কয়েক সপ্তাহ ধরে জোরালো জল্পনা-কল্পনা। সেটা হলো, বাংলাদেশ কঠিন শর্তাবলির ভয়ে এবং সেগুলোর সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাবের কথা বিবেচনায় নিয়ে আইএমএফের বিদ্যমান ঋণ কর্মসূচি থেকে সরে আসার কথা ভাবছে। কিন্তু আমার মত, এমন সিদ্ধান্ত ক্ষীণ দৃষ্টিসম্পন্ন এবং শুধু তাই নয়, দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য তা ক্ষতিকর। শুধু ঋণের তাৎক্ষণিক খরচের দিকে না তাকিয়ে বরং এই কর্মসূচির কৌশলগত সুবিধাগুলোর দিকে নজর দেওয়া জরুরি, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাত, করব্যবস্থা, সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনা ও বিনিময়হার নীতির মতো দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত কাঠামোগত সংস্কারে চাপ তৈরি করার কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে আইএমএফের শর্ত।

এ কথা সত্য, ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ বাংলাদেশের অর্থনীতির সাপেক্ষে খুব বড় অঙ্ক নয়, এই অর্থও আবার কয়েক ধাপে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই কর্মসূচিকে শুধু আর্থিক লেনদেন হিসেবে দেখা হলে আমরা বৃহত্তর চিত্রটা হারিয়ে ফেলব। আইএমএফের সঙ্গে যুক্ত থাকার মূল উদ্দেশ্য হলো, এর মধ্য দিয়ে নীতিগত শৃঙ্খলা আরোপ ও সংস্কারের সুযোগ তৈরি হয়। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। এর বড় কারণ অভ্যন্তরীণ চাপ ও চাহিদার দুর্বলতা এবং প্রতিষ্ঠানের ভেতরকার প্রতিরোধ। এই প্রেক্ষাপটে অতীতে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের চাপই অনেক সময় সংস্কারে গতি এনেছে। নির্দিষ্ট নীতিগত পদক্ষেপের সঙ্গে ঋণ বিতরণ যুক্ত করে আইএমএফ এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, যেখানে সরকারগুলো অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ মোকাবিলা করে রাজনৈতিকভাবে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

সমস্যা হলো, সরকার যদি আইএমএফের শর্তাবলি ধারণ না করে এবং তারা যদি আইএমএফের সঙ্গে মিলে সংস্কার কর্মসূচি পরিকল্পনায় কার্যকরভাবে অংশ না নেয়, তাহলে এই শর্তগুলো অনেক সময় বাইরের চাপ হিসেবে প্রতীয়মান হয়। তখন এই শর্তাবলির সেগুলোর প্রতি অভ্যন্তরীণ সমর্থন হারিয়ে যায়। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আইএমএফ ঋণ কর্মসূচির সফলতা ও ব্যর্থতা-উভয় উদাহরণই আমরা দেখতে পাই।

বাংলাদেশের জন্য এখন আইএমএফ কর্মসূচি থেকে সরে যাওয়ার অর্থ হবে, নীতিনির্ধারকদের চাপমুক্ত স্বস্তির জায়গায় ফিরে যাওয়া এবং যা কিছু কঠিন অথচ প্রয়োজনীয়, সেই সিদ্ধান্তগুলো আবার পেছানো; যে কাজটা অতীতেও বারবার হয়েছে। কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে যাওয়া আগের সরকারের সংরক্ষণমূলক নীতি প্রণয়নেরই পুনরাবৃত্তি, যারা স্বল্পমেয়াদি স্থিতিশীলতা ধরে রাখার স্বার্থে প্রয়োজনীয় সংস্কার এড়িয়ে গেছে, যার পরিণতিতে পরবর্তীকালে আরও কঠিন সংকটে পড়তে হয়েছে।
আইএমএফের ঋণের কিস্তি বিলম্বিত হওয়ার কারণ ইচ্ছাকৃত চাপ নয়, বরং বাস্তব সমস্যা-রাজস্ব আয় কমে যাওয়া, বিনিময়হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক না হওয়া, ভর্তুকি হ্রাসে গতি না আসা ও ব্যাংক খাত সংস্কারে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতির অভাব। এসব নতুন কিছু নয়, বরং অনেক বছর ধরেই এসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত আমরা আর নিতে পারি না।

কর্মসূচি থেকে সরে আসার বদলে বাংলাদেশের উচিত হবে, আইএমএফের সঙ্গে আরও গভীর আলোচনায় যুক্ত হওয়া। এর মধ্য দিয়ে বাস্তবসম্মত ও রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সংস্কারের পথরেখা নির্ধারণ করা। সে ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে এগোনোর ও আলোচনার সুযোগ আছে। সক্রিয়ভাবে আইএমএফের সঙ্গে কাজ করে বাংলাদেশ নিজের উন্নয়ন অগ্রাধিকারের সঙ্গে সংস্কার কর্মসূচিকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে পারে; নিশ্চিত করতে পারে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সুরক্ষা।

সবশেষে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি থেকে সরে দাঁড়ানো অর্থ হলো, একধাপ পেছনে যাওয়া। এতে দেশের অর্থনৈতিক পরিচালনার সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সমস্যা শর্ত নয়, বরং সংস্কারের গতি থেমে যাওয়া; যে কারণে অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের উচিত, এই কর্মসূচিতে অটল থাকা। শুধু অর্থের জন্য নয়, বরং উন্মুক্ত, স্থিতিশীল ও টেকসই অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার সুযোগ কাজে লাগাতে সংস্কারের পথে থাকা উচিত।

সেলিম রায়হান: নির্বাহী পরিচালক, সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

খাগড়াছড়িতে ট্রাক উল্টে ১ জন নিহত, আহত ৩

খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় একটি ট্রাক উল্টে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ট্রাকটির চালকসহ তিনজন। গতকাল রোববার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে উপজেলার বড়াদম এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তির নাম খোকন চন্দ্র দাস (৫০)। তিনি দীঘিনালা উপজেলার থানাপাড়া এলাকার সুকুমার দাসের ছেলে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেছে, এলাকায় থাকা নিজের বাগান থেকে ট্রাকটিতে কাঠ বোঝাই করে দীঘিনালা সদরে নিয়ে যাচ্ছিলেন খোকন চন্দ্র দাস। ট্রাকটিতে তিনি ছাড়াও চালক ও দুজন গাছ কাটার শ্রমিক ছিলেন। উপজেলার বড়াদম এলাকায় এলে ট্রাকটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায়। এ সময় ট্রাকে থাকা চারজনই আহত হন।

দুর্ঘটনার পর স্থানীয় বাসিন্দারা আহত চারজনকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। পরে গুরুতর আহত খোকন চন্দ্র দাসকে সেখান থেকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে দুজনকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। একজনের অবস্থা শঙ্কাজনক হওয়ায় তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

দীঘিনালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাকারিয়া দুর্ঘটনায় হতাহত হওয়ার বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ