ট্রাম্পের চলচ্চিত্র শুল্ক নিয়ে ‘ব্যঙ্গ’, হেসে উঠলো পুরো হল রুম
Published: 19th, May 2025 GMT
কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘দ্য ফিনিশিয়ান স্কিম’এর প্রচারণায় এসে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চলচ্চিত্র শুল্কের প্রস্তাব নিয়ে ব্যঙ্গ করেন খ্যাতনামা পরিচালক ওয়েস অ্যান্ডারসন।
সিনেমাটির নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন পুরো টিম। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে অ্যান্ডারসন বলেন, ‘মুভিটাকে কি কাস্টমসে আটকে রাখবে? এটা তো এভাবে পাঠানো হয় না।’ তার এমন মন্তব্যের পর হল জুড়ে হাসির রুল পড়ে যায়।
প্রসঙ্গত, ট্রাম্প সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, বিদেশে শুটিং হওয়া আমেরিকান সিনেমার ওপর শতভাগ শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা রয়েছে তার। কানে নিজের সিনেমার প্রচারণায় এসে ট্রাম্পের এমন নীতি নিয়েই ব্যঙ্গ করলেন পরিচারক।
ওয়েস অ্যান্ডারসনের নতুন চলচ্চিত্র ‘দ্য ফিনিশিয়ান স্কিম’ আংশিকভাবে জার্মানিতে শুটিং হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পরিচালক মজা করে বলেন, ‘আমি তো ভেবেছিলাম উনি (ট্রাম্প) আমাদের ছবি দেখে প্রশংসা করছেন। উনি কি ছবিটা দেখেছেন নাকি?’
এরপর তিনি বলেন, ‘১০০% শুল্কের কথা আমি আগে শুনিনি। এটা মানে কি উনি পুরো টাকাটাই নিয়ে নেবেন? তাহলে আমরা কী পাবো? ব্যাপারটা জটিল। সিনেমা তো আসলে এমনভাবে শিপ হয় না।’
‘দ্য ফিনিশিয়ান স্কিম’ ছবিতে অভিনয় করেছেন বেনিসিও দেল তোরো, মাইকেল সেরা এবং নবাগত মিয়া থ্রিপলেটন। থ্রিপলেটন হলিউড তারকা কেট উইন্সলেটের কন্যা।
দেল তোরো ছবিতে একজন শিল্পপতি জ্সা-জা কর্ডা চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যিনি বারবার হত্যাচেষ্টার শিকার হন। মিয়া থ্রিপলেটন তার মেয়ে ‘সিস্টার লাইসেল’-এর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, যিনি একজন সন্ন্যাসিনী, ধূমপায়ী ও মদ্যপ। মাইকেল সেরা অভিনয় করেছেন একজন সন্দেহজনক গৃহশিক্ষকের চরিত্রে।
ছবিটির সহ-লেখক রোমান কপোলার সঙ্গে কাজ করেছেন অ্যান্ডারসন। পরিচালক জানান, ছবির প্রাথমিক ভাবনা ছিল একজন ক্ষমতাশালী ব্যবসায়ীকে ঘিরে যিনি তার সিদ্ধান্তের সামাজিক প্রভাব নিয়ে উদাসীন।
সাংবাদিক সম্মেলনে অ্যান্ডারসন আরও জানান, তিনি রোমান কপোলা ও রিচার্ড আয়োয়াডেকে নিয়ে একটি নতুন সিনেমার চিত্রনাট্য লিখছেন। তিনি বলেন, ‘এই ছবিটাও বেশ অন্ধকারময় হবে। এখনই বিস্তারিত কিছু বলতে চাই না, তবে কিছু তো ঘোষণা করতেই হবে।’
এছাড়া পরিচালক জানান, ভবিষ্যতে মাইকেল সেরা ও বিল মারেকে নিয়েও কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে। সেরাকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘চলুন হাত মেলাই, যেন এটা অফিসিয়ালি থাকে। অনেকে ‘হ্যাঁ’ বলে পরে আর করে না।’’
বিল মারেকে উদ্দেশ করে তিনি আরও মজা করে বলেন, “চলো ‘The Life Aquatic 2’ বানাই, কেমন?”
‘দ্য ফিনিশিয়ান স্কিম’ সীমিত পরিসরে আগামী ৩০ মে মুক্তি পাচ্ছে। ৬ জুন থেকে বিশ্বব্যাপী প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হবে বলে জানিয়েছেণ পরিচালক।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক ন চলচ চ ত র উৎসব অ য ন ড রসন চলচ চ ত র কর ছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
অভ্যুত্থান শহর থেকে কেন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল না
প্যারি কমিউন ব্যর্থ হয়েছিল। ১৮৭১ সালের ১৮ মার্চ থেকে ২৮ মে পর্যন্ত। স্থায়ী ছিল মোট ৭২ দিন। ছিল প্যারিসের শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ প্রথমবারের মতো একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার চেষ্টা। এটি ছিল শ্রমিকশ্রেণির প্রথম রাষ্ট্র। কারণ হিসেবে জার্মান দার্শনিক ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস লিখেছেন, বিপ্লবকে শহরের শ্রমিকদের মিত্র গ্রামাঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে বিস্তৃত করতে না পারা। ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা মাহফুজ আলমও তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, অভ্যুত্থান শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে বিস্তৃত হয়নি।
প্যারি কমিউন যেসব কারণে ব্যর্থ হয়েছিল, সেগুলো হচ্ছে:
১. কমিউন ছিল মূলত শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের নেতৃত্বাধীন, যাঁদের অনেকেই প্রশাসনিক ও সামরিক নেতৃত্বে অনভিজ্ঞ ছিলেন। বিপ্লবীদের একটি অংশ ছিল উদারপন্থী, আরেকটি ছিল রেডিক্যাল (যেমন ব্লাঙ্কিপন্থী ও প্রুধোঁপন্থী), ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়।
২. বিপ্লবীদের যতটা কঠোর হওয়ার দরকার ছিল, তাঁরা ততটা ছিলেন না। উল্টো ফ্রান্সের তৎকালীন থিয়ারের নেতৃত্বে ক্ষমতাচ্যুত সরকার ভেরসাইয়ে অবস্থান নিয়ে সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করে।
এই বাহিনী পরবর্তী সময় প্যারিস আক্রমণ করে এবং ‘রক্তাক্ত সপ্তাহ’–এ ৩০ হাজার কমিউনারকে হত্যা করে।
৩. গোটা ইউরোপ কমিউনারদের বিপক্ষে সশস্ত্রভাবেই দাঁড়ায়।
৪. শুরু থেকেই প্যারিসকে অবরুদ্ধ করে। শহরের শ্রমিকদের সঙ্গে গ্রামের কৃষকদের মৈত্রী গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ভেরসাই বাহিনী ও প্রুশিয়ানদের দ্বারা ঘেরাওয়ের কারণে ফ্রান্সের কৃষকেরা পাশে দাঁড়াতে পারেননি।
এ ছাড়া কমিউন ছিল পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিজ্ঞতা। সমাজ তখনো পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল না। দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের ভাষায়, অপরিণত প্রলেতারীয় বিপ্লব। ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস ও কার্ল মাক্স প্যারি কমিউনের ব্যর্থতার মূলত দুটি কারণ লিখেছেন, একটি শহরের শ্রমিকদের সঙ্গে গ্রামের কৃষকদের মৈত্রী গড়ে তুলতে না পারা এবং বিপ্লবীদের আরও কঠোর হতে না পারা।
মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম বাঁচিয়েছে বাংলাদেশকে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ৫৪ বছরে একজন সরকারপ্রধানও কি রৌমারী, চিলমারী, ভূরুঙ্গামারীর যুদ্ধক্ষেত্রের গ্রামবাসীদের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন? মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোতেও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কলার ভেলায় যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে গেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতে।আবার লেনিনদের বলশেভিক পার্টি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সফল বিপ্লবের পর শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে বিস্তৃত করতে পেরেছিলেন। অথচ ১২টি দেশের সহযোগিতায় বড় কৃষকেরা বিপ্লবকে সশস্ত্রভাবে প্রতিরোধ করেছিলেন। তবু পেরেছিলেন। কেন?
কিন্তু চব্বিশের ছাত্র গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী সময় প্যারি কমিউন ও অক্টোবর বিপ্লবের মতো প্রচণ্ড একটি বিরোধী শর্তও নেই। সামরিক বাহিনী বিপক্ষে নেই, আন্তর্জাতিক সমর্থন কম নেই, শহরের সঙ্গে সঙ্গে মফস্সলে ও গ্রামেও অভ্যুত্থানের পক্ষে জাগরণ দেখা গেছে। কোথাও অবরোধ নেই, দমন নেই, বাইরের রাষ্ট্র আক্রমণও করছে না। সঙ্গে আছে রাষ্ট্রের সব জনগণের সমর্থন। এমনকি নারীরাও গণ–অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে ছিলেন। তাহলে গণ–অভ্যুত্থান শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে বিস্তৃত হচ্ছে না কেন?
বিপ্লব বা অভ্যুত্থান রক্ষা পায়, নেতৃত্বদানকারীদের মিত্রশক্তির ওপর। মিত্র জোটে কর্মসূচির ভিত্তিতে, শত্রুও জোটে একই কারণে। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের প্রধান কর্মসূচি ছিল ফ্যাসিবাদের উচ্ছেদ। ফ্যাসিবাদ হলো হিংসা-বিদ্বেষমূলক, বৈচিত্র্যময় স্ব–ব্যক্তিস্বাধীনতাবিরোধী অসহিষ্ণু ভাবনাকে বৈধতা দানকারী এমন চেতনা। এই চেতনার পক্ষে সম্মতি আদায় করা হয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার সঙ্গে সন্ত্রাসের মিশেল ঘটিয়ে।
ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইগুলোতে কারা মিত্র? অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে প্রমাণ হয়ে গেছে, তাঁরা হলেন শ্রমিক-কৃষক, ছোট ব্যবসায়ী-চাকরিজীবী, নারী ও সংখ্যালঘু জাতি-ধর্মের নাগরিকেরা। গণ–অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে যেসব ছাত্র, তারা তাঁদেরই সন্তান। তাই চাকরির অধিকার চাইতে গিয়ে ফ্যাসিবাদকেই অপসারণ করতে হয়।
মুসোলিনি ও হিটলার মনে করতেন, নারীর কাজ গৃহে। বড়জোর চিকিৎসক ও শিক্ষকতার পেশায়। নারীর মঙ্গল নারীর বদলে তাঁরাই নির্ধারণ করে দিতেন। তাঁদের তৈরি আদর্শ নারীর মডেলে নারীরা ফিরে যাবেন ঘরে; আর পুরুষ কাজ করবেন বাইরে। হিটলার মেয়েদের ঘরে ফেরাতে করলেন ‘বেকারত্ব প্রতিরোধ আইন’। যে মেয়েটি কাজ থেকে সরে এসে গৃহিণী হতে রাজি থাকতে, তাকে সুদহীন ঋণ দেওয়া হলো। প্রতিটি সন্তানের জন্য চার ভাগের এক ভাগ মকুব করা হলো। নারী-পুরুষের বিয়ের বয়স কমানো হলো। ইতালিতে মুসোলিনি চার্চের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিবাহবিচ্ছেদ নিষিদ্ধ করলেন।
১৮৮৬ সালে আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে শ্রমিকেরা জীবন দিয়েছেন। সেই থেকে মে দিবস পালিত হয়। শ্রমিকেরা যদি বিনোদনের সময় না পান, তাহলে তো তাঁকে মানুষ হিসেবেই স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। আট ঘণ্টা কর্মদিবস গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটি ন্যূনতম বৈশিষ্ট্য। আশুলিয়া আর যাত্রাবাড়ীতে শ্রমিকদের গড়ে তুলতে হয় প্রতিরোধের স্তালিনগ্রাদ আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক মর্যাদা তাঁরা পাবেন না। পাওনা মজুরি চাইতে হয় রাস্তায়।
কৃষক-জেলেদের ৩০০ বছরের হাট ও ঘাটের জমিদারি উচ্ছেদে উদ্যোগ নেই। উপকূলের লবণচাষির কথা নেই। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের দাম নির্ধারণ কীভাবে হবে, সেটা নিয়ে আলাপ নেই, কৃষি সংস্কার কমিশন নেই। জেলা-উপজেলার সংস্কৃতিকর্মীদের মহড়ার ঘর নেই, উপস্থাপনের মঞ্চ নেই। শহরাঞ্চলে প্রতি ৫৫০ জনে একজন চিকিৎসক আর গ্রামাঞ্চলে প্রতি ৯ হাজার ৯০ জনে একজন ডাক্তার। এই চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে কথা কোথায়?
ঢাকার পাশের জেলাবাসীরা যে ভাড়ায় ট্রেনে রাজধানীতে আসতে পারেন, কুড়িগ্রাম কিংবা রাঙামাটির বাসিন্দারা একই ভাড়ায় তা পারেন? হাসিনা সরকার গত বছরের ৪ মে দূরত্বভিত্তিক রেয়াত বাতিল করে, সেই রেয়াত আর পুনর্বহাল হলো কই? ৩০০ বছরের ঔপনিবেশিক শহর ও গ্রামের বৈষম্য বিলোপের আলাপ ছাড়া গণ–অভ্যুত্থান শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে বিস্তৃত হবে কীভাবে?
মাওলানা ভাসানী তাঁর ‘মাও সে-তুঙ এর দেশে’ বইতে লিখেছেন, ‘মাও সে-তুঙ–এর দেশে আমাকে সব থেকে মুগ্ধ করেছে কী—এ প্রশ্ন অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছেন।...অনেক ভেবে দেখেছি, প্রশ্নটির জবাব আমি এককথায় দিতে পারি। —হাসি। হ্যাঁ, হাসিই আমায় সব থেকে বেশি মুগ্ধ করেছে। চীনের মানুষ আজ হাসতে পারে।...আমরা কি হাসির উৎসের সন্ধান পাবো না?’ —একটা জাতি হাসবে কীভাবে? অন্ন, বস্ত্র ও চিকিৎসার জায়গাটা যখন নিশ্চিত, যখন তারা জানবে হঠাৎ অসুস্থ হলে রাষ্ট্র আছে, তখনই না হাসবে।
মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম বাঁচিয়েছে বাংলাদেশকে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ৫৪ বছরে একজন সরকারপ্রধানও কি রৌমারী, চিলমারী, ভূরুঙ্গামারীর যুদ্ধক্ষেত্রের গ্রামবাসীদের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন? মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোতেও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কলার ভেলায় যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে গেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতে।
আধুনিক ব্যবস্থা ও স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শক্তিকে কেন কৃষক-জেলেদের মাঝে পাওয়া গেল না।
নাহিদ হাসান: লেখক ও সংগঠক
[email protected]