মানিকগঞ্জে আবার ‘কিশোর গ্যাংয়ের’ দৌরাত্ম্য বাড়ছে
Published: 19th, May 2025 GMT
মানিকগঞ্জে ‘কিশোর গ্যাংয়ের’ দৌরাত্ম্য আবার বাড়ছে। কিশোরেরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে মারামারি, মেয়েদের উত্ত্যক্ত, মাদক সেবন, বিকট শব্দে দ্রুতগতিতে মোটরসাইকেল চালানোসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এ ঘটনায় অভিভাবক ও এলাকাবাসী উদ্বিগ্ন।
সম্প্রতি শহরে দুই দল কিশোরের মধ্যে ধারালো চাপাতি ও চায়নিজ কুড়াল নিয়ে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত হয় এসএসসি পরীক্ষার্থী এক কিশোর। এ ঘটনায় কিশোর গ্যাংয়ের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে সদর থানায় মামলাও হয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের সামনে ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করাসহ বিভিন্ন অভিযোগে আজ রোববার ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী আরও ১৩ জন কিশোরকে আটক করেছে পুলিশ।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের পর ছাত্রলীগের নেতারা বিদ্যালয়ের কিশোরদের নিয়ে রাজনৈতিক মিছিল-মিটিং করতেন। ছাত্রলীগের রাজনৈতিক প্রভাবে কিশোরদের কেউ কেউ ‘কিশোর গ্যাং’ গড়ে তোলে। তবে ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর কয়েক মাস কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত কমলেও সম্প্রতি আবার বেড়ে যায়। ‘সিনিয়র-জুনিয়র’ নিয়ে দ্বন্দ্ব, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, প্রেমবিষয়ক ঘটনা নিয়ে মারামারি এমনকি কুপিয়ে গুরুতর আহত করারও ঘটনা ঘটছে।
জেলায় কিশোর গ্যাং তৈরিতে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগকে দায়ী করেছেন জেলা ছাত্রদলের সভাপতি আবদুল খালেক। তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যে বখাটে কিশোর সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছিল, তারাই মূলত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। ছাত্রলীগ তাদের দিয়ে বিভিন্নভাবে আবার বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করছে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক মাসে শহরে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের মধ্যে অন্তত পাঁচটি সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে কয়েকজন কিশোর গুরুতর জখমও হয়। গত মঙ্গলবার দুপুরে শহরের এস কে সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে প্রকাশ্যে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা চায়নিজ কুড়াল ও চাপাতি নিয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী রাতুল হাসানকে (১৭) কুপিয়ে আহত করে। এ ঘটনায় আহত ছাত্র বাদী হয়ে পারভেজ মোল্লা (১৯), আল জারিয়াত (১৯) ও আসাদুজ্জামানসহ (২৬) কিশোর গ্যাংয়ের ১০ সদস্যের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা আরও ৩০ থেকে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়।
এ ছাড়া গতকাল শনিবার বেলা দেড়টার দিকে আইনজীবী সমিতির ২ নম্বর ভবনের সামনে শহীদ রফিক সড়কে কিশোর গ্যাংয়ের একই সদস্যরা চায়নিজ কুড়াল, চাপাতি ও লোহার রড নিয়ে মহড়া দেয়। এ সময় জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। খবর পেয়ে সদর থানা-পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে চায়নিজ কুড়াল ও চাপাতিসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। বাকিরা পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় শনিবার রাতে সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো.
এসআই নূরুল আমিন বলেন, আজ দুপুরে গ্রেপ্তার তিন কিশোরকে জেলা কিশোর আদালতে পাঠানো হয়েছে। পরে তাঁদের গাজীপুর কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
এদিকে আজ দুপুরে এস কে সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের অদূরে তালতলা এলাকায় একদল বখাটে কিশোর ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করছিল। খবর পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে সদর থানা-পুলিশ ১৩ জন কিশোরকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। তাদের বয়স ১৫ থেকে ১৭ বছর।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম আমান উল্লাহ সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে মামলা ও গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। ১৩ জনকে আটকও করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
শহরের খান বাহাদুর আওলাদ হোসেন খান ডিগ্রি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, শিশু-কিশোরদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে এখনই ফেরাতে হবে। অন্যথায় আগামী দিনগুলোতে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এ জন্য আইনশৃঙ্খল রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কঠোর হতো হবে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের যাতে কোনো ধরনের প্রশ্রয় না দেয়, সে বিষয়ে দলগুলোর নীতিনির্ধারকদের সচেতন থাকতে হবে। অভিভাবকদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে। তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি বাড়াতে হবে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সদর থ ন এ ঘটন য় র সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
ভারতের অশুল্ক বাধা আস্থার পরিবেশ ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে ফেলছে
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে পারস্পরিক নির্ভরতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে উভয় দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা ও অভিন্ন সীমান্ত এই অংশীদারিকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। সম্প্রতি উভয় পক্ষের কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং তার পাল্টা প্রতিক্রিয়া গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। বিশেষত অশুল্ক বাধা আরোপের ফলে যে নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে, তা কেবল ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, বরং আস্থার পরিবেশ ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাও হুমকির মুখে ফেলছে।
ভারতের পক্ষ থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের কিছু ভোগ্যপণ্য যেমন ফলের রস, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, প্লাস্টিক সামগ্রী ও তৈরি পোশাক প্রবেশে হঠাৎ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশও ভারতীয় সুতা আমদানিতে নির্দিষ্ট স্থলবন্দর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে সরাসরি শুল্ক বাড়ানো না হলেও কার্যত আমদানি-রপ্তানির বাস্তব পথ সংকুচিত করা হয়েছে। ফলে ব্যবসা পরিচালনায় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহারের ঘটনা এই চাপ আরও বৃদ্ধি করেছে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ভারতের মূল ভূখণ্ডসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চল বাংলাদেশের জন্য লাভজনক বাজার। সেখানে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, খাদ্যপণ্য, প্লাস্টিক সামগ্রী ইত্যাদির চাহিদা রয়েছে এবং এ চাহিদা মেটাতে স্থলপথে পণ্য প্রবেশ দীর্ঘদিন ধরে স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। হঠাৎ করে এই প্রবেশাধিকার সীমিত হলে শুধু ব্যবসায়িক ব্যয় বাড়বে তা নয়, বরং ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সীমান্তবর্তী ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা, যাঁরা সরাসরি এই বাজারের সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে তৈরি পোশাকের মতো পণ্য, যা বাংলাদেশের রপ্তানির অন্যতম প্রধান খাত, তা যদি দূরবর্তী সমুদ্রবন্দর যেমন কলকাতা বা নব সেবা বন্দরনির্ভর হয়ে পড়ে, তাহলে পরিবহন খরচ, সময় ও প্রতিযোগিতার দিক থেকে পিছিয়ে পড়বে।
এদিকে বাংলাদেশও ভারত থেকে আমদানি করা সুতার ওপর নির্ভরশীল; এটি দেশের বস্ত্র ও পোশাক খাতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল। এই আমদানিতে কোনো বাধা সৃষ্টিও অভ্যন্তরীণ শিল্প খাতের ব্যয় বৃদ্ধি ও উৎপাদন ব্যাহত করে। কাজেই এ ধরনের একতরফা এবং হঠাৎ সিদ্ধান্ত পরস্পর নির্ভরশীল দুই দেশের শিল্প খাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে এবং দীর্ঘদিনের পারস্পরিক আস্থা ক্ষুণ্ন করে।
প্রতিটি দেশ তার অর্থনৈতিক সীমান্ত ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে সার্বভৌম, তারপরও নীতিনির্ধারণে স্থিতিশীলতা, আগাম অবহিতকরণ ও যৌক্তিক সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। হঠাৎ করে আরোপিত নীতিগত প্রতিবন্ধকতা শুধু ব্যবসায়ীদের জন্যই অনিশ্চয়তা তৈরি করে না, বরং আঞ্চলিক বাণিজ্য ব্যবস্থায়ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে যে সরবরাহ শৃঙ্খলা দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে উঠেছিল, তা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককেও অবিশ্বাস ও সংশয়ের পথে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি থাকে।
এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সমস্যাগুলোর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। এসব সংকট পারস্পরিক প্রতিযোগিতা বা ‘শাস্তিমূলক প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে না দেখে বরং সহযোগিতার ভিত্তিতে সমাধানের পথ খুঁজে বের করাই সময়োপযোগী পদক্ষেপ। দুই দেশই আঞ্চলিক সংহতি, আন্তসীমান্ত বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির পক্ষে। তাই অশুল্ক বাধার মতো পদক্ষেপগুলোর প্রভাব নিরীক্ষা করে দ্রুত পুনর্বিবেচনার উদ্যোগ নিতে হবে।
ভবিষ্যতে এমন সংকট এড়াতে উভয় দেশের সরকার, নীতিনির্ধারক, বাণিজ্য সংগঠন ও বেসরকারি খাতের মধ্যে গঠনমূলক সংলাপ জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সহজ বাণিজ্য কাঠামো গড়ে তোলা দরকার, যেখানে অপ্রত্যাশিত নীতিগত বাধা কমে আসবে এবং ব্যবসায়িক সম্পর্ক আরও মজবুত হবে।
সবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশ-ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক শুধু দুই দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থেই নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর সংহতি, স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্পর্ক যেন অশুল্ক বাধা, সমন্বয়হীনতা কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল নীতির কবলে পড়ে দুর্বল না হয়ে পড়ে, সেদিকে সচেতন ও দায়িত্বশীল দৃষ্টি দেওয়া সময়ের দাবি। আলোচনার মাধ্যমে ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়াই এই অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদি সমৃদ্ধির সঠিক পথ।
সেলিম রায়হান: নির্বাহী পরিচালক, সানেম