আয়ে শীর্ষে অ্যাপেক্স, মুনাফায় বাটা
Published: 20th, May 2025 GMT
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বহুজাতিক কোম্পানি বাটা শুর চেয়ে বেশি ব্যবসা করেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার। গত জানুয়ারি–মার্চে জুতার দেশীয় কোম্পানি অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার ৫৪০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। একই সময়ে জুতার বহুজাতিক কোম্পানি বাটা শু ব্যবসা করেছে ৩৫৮ কোটি টাকার। সেই হিসাবে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বাটার চেয়ে অ্যাপেক্স ১৮২ কোটি টাকা বা প্রায় ৫১ শতাংশ বেশি ব্যবসা বা আয় করেছে।
বাটার চেয়ে অ্যাপেক্স বেশি ব্যবসা করলেও মুনাফায় শীর্ষে রয়েছে বাটা শু। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বাটা মুনাফা করেছে ৩৭ কোটি টাকা। সেখানে অ্যাপেক্সের মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৯৭ লাখ টাকা। সেই হিসাবে অ্যাপেক্সের চেয়ে ৫১ শতাংশ কম ব্যবসা করেও বাটা শু অ্যাপেক্সের চেয়ে ৩৬ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে। মূলত দুটি কারণে মুনাফায় অ্যাপেক্সকে টপকে গেছে বাটা। তার মধ্যে অন্যতম অ্যাপেক্সের তুলনায় বাটার পণ্য উৎপাদন খরচ ছিল কম। আবার ব্যাংকঋণের সুদ বাবদ খরচও অ্যাপেক্সের তুলনায় অনেক কম ছিল বাটার।
কোম্পানি দুটির গত জানুয়ারি–মার্চের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে সম্প্রতি কোম্পানি দুটি আলাদাভাবে তাদের এই আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বাটা ও অ্যাপেক্সের ব্যবসা ও মুনাফার এই তারতম্য পাওয়া গেছে।
আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ৩৫৮ কোটি টাকার ব্যবসা বা আয়ের বিপরীতে বাটা শুর পণ্য উৎপাদনের পেছনে খরচ হয়েছে ১৯৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ কোম্পানিটির আয়ের ৫৪ শতাংশ অর্থ পণ্য উৎপাদনের পেছনে খরচ হয়েছে। আর জুতা ও অন্যান্য সামগ্রী বিক্রি করে অ্যাপেক্সের ৫৪০ কোটি টাকার আয়ের বিপরীতে উৎপাদন খরচ ছিল ৪১৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ কোম্পানিটির আয়ের ৭৭ শতাংশ অর্থ পণ্য উৎপাদনের পেছনে খরচ করতে হয়েছে। এই তুলনায় দেখা যায়, ১০০ টাকা আয় করতে বাটার উৎপাদন খরচ যেখানে ৫৪ টাকা, সেখানে অ্যাপেক্সে ১০০ টাকার আয়ের বিপরীতে উৎপাদন খরচ ৭৭ টাকা। উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ার কারণে ভালো ব্যবসা করেও বাটার চেয়ে বেশি মুনাফা করতে পারেনি দেশীয় কোম্পানি অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার।
আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জানুয়ারি–মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংকঋণের সুদ বাবদ বাটার খরচ ছিল প্রায় ছয় কোটি টাকা। একই সময়ে এই খাতে অ্যাপেক্সের খরচ ছিল প্রায় ১৫ কোটি টাকা। এই সুদ ব্যয়ও মুনাফার ক্ষেত্রে অ্যাপেক্সকে বাটার চেয়ে পিছিয়ে দিয়েছে।
ভালো ব্যবসা করেও মুনাফায় বাটার চেয়ে পিছিয়ে থাকার কারণ জানতে চাইলে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) দিলীপ কাজুরি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাটার তুলনায় আমাদের উৎপাদন খরচ বেশি। এ কারণে বাটার চেয়ে বেশি ব্যবসা করেও আমরা মুনাফায় পিছিয়ে রয়েছি। বাটা তাদের জুতার বড় অংশ আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করে। এমনকি দেশজুড়ে শোরুমগুলোর কর্মীদের বড় অংশও আউটসোর্সিংয়ে করা হয়। সেখানে আমাদের পণ্য তৈরি হয় নিজস্ব কারখানায়। দেশজুড়ে আমাদের আউটলেটগুলোও পরিচালিত হয় নিজস্ব কর্মী দিয়ে। এ কারণে আমাদের উৎপাদন খরচ বাটার তুলনায় বেশি। আমরা পণ্যের গুণগত মানের সঙ্গে আপস করি না। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে মুদ্রার বিনিময় হারসহ নানা কারণে উৎপাদন খরচ যেভাবে বেড়েছে, সেই তুলনায় পণ্যের দাম খুব বেশি বাড়েনি। এ কারণেও আমাদের উৎপাদন খরচ বেশি পড়ছে।
দেশে জুতার বাজারে বর্তমানে শীর্ষ দুই কোম্পানি অ্যাপেক্স ও বাটা। জুতার বাজারে ব্যবসার ক্ষেত্রে বহুজাতিক বাটাকে অনেক আগেই পেছনে ফেলেছে অ্যাপেক্স; কিন্তু মুনাফায় বাটার চেয়ে পিছিয়ে আছে অ্যাপেক্স। বাটা শু তাদের আর্থিক বছরের হিসাব করে পঞ্জিকা বছরের (জানুয়ারি–ডিসেম্বর) সঙ্গে মিলিয়ে। আর অ্যাপেক্সের আর্থিক বছর হিসাব হয় অর্থবছরের (জুলাই–জুন) সঙ্গে মিলিয়ে। সেই হিসাবে অ্যাপেক্সের সর্বশেষ হিসাব বছর ছিল ২০২৩–২৪ অর্থবছর। ওই বছর কোম্পানিটি ব্যবসা করেছে ১ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকার। তার বিপরীতে হিসাব বছর শেষে কোম্পানিটির কর–পরবর্তী মুনাফা ছিল প্রায় ১৮ কোটি টাকা। আর বাটা শু ২০২৩ সালে সমাপ্ত হিসাব বছরে ব্যবসা করেছে ৯৮৮ কোটি টাকার। তার বিপরীতে বহুজাতিক কোম্পানিটি বছরের শেষে মুনাফা করেছিল ৪০ কোটি টাকা।
কোম্পানি দুটির পুরো বছরের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায়ও দেখা যায়, বাটার চেয়ে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ব্যবসা করেও মুনাফায় পিছিয়ে ছিল অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার। সেটিরও অন্যতম কারণ উৎপাদন খরচে পিছিয়ে থাকা। ২০২৩–২৪ হিসাব বছরে অ্যাপেক্সের ১০০ টাকা আয় করতে পণ্য উৎপাদনের পেছনে খরচ করতে হয়েছে ৭০ টাকা। সেখানে বাটার ১০০ টাকার আয়ের জন্য উৎপাদন খরচ ছিল ৫৪ টাকা।
জানতে চাইলে বাটা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ঈদের কারণে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ভালো ব্যবসা করেছে বাটা। এই সময়ে উৎপাদন সক্ষমতা সর্বোচ্চ মাত্রায় ব্যবহার করা হয়েছে। আবার দর-কষাকষির মাধ্যমে অনুকূল শর্তে কাঁচামাল সংগ্রহ করেছে। সেই সঙ্গে খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এর ফলে প্রথম প্রান্তিকে ভালো মুনাফা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বাটা বাংলাদেশ জানিয়েছে, সাত বছর ধরে চামড়া ও পাদুকা খাতে সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে তারা। ২০২৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি শুল্ক ও কর বাবদ মোট ২৮১ কোটি টাকার বেশি সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বছর র প রথম ত ন ম স অ য প ক স ফ টওয় য র হ স ব বছর র ব পর ত র আর থ ক ১০০ ট ক খরচ ছ ল আম দ র র আয় র ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে সুবাতাস
বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদেশ থেকে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আগের ২০২৩–২৪ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় সাড়ে ৬ বিলিয়ন বা ২৭ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী আয় পাঠিয়েছেন তাঁরা। অন্যদিকে বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে রপ্তানি আয়ে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে ডলার–সংকট কেটে গেছে, বদৌলতে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত বেড়েছে। পাশাপাশি দেশের লেনদেন ভারসাম্যের চিত্রও বদলে গেছে। চলতি হিসাবে বড় ধরনের যে ঘাটতি ছিল, তার অনেকটাই কমে এসেছে, যা স্বস্তি দিচ্ছে বৈদেশিক বাণিজ্যে। এ ছাড়া ডলারের বাজার স্থিতিশীল হওয়ায় আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি আটকে গেছে।
এদিকে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে তথা ব্যাংকগুলোতে ডলার এখন ১২৩ টাকার মধ্যে লেনদেন হচ্ছে। আমদানিতেও ডলারের একই দাম পড়ে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সদ্য সমাপ্ত জুন মাসে প্রায় ২ দশমিক ৮২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। এর মধ্যে শেষ দিনে (৩০ জুন) এসেছে ১১ দশমিক ৩ মিলিয়ন। আগের অর্থবছরের জুনে এসেছিল ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে দেশে সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। দেশের ইতিহাসে এর আগে কোনো অর্থবছরে এত প্রবাসী আয় আসেনি। এই আয় আগের অর্থবছরের ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে ৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার বা ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার।
ডলারের বাজার স্থিতিশীল হওয়ায় আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারেও স্বস্তি ফিরে এসেছে।এদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট, ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক, ভারতের বিধিনিষেধসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্যেও দেশের পণ্য রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় আছে। গত মে মাসে ৪ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) তথ্য দেখা যায়, বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) মোট ৪৪ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি। বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসের মধ্যে ৭ মাসেই ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়।
এদিকে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ডলারের বাজার স্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ ছাড়ের ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরের শেষ দিনে গত সোমবার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ মান অনুযায়ী, রিজার্ভ অবশ্য ২৬ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রবাসী আয়ে উচ্চহারের প্রবৃদ্ধি দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এতে মুদ্রাবাজারে ডলারের ওপর চাপ কমেছে। অবৈধ পথে অর্থ পাঠানোর বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ এবং বৈধ পথে প্রবাসী আয় পাঠানোকে উৎসাহিত করতে নানা প্রণোদনা প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে।
এদিকে ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের লেনদেন ভারসাম্যে উন্নতি ঘটেছে। তাতে চলতি হিসাবের ঘাটতি কমেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ৬ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলার, যা বিদায়ী অর্থবছরের একই সময়ে কমে হয়েছে ১ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে লেনদেনের ভারসাম্যে ৫ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি ছিল, যা বিদায়ী অর্থবছরের একই সময়ে কমে হয়েছে দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, গত কয়েক মাসে বিদেশি সব বকেয়া দেনা পরিশোধ হয়ে গেছে। লেনদেনের ভারসাম্যে উন্নতি হওয়ায় ডলারের ওপর চাপ কেটে গেছে। বাংলাদেশের প্রতি বিদেশি ব্যাংকগুলোর আস্থা ফিরে এসেছে, যা বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে এনে দিয়েছে।