃত্ত আর ভাঙে না।

দেশপ্রেম মানুষের একটা সেন্টিমেন্ট। উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা তার অনুষঙ্গ। উন্নয়ন না হলে দেশের দরকার কী। মানুষের এই সেন্টিমেন্ট নিয়ে হাডুডু খেলে পাকা খেলুড়েদের কতিপয় সিন্ডিকেট। তারা ঘাড়ে-গর্দানে স্ফীত হয়। তারা অনেকেই টেম্পো ছেড়ে বিএমডব্লিউ চড়ে। এক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আরেক সিন্ডিকেট আশার বাণী শোনায়। আমরা পাঁচ-দশ বছর আগের কথা ভুলে যাই। আবারও ছুটি মরীচিকার পেছনে।

সোনার বাংলা শ্মশান কেন—এই জিজ্ঞাসা থেকে আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন একসময় পৌঁছে গেল তুঙ্গে। আমরা স্বাধীন হলাম। আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবকেরা আমাদের উপহার দিলেন শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ মন্বন্তর। গুদামে চাল পচে। মানুষ না খেতে পেয়ে রাস্তায় মরে। তখন থেকেই আমরা দেখেছি একের পর এক হীরক রাজার শাসন। কখনো সিভিল পোশাকে, কখনো সামরিক উর্দিতে।

জনগণের আকাঙ্ক্ষা আর সেন্টিমেন্টকে পুঁজি করে ঘটল একের পর এক পালাবদল। একাত্তর, পঁচাত্তর, নব্বই, ছিয়ানব্বই এবং সর্বশেষ চব্বিশ। আমরা দেখলাম ইতিহাসের দীর্ঘতম জুলাই। মনে হয়েছিল, জীবন-মরণ করি পণ/ শেষ যুদ্ধ শুরু আজ কমরেড/ এসো মোরা মিলি একসাথ।

 একটা জগদ্দল পাথর সরে গেল; কিন্তু তারপর?

তিন.

৩৬ জুলাই কি অভ্যুত্থান, বিদ্রোহ, বিপ্লব, নাকি দাঙ্গা। এ নিয়ে কণ্ঠজীবী আর কলমজীবীদের বাহাস চলছে। একটি শব্দ নিয়ে আমরা একমত হতে পারছি না। আমরা নাকি দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছি। সবাই এত স্বাধীন, যে কেউ যা খুশি করতে পারে। অমুককে ধরো, তমুককে মারো, এই চলছে দিনরাত। এটাই নাকি বিপ্লবের নিয়ম যে সে কোনো নিয়ম মানে না। ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে শোনা গানের সেই চরণের কথা মনে হয় ‘পুরোনো সব নিয়ম ভাঙে অনিয়মের ঝড়।’ আমরা সেই ঝড়ের কবলে পড়েছি।

দেশটা যেখানে ছিল, সেখানেই আছে। কর্তারা সংবিধানের শব্দাবলি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। সরকারি দপ্তরে সেবা পাওয়া যায় না। গণপরিবহনে অব্যাহত আছে মাফিয়া রাজত্ব। গাঁওগেরামের ছেলেরা ড্রোন আর বিমান বানাচ্ছে। আর আমাদের সেরা প্রকৌশলবিদদের আঁতুড়ঘরে তৈরি হচ্ছে রিকশা। অথচ আমাদের দরকার ছিল কয়েক হাজার আধুনিক বাস। একটা জাতি কতটা পশ্চাৎপদ মানসিকতায় ভুগলে এমন হতে পারে!

আমরা থ্রি জিরোর গল্প শুনছি। লোকে ঠাট্টা করে বলে—আমাদের এখন জিরো গ্রোথ, জিরো এমপ্লয়মেন্ট, জিরো ল অ্যান্ড অর্ডার। আগে আমার কী দরকার? ইউরোপ শিল্পোন্নয়ন আর প্রবৃদ্ধির চূড়ায় উঠে এখন মানবিক হচ্ছে। আর আমরা এখনো ভালোভাবে ‘টেক অফ’ করতে পারিনি। আমরা কি ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ব? আমাদের অগ্রাধিকার কি আমরা বুঝব না? দেশে এখন যে জিনিসটার চাষ সবচেয়ে বেশি হচ্ছে, তা হলো ‘হতাশা’। রাজনীতির রেটোরিকের বাইরে আমরা এখনো যেতে পারিনি। সবাই আছেন বাঁধা বুলিতেই। কেউ বলেন ৩১ দফা, কেউ বলেন নয়া বন্দোবস্ত, কেউ বলেন দায় ও দরদের রাজনীতি। চমৎকার শব্দাবলি!

বড় ক্যানভাসে চিন্তা করলে দেখা যাবে, একটা জাতির জীবনে এক বছর কিছুই না। কিন্তু আমরা তো শূন্য থেকে শুরু করছি না। ১৯১৯ সাল থেকে এ দেশে নির্বাচন হচ্ছে। একাধিক রাজনৈতিক দল শত বছরের পুরোনো। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমরা কি কিছু শিখেছি? নাকি প্রতি পাঁচ বছর পরপর আমরা নতুন করে শুরু করছি?

দেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত শব্দ হলো সংস্কার। সংস্কার কি শুধু সংবিধানে হবে? আমাদের অগ্রাধিকারের জায়গাগুলো কী? শুধু সংবিধান খেয়ে কি মানুষ বাঁচবে? মানুষকে শান্তি আর স্বস্তি দিতে যে চারটি সেবার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, তা হলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গণপরিবহন এবং জননিরাপত্তা। এ চারটিতেই আমাদের স্কোর খারাপ। এসব জায়গায় কাজ করতে হলে কি নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার আছে? শুরু তো করা যায়? আমরা তো দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখছি না।

চার.

সংবিধানে ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটা থাকলেই আমরা অনেকে খুশি। ওটা বাদ দেওয়া যাবে না। আবার আমরা ‘খিলাফত’ও চাই। রাজনীতিবিদেরা এসব শব্দ নিয়ে মল্লযুদ্ধ করতে থাকুক। তাঁদের তো আর খাওয়া-পরার ভাবনা নেই।

মানুষকে বাঁচাতে হলে তার জন্য চাই নানান আয়োজন। এ মুহূর্তে সবচেয়ে দরকার আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার আর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। এ দুটি বিষয় নিয়ে কে কী ভাবছেন, সেটি জানা দরকার। বায়বীয় রাজনৈতিক স্লোগান দিয়ে শূন্যে আস্ফালন করে কী হবে? রাজনীতির চিরাচরিত মডেল আর এ দেশে কাজ করবে না।

জুলাই আন্দোলনে দেখেছি, নারী-পুরুষ, শিশু–কিশোর, তরুণ-প্রবীণনির্বিশেষে মানুষ প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে পথে বের হয়েছিলেন। এই লক্ষ কোটি মানুষ তো বিসিএস আর কোটা নিয়ে মাতম করেনি। তারা একটা দম বন্ধ করা পৈশাচিক শাসনব্যবস্থা থেকে মুক্তি চেয়েছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল ছাত্রদের। জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলে দাবিটা চাকরির কোটা অতিক্রম করে এক দফার আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। হাতে গোনা কিছু সুবিধাভোগী আর পরিবারপূজারি ছাড়া সবাই চেয়েছে হাসিনার পতন। আটঘাট বেঁধে, ব্লু-প্রিন্ট বানিয়ে, মিশন-ভিশন স্থির করে আন্দোলন হয়নি, তাই হাসিনা পালানোর পর একটা প্রশ্ন সামনে এসে গেছে—এখন আমরা কোন পথে চলব?

সবাইকে নিয়ে একটা সামাজিক চুক্তি করা ছাড়া সামনে এগোনো যাবে না। এখানে যদি কেউ মনে করেন আমরা বেশি বুঝি, অন্যরা কম বোঝে, সবাইকে হেদায়েত করার দায়িত্ব আমাদের, তাহলে ভুল হবে। সবাইকে নিয়ে চলার মানসিকতা এবং সক্ষমতাই বলে দেবে আমরা এই অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব কি না।

বাংলাদেশটা কিন্তু এখনো উত্তপ্ত। ৩৬ জুলাই ইতিহাসের চাকা থেমে গেছে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কোনো কিছুই মীমাংসিত নয়।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ