বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত নিছক ভূগোল নয়; যেন এক নৃশংস আয়না, যাতে ভারতীয় গণতন্ত্রের সাজানো ময়ূর পেখম ঝরে পড়ে। মে মাস থেকে রাতের আঁধারে নারী-পুরুষ-শিশু, এমনকি আদালতে বিচারাধীন শরণার্থীকে পর্যন্ত গহিন বন ও উত্তাল নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। কারও হাতে খাবার নেই, কারও গায়ে কাপড় পর্যন্ত নেই। 

অমানবিক অভিযানগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মোদি সরকারের সুপরিকল্পিত বর্জননীতি, যাতে মুসলমানসহ সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব রাজনৈতিক লাঠিতে পরিণত হয়েছে। সুন্দরবনের খাঁড়িতে একসঙ্গে ৭৮ জনকে ফেলে রাখা; ফেনী নদীতে পাঁচ নারী-শিশুকে প্লাস্টিক বোতলে বেঁধে ভাসিয়ে দেওয়া অথবা দিল্লি থেকে তুলে আনা ৪০ রোহিঙ্গাকে নৌবাহিনীর জাহাজে আন্দামান সাগরে নামিয়ে দেওয়া– এসব কাহিনি ভারতীয় রাষ্ট্রের নির্দয় চেহারাই উন্মোচন করে। 

আন্দামানের অন্ধকার সমুদ্রে তাদের ছিল শুধু সস্তা লাইফ জ্যাকেট; জাহাজের সেদ্ধ ভাতও ছুড়ে দেওয়া হয়নি। ঢেউয়ে দুলতে দুলতে ১০ ঘণ্টা পর থাইল্যান্ডগামী মাছ ধরা ট্রলারে তোলার সময় দেখা যায়, তারা ক্ষুধা আর আতঙ্কে কাঁপছে। জাতিসংঘের মিয়ানমার-বিষয়ক বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার টম অ্যান্ড্রুজ এর নিন্দা করে বলেন, এটি আন্তর্জাতিক আইনের নগ্ন লঙ্ঘন ও রাষ্ট্রীয় নৃশংসতার টেক্সটবুক উদাহরণ।
আসামের স্কুল শিক্ষক খায়রুল ইসলামকে চোখ বেঁধে নির্যাতনের পর সীমান্তে ফেলে দেওয়াও নৃশংস সিন্ডিকেটের অংশ। অথচ আদালতে তাঁর নাগরিকত্বের মামলা চলমান। মিশেল ফুকো যাকে বায়োপলিটিক্স বলেছেন, তার ভারতীয় সংস্করণ আজ বাস্তব। নাগরিকত্ব নির্ধারিত হচ্ছে রক্তের শুদ্ধতা আর ডিজিটাল তালিকার রুলবুকে। 

আইনি মোড়কে সাম্প্রতিক বর্বরতার গোড়ায় রয়েছে গত ৪ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অভয় এস ওকা ও বিচারপতি উজ্জ্বল ভূঞার বেঞ্চের একটি আদেশ। ৬৩ জন ঘোষিত ‘বিদেশি’কে দ্রুত বাংলাদেশে পাঠাতে আসাম সরকারকে ভর্ৎসনা করা হয় সেখানে। শর্ত ছিল– আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের মাধ্যমে হস্তান্তর করতে হবে। কয়েক দিনের মধ্যেই গৌহাটি হাইকোর্ট ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের একতরফা সিদ্ধান্তকে ‘প্রশাসনিক চূড়ান্তবাদ’ বলে মান্যতা দেন। সংবিধানের ১৪, ২১ ও ২২ অনুচ্ছেদের স্পষ্ট আশ্রয় থাকা সত্ত্বেও আদালত নীরব থেকে বিজেপি সরকারের এজেন্ডাকে বৈধতা দেন। সুপ্রিম কোর্টের সীমিত নির্দেশ এভাবে গণ-পুশইনের দানবীয় রূপ নেয়। প্লেটোর ন্যায়রাষ্ট্র এখানে অনুপস্থিত; হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ বিভাজনের বীজ বুনছে। মুসলমান, বাঙালি, রোহিঙ্গা– সবাইকে ‘অনুপ্রবেশকারী’ ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে।
ভারত ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশনে সই করেনি। সে সুযোগে নন-রিফুলমেন্ট নীতিকে ব্যাখ্যা-বিকৃত করে; তবু আইসিসিপিআর ও সিআরসিতে স্বাক্ষরকারী হওয়ায় দায়বদ্ধতা এড়াতে পারে না। 
আন্তর্জাতিক আইনকে ‘শহুরে নকশাল’ আখ্যা দিয়ে বাতিলের দলে পাঠানো এই রাষ্ট্রব্যবস্থা বিশ্ব-সম্মিলিত নৈতিক মানদণ্ডে নিজের জায়গা ক্রমে হারাচ্ছে। ব্রুনো লাতুর বলেছেন, রাষ্ট্রের বৈধতা তৈরি হয় নৈতিক জবাবদিহি ও প্রাতিষ্ঠানিক আস্থায়। আজকের ভারত সে আস্থা ধ্বংস করেছে; প্রতিষ্ঠানগুলোর খোলস রেখেছে, ভেতর ভরেছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিষে। ভোট আছে, কিন্তু গণতন্ত্রের প্রাণ নেই। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এনআরসি আর পুশইন প্রকল্প একত্রে সেই রাক্ষুসে ছাঁকনি, যা বহু-সাংস্কৃতিক ভারতের শরীরকে চিবিয়ে মৌলবাদী রাষ্ট্রের কঙ্কালসার প্রতিমায় রূপ দিচ্ছে। 

নদীতে কাঁপতে থাকা শিশু, চোখবাঁধা শিক্ষক, সমুদ্রে ফেলে দেওয়া রোহিঙ্গা– এসব চিত্র শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রতীক নয়, বরং তা সেই কাকের খোলস, যা ময়ূরের পালক ধারণ করে ছিল। এখন পেখম খুলে যাওয়ায় আসল রূপ নগ্ন হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক সুবিধাবাদের তাড়নায় এই দমননীতি চলতে থাকলে ভারতের আন্তর্জাতিক মর্যাদা আর দক্ষিণ এশিয়ায় নেতৃত্ব দাবির ভরকেন্দ্র ভেঙে পড়বে। 
রাষ্ট্রের শক্তি আসে দায়বদ্ধতা থেকে। দায়বদ্ধতা মানে দুর্বলতম মানুষকে রক্ষা করা। মোদি সরকারের সামনে এখন একটিই নৈতিক দ্বন্দ্ব– বহুত্ববাদকে পুনর্জাগ্রত করবে, নাকি উগ্রবাদের ময়ূররূপী মুখোশ চিরতরে কাকের কালো চিহ্নে রূপান্তর করবে।

সাঈফ ইবনে রফিক: সীমান্ত বিশ্লেষক

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

দ্রুত নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করুন: আকবর খান

ঢাকা-৮ আসনে দ্রুত নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য আকবর খান। তিনি বলেন, “ভোটের অধিকার জনগণের পবিত্র আমানত, এটি সচেতনভাবে প্রয়োগ করতে হবে।”

বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) রাজধানীর মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা জননেতা সাইফুল হক-এর ঢাকা-৮ আসনে নির্বাচনী গণসংযোগ ও প্রচারপত্র বিতরণ কর্মসূচিতে তিনি একথা বলেন।

গণসংযোগের শুরুতে ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি মীর মোফাজ্জল হোসেন মোশতাকের সভাপতিত্বে এক সংক্ষিপ্ত পথসভা হয়। 

সেখানে আকবর খান বলেন, “নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে অবিলম্বে ভোটের গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরিতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে—২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে—ঢাকা-৮ আসনের বহু নাগরিক ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যে তরুণের এখন বয়স ২৫ বা ২৬, তারা কখনো ভোট দিতে পারেনি, ভোট কী তা জানে না- এটি গণতন্ত্রের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়।”

তিনি আরো বলেন, “গত ১৬-১৭ বছর ধরে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এবং আমাদের নেতা সাইফুল হক জনগণের ভোটাধিকারের আন্দোলনে রাজপথে সংগ্রাম করে আসছেন। এর জন্য জেল-জুলুম, নির্যাতন সহ্য করেও তিনি থেমে থাকেননি। ভোটাধিকার গণমানুষের দীর্ঘ লড়াই ও ত্যাগের ফসল। এই অধিকার ভুল ব্যক্তিকে নির্বাচিত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।”

আকবর খান বলেন, “জননেতা সাইফুল হক গণমানুষের পরীক্ষিত নেতা। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের জনগণ যেন তাকে ভোট দিয়ে নিজেদের সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার কথা ও দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস সংসদে তুলে ধরার সুযোগ করে দেন- এটাই আমাদের আহ্বান।”

গণসংযোগ ও প্রচারপত্র বিতরণ কর্মসূচি বাংলাদেশ ব্যাংক এলাকা থেকে শুরু হয়ে মতিঝিল, কমলাপুর, ফকিরাপুল, কালভার্ট রোড হয়ে বিজয়নগরে এসে শেষ হয়। এতে শতাধিক নেতাকর্মী অংশ নেন।

কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা সিকদার হারুন মাহমুদ, মীর রেজাউল আলম, কবি জামাল সিকদার, ফাইজুর রহমান মুনির, বাবর চৌধুরী, মহানগর নেতা যুবরান আলী জুয়েল, সালাউদ্দিন, রিয়েল মাতবর, আরিফুল ইসলাম, মুজিবুল হক চুন্নু, গোলাম রাজিব, মাহমুদুল হাসান খান, ফয়েজ ইবনে জাফর, নান্টু দাস, শিবু মহন্ত ও হুমায়ুন কবির প্রমুখ।

ঢাকা/এএএম/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ৩০০ আসনে প্রার্থী বাছাই প্রায় চূড়ান্ত: তারেক রহমান
  • গণতন্ত্রের পথে সংকট দেখছেন তারেক
  • এমন তো হবার কথা ছিল না: তারেক রহমান
  • সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাই এখন জাতির দাবি
  • জনগণের বৃহত্তর ঐক্য ছাড়া এই ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার পতন হবে না: সাকি
  • দ্রুত নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করুন: আকবর খান