দৃষ্টিনন্দন পূর্বাচল উপশহর এখন অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রম। ছিনতাই, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হত্যা।
রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পটির অবস্থান রাজধানী ঢাকা থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলায়।
একটি পরিসংখ্যানে জানা গেছে, গত আট বছরে এখানে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে দুই ডজন। যাদের অধিকাংশেরই পরিচয়ই জানা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপ্রতুলতা ও তৎপরতার অভাবেই ঘটছে হত্যাসহ নানা অপরাধ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২৪ সালের ১৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের শিল্পপতি জসিম উদ্দিনের সাত টুকরো লাশ পূর্বাচলের ৫ নম্বর সেক্টরের একটি লেক থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে, তাঁকে রাজধানীর কোনো এক স্থানে হত্যা করে নিরাপদ স্থান হিসাবে পূর্বাচলে তাঁর লাশ ফেলে দেওয়া হয়। ২০২৩ সালের ৭ জুলাই পূর্বাচলের ১৯ নম্বর সেক্টর থেকে অজ্ঞাতনামা যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। একই বছরের ২৪ আগস্ট ২০ নম্বর সেক্টর এলাকার একটি সবজিক্ষেত থেকে আব্দুল্লাহ আল মামুন নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের লাশ উদ্ধার করা হয়। একই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর ১০ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সেতুর নিচ থেকে কাপড়ে মোড়ানো অবস্থায় মানুষের বেশ কিছু কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। ২০২২ সালের ১৯ মে ২৫ নম্বর সেক্টর এলাকা থেকে মজিবুর রহমান নামে এক ব্যক্তির লাশ ও একই বছরের ২৭ ডিসেম্বর অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া গত বছর ২০ ডিসেম্বর আব্দুর রউফ ও শিপন মিয়া নামে দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পূর্বাচলের ৩ নম্বর সেক্টরের ভূঁইয়া বাড়ি ব্রিজের পাশে নিহত হয়। গত বছর ১৯ ডিসেম্বর মধ্যরাতে বুয়েটের সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থী মুনতাসির মাসুদ তাঁর দুই সহপাঠীকে নিয়ে ৩০০ ফুট সড়কের পূর্বাচল এলাকা থেকে খাবার খেয়ে মোটরসাইকেলে করে ঢাকায় ফিরছিলেন। পুলিশের চেক পোস্ট অতিক্রম করার সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ তাদের গতিরোধ করে। এ সময় বেপরোয়া গতিতে আসা একটি প্রাইভেটকার চেকপোস্টের ব্যারিকেড ভেঙে তাদের মোটরসাইকেলটিকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় মুনতাসির মাসুদের। গুরুতর আহত হন তার দুই সহপাঠী অমিত সাহা ও মেহেদি হাসান খানসহ দুই পুলিশ সদস্য।
গত বছর ১৬ ডিসেম্বর রাতে মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতে বের হয় সুজানা ও কাব্য নামে দুই শিক্ষার্থী। এরপর থেকে তারা নিখোঁজ হয়। এর তিন দিন পর পূর্বাচল উপশহরের ২ নম্বর সেক্টরের বউরারটেক এলাকার ৩০০ ফুট সড়ক-সংলগ্ন লেক থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া চলতি বছর ৬ জানুয়ারি অজ্ঞাত (২৫) এক তরুণীর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ৫ নম্বর সেক্টর থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়।
এ ব্যাপারে রূপগঞ্জের কাঞ্চন পৌরসভায় অবস্থিত সলিমুদ্দিন চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলমের ভাষ্য, সন্ধ্যার পর পূর্বাচল উপশহরে ছিনতাই, ডাকাতি এবং অন্য স্থানে খুন করে এখানে লাশ ফেলে যাওয়াসহ নানা অপরাধের কারণে এই এলাকার মানুষ খুবই আতঙ্কে আছে। সরকারের উচিত এখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রতি আরও নজর দেওয়া।
কাঞ্চন পৌরসভার সাবেক মেয়র দেওয়ান আবুল বাশার বাদশা বলেন, পূর্বাচল উপশহরের নীরব জায়গাগুলোতে পুলিশি টহল আরও বাড়াতে হবে। প্রতিটি লাশের পূর্ণ তদন্তের পর অপরাধীদের শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তাহলে এলাকার মানুষ শান্তিতে থাকবে।
রূপগঞ্জ থানার ওসি লিয়াকত আলী জানান, অন্য কোথাও মানুষ হত্যা করে লাশ ফেলার জন্য পূর্বাচল উপশহরের একেবারে নির্জন জায়গাগুলোকেই অপরাধীরা বেছে নেয়। অপরাধীদের ধরা ও অপরাধ দমনের জন্য একাধিক জায়গায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। সারারাত পুলিশের একাধিক দল টহলরত অবস্থায় থাকে। অপরাধ নির্মূলের চেষ্টা করা হচ্ছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন র য়ণগঞ জ ড স ম বর অপর ধ দ এল ক র অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
দুর্গাপূজার নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিন
আজ মহালয়া। সনাতন ধর্মের ভাষ্যমতে, দিনটি পিতৃপক্ষের সমাপ্তি এবং দেবীপক্ষের সূচনার প্রতীক। মহালয়ায় হিন্দু সম্প্রদায় তাঁদের পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে তর্পণ করেন, তাঁদের শান্তি কামনা করেন এবং একই সঙ্গে দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে আহ্বান জানান।
মহালয়াকে কেবল আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠান নয়; বরং সনাতনী সমাজের সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং সামাজিক সংহতির এক গভীর প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। ভোরের আলো আর শিশিরসিক্ত প্রভাতে এ মহালয়ার আচার আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রত্যেক প্রজন্মকে অতীতের শিক্ষার আলো ধরে সমাজের নৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা প্রতিবছরের মতো এবারও ভক্তি, সংস্কৃতি ও সামাজিক সম্প্রীতির মিলনক্ষেত্র হিসেবে উদ্যাপিত হবে। এ উৎসবের মর্যাদা রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্র, সম্প্রদায় ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত দায়িত্ব।
দুঃখজনক হলেও সত্য, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন অশুভ চক্র সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে প্রতিমা ভাঙচুরের মাধ্যমে অনৈতিক প্ররোচনা সৃষ্টি করছে। গত কয়েক দিনে কুষ্টিয়া, গাজীপুরসহ কয়েকটি জায়গায় প্রতিমা ভাঙচুরের খবর পাওয়া গেছে, যেটি উদ্বেগজনক। এ কর্মকাণ্ড শুধু ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করে না; বরং সমাজের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংহতিতেও ক্ষতি করে। আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে দেশের ৫টি জেলাকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ও ২৪টি জেলাকে মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ‘সম্প্রীতি যাত্রা’ নামের একটি সামাজিক প্ল্যাটফর্ম। তাই দুর্গাপূজায় নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়াই অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তৎপরতা এ প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে প্রশংসনীয়। কমিশনারের নেতৃত্বে ডিএমপি ইতিমধ্যে ২৫৮টি মণ্ডপে নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছে। এতে অন্তর্ভুক্ত আছে মণ্ডপভিত্তিক পাহারা, পৃথক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, প্রতিমা বিসর্জনের দিন সার্বিক তৎপরতা, সিসিটিভি স্থাপন, অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল তথ্য প্রতিরোধে নজরদারি। এটি প্রমাণ করে, সামাজিক ন্যায় ও আইনশৃঙ্খলার অটল ভিত্তি রক্ষায় রাষ্ট্র সচেতন ও সংবেদনশীল ভূমিকা গ্রহণ করছে।
একইভাবে সারা দেশে প্রায় ৩০ হাজার মণ্ডপে নিরাপত্তার আওতায় আনা অত্যন্ত জরুরি। প্রতিটি মণ্ডপে পর্যাপ্ত পুলিশি পাহারা, সিসিটিভি নজরদারি, অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা, জরুরি সেবা সংযোগ ও দর্শনার্থীদের সুশৃঙ্খল চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। তবে সরকারের একক তৎপরতা যথেষ্ট নয়, স্থানীয় কমিউনিটি, পূজা উদ্যাপন পরিষদ এবং সাধারণ নাগরিকদের সচেতন অংশগ্রহণ সমানভাবে অপরিহার্য। প্রতিটি মণ্ডপে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্যান্য সরকারি সংস্থার সমন্বিত কার্যক্রম এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।
দার্শনিকভাবে ভাবলে দুর্গাপূজা কেবল দেবীর আরাধনা নয়, এটি মানবসমাজের নৈতিক সংহতি ও সাম্প্রদায়িক ঐক্যের এক জীবন্ত প্রতীক। প্রতিমা ভাঙচুর বা অশুভ প্ররোচনার বিরুদ্ধে সক্রিয় তৎপরতা মানে কেবল আইন রক্ষা নয়; বরং সমাজের নৈতিক ক্ষেত্রও রক্ষা করা। নাগরিকের সচেতনতা ও রাষ্ট্রের সংহত তত্ত্বাবধানের সমন্বয় নিশ্চিত করলে উৎসবের মর্যাদা ও সামাজিক সম্প্রীতি অটুট থাকবে।
আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজার প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রত্যেকের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব সুস্পষ্ট। সেটি হলো কেউ যেন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পবিত্রতা বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সূক্ষ্ম সূত্রকে বিপন্ন করতে না পারে। রাষ্ট্রের নীতি ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত কার্যক্রম যদি জনগণের সচেতনতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার সঙ্গে মিলিত হয়, তবেই আমরা দেখতে পাব উৎসবমুখর ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে দুর্গাপূজার চিত্র। তখন এটি কেবল ধর্মীয় উৎসবের মহিমা বহন করবে না; বরং মানবসমাজের নৈতিক সংহতি, সাংস্কৃতিক ঐক্য ও সামাজিক সুষমতার স্থায়ী প্রতীক হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হবে।