কানের ঝকঝকে নীল আকাশ। একদিন আগেও এই আকাশ ছিল মেঘলা। অথচ শুক্রবারের আকাশ একেবারে নির্মল। আকাশের এই নীলাভ নীল যেন কান সাগরে আছড়ে পড়ছে। এই সাগরের তীর ঘেঁষেই পালে দ্য ফেস্টিভ্যাল ভবন। যে ভবনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্ব সিনেমার অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ আসর কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৮তম আসর। ভবনের পাশেই ক্লৌডে ডেবাসি থিয়েটার। ফরাসি বিখ্যাত সুরকারের নামেই এই থিয়েটার। উৎসবের এই সময়টায় এটি সিনেমাপ্রেমীদের আনাগোনায় মুখর থাকে। পুরো সিঁড়ি থাকে লালগালিচা বিছানো। যারা এই হলে প্রদর্শিত সিনেমা দেখতে আসেন, তারা এই লালগালিচায় হেঁটেই থিয়েটারে প্রবেশ করেন। এ সময় দর্শনার্থীরা একটু হলেও গালিচার ওপর থমকে দাঁড়ান। ছবি তোলেন। সেই ছবি ছড়িয়ে দেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
এই ডেবাসি থিয়েটারই গতকাল স্থানীয় সময় বেলা ১১টায় হয়ে উঠল বাংলাদেশময়। এখানেই প্রদর্শিত হলো প্রথমবারের মতো কান চলচ্চিত্র উৎসবের স্বল্পদৈর্ঘ্য শাখার প্রতিযোগিতা বিভাগে অংশ নেওয়া সিনেমা ‘আলী’। প্রদর্শনী শেষে যখন মাইক্রোফোনে সিনেমাটির পরিচালক আদনান আল রাজীবের নাম ঘোষণা করে মঞ্চে ডাকা হলো, তখনই পুরো হল যেন উল্লাসে ফেটে পড়ে। আর এরই সঙ্গে ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বলে অক্ষরে লেখা হয়ে গেল বাংলাদেশের নতুন এক অধ্যায়।
রাজীব গিয়ে দাঁড়ালেন উৎসব পরিচালক থিঁয়েরির পাশে। হাসিমুখে হাত মেলানোর পরই মাইক্রোফোন নিয়ে ছলছল চোখে সবার দিকে তাকালেন বাংলাদেশের এই পরিচালক। সবার অভিবাদন গ্রহণ করে নির্মাতা বলেন, এটা শুধু আমার একক যাত্রা নয়। এটা সবার গল্প– যারা স্বপ্ন দেখে, প্রতিবাদ করে, নিজের ভাষায় কথা বলতে শেখে। আমাদের আলী বাংলাদেশের, পুরো বিশ্বের। আপনাদের ভালোবাসার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।
এ সময় রাজীব আরও বলেন, আলী শুধু একটি সিনেমা নয়, এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও মানবিক অভিব্যক্তির এক চিত্রপট, যা আজ কান উৎসবে দর্শক-সমালোচকদের চোখে চমকজাগানো বাস্তবতার মুখ তুলে ধরেছে।
স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রতিযোগিতা বিভাগে এটি বাংলাদেশের প্রথম অংশগ্রহণ, যা ইতোমধ্যে জাতির জন্য এক ঐতিহাসিক গর্ব। ‘আলী’ পুরস্কার জিতবে কিনা, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে আজকের এই মুহূর্ত, কান উৎসবের বিশাল পর্দায় ভেসে ওঠা আলীর চোখ, তার কণ্ঠে উচ্চারিত গান এবং তার যন্ত্রণার ছায়া– এ সবই বলছে, বাংলাদেশের একখণ্ড চেতনা।
সিনেমাটিতে ‘আলী’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন আল আমীন। গতকালের প্রদর্শনীতে হাজির ছিলেন তিনিও। তারও চোখেমুখে সাফল্যের আভা। দৃঢ়চিত্তে তিনি জানালেন, আমাদের সিনেমা সেরা হবে। কানে আমরা বাংলাদেশের বিজয়ের পতাকা ওড়াব।
এদিকে আজ পর্দা নামছে উৎসবের। বাংলাদেশের দর্শকরা হয়তো রাতের মধ্যেই জেনে যাবেন কান চলচ্চিত্র উৎসবে কার হাতে সেরার খেতাব জুটছে।
কান উৎসবের অফিসিয়াল সাইটে ‘আলী’র গল্প নিয়ে বলা হয়েছে, উপকূলীয় একটি শহরের গল্প, যেখানে নারীদের গান গাইতে দেওয়া হয় না। সেখানে এক কিশোর গানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে উপকূল ছেড়ে শহরে যেতে চায়। এই গান গাওয়া নিয়েই রয়েছে এক রহস্য।
কানের অফিসিয়াল সিলেকশনের স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা বিভাগে দেশের কোনো সিনেমার তালিকাবদ্ধ হওয়া এটাই প্রথম। সর্বশেষ ২০২১ সালে আঁ সার্তে রিগা বিভাগে সিনেমা ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ প্রদর্শিত হয়েছিল। গত ১৩ মে পালে দ্য ফেস্টিভ্যালে শুরু হয়েছে ৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসব। এবারের উৎসবে বিশ্বের খ্যাতনামা অভিনেত্রী, গায়িকা ও মডেলরা বাহারি পোশাকে হেঁটেছেন। এবারের আসরে মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত হয়েছে ২২টি চলচ্চিত্র।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: চলচ চ ত র উৎসব ক ন চলচ চ ত র উৎসব প রদর শ ন উৎসব উৎসব র
এছাড়াও পড়ুন:
১১ বছর পেরিয়ে গেলেও দগদগে ব্রাজিলের সেই ক্ষত
হেক্সা জয়ের বড় স্বপ্ন নিয়ে ২০১৪ সালে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল ব্রাজিল। তবে সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে স্বাগতিকরা আটকে যায় সেমিতেই। সেবার বেলো হরিজেন্তের মিনেইরো স্টেডিয়াম সেমিফাইনালে জার্মানি গুণে গুণে ৭ বার বল ঢুকিয়েছিল ব্রাজিলের জালে। যা ফুটবল সমর্থকদের কাছে ‘সেভেন আপ’ নামে পরিচিত। ৮ জুলাই ২০১৪, এই তারিখটা দগদগে ক্ষত হয়ে থাকবে ব্রাজিলের ফুটবলে। সেই ম্যাচের ১১ বছর পূর্তি হল আজ। প্রতি বছর এ দিনটা এলেই দগদগে হয়ে ভেসে ওঠে ভয়াবহ সে স্মৃতি। ৭ শব্দটাই একটা ট্রমাতে পরিণত হয় ব্রাজিলের জন্য।
সেদিনের সেই ম্যাচের আগে ব্রাজিলের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডির নাম ছিল মারাকানাজো। ১৯৫০ সালের সেই বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচে শুধু ড্র হলেই চলত ব্রাজিলের। এমন উপলক্ষ্যে দুই লাখ দর্শক হাজির হয়েছিলেন মাঠে। কিন্তু উৎসবের সেই ম্যাচ বিষাদে পরিণত হয় উরুগুয়ের বিপক্ষে ব্রাজিলের ২-১ গোলের হারে। লাখো জনতার স্রোতে থেমে যায় সাম্বার উৎসব। ওই ট্রাজেডির ৬৪ বছর পর মিনেইরো স্টেডিয়ামের সেই বিপর্যয়ের পর থেকেই তুলনা চলে, মারাকানাজো নাকি মিনেইরাজো- বিপর্যয়ের মাত্রা বেশি কোনটিতে।
বিশ্ব ফুটবলে সবচেয়ে সফল দল ব্রাজিল, কিন্তু ব্রাজিলিয়ানরাও জানেন এই ইতিহাস আর পাল্টানো যাবে না। যতবার বিশ্বকাপ দরজায় কড়া নাড়বে ততোবার ঘুরে ফিরে আসবে ওই গল্প। সেই দিনের হারার যন্ত্রণাময় মুহূর্ত নিশ্চয়ই এখনও বেশ মনে লেগে আছে বহু সেলেসাও সমর্থকের হৃদয়ে। মিনেইরাজোর সেই ট্রমা ব্রাজিলের প্রাণভোমরা নেইমারও ভুলতে পারেননি।
২০২২ কাতার বিশ্বকাপের আগে এক সাক্ষাৎকারে নেইমার জানিয়েছিলেন, ‘আমি বলবো না সেটা (ঘরের মাঠে জার্মানির বিপক্ষে ৭-১ গোলে হার) আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে মুহুর্ত। তবে এটি অবশ্যই সবচেয়ে কঠিন মুহুর্তগুলির মধ্যে একটি ছিল। আমার প্রথম বিশ্বকাপ, আমার নিজের দেশে, তাই আমি খুব জিততে চেয়েছিলাম।’
ব্রাজিলের সে সময়ের তারকা স্ট্রাইকার ফ্রেডের বাড়ি ছিল হরিজেন্তেই। জার্মানির কাছে ওমন বিধ্বস্ত হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, ‘ম্যাচ শেষ হওয়ার পর আমি একটা গর্তে লুকিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। যেখান থেকে আর কখনোই ফিরে আসতে হবে না।’
সে ট্রাজেডির অনেক পরে সংবাদমাধ্যমে এই নিয়ে কথা বলেছেন ব্রাজিলের গোলরক্ষক হুলিও সিজার। যাকে ফাঁকি দিয়েই জার্মানরা একে একে সাতবার বল জড়িয়েছিল জালে। সিজার বলেছিলেন, ‘এখনো যখন আমি শুয়ে থাকি, ম্যাচটি নিয়ে চিন্তা করি। আমি কল্পনা করি সেই দিনটির কথা, বহু বছর পর যেদিন সংবাদমাধ্যমে ঘোষণা হবে- হুলিও সিজার, ৭ গোল খাওয়া গোলরক্ষক মারা গেছেন।’
সেলেসাওদের তখনকার কোচ ছিলেন ব্রাজিলের ২০০২ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক লুইস ফিলিপ স্কলারি। তিনি বলেছিলেন, ‘এটা আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিন। আমি সম্পূর্ণ দায় নিচ্ছি।’ ম্যাচ শেষে কাঁদতে কাঁদতে জাতির উদ্দেশে ক্ষমাও চেয়েছিলেন অধিনায়ক ডেভিড লুইজ।
ব্রাজিলিয়ান দৈনিক গ্লোবো ম্যাচটার স্মৃতি নিয়ে মুখোমুখি হয়েছিল তখনকার জার্মান কোচ জোয়াকিম লো। তাদের দেওয়া সাক্ষাৎকারে এখনও ম্যাচের স্মৃতি তরতাজা জোয়াকিমের, ‘ঘরের মাঠে সেমিফাইনাল খেলাটা সবসময় চাপের। ব্রাজিলও সেই চাপে ছিল। আমি সেই বিশ্বকাপের কথা প্রতিদিনই স্মরণ করি, কারণ এটা বিশেষ অভিজ্ঞতা ছিল। ব্রাজিলের মতো ঐতিহ্যবাহী দেশে বিশ্বকাপ জেতাটা বিশেষ কিছু।’
মারাকানায় ব্রাজিলকে ৭-১ গোলে হারানো নিয়ে জোয়াকিম বলেন, ‘ব্রাজিলের জাতীয় সঙ্গীত বাজার পর থেকে দর্শকরা আবেগী হয়ে পড়েছিল। প্রথম কয়েক মিনিট ব্রাজিলই ভালো খেলেছে। কিন্তু প্রথম ১০ মিনিটে গোল পেয়ে গেলাম আমরা (১১ মিনিটে করেছিলেন মুলার)। এটা আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়।’
সেই ম্যাচে দুর্দান্ত খেলেন জার্মানির ক্লোসা, মুলার, ক্রুস এবং ওজিল। সবাই মিলে গোল উৎসবে মেতে উঠেছিলেন। জার্মানির সেই বিজয়ী দলের খেলোয়াড় ম্যাটস হামেলস পরে জানিয়েছিলেন, তারা ইচ্ছা করেই বিরতির পর আর কোনো জাদুকরি খেলা খেলতে চাননি। তারা শুধু চেয়েছিলেন ম্যাচটি শেষ করতে। ম্যাটস হামেলস বলেন, আমরা শুধু চেয়েছি খেলায় মনোযোগী থাকতে। খেলার মধ্যে সেলেসাওদের কোনোভাবেই অপমান করতে চাইনি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, খেলার মধ্যে সিরিয়াস থাকতে হবে। তবে ব্রাজিলকে অপমান করা হয়, এমন কিছু থেকে বিরত থাকব। খেলার মধ্যে জয়-পরাজয় থাকবেই। তবে প্রতিপক্ষকে সম্মান দেখাতে হবে। আমরা সে কাজ করেছি। দ্বিতীয়ার্ধের পর আমরা কোনো জাদুকরি খেলা দেখাইনি।
যদিও পরবর্তীতে ম্যাটস হামেলসের এমন কথা উড়িয়ে দিয়েছেন জার্মান কোচ জোয়াকিম। তার কথায়, ‘এটা বাজে কথা। বরং আমি মনে করিয়ে দিয়েছিলাম বাছাইপর্বে সুইডেনের কাছে শুরুতে ৪ গোল দিয়ে শেষ ৩০ মিনিট ৪ গোল হজম করার কথা। ফুটবলে যে কোনও কিছু ঘটতে পারে। তবে খারাপ লাগছিল ব্রাজিলের জন্য। কারণ এর আগে ঘরের মাঠে ২০০৬ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে এভাবে বাদ পড়ার বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমাদেরও। নিজেদের দলের জন্য গর্ব হলেও ব্রাজিলের জন্য খারাপ লাগছিল আমার।’
সেই হারের ১১ বছর পরও বড় কোনো শিরোপা জিততে পারেনি ব্রাজিল। গত কোপা আমেরিকায়ও সেলেসাওরা ছিল পরিষ্কার ফেভারিট। তবু কোয়ার্টারেই থামতে হয়েছে তাদের। উরুগুয়ের বিপক্ষে নির্ধারিত সময়ে গোলশূন্য ড্র করার পর টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হেরে আসর থেকেই বিদায় নেয় দরিভাল জুনিয়রের দল।