জাতীয় বাজেটের ১৫% স্বাস্থ্যে রাখার প্রস্তাব কমিশনের
Published: 6th, May 2025 GMT
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন বলেছে, জনমুখী, সহজলভ্য ও সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। নিম্ন আয়ের মানুষকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি সংবিধানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে আইনি অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিশন।
গতকাল সোমবার সকালে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখনো একটি ন্যায্য, মানবিক ও টেকসই স্বাস্থ্যব্যবস্থা গঠনের পথে দৃশ্যমান বাধাগুলোকে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। দুর্নীতি, সক্ষমতার ঘাটতি, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং চিকিৎসাশিক্ষার নিম্নমান ভবিষ্যতের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে উঠেছে। দেশের স্বাস্থ্য খাত আজ জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি।
স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে সরকার বছরের পর বছর বরাদ্দ কম দিয়ে চলেছে। বিশেষজ্ঞরা এই খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলে আসছেন। গত এক দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, জাতীয় বাজেটের গড়ে ৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয় স্বাস্থ্যে। অন্যদিকে জিডিপির অংশ ২ শতাংশ কখনো ছাড়ায়নি। স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন মনে করে, স্বাস্থ্যে জিডিপির অন্তত ৫ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
দুর্নীতি, সক্ষমতার ঘাটতি, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং চিকিৎসাশিক্ষার নিম্নমান ভবিষ্যতের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে উঠেছে। দেশের স্বাস্থ্য খাত আজ জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি।গতকাল প্রধান উপদেষ্টাকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদন দেওয়ার পর স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্যরা ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলন করেন। এ সময় তাঁরা প্রতিবেদনের নানা দিক সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন। ওই অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রধান ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান বলেন, কমিশন বাস্তব কিছু সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক করা, স্বাস্থ্যসেবার জন্য পৃথক কমিশন করা, সেবা বিকেন্দ্রীকরণ করা—এই প্রস্তাবগুলো গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের ৩২২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের মূল বিষয়বস্তু ও সুপারিশ উপস্থাপন করেন কমিশনের সদস্য ও ক্যানসার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন। তিনি বলেন, প্রতিবেদন তৈরির জন্য বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে তাঁরা ৩২টি সভা করেছেন, ঢাকার বাইরে আটটি জেলা শহরে পরামর্শ সভা হয়েছে এবং কমিশনের ১২ জন সদস্য নিজেরা সভা করেছেন ৫১টি। পাশাপাশি অভিজ্ঞ ব্যক্তি, সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী, বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়েছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে দেশের আট বিভাগের ৮ হাজার ২৫৬ জন প্রাপ্তবয়স্কের মতামত জরিপ করা হয়। ওই জরিপের মতামতও কমিশন গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে।
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন মনে করে, স্বাস্থ্যে জিডিপির অন্তত ৫ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।টেকসই অর্থায়ন দরকারসংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বা সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় স্বাস্থ্য খাত নেই। বিগত ১৫ বছরের বাজেট বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বরাদ্দের দিক থেকে স্বাস্থ্য এখনো নিচের দিকে—৮ নম্বরে। এগিয়ে থাকা অন্য খাতগুলো হচ্ছে জনপ্রশান, শিক্ষা, পরিবহন ও যোগাযোগ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা, কৃষি এবং সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ।
প্রতিবদনের এই অংশ অর্থাৎ ‘স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ন’ অধ্যায়টি লেখার মূল দায়িত্বে ছিলেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী আহমদ এহসানূর রহমান। সংবাদ সম্মেলন শেষে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনবিষয়ক কিছু সংস্কার ছাড়া বাকি প্রায় সব সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে হলে অর্থ প্রয়োজন। বাজেট বরাদ্দ কম রেখে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি আমরা স্বাস্থ্য খাতে টেকসই অর্থায়নের কিছু সুপারিশও করেছি।’
সুপারিশে বলা আছে, সরকারকে এখনই স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে, সামগ্রিক জনস্বাস্থ্য ব্যয় জিডিপির অন্তত ৫ শতাংশ এবং মোট বাজেটের প্রায় ১৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, এই বিনিয়োগের মাধ্যমে সেবা বিস্তৃত হবে, ব্যক্তিগত ব্যয় কমবে, জনগণের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য অবকাঠামো, জনবল ও আধুনিক প্রযুক্তিতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী যেসব দেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে এগিয়ে আছে, তারা স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ বা তার বেশি ব্যয় করছে।
আইনবিষয়ক কিছু সংস্কার ছাড়া বাকি প্রায় সব সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে হলে অর্থ প্রয়োজন। বাজেট বরাদ্দ কম রেখে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা সম্ভব না।আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী আহমদ এহসানূর রহমান‘স্বাস্থ্য অর্থায়ন সুরক্ষা আইন’ প্রণয়নসহ প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য খাতে টেকসই অর্থায়নের ব্যাপারে ৩৩টি সুপারিশ করা হয়েছে। তামাক, চিনিযুক্ত পানীয়, এনার্জি ড্রিংক, বুকের দুধের বিকল্প পণ্য, ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত প্যাকেটজাত খাবার, অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার বা এই ধরনের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্যের ওপর কর বৃদ্ধি করতে হবে এবং কর থেকে প্রাপ্ত অর্থের একটি অংশ স্বাস্থ্যের জন্য নির্ধারণ করতে হবে। একইভাবে অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল পণ্যের ওপর কর চালু বা কর বাড়িয়ে অর্জিত আয়ের একটি অংশ স্বাস্থ্যের জন্য রাখতে হবে। করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা তহবিল, স্বাস্থ্য উন্নয়ন প্রবাসী বন্ড চালু, সামাজিক বিমা চালুর কথা সুপারিশে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ক্রয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়িয়ে অর্থের সাশ্রয় করার কথা প্রতিবেদনে বলা আছে।
তামাক, চিনিযুক্ত পানীয়, এনার্জি ড্রিংক, বুকের দুধের বিকল্প পণ্য, ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত প্যাকেটজাত খাবার, অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার বা এই ধরনের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্যের ওপর কর বৃদ্ধি করতে হবে এবং কর থেকে প্রাপ্ত অর্থের একটি অংশ স্বাস্থ্যের জন্য নির্ধারণ করতে হবে।সেবা বিনা মূল্যে ও আরও কিছুসংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে, অতি দরিদ্র ২০ শতাংশ মানুষ বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা পাবে। এদের ১০ শতাংশ চিকিৎসাসেবা পাবে সরকারি হাসপাতাল থেকে এবং বাকি ১০ শতাংশ সেবা পাবে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে।
প্রতিবেদনে বলা আছে, যারা অতি দরিদ্র, তারা যেকোনো কাছাকাছি প্রতিষ্ঠানে বিনা মূল্যে সব ধরনের সেবা পাবেন। প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে ১০ শতাংশ দরিদ্র রোগীকে বিনা মূল্যে অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগ পরিষেবা, ওষুধ ও ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা দিতে হবে। ১০ শতাংশ দরিদ্র রোগীকে একই সেবা বিনা মূল্যে দেবে বেসরকারি হাসপাতাল। তবে প্রতিবেদনে এ কথাও বলা আছে যে এটি নতুন কোনো শর্ত নয়। এটি ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতাল পরিচালনার প্রাথমিক শর্ত, যা রাজনৈতিক ও অন্য কোনো কারণে অতীতে বাস্তবায়িত হয়নি।
এ ব্যাপারে সংস্কার কমিশনের সদস্য আবু মোহাম্মদ জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই বিষয়টিকে যেন বাধ্যতামূলক করা হয়, সে জন্য আমরা প্রতিবেদনে রেখেছি।’
প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে ১০ শতাংশ দরিদ্র রোগীকে বিনা মূল্যে অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগ পরিষেবা, ওষুধ ও ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা দিতে হবে। ১০ শতাংশ দরিদ্র রোগীকে একই সেবা বিনা মূল্যে দেবে বেসরকারি হাসপাতাল।উন্নত সেবা পাওয়ার ব্যাপারে আরও কিছু সুপারিশ করেছে কমিশন। তারা বলেছে, একজন চিকিৎসক একজন রোগীকে কমপক্ষে ১০ মিনিট সময় দিয়ে দেখবেন, এই বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য প্রতি সপ্তাহে চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র নমুনা যাচাই পদ্ধতি চালু করার কথা বলেছে কমিশন।
সরকারি হাসপাতালে সপ্তাহে সাত দিনে ২৪ ঘণ্টা ফার্মেসি চালু রাখার কথা বলা হয়েছে। সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলোর দৈনিক কার্যক্রম সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত (পাঁচ দিন) বাড়াতে হবে। সময় বাড়ালে বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরতা কমবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ওষুধশিল্প স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে, যা অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৯৮ শতাংশ উৎপাদন করে। তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে মানুষ ওষুধ পায়। কমিশন ওষুধ গবেষণায় প্রণোদনার সুপারিশ করেছে।
সরকারি হাসপাতালে সপ্তাহে সাত দিনে ২৪ ঘণ্টা ফার্মেসি চালু রাখার কথা বলা হয়েছে। সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলোর দৈনিক কার্যক্রম সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত (পাঁচ দিন) বাড়াতে হবে। সময় বাড়ালে বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরতা কমবে।সবচেয়ে সহজ ও সবচেয়ে কঠিন প্রস্তাব কোনটিসংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকেরা জানতে চেয়েছিলেন, বাস্তবায়নের জন্য সবচেয়ে সহজ ও সবচেয়ে কঠিন প্রস্তাব কোনটি? এই প্রশ্নের উত্তর তিনজন কমিশন সদস্য তিন রকম দিয়েছেন।
কমিশনের সদস্য ও পথিকৃৎ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক লিয়াকত আলী বলেন, আইন সংস্কারের সুপারিশ প্রতিবেদনে বলা আছে। এটা সরকার চাইলেই করতে পারে। এখন অধ্যাদেশ জারি করে করা সম্ভব। এটা সহজ। সবচেয়ে কঠিন, মানসিকতার পরিবর্তন। এটা সাধারণ মানুষ ও নীতিনির্ধারক সবার জন্যই কঠিন।
কমিশনের আরেকজন সদস্য ও কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি আবু মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস গঠনের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেটা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। এটা করতে নানা বাধার মুখে পড়তে হবে। এ ছাড়া সমন্বয়ের যেসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নও কঠিন হবে।
কমিশন সদস্য ও আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী আহমদ এহসানূর রহমান বলেন, কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করা কঠিন বা সহজ নয়। দেখতে হবে কোন সুপারিশ বা সুপারিশগুলো গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলোকে গুচ্ছ পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘স্বাস্থ্যকে পণ্য হিসেবে না দেখে কমিশন সদস্যরা স্বাস্থ্যকে সেবা হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সেটাই করা উচিত।’
জরুরি সেবা ও অ্যাম্বুলেন্সকে ভুললে চলবে নাসংবাদ সম্মেলনের প্রায় শেষ পর্যায়ে আইসিডিডিআরবির পরামর্শক ও কমিশন সদস্য আজহারুল ইসলাম খান বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, জরুরি চিকিৎসাসেবা এবং অ্যাস্বুলেন্স সেবা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। তিনি বলেন, দেশে জরুরি সেবার অবস্থা খুবই করুণ। বেসরকারি খাতে কোনো জরুরি সেবা নেই। সরকারি খাতে যা আছে, তা পর্যাপ্ত নয়। একই অবস্থা অ্যাম্বুলেন্স সেবার ক্ষেত্রেও দেখা যায়। এই দুটি বিষয়ে সাংবাদিকদের সোচ্চার হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
নারীর জন্য পৃথক ইনস্টিটিউটসংস্কার কমিশন নারীর জন্য পৃথক ‘জাতীয় নারী স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে। এই প্রতিষ্ঠান নারীর বিশেষায়িত সেবা, রেফারেল ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে।
সংবাদ সম্মেলনে কমিশন সদস্য ও নারী স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সায়েবা আক্তার বলেন, নারীস্বাস্থ্যের বিষয়ে মাতৃ ও প্রজননস্বাস্থ্যের মধ্যেই আলোচনা আটকে থাকে। কিন্তু নারীর আরও বহুবিধ স্বাস্থ্য সমস্যা আছে। দেশে ২০–২২টা বিশেষায়িত হাসপাতাল আছে। কিন্তু নারীর স্বাস্থ্য সমস্যা দেখার, বোঝার কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এটা এখন করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনের শেষ বক্তা ছিলেন কমিশনের সদস্য ছাত্র প্রতিনিধি ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী উমাইর আফিফ। তিনি বলেন, জুলাই গণ–অভ্যুত্থান সংস্কার কমিশনগুলো তৈরির সুযোগ করে দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপট মনে রাখা উচিত।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ব স থ য র জন য শ দর দ র র গ ক আইস ড ড আরব স প র শ কর ছ প রস ত ব দ র জন য প ব যবস থ ব সরক র সদস য ও এই প র বর দ দ র ওপর সবচ য় ট কসই
এছাড়াও পড়ুন:
স্বামীকে ফিরে পেতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলেন ‘র্যাঞ্চোর’ স্ত্রী গীতাঞ্জলি
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও পরিবেশ আন্দোলনকর্মী ম্যাগসাইসাই পুরস্কারপ্রাপ্ত সোনম ওয়াংচুকের মুক্তির দাবিতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন তাঁর স্ত্রী গীতাঞ্জলি আংমো। গতকাল বৃহস্পতিবার শীর্ষ আদালতে তিনি হেবিয়াস কর্পাস (আসামিকে আদালতে হাজির করা) আবেদন দাখিল করেছেন।
আবেদনে গীতাঞ্জলি বলেছেন, এক সপ্তাহ কেটে গেলেও এখনো পর্যন্ত তাঁর স্বামী সোনম ওয়াংচুকের স্বাস্থ্য ও শারীরিক অবস্থা নিয়ে তাঁকে কিছুই জানানো হয়নি। কেন তাঁর স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সে বিষয়েও তাঁকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর হিংসাত্মক ঘটনার দুই দিনের মাথায় সোনম ওয়াংচুককে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে (এনএসএ) গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পরেই তাঁকে লেহ্ থেকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজস্থানের যোধপুর কারাগারে। সোনমের গ্রেপ্তারি ‘বেআইনি’ দাবি করে শীর্ষ আদালতের হস্তক্ষেপ দাবি করেন গীতাঞ্জলি।
সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়াও গীতাঞ্জলি চিঠি লিখেছেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, লাদাখের উপরাজ্যপাল কবীন্দ্র গুপ্ত, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘাওয়ালকে।
প্রতিটি চিঠিতেই গীতাঞ্জলি স্বামীর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করে জানতে চেয়েছেন, জনগণের স্বার্থকে সমর্থন করা অন্যায় ও পাপ কি না। সর্বোচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার বিষয়টি তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও জানিয়েছেন। বলেছেন, এত দিন হয়ে গেলেও স্বামী কেমন আছেন, তা তাঁকে জানানো হয়নি। তাঁর সঙ্গে কথা বলানো হয়নি। বরং বেশ কিছুদিন ধরেই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো দিয়ে তাঁদের নানাভাবে হয়রান করা হচ্ছে।
সোনমকে নিয়েই আমির খান তৈরি করেছিলেন ‘থ্রি ইডিয়টস’ সিনেমা। জনপ্রিয় সেই সিনেমায় সোনমের নাম ছিল ‘র্যাঞ্চো’। লাদাখের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এনেছেন সোনম। প্রযুক্তির ব্যবহার, পরিবেশ–বান্ধব উদ্ভাবনী ক্ষমতার মধ্য দিয়ে তিনি সমাজের যে উন্নয়ন ঘটিয়েছেন, সারা দেশ তার স্বীকৃতি দিয়েছে। উপকৃত হয়েছেন হিমালয়ে দিন ও রাত কাটানো ভারতীয় সেনা সদস্যরা।
কেন্দ্রীয় সরকার ও বিভিন্ন রাজ্য সরকার সোনমের পরামর্শ গ্রহণ করেছে। কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি কিছুদিন আগেও ছিল তাঁর গুণমুগ্ধ। সোনমও সপরিবারে বিজেপিকে সমর্থন করে এসেছেন।
২০১৯ সালে জম্মু–কাশ্মীরকে দুই ভাগ করে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ে তোলার পর সোনম প্রকাশ্যে সেই সরকারি সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জয়গান করে লাদাখে মিছিল করেছিলেন। বিবৃতি দিয়েছিলেন।
অথচ সেই ব্যক্তিই ধীরে ধীরে হয়ে গেলেন বিজেপি সরকারের চোখের বালি। এতটাই যে জাতিসংঘের সহযোগিতায় পাকিস্তানের গণমাধ্যম ‘ডন’–এর উদ্যোগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ইসলামাবাদে আয়োজিত জলবায়ু সম্মেলন ‘ব্রিদ পাকিস্তান’–এ অংশ নেওয়ায় সরকারের চোখে তিনি ‘পাকিস্তানি চর’ হয়ে গেছেন।
লাদাখের শীর্ষ পুলিশ কর্তা এসডি সিং জামওয়াল সরাসরি সেই সন্দেহ প্রকাশ করে জানিয়ে দেন, আন্দোলনকারী যুব–জনতাকে সোনমই খেপিয়েছিলেন। হিংসা ছড়ানোর দায় তাঁরই।
শুধু তা–ই নয়, সোনম ওয়াংচুক যে কারণে সারা পৃথিবীতে প্রশংসিত, তাঁর তৈরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সুনাম যে কারণে দেশে–বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে, সরকারের তদন্তের আওতায় সেগুলোকেও টেনে আনা হয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।
স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, সোনমের আন্দোলন এমন কোনো স্বার্থে ঘা দিয়েছে, যা কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। শাসকের নয়নের মণি থেকে তাই তিনি হয়ে উঠেছেন চোখের বালি।
লাদাখের আপামর জনতা পৃথক রাজ্য গঠন, নিজস্ব বিধানসভা এবং গোটা অঞ্চলকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় আনার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সোনম ওয়াংচুক সেই আন্দোলনকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করছেন। সে জন্য বারবার গান্ধীজির শেখানো পথে অনশন সত্যাগ্রহ আন্দোলন করছেন।
গত সেপ্টেম্বরেও সোনম এই দাবি পূরণে অনশন করছিলেন। হিংসাত্মক ঘটনার পর তার নিন্দা করে তিনি অনশন প্রত্যাহার করেন। অথচ একদিন পরেই তাঁকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সোনমের বক্তব্য, লাদাখের পরিবেশ রক্ষার একমাত্র উপায় উপজাতি অধ্যুষিত এই বিস্তীর্ণ এলাকাকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় আনা। কেন্দ্রীয় শাসক দলের নেতারা ২০১৯ সাল থেকেই এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিলেন। না হলে লাগামছাড়া ও পরিকল্পনাহীন উন্নয়নের নামে লাদাখের পরিবেশগত ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট নষ্ট হয়ে যাবে। গোটা দেশের পক্ষে তা হবে মারাত্মক।
যদিও সরকার মনে করে, লাদাখের খনিজ সম্পদ ও নবায়নযোগ্য শক্তির উপযুক্ত ব্যবহার উন্নয়নের জোয়ার আনবে। বেসরকারি শিল্পপতিরা ইতিমধ্যেই সেখানকার বিপুল সৌর ও তাপবিদ্যুৎ সম্ভাবনা বাস্তবায়িত করতে আগ্রহ দেখিয়েছে। লিথিয়ামের মতো বিরল খনিজ সম্পদের সদ্ব্যবহারে তারা উৎসাহী। লাদাখ ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত হলে তা সম্ভবপর না–ও হতে পারে।
সোনমের গ্রেপ্তারের বিরোধিতা করেছে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের লেহ অ্যাপেক্স বডি (এপিএল) ও মুসলিম প্রধান কারগিল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স। দুই সংস্থা লাদাখের দাবিদাওয়া নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে।
৬ অক্টোবর সেই বৈঠকের পরবর্তী দিন নির্ধারিত। কিন্তু ইতিমধ্যেই দুই সংগঠন আলোচনায় অংশ না নেওয়ার কথা জানিয়ে দিয়েছে। তাদের দাবি, সোনমসহ গ্রেপ্তার সবার নিঃশর্ত মুক্তি ও সব অভিযোগ প্রত্যাহার ও সুপ্রিম কোর্টের কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দিয়ে ২৪ সেপ্টেম্বরের সহিংসতার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে।
জাতীয় নিরাপত্তা আইনে (এনএসএ) কাউকে গ্রেপ্তার করা হলে তাঁকে টানা এক বছর বিনা বিচারে আটক রাখা যায়। এনএসএ, ইউএপিএ এবং এ ধরনের বিভিন্ন আইনে ধৃত বহু আন্দোলনকর্মীকে বছরের পর বছর বিনা বিচার ও বিনা জামিনে আটক রাখা হয়েছে। সোনম ওয়াংচুকের ভাগ্যও তেমন হবে কি না, তা শীর্ষ আদালত বিচার করবেন। ৬ অক্টোবর পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের ছুটি। গীতাঞ্জলির আবেদনের বিচার সম্ভবত তারপর।