শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৭ বছরের পুরোনো অভিযোগ পুনর্যাচাই
Published: 23rd, May 2025 GMT
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবৈধ সম্পদ অর্জনের ২০০৭ সালের একটি অভিযোগ পুনর্যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ১৭ বছর আগে ২০০৮ সালে অভিযোগটির পরিসমাপ্তি (প্রমাণিত হয়নি) হয়েছিল।
২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার হলফনামা সম্প্রতি খতিয়ে দেখা হলে তাতে সম্পদ নিয়ে অসত্য তথ্য পাওয়া যায়।
এ ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব বরাবর চিঠি দিয়েছে দুদক। দুদক চেয়ারম্যান ড.
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনী হলফনামায় অসত্য তথ্য দেওয়ার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশনকে বলা হয়েছে। হলফনামায় উল্লেখ করা সম্পদ ও তাঁর ২০০৮ সালের আয়কর বিবরণীর সম্পদ যাচাই করা হচ্ছে। অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি দুদকের নিয়মিত কাজের অংশ। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কোনো ইস্যু নেই। নির্বাচনী হলফনামায় দুদকে এমন তথ্য দেওয়া হলে সেটি আইন অনুযায়ী দুদক অনুসন্ধান করে।
ছয় মাস ধরে কাজ করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কোনো চাপ অনুভব করেননি বলে তিনি জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে। দুদকের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা কমিশনে সম্পদ বিবরণী জমা দিয়েছিলেন। পরে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েই অভিযোগ বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় ওই সময়ের কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অভিযোগটির পরিসমাপ্তি করা হয়।
এ ব্যাপারে শেখ হাসিনার আয়কর আইনজীবী তৌফীক নাওয়াজের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি সমকাল।
২০০৭-০৮ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ জমা পড়ে। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও করা হয়েছিল। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নাইকো দুর্নীতি, মিগ-২৯ বিমান ক্রয় দুর্নীতি, বাড়ি সজ্জিতকরণে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করা হয়েছিল। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, বড়পুকুরিয়া, নাইকো, গ্যাটকো দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করা হয়েছিল।
এরপর ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার পর আদালতের রায়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা সব মামলা একে একে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর ২০১৪ সালে দশম, ২০১৮ সালে একাদশ ও ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগই সরকার গঠন করেছিল। এই দীর্ঘ সময়ে খালেদা জিয়ার কোনো মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। এ সময়ে তাঁকে জেল-জুলুমসহ নানা নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের সময় আদালতের রায়ে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার করা হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুদকের মাধ্যমে মামলাগুলো করিয়াছিলেন।
ইসিতে দুদকের চিঠি
ইসিতে পাঠানো দুদকের চিঠিতে শেখ হাসিনা নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় সম্পদ ঘোষণায় অসত্য তথ্য দেওয়ায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর আওতায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। শেখ হাসিনার সম্পদ বিবরণী দুদকে দাখিল করা হয়।
ওই সম্পদ বিবরণী যাচাইকালে দেখা যায়, তিনি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে হলফনামার মাধ্যমে দাখিল করা পরিসম্পদ ও দায়ের বিবরণীতে তাঁর নিজ নামে অর্জিত কৃষিজমির পরিমাণ ৬.৫০ একর উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে ক্রয় করা জমির অর্জনকালীন আর্থিক মূল্য দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। সমসাময়িক সময়ে তাঁর দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণী যাচাইকালে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী শেখ হাসিনার নিজ নামে অর্জিত ২৮.৪১ একর জমির তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে তাঁর ক্রয় করা জমির মূল্য ৩৩ লাখ ৬৬ হাজার ১০ টাকা। সে অনুযায়ী তিনি হলফনামায় ২১.৯১ একর জমির তথ্য গোপন করেছেন এবং ক্রয় করা জমির মূল্য ৩১ লাখ ৯১ হাজার ১০ টাকা কম দেখানোর মাধ্যমে হলফনামায় অসত্য তথ্য দিয়েছেন।
চিঠিতে আরও বলা হয়, শেখ হাসিনা মাগুরা-১ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য ডা. মোহাম্মদ সিরাজুল আকবরের সংসদ সদস্যপদের শুল্কমুক্ত কোটা ব্যবহার করে বেনামে ২ লাখ ৩০ হাজার ইউরো মূল্যে গাড়ি আমদানির এলসির বিপরীতে ব্যাংক থেকে পরিশোধিত মোট ১ কোটি ৯৩ লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্যের একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি আমদানি করেন। নিজ আবাসিক ঠিকানা ‘সুধা সদন’, বাড়ি নম্বর-৫৪, রোড নম্বর-৫, ধানমন্ডি, আবাসিক এলাকা, ঢাকার ঠিকানা ব্যবহার করে গাড়িটি রেজিস্ট্রেশন (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-৬৩৬৪) করেন। নিজে তা ব্যবহার করেছেন। ডা. মোহাম্মদ সিরাজুল আকবরের আয়কর নথিতে কিংবা নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা তাঁর হলফনামায় গাড়িটির বিষয়ে কোনো তথ্য উল্লেখ করেননি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: হলফন ম য় ২০০৮ স ল দ খ ল কর সরক র র ব যবস থ অন য য় হ র কর হয় ছ ল
এছাড়াও পড়ুন:
শ্বাসমূল
তখন সকাল।
তাড়াহুড়ো করে শহরের লোকজন বেরোচ্ছে। জ্যামের শহরে পাঞ্চ মেশিনের ভয় সবার মনেই। এক–দুই মিনিট এদিক–ওদিক হলেই মাস শেষে স্যালারি কাটবে। এমনিতেই সংসার চালানো উচ্চতর গণিতের মতো কঠিন হয়ে যাচ্ছে দিন দিন, তার মাঝে যদি বেতনটেতন কাটে, উপায় নেই আর। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে বাসে ওঠে শিকদার আলী। গোলাপি রঙের বাস।
জানালার পাশের সিট পেলে নিজেকে দারুণ ভাগ্যবান মনে হয়। না, এই শহরে জানালার পাশে বসলে এমন কোনো ভিউ পাওয়া যায় না। সুবিধা একটাই, দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের কনুইয়ের গুঁতো খাওয়া থেকে মুক্তি। বাস রিকশার মতো চলতে থাকে, যাত্রীরা কন্ডাক্টরকে গালিগালাজ করতে থাকে, ড্রাইভার যেখানে খুশি বাস থামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে—এই সব চিরচেনা দৃশ্যের মধ্য দিয়েও একটা দৃশ্যে চোখ আটকে যায় শিকদার সাহবের।
একজন মেয়ে, বয়স কত হবে, ১৫-১৬, রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর পিঠে একটা বড় ব্যাকপ্যাক, ব্যাকপ্যাকের সাথে বাঁধা একটা তাঁবু।
এক মুহূর্তের দেখা। কিন্তু শিকদার সাহেবের মাথায় তা গেঁথে গেল একেবারে।
পুরো রাস্তা যেতে যেতে তার মাথায় এটাই ঘুরতে থাকে। ব্যাকপ্যাক। তাঁবু। পাহাড়। বান্দরবানের কথা মাথায় আসে। ক্যাম্পাসে থাকতে কতবার গিয়েছেন বান্দরবানে। সময় পেলেই। হাতে টাকা নেই, তা–ও। বান্দরবান গেলেই মনে হতো, এই জায়গায় সবকিছু চেনা। জাতিস্মরের মতো। আগের জন্ম যেন এখানেই হয়েছিল। ঘুরে বেড়াতেন এ পাহাড় থেকে সে পাহাড়। আহা রে! বিয়ের পর জীবন থেকে যেন ঘোরাঘুরি মুছেই গেল। বাদুড়গুহা নামে একটা পাথুরে গুহার খোঁজ দিয়েছিল স্থানীয় এক দোকানি। কত শখ ছিল একদিন যাবেন সেখানে। সারা রাত তাঁবু করে থাকবেন বাদুড়গুহার পাশে। সে আর হলো কই! জীবনের ঘানি মনে হয় এটাকেই বলে। চোখের পলকে যেন ১৭ বছর কেটে গেছে। এই ১৭ বছরে জীবনের সফলতা মনে হয় একটাই—মানুষ থেকে একটু একটু করে ডানাগুলো কেটে রোবট হয়ে উঠেছেন। পাহাড়ের আনাচে–কানাচে হাঁটাহাঁটি, ঝিরিপথের নৈঃশব্দ্য, পাতায় পাতায় ঘষা খাওয়ার সংগীত, পাহাড়ি নদী, তাঁবুতে থাকা। জীবন তো ছিল তখনই, এখন তো শুধু বেঁচে থাকার অভিনয়।
এই সব ভাবতে ভাবতে শিকদার সাহেব দেখেন, চলে এসেছেন আরামবাগ। নামার কথা পান্থপথ। বাস সেই কখন পান্থপথ ছেড়ে চলে এসেছে মতিঝিলের আরামবাগ, টেরও পাননি তিনি। মানুষ বড় আশ্চর্য প্রাণী, তার মতিগতি বোঝা দায়। সব সময়ের ঠান্ডা মাথার শিকদার সাহেব নইলে কি আর আজ অফিসের মিটিং ফেলে আরামবাগ চলে আসেন?
বাস থেকে নেমে দীর্ঘ ১০ বছর পর একটি সিগারেট ধরালেন তিনি। লাল বেনসন। শুরুতে ধোঁয়ার ধাক্কাটা বেশ কড়া লাগে। এত দিন পর ধোঁয়া ঢুকেছে শরীরে। তবু তিনি পুরো সিগারেট শেষ করেন। মাথার ভেতরে কিছু একটা হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। যন্ত্র হলে জাংক ফাইল ডিলিট করে দিলেই মনে হয় হতো। আহা রে মানুষ, না হতে পারে যন্ত্র, না হতে পারে মানুষ!
সিগারেট শেষ করে শিকদার সাহেব পাশের কাউন্টার থেকে একটি টিকিট কিনে ফেলেন। ঢাকা টু বান্দরবান। এগারো শ টাকা। ঠিক উনিশ মিনিট পর, ২০২৫ সালের ১০ এপ্রিল শিকদার সাহেবের যাত্রা শুরু হয় বান্দরবানের উদ্দেশে, সিট নাম্বার এফ টু। এই কাজটা কেন করলেন, কীভাবে করলেন এর কোনো উত্তর তার কাছে মনে হয় নেই। সব উত্তর কি আর নিজের কাছে থাকে সব সময়?
২.দিনের বেলা সারা দিন কাটে মিটিংয়ে অফিসের নানাবিধ কাজকামের মধ্যে। এক কাপ কফি খাওয়ার সময়ও মাঝেমধ্যে পাওয়া যায় না। বহুদিন পর শিকদার সাহেব যেন একটা ঈদের ছুটির ঘুম দিলেন বাসে। বাস চট্টগ্রামে থামে, যাত্রীরা নেমে খাওয়াদাওয়া করে। সেখানেও শিকদার সাহেব নামলেন না। ঘুম যেন বিরক্ত না হয়। যখনই চোখ খোলেন, দেখেন শাঁই শাঁই করে বাস ছুটে যাচ্ছে। ঠিক যেন স্টুডেন্ট লাইফের মতো। সঙ্গে আরও সাত–আটজন বন্ধুবান্ধব আছে। নেমেই নাশতা করে উঠে যেতে হবে বান্দরবানের লোকাল বাসে, বাসে করে সরাসরি থানচি। থানচি থেকে বোট ছাড়ে, বোটে করে রেমাক্রি। আহা রেমাক্রি, মনে পড়তেই চোখ ভিজে যায়। কী এক জায়গা! সেখান থেকে ট্র্যাকিং করে নাফাখুম, আমিয়াখুম। কিংবা বগা লেক হয়ে কেওক্রাডংয়ের চূড়া। এখন নাকি পিচঢালা রাস্তা হয়ে গেছে, কেওক্রাডংয়ে উঠতে ট্র্যাকিং করতে হয় না। একসময়ের শীর্ষ চূড়া কেওক্রাডং, বেচারার অবস্থা ভেবে মায়াই লাগে। আটজনের একটা টিম আস্তেধীরে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছে ট্র্যাকিং করে, এর সঙ্গে কি কারও তুলনা হয়! শিকদার সাহেবের হঠাৎ মনে হয়, তিনি একজন পাহাড়প্রেমী মানুষ। এত দিন টের পাননি।
বান্দরবান নেমে বেশ অবাকই লাগে। বাসস্ট্যান্ড থেকে নেমে চারপাশ দেখেন। তার কাছে মনে হয়, কিছুই পরিবর্তন হয়নি। যা ছিল, তা–ই আছে। ভালোই লাগে। চেঞ্জ না হলেই তো ভালো। এখান থেকে যেতে হবে থানচি। বাদুড়গুহা ওদিকেই। একটা রিকশা নিয়ে একটানে চলে যান রাজার মাঠ। খুব প্রিয় এক চায়ের দোকান ছিল এখানে, এখনো আছে কি না, কে জানে। গিয়ে তার আরও বেশি অবাক লাগে, দোকান তো আছেই, একেবারে যেমন ছিল তেমনই আছে। এমনকি দোকানিও যেমন দেখতে ছিলেন, তেমনই আছেন। কে জানে, আদিবাসীদের বয়স হয়তো কমই বাড়ে। তাই বলে, এত দিনেও, মানে সতেরো বছরেও তার চেহারার বিশেষ পরিবর্তন হবে না? কী আজব!
বাড়িতে এতক্ষণে একবার কল করার জন্য মনে হয় শিকদার সাহেবের। পকেটে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন, ফোন নেই। বাসের সিটেই মনে হয় রেখে চলে এসেছেন। কাউন্টারে গিয়ে কথা বলা দরকার। পর মুহূর্তেই আবার মনে হয়, দরকার নেই। ফোন ছাড়াই ভালো। কিছু জানানোরও দরকার নেই। যা হওয়ার হবে। কোনো চাপও লাগে না তার। এই দুনিয়া, জগৎ সংসার নিয়ে অনেক চাপ নিছেন, আর না। দোকানে আরেক কাপ চা দিতে বলেন তিনি।
ততক্ষণে সন্ধ্যা।
৩.রাতটা কাটিয়েছেন রাজার মাঠের পাশে যে বৌদ্ধবিহারটা আছে, তার এক গেস্টরুমে। একবার এখানে ছিলেন। মাত্র ছয় শ টাকা রুম ভাড়া। একটামাত্র খাট, পাশেই জানালা। জানালা দিয়ে একটা কৃষ্ণচূড়াগাছ দেখা যায়। সতেরো বছরেও ছয় শ টাকার ভাড়া যা ছিল তাই আছে, এটা দেখেই আবারও অবাক লাগে। এত বদলে যাওয়ার তাড়া নেই এখানে। জীবনও খানিক স্লো। ভালো। খুব ভালো। রাতে পেট ভরে খেয়েছেন। ভাত, পাহাড়ি মোরগ আর পাতলা ডাল। নিজের মাঝে ভীষণ রকমের তৃপ্তি খুঁজে পান তিনি, যেন বহুদিন পর প্রাণভরে শ্বাস নিচ্ছেন। এসি রুমে নয়, ঢাকার বাসে নয়, অফিসের মিটিং রুমে নয়, যেখানে তার ভালো লাগে, সেখানে শ্বাস নিচ্ছেন তিনি।
পরদিন রুমা বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে উঠে পড়েছেন। গন্তব্য থানচি। শিমিয়ান নামের একজন গাইড ছিলেন, যে বাদুড়গুহা চেনে। তার সঙ্গে যাওয়া দরকার। যোগাযোগই তো নেই। বেঁচে আছে কি না, কে জানে। ফোন থাকলে ফেসবুকে একবার দেখা যেত। এটাও খারাপ না। ফোনও নেই, যোগাযোগও নেই। ফোন সঙ্গে না থাকলেই নিজেরে কেমন জানি স্বাধীন স্বাধীন লাগে। খুব উপভোগ করার মতো বিষয়টা। এই প্রথম ফোন হারিয়ে প্রচণ্ড আনন্দ লাগল তার।
সে এক বাস! কত রকম মানুষ। বাঙালি আদিবাসী সবাই আছে। শিকদার সাহেবই একমাত্র, যার সঙ্গে কিছু নেই। সবার সঙ্গেই বড় বড় ব্যাগ, নয়তো বস্তা। মেমোরি লেনে হাঁটতে হাঁটতে শিকদার সাহেবের মাথায় একে একে চলে আসে অসংখ্য স্টিল পিকচার—ক্যাম্পাসের সেকেন্ড ইয়ারের প্রেম, দেবতা পাহাড়ে জীবনের প্রথম চুমু, এলাচি মদ খেয়ে গাছের নিচেই ঘুমিয়ে পড়া, হঠাৎ আবিষ্কার করা কোনো ঝরনা—একেক জায়গায় একেক রকম স্মৃতির আখড়া যেন। মাঝেমধ্যে মনে হয়, একটু বাড়াবাড়িই যেন হচ্ছে। স্ত্রীকে নিয়ে আরও পাঁচটি দেশ ঘুরেছেন, কত সুন্দর সুন্দর হোটেলে থাকা হয়েছে। বালি কিংবা কলোম্বোর সঙ্গে তুলনা করলে বান্দরবান তো কিছুই নয়, তাহলে এত কেন ইমোশনাল হয়ে উঠছেন? নিজেই নিজের সঙ্গে তখন ডিবেট চলে, মনে হয় লজিক খাটে না সব জায়গায়। অথবা লাইফের প্রথম ওয়াইল্ড অ্যাডভেঞ্চারের সুখস্মৃতি, সে জন্যই হয়তো এত স্পেশাল। আবার কখনো মনে হয়, শহর থেকে এই এক্সিট রুট পেয়েই হয়তো এত ভালো লাগছে। এ যেন নিজেকে আবিষ্কার করার মতো সুখ! এই সব ভাবতে ভাবতেই থানচি এসে পৌঁছায় বাস। এখানেও ভাড়া সেই আগেরটাই, ১২০ টাকা মাত্র। পকেটে ক্যাশ খুব বেশি নেই, কার্ড থেকে টাকা তুলতে হবে। এদিকে তো এটিএম বুথও নেই, বান্দরবান শহর থেকে টাকা তুলে আনলে ভালো হতো। ধুর, যা হওয়ার হবে, এত চিন্তা করার সময় নেই আপাতত। এ ভেবেও অবাক লাগে, ফেলে আসা স্ত্রী-সন্তান, কারও কথাই একবারের জন্যও মাথায় আসছে না!
থানচি বাজারে গিয়ে শিমিয়ানের খোঁজ নিতে হলো। জানা গেল, শিমিয়ান গ্রুপ নিয়ে ট্র্যাকিংয়ে গেছে তিন দিন আগে। ফিরতে ফিরতে আরও দুদিন। অন্য কাউকে নিয়েই যেতে হবে। তাতেও কোনো সমস্যা নেই। চিনলেই হলো। গায়ে স্যুট ছিল, সেটা ফেলে এসেছেন ঢাকার বাসেই। থানচি বাজারে একটা শিঙাড়া দোকান ছিল, বড় বড় শিঙাড়া তৈরি করত। কত দিন আগে এসেছেন, এখনো মনে হয় সব পথ চেনা। সোজা সে রাস্তায় গিয়ে শিঙাড়ার দোকানটা পাওয়া গেল। দুধ, চিনি বেশি দিয়ে এক কাপ চা আর তিনটা শিঙাড়া নিয়ে বসলেন শিকদার সাহেব। এবার প্ল্যান করতে হবে বাদুড়গুহার। এক কাপ চা আর তিনটি শিঙাড়ার দাম নিল বিশ টাকা—এখনো সেই আগের দাম, অবাকই লাগে তার।
জয় নামে একজন গাইড পাওয়া গেল। কিন্তু জয় জানাল, বাদুড়গুহা একটা আছে, সেটা রোয়াংছড়িতে। শিকদার সাহেব যখন শিমিয়ানের কথা বললেন, তখন জয় সঙ্গে সঙ্গে হেসে বলে, আচ্ছা শিমিয়ানের বাদুড়গুহা এদিকেই।
মানে?—অবাক হয় শিকদার।
জয় জানায়, শিমিয়ান এদিক–সেদিক নিজে নিজেই ঘুরে বেড়ায় ছোটবেলা থেকে। সে এদিকে একটা গুহা আবিষ্কার করেছে, যার নাম সে দিয়েছে বাদুড়গুহা। এখন পর্যন্ত খুব মানুষই গেছে সেখানে।
শিকদার মুচকি হাসে। আহা জীবন। এই জীবন কোথায় ছিল এত দিন?
৪.শিকদার আর জয়, সঙ্গে একজন মাঝি। ট্রলার নৌকা। পাহাড়ি সাঙ্গু নদীর মাঝ দিয়ে ছুটে চলে সে নৌকা। কত রকম কথা পাল তোলে জয়ের সঙ্গে। জয় জানায়, সে একদিন একটা ট্রলার বোট কিনবে। তারপর নিজেই চালাবে। এখন অনেক ট্যুরিস্ট আসে, ব্যবসা খারাপ হবে না। শিকদার বলে তার শহুরে জীবনের কথা। শুধু বলে না সে কীভাবে অফিসে যেতে গিয়ে চলে এল এখানে।
এখনো বাসভাড়া একই, এটা তার খুব অবাক লাগে। এমনকি শিঙাড়ার দাম।
জয় হেসে বলে, শিঙাড়ার দোকানই তো হইছে এক মাস আগে, দাম বাড়াবে কী।
শিকদার বলে, না, আমি অনেক আগে যখন আসছিলাম, এখানে শিঙাড়া খেতাম, এখন মনে হয় তাহলে অন্য লোক চালায়।
জয় মাথা নাড়ে। বলে, এখানে আগে দোকান ছিল না। বিল্লাল নামের এক লোক এখানে গত মাসে শিঙাড়ার দোকান দিসে।
শিকদার কথা বাড়ায় না। জয় মনে হয় জানে না।
আসে শিমিয়ানের কথাও। শিমিয়ানের এক ছেলে ছিল, ক্লাস ফোরে পড়ত। এখন কী অবস্থা।
জয় আবারও হেসে বলে, জয়ের ছেলে ক্লাস ফোরেই পড়ে। এক ছেলে তার।
শিকদার আবারও চুপ হয়ে যায়। এত দিনে শিমিয়ানের ছেলে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ফেলার কথা, যদি পড়াশোনা করে আরকি। কোন শিমিয়ানের কথা বলছে জয়, কে জানে।
নৌকা এগিয়ে চলে আস্তে আস্তে। পানি এখন কম নদীতে, মাঝে মাঝে নদীতে নেমে ধাক্কা দিতে হয়। শিকদার নিজেও নেমে পড়ে। ধাক্কা দেয়। ঠিক আগের মতো। শুধু তার মনে হয়, তার সঙ্গের বাকিদের সে দেখতে পাচ্ছে, তারা সবাই বোটেই আছে। কারও মুখে সিগারেট, কারও মুখে গান।
জয় একসময় জানায় তার নিজের কথা। জানায় তার ভবিষ্যৎ স্বপ্নের কথা। কথায় কথায় জানায়, থানচির বিখ্যাত ফুটবলার জয়া মারমার কথা। জয়ের মেয়ে বড় হলে তাকেও সে জয়া মারমার মতো ফুটবলার বানাবে।
এই মুহূর্তে এসে থেমে যায় শিকদার। জয়া মারমা রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে আজ তিন বছর হলো, জয় কি সেটা জানে না? না জানার তো কোনো কারণ নেই! কিছু একটা খেলে যায় শিকদারের মাথায়। দশ বছর আগের বাসভাড়া, আগের মতো দেখতে আশপাশের সব, বিল্লালের শিঙাড়া দোকান গত মাসে শুরু করা—সব মিলিয়ে শিকদারের হিসাব মেলে না। সে গিয়ে দাঁড়ায় মাঝির পাশে। মাঝিকে জিজ্ঞেস করে, ‘নৌকা কবে নিসেন?’
মাঝি দূরের পানে তাকিয়ে বলে, এই তো, ‘তিন বছর হইব সামনের আগস্টে।’
শিকদার আবার জিজ্ঞেস করে, ‘তাহলে, কত সালে নিসিলেন?’
মাঝি একটু হিসাব করে জানায়, ‘২০০৫–এর আগস্টে।’
শিকদারের মাথায় এবার সব হিসাব যেন মিলে যায়। শিঙাড়ার দোকান গত মাসে দিসে, সেটাই তো সে জানত, ২০০৮–এ বিল্লাল শিঙাড়ার দোকান শুরু করেছে। তখন বাসভাড়া এতই ছিল। শিমিয়ানের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ২০০৮–এ, তখন তার ছেলে ক্লাস ফোরে পড়ত। শিকদার কোনোভাবে আগের সেদিন ভাবতে ভাবতে ২০০৮-এ এসে পড়েছে। এখানের সবকিছু ২০০৮–এ আটকে আছে, নাকি শিকদার নিজেই ২০০৮–এ আটকে গেছে?
শিকদার আস্তে করে মাঝিকে জিজ্ঞেস করে, ‘আজকে কত সালের কত তারিখ ভাই?’
মাঝি একটু বিরক্তই হয়। তাকে কেউ মনে হয় কখনো তারিখ জিজ্ঞেস করে না, সাল জিজ্ঞেস করার তো প্রশ্নই আসে না। সে বিরক্তি না লুকিয়েই উত্তর দেয়, এপ্রিলের ১২। সাল ২০০৮।
মাথায় একটা চক্কর খায় শিকদার। সেই সঙ্গেই নৌকাটা ধাক্কা খায় একটা পাথরে। দাঁড়ানো অবস্থা থেকে পড়ে যায় শিকদার। সে দেখতে পায়, সাঙ্গুর পাথর কেমন মিলিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। ধোঁয়ার মতো হারিয়ে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে বাতাসে। বাতাসে মিশে যেতে যেতে চিরপরিচিত একটা কিছুর মতো হয়ে যাচ্ছে পাথরগুলো। প্রতিদিনের দেখা দৃশ্যের মতো।
৫.পান্থপথ।
বাসের জানালা দিয়ে তাকিয়েই হঠাৎ শিকদার দেখতে পান, পান্থপথ চলে এসেছে।
পকেটে ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে। শিকদার ফোন বের করেন পকেট থেকে। কোনো এক রিয়েল এস্টেট কোম্পানি স্বপ্নের ফ্ল্যাট কেনার মেসেজ পাঠিয়েছে।
ঘামে ভিজে গেছে পুরো শরীর।
শিকদার সাহেব আস্তে করে উঠে দাঁড়ান। বাস থেকে নামতে হবে। নেমে রিকশা দিয়ে ১৫ মিনিট গেলেই অফিস।
আজকে আবার অফিসে মিটিং।